Category Archives: বাংলা আর্কাইভ

মুক্তিযুদ্ধ ও ভবিষ্যত প্রজন্ম – এম. এম. আকাশ

“যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বও তার নাম ‘মুক্তি’ এই ধরনের একটি কাব্যিক বাক্য দিয়ে শুরু হয়েছে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক একটি প্রকাশনা। লিখেছেন বিশ্বব্যাংকের একজন বাঙালি কর্মকর্তা, শেখর বসু। লেখাটি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে বিশ্বব্যাংকও এখন চাইছে তার “এ্যাজেন্ডা” কে কোন না কোনভাবে মুক্তিযুদ্ধেও রোমান্টিক আবেদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে। আসলে পৃথিবীতে যা কিছু উজ্জ্বল, মহান, গতানুগতিকতার ঊর্ধ্বে, তার প্রতি সকলেরই থাকে শ্যোন দৃষ্টি। সকলেই চান তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে।

এ্যাকনামারার বিশ্বব্যাংক শুধু নয়, যারা একসময় ভেবেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ মাঝপথে থেমে যাক, আপোসের পথে অগ্রসর হোক এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ‘কনফেডারেশানের’ মাধ্যমে যুদ্ধেও মীমাংসা হোক তারাও আজ বাস্তবতার কাছে নতিস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধেও নানারকম ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তাদেও কেউ কেউ হয়তো যুদ্ধেও পর মুক্তিযুদ্ধেও বড় প্রবক্তা সেজেছিলেন এবং ক্ষমতায় অংশগ্রহণও করেছিলেন (খোন্দকার মোশতাক আহমদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুর প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য)।

এ কথা ঠিক যে, এই বিভীষণরা এত দ্রুত ক্ষমতার কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নেতৃত্বেও বিশ্বাসপ্রবণতা ও নানাবিধ দুর্বলতার দরুণ। অবশ্য সেজন্য তাদের অনেককে প্রাণ দিয়েই তার মাশুল দিতে হয়েছে। ১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশে হয়েছিল তার পেছনে আমেরিকা থেকে যথাসময়ে খাদ্য আমদানি বন্ধ হওয়াটা একটা প্রধান কারণ ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে আমাদেও দেশের ভিতরেও যে মজুতদারি ও দুর্নীতি ছিল সেটাও তো সত্য। সেই কাজগুলো তো তদানীন্তন স্বাধীনতাপন্থীরাই করেছিলেন। নব্য ধনীদেও বিকাশ স্বাধীনতার পথে মোটেও ঠেকে থেকেছে কি? (বঙ্গবন্ধুর তদানিন্তন বক্তৃতাগুলো দ্রঃ) কিন্তু সবচেয়ে দুর্ভাগ্যেও বিষয় হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশের নব্যধনীরা স্বাধীনতার ধারাকে অবশেষে উল্টে দেয়ার পর স্বাধীনতাপন্থীরা এতই ভীত এবং দুর্বল হয়ে পড়েন যে, কোন দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন। বরং দীর্ঘকাল পর বর্তমানে ক্ষমতায় এসেও আজ তারা ইতিহাস থেকে উল্টো এই শিক্ষাই নিয়েছেন যে, বাংরাদেশের নব্যধনীরা স্বাধীনতার ধারাকে অবশেষে উল্টে দেয়ার পর স্বাধীনতাপন্থীরা এতই ভীত এবং দুর্বল হয়ে পড়েন যে, কোন দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তারা ব্যর্থ হন। বরং দীর্ঘকাল পর বর্তমানে ক্ষমতায় এসেও আজ তারা ইতিহাস থেকে উল্টো এই শিক্ষাই নিয়েছেন যে, ‘আপোস ছাড়া উপায় নেই। ক্ষমতায় থাকতে হলে শত্রুদের সঙ্গে আপোস করেই ক্ষমতায় থাকতে হবে’। এ ধরনের শিক্ষা নিয়ে যারা চলতে চান, তারা হয়তো সহজে ক্ষমতাচ্রুত হবেন না ঠিকই, কিন্তু ক্ষমতায় থেকে দেশের বড় কোন একটা মঙ্গলও তাদেও দ্বারা সম্ভব হবে না (এটা তাদেও বর্তমান কার্যকলাপ থেকে এত সুস্পষ্ট যে বাড়তি ব্যাখ্যা নিস্প্রয়োজন)। এই আপোসের স্বার্থে আমাদেও দেশের রাজনীতিকে আজ একটি ভূয়া বিতর্কেও মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে। স্বাধীনতাপন্থী বনাম স্বাধীনতাবিরোধী। বস্তুত এই বিতর্কেও বিভ্রান্তি এতই জটিল যে, তার ফলে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধেও প্রশ্নে এখন পর্যন্ত হতবিহ্বল হয়ে রয়েছেন।

জটিলতার গ্রন্থি উন্মোচন করতে হবে:

মনে রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধেও একটি অতীত আছে, আবার এর একটা ভবিষ্যতের দিকও আছে। অতীত দিকটা খুবই গৌরবোজ্জ্বল। সেটা ১৯৫২-ও ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ এর সশস্ত্র যুদ্ধ পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। এই সংগ্রামে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ছিল গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। তবে নিঃসন্দেহে শেখ মুজিব ছিলেন এই আন্দোলনের সবচেয়ে অগ্রসর পুরোধা এবং সে কারণেই অন্য দলগুলোর তুলনায় তার দল আওয়ামী লীগের ভূমিকা স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বেও ভূমিকা রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কি শুধুই ৯ মাসের যুদ্ধ এবং যুদ্ধপূর্ব পটভূমি নির্মাণের সংগ্রামের ইতিহাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ? এভাবে যারা মুক্তিযুদ্ধকে সীমাবদ্ধ খন্ডকালীন অতীতের বাক্সে বন্দি করে প্রাণহীন বিষয়ে পরিণত করতে চান, তারা আসলে জেনে বা না জেনে মুক্তিযুদ্ধেরই সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছেন। রাজনৈতিক স্বাধীনতা আজ যদি অর্থনৈতিক মুক্তির পথে এগিয়ে না যায় তাহলে শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার আবেদন যে ভবিষ্যত প্রজন্মেও হৃদয়ে ক্রমশ ম্লান এবং বিবর্ণ হয়ে যেতে বাধ্য এ কথাটি তারা অনেকেই অনুধাবন করেন না। অতীতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে সব শ্রেণী অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা শুধুমাত্র পতাকা বদল, জাতীয় সঙ্গীত বদলের জন্য রড়াই করেন নি। এগুলোর যত প্রতীকী মর্যাদাই থাকুক না কেন, আসলে বাস্তব সংগ্রাম বাস্তব দ্বন্দ্ব থেকেই উতসারিত হয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যদি সবার উপর নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে না পরতো, যদি বাঙালি শ্রমিকদেও উপর পাকিস্তানের ২২টি একচেটিয়া পুঁজিপতি পরিবার দীর্ঘ ২৪ বছর নির্মম শোষণ না চালাতো, যদি ২২ পরিবারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বাঙালি পুঁজিপতিরা না হেরে যেত, যদি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানরা হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়ে যে নিরঙ্কুশ বিকাশের স্বপ্ন দেখেছিল তা পাঞ্জাবি মুসলমানদের দাপটে চূর্ণ-বিচূর্ণ না হতো, যদি বাংলার কৃষক বছর বছর বন্যায় ও পটের দামের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুও দিকে অগ্রসর না হতো, তাহলে মুক্তিযুদ্ধে এই সব শ্রেণীগুলো তাদের সাধারণ শত্রুও বিরুদ্ধে একত্রে সমবেত হতেন কিনা তা বলা বলা মুশকিল। নিছক পতাকার জন্য বাঙালি জাতি কখনোই অস্ত্র হাতে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধক্ষেত্রে নামে নি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে পতাকা, ভূখন্ড, রাজনৈতিক স্বাধীনতা-এগুলোই জীবনের চেয়ে দামি হয়ে উঠেছিল। আসলে এগুলো ছিল ‘পন্থা’, এগুলো মূল আদর্শ বা লক্ষ্য ছিল না (এমন কি সুদূও অতীতের ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের কর্মসূচিতেও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য বলিষ্ঠভাবে উচ্চারিত হয়েছিল)। এ কথা অবশ্য ঠিক যে, মূল উদ্দেশ্য “শোষণ-শাসন ও মুক্তির” জন্যই প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতার। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতা কখনোই “ঊহফ-রহ-রঃংবষভ” ছিল না। এ জন্যই আমি আবারো বলতে চাই রাজনৈতিক স্বাধীনতার পর্যায়টি নিঃসন্দেহে গৌরবজনক কিন্তু সেটিই শেষ কথা নয়। সেটি মুক্তিযুদ্ধেও একটি দিক এবং সেই দিকটি এখন হচ্ছে অতীতের দিক। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধেও কোন কোন বিশেষ ইস্যু এখনও বহুদিন পর্যন্ত সমান সজীব থাকবে। ঘাতক-দালার, যুদ্ধাপরাধীদেও বিচার ও সাম্প্রদায়িকতার নির্মূল সে ধরনের দু’টি বিষয়।

মুক্তিযুদ্ধেও পর দেশবাসী যুক্তিসঙ্গতভাবেই চাইলো তাদেও সামগ্রিক অর্থনৈতিক মুক্তি। এটিই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধেও স্বাভাবিক পরিণতি তথা ভবিষ্যতের দিক। এই দিকটিই আজ ক্রমশ বিকশিত হবে বা হওয়ার কথা। বস্তুত জাতি আজ এখানে সঠিক পথের সন্ধান পাচ্ছে না বলেই বিভ্রান্ত হয়ে কেউ অতীতের মহিমাকীর্তন করছেন অথবা কেউ রাজনৈতিক স্বাধীনতা নতুন করে রক্ষার নামে নিরর্থক বিতর্কে লিপ্ত হচ্ছে। এ কথা অনেক সত ধার্মিক বয়স্ক লোককেও ভুলে যেতে দেখেছি যে, আজকের দুনিয়ায় ভারত যত বৃহত রাষ্ট্রই হোক না কেন, চাইলেই সে আজ আর আমাদেরকে দখল করে নিতে পারবে না। বরঞ্চ এই মুহূর্তে তার নিজের ঘর সামলাতেই সে অনেক বেশি ব্যস্ত। তাই ভারত বিরোধিতায় মনোযোগ না দিয়ে, নিজের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে কিভাবে ভারতীয় পণ্যেও সঙ্গে সমানে সমান হয়ে ওঠা যায় সে দিকটায় নজর দেয়াই অধিকতর বাঞ্ছনীয়। যেক্ষেত্রে এদেশের মুক্তবাজার ও বিশ্বব্যাংকের অনুগত দুই প্রধান রাজনৈতিক ধারাই কম-বেশি ‘মুক্ত-কচ্ছ’ (এই শব্দটি আমি বেগম মতিয়া চৌধুরীর কাছ থেকে পেয়েছি এবং তিনি নিজে মনে করেন যে, এ নীতি থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন!)। দুই প্রধান দল যত জোরেশোরে পরস্পরকে দেশ বিক্রিও অভিযোগ করে থাকে, তার সিকি ভাগ শক্তি ব্যয় করে তারা যদি জাতীয় উতপাদনশীল পুঁজিকে আপাতত সংরক্ষণ সুবিধা এবং যথাসময়ে তা প্রত্যাহার করে নিয়ে তাদেরকে সাবালক ও প্রতিযোগিতায় সক্ষম হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করত, তাহলে দেশ প্রকৃতই অথৃনৈতিক মুক্তির পথে অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারতো। আর এ কাজটি না করে ‘ভারতের কাছে দেশ বিক্রি’র বিরুদ্ধে পরস্পরকে শত গালাগালি দিলেও, দেশের বিক্রি হওয়াটা কিন্তু ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। কেউ হয়তো পাল্টা প্রশ্ন করবেন ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ বাদ দিয়ে কি ‘সমাজতন্ত্রে’ অর্থনৈতিক মুক্তি হবে? সোভিয়েত ও পূর্ব ইউরোপের পতনের পর এই প্রশ্ন অবশ্যই একটি সঙ্গত প্রশ্ন। কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে যে, পৃথিবীতে পুঁজিবাদী পথের যারা আজ উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তারা কেউই তাদের উন্নতির নিচুতর স্তরে মুক্তবাজার অর্থনীতির উপর নির্ভর করেন নি। প্রথম মহাযুদ্ধেও আগে যেসব পুঁজিবাদী দেশ উন্নতি অর্জন করেছিল (আমেরিকা, বৃটেন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানী ইত্যাদি) তারা সকলেই দেশের ভেতর ও বাইরে আদিম লুণ্ঠনের মাধ্যমেই তাদেও পুঁজিবাদী উন্নয়ন ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। অন্যদিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পুঁজিবাদী পথে যেসব দেশ উন্নতি করেছে, সেই সব দেরিতে শিল্পায়িত দেশগুলোর (দঃ কোরিয়া, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ব্রাজিল, ভারত ইত্যাদি) প্রত্যেকটিতে রাষ্ট্রেও একটা শক্তিশালী কার্যকর ভূমিকা খুবই দৃষ্টিগ্রাহ্য। বস্তুত, পুঁজিবাদ যেসব দেশে দেরিতে নির্মিত হয়েছে সেসব দেশে রাষ্ট্র ধাত্রীর মতো পুঁজিবাদকে জন্মদান, লালন-পালন ও পর্থ প্রদর্শন করেছে। মুক্তবাজারে প্রতিকুল ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে নাবালক পুঁজিবাদকে ঠেলে দেয়নি। যেখানে দিয়েছে সেখানে পুঁজি নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারে নি। প্রথম পথটির আজ আর পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়। আর দ্বিতীয় পথটি রাষ্ট্রের শক্তিশালী ভূমিকা ছাড়া অসম্বব। তাই আজ ‘অর্থনেতিক মুক্তিকে’ যদি কেউ ‘পুঁজিবাদী শিল্পায়নেই’ সীমাবদ্ধ করে দেখতে চান, তাকেও আজ অতপর “রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের”-ই কোন না কোন রূপের আশ্রয় নিতে হবে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের নতুন দলিলগুলোতে এর একটা অগ্রিম উপলব্ধির সুর শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। তারা অতি সম্প্রতি আর রাষ্ট্রকে গুটিয়ে ফেলতে বলছেন না, বলছেন কার্যকর রাষ্ট্র গড়ে তোলার কথা। কিন্তু হায়, ইতোমধ্যেই তাদের পুরাতন প্রেসক্রিপশান-এর মাশুল দিচ্ছে আফ্রিকার নৈরাজ্যমূলক রাষ্ট্রহীন দেশগুলো।

