পাকিস্তান ভাঙ্গনের মুখোমুখি

দি টাইমস, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

দিল্লি, ২৭ ফেব্রুয়ারি। পশ্চিম পাকিস্তানের ও পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো প্রথমবারের মতো জনঅংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কট করার ফলে মীমাংসার আর কোনো পথ খোলা রইলো না। সত্যিকারের বিপদ এখন দেখা গিয়েছে। ভুট্টো ও পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান অধিবেশন বসার ১২০ দিনের মধ্যে পরস্পরের কাছে সমর্থনযোগ্য ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মাধ্যমে অনুমোদিত একটি সংবিধান প্রণয়ন করবেন বলে কথা ছিল। তেমনটি ঘটার সম্ভাবনা কমই ছিল, কিন্তু এখন যেটা দাঁড়ালো তাতে, তেমন হবার আশা অপসৃত হলো।

এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে যতক্ষণ না প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুই নেতার মধ্যে অধিবেশন বসার তারিখ ৩ মার্চের মধ্যে মধ্যস্থতা করার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করছেন, পাকিস্তানে একটি ব্যাপক আকারের বিচ্ছিন্নতা-আন্দোলন শুরু হবার হুমকির মুখে পড়ছে। কিন্তু সমঝোতা হবার আর কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিব ও তার আওয়ামী লীগ চাচ্ছে ভুট্টো ও তার পিপলস্ পার্টিকে সহ অথবা ছাড়াই অধিবেশন আহ্বান করতে। ৩১৩টি আসনের মধ্যকার ১৬৭ আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নিজেরাই তাদের প্রস্তাবিত চূড়ান্ত-স্বায়ত্তশাসনের সংবিধান পাশ করাতে সম। তাদের প্রস্তাব অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হবে এবং তার হাতে কেবল তিনটি দায়িত্ব থাকবে: প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা।

অন্যদিকে ভুট্টো কার্যকর কেন্দ্রীয় সরকার চান। বাঙালিরা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে তাদের সাংবিধানিক প্রস্তাবনা পাশ করিয়ে নেয়, তবে সেটা পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি ভুট্টো যদি সংবিধান প্রণয়নে অংশগ্রহণও করেন তারপরও সন্দেহ থেকে যায় যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এমন কোনো সংবিধান অনুমোদন করবেন বা পারবেন যা বাঙালিদের চাপে প্রণীত হয়েছে। অধিবেশন বয়কট সম্পর্কিত ব্যাখ্যা দেবার সময় ভুট্টো এই শংকার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। এসপ্তাহের প্রথম দিকে তিনি পাকিস্তান রেডিওকে বলেছিলেন তিনি সত্যিকার অর্থে সংবিধান প্রণয়ন করতে যাচ্ছেন না … তিনি ঢাকায় যেতে পারেন কেবল এই শর্তে যে বাঙালিরা তাদের চূড়ান্ত স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক ছয় দফার ব্যাপারে আপস করবে।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে পারস্পরিক মিলিত হবার কোনো সম্ভাবনা আর দেখা যাচ্ছে না। শেখ মুজিবুর রহমান বলছেন এবং বলতে থাকবেন যে পাকিস্তানকে যদি একক দেশ হিসেবে টিকিয়ে রাখতে হয় তবে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার ওপরে ভিত্তি করেই সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। তিনি তার ছয়দফা কর্মসূচীর ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। রাজস্ব ও বৈদেশিক বাণিজ্য কি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই থাকবে, না তা প্রাদেশিক সরকারের হাতে যাবে — দুই নেতার মধ্যে সত্যিকারের বিরোধ সেবিষয়েই।

মি. ভুট্টোর জনপ্রিয়তা ভারত-বিরোধী অবস্থানের কারণেই। তিনি চান রাজস্বের ব্যাপারটি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই থাকবে যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি শক্তিশালী প্রতিরা-ব্যবস্থা থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পারেন না তার প্রদেশ কেন ১২০০ মাইল দূরে অবস্থিত কাশ্মিরীদের জন্য প্রতিরা বাজেটের অর্ধেক অংশে অবদান রাখবে। কাশ্মির নিয়ে দিল্লির সঙ্গে পাঞ্জাবের বিরোধের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বন্ধ করে দেবার অধিকার পশ্চিম পাকিস্তানের আছে কিনা সেবিষয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।

এমাসের প্রথম দিকে এক সভায় দু-নেতা জনসম্মুখে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে এই দুই দফায় তাদের মতৈক্য হয় নি এবং ফলে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় তা মি. ভুট্টোকে অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়। মনে করা হচ্ছে শেখ মুজিবুর অবশ্যই নির্ধারিত ৩ মার্চেই অধিবেশন বসতে হবে। যদি সামান্য কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী সংবিধান প্রণয়নে কাজ করেন তবে যেকোনো অর্থেই পূর্ব পাকিস্তানের ইচ্ছা অনুসারেই সংবিধান প্রণীত হবে।

এই পরিস্থিতিতে, এটা আশা করা হচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট সংবিধান অনুমোদন করবেন না এবং হয় শেখ মুজিবুর রহমান অথবা ভুট্টো এককভাবেই স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন।