Tag Archives: পূর্ব পাকিস্তান

মুজিব ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি

দি গার্ডিয়ান, ১৩ মার্চ, ১৯৭১

মার্টিন এডনে

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

ঢাকা, মার্চ ১২। শেখ মুজিব আজ ঘোষণা দিয়েছেন যে পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে একবার ও শেষবারের মতো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক। যে-দলটি পূর্ব বাংলার সত্যিকারের সরকার হিসেবে কাজ করছে সেই আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব আমাকে বললেন: ‘আমি ব্যাপারটা সমাধা করতে আলোচনায় বসতে রাজি আছি। আমি যা বলেছি, পষ্ট করেই বলেছি। আমার নাগরিকেরা স্বাধীন নাগরিক হিসেবে একটি স্বাধীন দেশে বাস করতে চায়।’ ব্যাপারগুলো বিস্তারিতভাবে জানতে চাইলে, যেমন প্রতিরক্ষা বাজেটের ব্যাপারটা — যা আলোচনার একটি বিষয় হতে যাচ্ছে, তিনি বলেন: ‘দ্বিধাগ্রস্ত হবার আর কোনো সুযোগ নেই, আমি আমার জনগণের রক্তের বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।’ তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে চান কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন: ‘তারা যদি আমাদের অংশ হিসেবে থাকতে বলে, তবে ভাইয়ের মতো একসঙ্গে থাকাই ভালো হবে।’

মুজিব বাঙালিদের ঐক্যের কথা জোর দিয়ে বলেন — যে-ঐক্য গত সপ্তাহজুড়ে প্রদর্শিত হয়েছে। তিনি দাবি করেন তাদের মগ্নতা ও নিয়মানুবর্তিতা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে তাদের সাহায্য করবে। তিনি অভিযোগ করেন পূর্ব বাংলার সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে উপনিবেশের মতো ব্যবহার করা হয়েছে। সৌদি আরব ও চেকাস্লাভিকিয়া থেকে পাঠানো হেলিকপ্টার বাঙালিরা কখনো দেখে নি। বন্যা নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক সহায়তার সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ ‘রাতদিন কাজ করেছে এমনকি কোনো খাবার ছাড়াই’ এবং তিনি যদি বলেন তো ছাত্ররাও মাঠ পর্যায়ে যাবে। তিনি বলেন: ‘আমরা একটি নিয়মানুবর্তী জাতি; আপনি কি তা লক্ষ করেন নি?’

তিনি জোরারোপ করেন যে যদি রোববারের জনসভায় সেনাবাহিনী তাদের বিপে নামতো তবে জনগণ তা প্রতিহত করতে প্রস্তুত ছিল। ‘আমাদের জনগণ মৃত্যুকে বরণ করে নেবে। তারা প্রতিদিন ঘুর্ণিঝড়ে, বন্যায়, কলেরায়, অনাহারে মারা যায়। আমরা আরেক বার মরবো এবং সবার জন্য মরবো।’ পূর্ব পাকিস্তানের মর্যাদা যদি পরিবর্তিত হয় তবে তার পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তার উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানান, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বমতের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি স্পষ্টতই সচেতন।

পাকিস্তানের অখণ্ডতা রায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধাবস্থান নেয়া ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ছাপা হওয়া একটি প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য অংশ এখানকার একটি পত্রিকায় গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়েছে। এখানকার অর্থনীতি সংকটে পতিত হবার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ বাণিজ্যিক বিনিময়ের ওপরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা খানিকটা শিথিল করেছে। দীর্ঘণ ব্যাংক খোলা রাখা অনুমোদন করা হয়েছে, অর্থ বিনিময় ও মাল খালাসের সীমা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পণ্য পরিবহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের জন্য সপ্তাহে ১০,০০০ রুপি পর্যন্ত অর্থ গ্রহণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বন্দর কর্তৃপকে সব ধরনের কাজ চালিয়ে যাবার জন্য বলা হয়েছে। শিল্পোন্নয়ন কর্পোরেশনের কারখানাগুলো চালু হয়েছে এবং কৃষিজ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কাজ চালিয়ে যাবার জন্য বলা হয়েছে।

রয়টার্স-এর সংযুক্তি: প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আজ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকার পথে করাচিতে আসছেন। প্রেসিডেন্ট তার যাত্রা গোপন রেখেছেন। ওদিকে ঢাকার ১৭২ মাইল পশ্চিমে একটি জেলখানায় দাঙ্গা বেধে গেলে রীদের গুলিতে দু-জন বন্দি মারা গেছে এবং ২২ জন আহত হয়েছে। লোহার রড ও অন্য অস্ত্রের আঘাতে ৩০ জন পুলিশও আহত হয়েছে। গতকাল রাতে বরিশাল জেলে ২০০ জন বন্দি রীদের ওপরে চড়াও হলে দাঙ্গা বেধে যায়। পুলিশ বলেছে বন্দিদের জেলখানার মূল গেট ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু তাদের মধ্য থেকে ২২ জন জেলখানার উঁচু দেয়াল অতিক্রম করে পালিয়েছে। বর্তমান আন্দোলন চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের জেলখানা থেকে প্রায় ৩৮৫ জন বন্দি পালিয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তান ক্ষমতা দেখাচ্ছে

দি গার্ডিয়ান, ১২ মার্চ, ১৯৭১

মার্টিন এডনে

ঢাকা, মার্চ ১১। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি চরম সংকটের মুখে পড়েছে। কারণ আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমানই এখন প্রদেশটির সরকারের মতো কাজ চালাচ্ছেন এবং তার নির্দেশ মতো স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বন্ধ রয়েছে। যদিও অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ আছে — ব্যবসায়ীরা এক মাসে ১,০০০ টাকা ও চাকুরীজীবিরা ১,৫০০ টাকার বেশি তুলতে পারবে না — কিন্তু ব্যাংকগুলো এই চাহিদাটুকুও পূরণ করতে পারছে না, এমনকি তারা একে অপরের চেককেও বিশ্বাস করছে না। পাটকলগুলো আগামী রোববারে পাট কিনতে ও মাসিক বেতন-প্রদান করতে পারেব কিনা তা নিয়েও তারা চিন্তিত। আওয়ামী লীগ গর্ব করে বলছে রফতানি বন্ধ আছে কারণ জাহাজের মালিকরা শুল্ক ধর্মঘটে যোগ দেয় নি।

রোববারে মুজিবের বক্তৃতার পর যে অনুপ্রেরণা কাজ করছিল, প্রেসিডেন্টের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয় তা দেখতে যে-উদ্বিগ্ন প্রতীক্ষা শুরু হয়েছে তা অনুপ্রেরণাকে দূর করে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে কবে আসবেন তা অনিশ্চিত, কিন্তু গুজব শোনা যাচ্ছে যে তিনি আজ রাতেই আসছেন।

দ্রব্যমূল্যের দামের ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে — চালের দাম বেড়েছে শতকরা ২০ ভাগ এবং রান্নার তেলের দাম বেড়েছে শতকরা ৫০ ভাগ। অনেক লোকই ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে গিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এরকম একটি কথাও অনেকে ভাবছেন যে বর্তমানের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারে না। কেউ কেউ বলছেন এসব করে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থই পূরণ করা হচ্ছে। কেবল ব্যবসায়ীরা নয়, অনেক লোকই এখন ভাবছে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়া খুব বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে কিনা। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত পাঁচ লক্ষ বাঙালির সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ নেই।

এরকম কোনো ধারণা দেয়া মুশকিল যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এই প্রদেশটি নিজেকে কতটা স্বাধীন ভাবে যার সঙ্গে কোনো ধরনের ডাক, টেলিফোন বা টেলিগ্রামে যোগাযোগ নেই। একটা রিকশায় করে আমি একটি পানির গাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। গাড়িটির পেছনে ছয় জন লোক ঝুলছিল। তারা বলে উঠলো: “জয় বাংলা”। আমার রিকশাচালক মাথা ঘুরিয়ে বললো: “স্বাধীন বাংলা”। আমি জিজ্ঞেস করলাম এই দু-টি চিৎকারের মধ্যে পার্থক্য কী? রিকশাওয়ালাটা বললো, “কোনো পার্থক্য নেই”।