একথা ঠিক যে বর্তমানে বাংলাদেশে চালু “স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে” অথবা “ভারতের দালাল বনাম ভারতের শত্রু” এ ধরনের নিষ্ফলা বিতর্কেও চেয়ে একটি “উতপাদনশীল রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ” নির্মাণের ‘এ্যাজেন্ডা’ অপেক্ষাকৃত এর ধাপ অগ্রগতি। নিদেনপক্ষে এই এ্যাজেন্ডাকে কেন্দ্র করেও যদি চলতি বিতর্কগুলো পুনর্বিন্যস্ত হত তাহলে তার মর্মবস্তু হত ভিন্ন। তখন আমরা তর্ক করতাম:

ক) বৃহত ঋণখেলাপিদেও অর্থ উদ্ধার করে শ্রমঘন ক্ষুদ্র ও মাঝারি পুঁজিপতিদেও ঋণ দেব কি, দেব না?
খ) ভূমি সংস্কার ও বর্গা সংস্কার করে অবাজার পদ্ধতিতে খোদ উতপাদক কৃষকদের হাতে জমি, উপকরণ, পানি এগুলো পৌঁছে দেন নাকি ধনী কৃষক ও জোতদারনির্ভও কৃষি উতপাদন অব্যাহত থাকবে। খোদ কৃষককে ভর্তুকি দেয়ার জন্য প্রতিরক্ষা ব্যয় কতটুকু কমাবো ইত্যাদি।
গ) গুটিকয়েক পরিবারকে টার্গেট করে একচেটিয়া পুঁজিবাদ তৈরি করব না প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদ তৈরি করব?
ঘ) বিশ্বব্যাংকের নির্দেশ মত ‘মুক্ত কচ্ছ’ বাজারনীতি অনুসরণ করবো না চীনের মত প্রয়োগবাদী বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করবো?
ঙ) রাষ্ট্রকে আগেই গুটাবো না কি রাষ্ট্রকে যতটা সম্ভব বিকেন্দ্রীভূত, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক করবার চেষ্টা করব আগে?
চ) ‘সিভিল সোসাইটি’ তৈরির নামে বা দারিদ্র দূর করার নামে এনজিও লর্ডদের ও ব্যক্তিখাতের হাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সামাজিক খাতগুলো ন্যস্ত করবো, নাকি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বের মধ্যেই এগুলোকে প্রধানত রাখব।
ছ) দারিদ্র দূর করার কর্মসূচি শুধু টুকটাক নিরাপত্তা জালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি মূল ধারার অর্থনীতিতে দরিদ্রদের সম্পৃক্ত করতে হবে?

তালিকা আর বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। এই সব অনুচ্চারিত অস্ফুট বিতর্কগুলো বর্তমানে সামনে নিয়ে আসতে হবে। জীবনের প্রয়োজনে তা অবশ্য অনিবার্যভাবে ইতোমধ্যেই আসতে শুরু করেছে। যদি মুক্তিযুদ্ধকে সত্যই কেউ ভালবাসেন এবং নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধেও ভবিষ্যত আবেদন অটুট রাখতে চান তাহলে তাকে এই আশু কর্তব্যেও দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে। আরো অগ্রসর কর্তব্য তথা ‘শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা’ বা ‘নবায়িত সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা তা এই আশু গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়েই সামনে চলে আসবে। মনে রাখা দরকার মুক্তিযুদ্ধেও ভবিষ্যত হচ্ছে জাতির জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন। আর জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের ভবিষ্যত হচ্ছে ‘নবায়িত সমাজতন্ত্র’। এই ভাবে নিরন্তও দ্বন্দ্বের মাধ্যমেই ভবিষ্যত প্রজন্ম অগ্রসর হবে প্রগতির পথে।

এম. এম. আকাশ : অর্থনীতিবিদ। শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

যুদ্ধাপরাধের বিচার : বাংলাদেশ এবং জার্মানি : একটি নিরপেক্ষ পর্যালোচনা

*অস্ট্রেলিয়া থেকে মোবায়েদুর রহমান*

কিছুদিন আগে একটি মহল থেকে যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবী করা হলো তখন বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অবস্খান গ্রহণ করলেন। সেই অবস্খানকে কেন্দ্র করে এই ইস্যুতে একাধিক চিন্তাধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকার প্রধান ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ বলেছেন যে, যুদ্ধাপরাধ তথা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যে কেউ চাইতেই পারেন। সকলের জন্যই আইনের দরজা খোলা আছে। যে কোনো ব্যক্তি আইন আদালতে এই বিচার চাইলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। ড. ফখরুদ্দীনের এই বক্তব্যের পর ঐ মহল থেকে দাবি করা হয় যে, রাষ্ট্রকে বাদী হয়ে এই মামলা করতে হবে। অর্থাৎ কোন কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা হবে সেটা ঠিক করবে রাষ্ট্র। তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষীসাবুদ এবং প্রমাণপত্রও যোগাড় করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এসব দাবির প্রেক্ষিতে আইন ও তথ্য উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন সরকারের অবস্খান এ ব্যাপারে আরো পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেছেন যে, সরকারের প্রধান কাজ হলো নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। নির্বাচনের পর নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বলেন, সরকারের হাতে সময় খুব কম। এই কম সময়ে অন্যান্য কাজ হাতে নিলে মূল কাজ অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সে জন্য সরকার এসব কাজ হাতে নিতে পারবে না। তিনি আরো বলেন যে, নির্বাচনের পর যে নতুন সরকার আসবে তারা সিদ্ধান্ত নেবে যে যুদ্ধাপরাধের বিচার সংক্রান্ত ইস্যুটি তারা টেকআপ করবেন কি করবেন না।

পরবর্তীতে সাংবাদিকরা এই ইস্যুতে আইন উপদেষ্টাকে আরো প্রশ্ন করলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, বিগত ৩৬ বছরে কেন এই বিচার করা হয়নি? অনেক সরকার এসেছে এবং অনেক সরকার গেছে। কেউ তো এ ব্যাপারে কিছু করেননি। কিন্তু কেউ এই ইস্যুটি টেকআপ করেননি। ৩৬ বছর একাধিক গণতান্ত্রিক সরকার যে কাজটি করেনি সেই কাজটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে করার জন্য আপনারা চাপ দিচ্ছেন কেন? আইন ও তথ্য উপদেষ্টার এসব মন্তব্যের পর এই ইস্যুটি একটু ভিন্নখাতে প্রবাহিত হয়েছে। তবে এই ব্যাপারে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছেন প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জী। একটি সেমিনারে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। দু’টি পত্রিকায় তার ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছে। ঐসব পত্রিকার প্রতিনিধি দেব মুখার্জীর নিকট থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে জানতে চান। উত্তরে দেব মুখার্জী বলেন, “এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত সৈন্যকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল সেটা তো তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনা না করে এবং তাদের সম্মতি ছাড়া করা হয়নি।” উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান অসংখ্যবার ঘোষণা করেন যে, বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই হবে। এজন্য প্রথমে ১৫ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়। তখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, মিলিশিয়া, রেঞ্জার ও ফন্সান্টিয়ার গার্ড মিলে মোট ৯৩ হাজার নিয়মিত ও অনিয়মিত সৈন্য বুদ্ধিজীবী হিসাবে ভারতের হেফাযতে ভারতে অবস্খান করেছিল। যাই হোক, ১৫ হাজার সৈন্যের বিচার একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে যায়, এই বিবেচনায় তালিকা ছোট করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এভাবে ছোট করতে করতে ১৫ হাজারের স্খানে ১৯৫ জনের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের দায়ে এই ১৯৫ জনের বিচার করাও সম্ভব হয়নি। বাবু দেব মুখার্জীর বক্তব্য অনুযায়ী এই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত পাক সেনাসহ ঐ ৯৩ হাজার পাকিস্তানী যুদ্ধাবন্দীকে বাংলাদেশের সম্মতিক্রমে ভারত পাকিস্তানে ফেরত পাঠায়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, পাকিস্তানের আধা সামরিক বাহিনী, ফন্সন্টিয়ার গার্ড, রেঞ্জার এবং বেসামরিক প্রশাসনের উচ্চপদস্খ পাকিস্তানী অফিসারদের সকলেই নিরাপদে পাকিস্তান ফেরত যাওয়ার পর দেশে পড়ে রইলো কারা? রইলো তারা, যারা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কাটিয়েছেন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে। এরাই সেই হতভাগ্য মানুষ, যাদেরকে পরলোকগত সাংবাদিক জনাব এনায়েতুল্লাহ খান ব্যথিত হৃদয়ে বলেছেন, “সিক্সটি ফাইভ মিলিয়ন কোলাবরেটরস।” অর্থাৎ, সাড়ে ছয় কোটি দালাল।”

সাড়ে ছয় কোটি দালাল

উপরোক্ত শিরোনামের লেখাটি মরহুম এনায়েতুল্লা খান সাপ্তাহিক ‘হলিডে’তে ১৯৭৩ সালে স্বনামে লিখেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বাংলাদেশের একটি চিহ্নিত মহল দেশ প্রেমের সোল এজেন্সি নিয়েছেন। কথায় কথায় তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিশেষ করে ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ১৯৭৩ সালে ‘হলিডে’ সম্পাদক আলোচ্য নিবìেধ তাদেরকে ‘নব্য দেশপ্রেমিক’ বলে কটাক্ষ করেছেন। ওরা স্বাধীনতার উষালগ্ন থেকেই প্রতিপক্ষের দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করছেন। আজও তারা হিংসাত্মক ও উস্কানিমূলক ভাষায় সেই অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বাধীনতার পর আবদুল আলিম, আবদুল আহাদ, আবদুল লতিফ, ফেরদৌসি রহমান প্রমুখ স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পীকে রেডিও এবং টিভির কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। তখন মরহুম এনায়েতুল্লা খান ঐ নিবìধটি লেখেন। তিনি বলেন, অকুপেশন পিরিয়ডে অনেক কণ্ঠশিল্পী রেডিও এবং টিভিতে কণ্ঠদান করেন। এজন্য তাদেরকে ‘দখলদার বাহিনীর দালাল’ হিসাবে রেডিও এবং টিভিতে নিষিদ্ধ করা হয়। “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কতিপয় ব্যক্তির এই স্বৈরাচারী (হাইহ্যাণ্ডেডেডনেস) পদক্ষেপ অনেককে আহত করে। এই কাজ এবং এই ধরনের আরো কিছু কাজের ফলে যারা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলেন তারা এবং নয়মাসের ত্রাসের রাজত্বে যারা দেশে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে আস্খার সঙ্কট সৃষ্টি হয়।’ জনাব এনায়েতুল্লা খান খান বলেন, “দেশের অভ্যন্তরে থেকে যারা ঐ যন্ত্রণাদায়ক নয় মাসে অফিসে হাজির হয়ে যেমন কেউ দালাল হয়ে যায় না, তেমনি শুধুমাত্র সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কেউ পূর্ববর্তী ২৪ বছরের দোষ স্খলন করতে পারে না। এ দেশে দখলদারিত্বের সাথে যদি দালালদের সংখ্যা প্রচুর হতো তাহলে দখলদার সরকারকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পুলিশ, আমলা এবং টিভি ও রেডিও শিল্পী আমদানি করতে হতো না। এরপর জনাব খান বলেন, সেই দু:সাহসিক কথা, একটি কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা দরকার। বাধ্য হয়ে অফিস আদালত করা, স্কুল কলেজে যাওয়া, কোনরূপ তদ্বির না করেই ইয়াহিয়া খানের প্রশংসাপত্র পাওয়া, রেডিও টিভিতে কণ্ঠদান কোনোভাবেই দালালী নয়। যদি তাই হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধকালে যে সাড়ে ছয় কোটি মানুষ দেশের অভ্যন্তরে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা সকলেই দালাল এবং দালাল হওয়ার জন্য তারা গর্বিত। ঐ নয় মাসে সমগ্র বাংলাদেশ ছিল একটি বিশাল ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ সকলকে কাজ করতে হতো শৃঙ্খলিত দাসের মত। প্রতিটি মুহূর্ত তারা মৃত্যুভয়ে কাটিয়েছেন।”
এই ছিল এনায়েতুল্লাহ খানের লেখার সংক্ষিপ্তসার। সীমান্ত পারের নিরাপদ আস্তানা থেকে ফিরে এসে যারা দালাল বা যুদ্ধাপরাধী খুঁজে ফিরেছেন এবং ৩৬ বছর পরও খুঁজে ফিরছেন তাদেরকে জনাব খানের এই পটভূমি বিবেচনা করতে হবে।

নুরেমবার্গ বিচার এবং এ দেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সপক্ষে যখন তখন জার্মানির নুরেমবার্গ ট্রয়ালের উদাহরণ দেওয়া হয়। বলা হয় যে, ৫০ বছর পর যদি হিটলারের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে পারে তাহলে ৩৬ বছর পর বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে পারবে না কেন? এ ধরনের কথা কি অজ্ঞতা? নাকি ইচ্ছাকৃত তথ্য বিকৃতি? ইতিহাস সম্পর্কে যাদের ক. খ. গ. জ্ঞানও আছে তারাও বিলক্ষণ জানেন যে, ১৯৩৯ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্যদিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৯৪৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হয়। যুদ্ধ শেষের মাত্র ১ মাস ২০ দিন পর ১৯৪৫ সালের ২০ নভেম্বর থেকে জার্মানির নুরেমবার্গ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়। ১৯৪৬ সালের ১লা অক্টোবর এই বিচার শেষ হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ৫০ বছর পরে নয়, মাত্র ১ মাস ২০ দিন পর এই বিচার শুরু হয়।

নুরেমবার্গে কাদের বিচার হয়েছিল?

যুদ্ধাপরাধী হিসাবে নুরেমবার্গে যাদের বিচার হয়েছিল তারা কারা? কোন ধরনের কোর্টে তাদের বিচার হয়েছিল? সম্মানিত পাঠক ভাইদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, ৬টি সরকারি সংস্খা এবং ২৪ জন উচ্চ পদস্খ সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে চার্জশীট প্রণয়ন করা হয়। যেসব সংস্খার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয় সেগুলো হচ্ছে (১) হিটলারের মন্ত্রিসভা, (২) নাৎসী দলের শীর্ষ নেতৃমণ্ডলী (৩) এসএস বা দলীয় পুলিশ ও এসডি (নিরাপত্তা পুলিশ) (৪) গেস্টাপো (৫) দি এসএ এবং (৬) সেনাবাহিনী এবং জেনারেল স্টাফের হাইকমান্ড। যে ২৪ ব্যক্তিকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, হেড অব চ্যান্সেলারী মার্টিন বোরম্যান, এ্যাডমিরাল অব দি ফ্লিট এবং হিটলারের মনোনীত উত্তরাধিকারী ডেনিজ কার্ল, অধিকৃত পোল্যান্ডের গভর্নর জেনারেল ফ্রাঙ্ক ফন্সান্স, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফিন্সক উইহ্যহেন, প্রুশিয়ান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেবম্যান গোরিং, মিলিটারী কমান্ডের প্রধান এবং হিটলারের কৌশলগত উপদেষ্টা আলফেন্সড জড্ল্, নিরাপত্তা পুলিশের প্রধান আরনেস্ট ক্যালটান রুনার, সেনাবাহিনীর ফিল্ড মার্শাল উইলহ্যাম কেউটেল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভন রিবেনট্রপ, অধিকৃত এলাকাসমূহের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী আনফেন্সড রোজেনবার্গ, শ্রমিকদের সংগঠক ফিন্সটজ সকেল অধিকৃত নেদারল্যান্ডের কমিশনার আর্থার ইনকোয়াট, সেমিটিক বিরোধী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়াস ট্রিচার প্রমুখ।
নুরেমবার্গ বিচারের আদালত গঠিত হয় তৎকালীন ৪টি বৃহৎশক্তি হতে গৃহীত তিনজন করে প্রতিনিধি নিয়ে। এরা হলেন একজন বিচারপতি, একজন বিকল্প বিচারপতি এবং একজন প্রসিকিউটর। এভাবে আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইংল্যান্ড এবং ফন্সান্স প্রতিটি দেশের তিনজন করে প্রতিনিধি নিয়ে মোট ১২ সদস্য বিশিষ্ট আদালত গঠিত হয়। আদালতের নাম দেয়া হয় ‘আন্তর্জাতিক মিলিটারী ট্রাইব্যুনাল’ আমেরিকার তরফ থেকে মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি রবার্ট জ্যাকসনকে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান আমেরিকার তরফ থেকে চিফ প্রসিকিউটর মনোনীত করেন।

নুরেমবার্গ ট্রায়ালের পাশাপাশি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিদাররা কি বলছেন? যারা মূল অপরাধী অর্থাৎ পাকবাহিনী, তারা সকলেই সহি সালামতে দেশে ফিরে গেছেন। নুরেমবার্গে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয় সেগুলো ছিল সরকারি পুলিশ সংস্খা, সরকারি গোয়েন্দা সংস্খা, মিলিটারীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, হিটলারের মন্ত্রিসভার সমস্ত সদস্য ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশে সেখানে পুলিশ, মিলিটারী বা ৯ মাসের মন্ত্রিসভার কোনো সদস্যের উল্লেখ নেই, নুরেমবার্গ ট্রায়ালে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী প্রধানকে আসামী করা হয়েছিল। ৩৬ বছর পর বাংলাদেশে পাক আর্মির কোন সদস্যকে দূরের কথা, একজন সিপাহীর বিচার করাও সম্ভব নয়। নুরেমবার্গে দুই লক্ষ এফিডেভিট পর্যালোচনা করা হয় এফিডেভিট এক হাজার ব্যক্তির টেস্টিমোনি গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশে যাদের বিচারের কথা বলা হচ্ছে তারা নুরেমবার্গ ট্রায়ালের কোন ক্যাটাগরিতেই পড়েন না। তাহলে আওয়ামী ও বাম ঘরানা যুদ্ধাপরাধের নামে কাদের বিচার করতে চান? কিভাবে বিচার করতে চান?