এখানকার সব বিচারপতি একটি নতুন গভর্নরের অধীনে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এ-হলো বাঙালি ঐক্যের আরেক সাক্ষ্য যার মধ্যে ব্যবসায়ী গর্ব এবং হাওয়ার কাছে সমর্পণের বিচক্ষণতা। এই চেতনার স্রোত সৃষ্টি হয়েছে মুজিবের আহ্বান থেকে। আবার মুজিবেরও কোনো উপায় নেই, তাই তাকে এই চেতনা বহন করতে হচ্ছে। এটা মনে হচ্ছে যে ইয়াহিয়া আসছেন শেখকে কিছু ছাড় দিতে, কিন্তু কোন পর্যন্ত তিনি তা দিতে পারেন তার নানা দিক রয়েছে। এটা পরিস্কার যে মুজিব যদি তার অনুসারীদের সঙ্গে রাখতে চান তবে তাকে অন্তঃত আওয়ামী লীগের ছয় দফা অনুসারে দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে এবং রাজস্ব ও বৈদেশিক বাণিজ্য হাতে রাখতে হবে।

কিন্তু এটা খুবই সন্দেহজনক সেনাবাহিনী এটা মেনে নিবে কিনা। কারণ জাতীয় বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি তারা প্রতি বছর নিয়ে থাকে। শেখের সমর্থকরা এটা দাবি করছেন যে ইয়াহিয়া প্রদেশের মতা আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবের কাছে হস্তান্তর করবেন, কিন্তু এটা একটা আশাবাদী ধারণা মাত্র। এটা জানা কঠিন যে মুজিব কী ধরনের স্বায়ত্তশাসন রফা করবেন, যিনি এখন পর্যন্ত বিশ্বাস করেন স্বাধীনতার সামান্য কম স্বায়ত্তশাসন পেলে থেমে যাওয়া যায়। হয়তো দুই প্রধানমন্ত্রির কনফেডারেশনকে তিনি মেনে নেবেন। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী ঢাকা বিমানবন্দরের কাছাকাছি অপেক্ষা করছে। তারা বিশ্বাস করে আদেশ দেয়া হলে তারা দ্রুতই প্রদেশটিকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে, যদিও বাঙালিরা দূরবর্তী যোগাযোগ-ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটিয়ে চলেছে। অবশ্য তারা এটাও জানে যে এই সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক ফলাফল কত ভয়াবহ হতে পারে।

এখানে দুই ডিভিশন সৈন্য আছে বলে জানা যায় যাদের মধ্যে কিছু আছে বাঙালি। এছাড়া আছে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস্, যারা স্থায়ী সীমান্তরাকারী বাহিনী। তাদের সংখ্যা ২০,০০০-এর কিছু বেশি যারা সেনা ঘাঁটি থেকে দূরে এখানে রয়েছে এবং তাদের হাতে রাইফেলের চাইতে সামান্য শক্তিশালী অস্ত্র রয়েছে। অভিযান শুরু হলে তাদের আনুগত্য বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে। আবার এরকম গুজবও শোনা যাচ্ছে বিমানযোগে আরও সৈন্য আসছে এবং নৌজাহাজে আরও সৈন্য রওয়ানা দিয়েছে। সেনাবাহিনীর ওপর কঠোর নির্দেশ আছে যাতে কোনো ধরনের ঘটনাকে তারা উস্কে না দেয় গত রাতে এখান থেকে উত্তরে কিছু সরবরাহের জন্য যাওয়া চারটি গাড়ির একটি কনভয় জনতার বাধার মুখে পড়লে গুলিবর্ষণ ছাড়াই তার ফিরে যায়। কিন্তু সাধারণভাবে সেনাবাহিনী সাধারণ ঠিকাদারদের মাধ্যমেই বিভিন্ন সরবরাহ পাচ্ছে যদিও চরমপন্থী নেতারা তা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

এখানে আরও একটি কথা হচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট যদি কঠোর পদক্ষেপ নেন তবে তার ফল কী হবে। এর অর্থ পাল্টা উদ্যোগ মুজিবের দিক থেকে না এসে অন্য দিক থেকেও আসতে পারে। কট্টরপন্থীদের কাছে মুজিব কোনো বিপ্লবী নন এবং তার রাজনৈতিক দর্শনও যথেষ্ট অস্পষ্ট। কিছু তথাকথিত গেরিলা-গোষ্ঠী আছে যারা গত কয়েক মাসে গ্রামাঞ্চলে কিছু রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করেছে এবং এরকম একটি ভয় আছে যে পশ্চিমবঙ্গের মতো এখানেও নকশাল আন্দোলন ছড়িয়ে যেতে পারে — বিশেষত মুজিবকে যদি দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। বাঙালিদের সাহসিকতার কথা শোনা গেলেও বৃহদাকারে সংগঠিত কোনো প্রতিরোধের পরিকল্পনার নিদর্শন দেখা যায় নি।

গত কয়েক সপ্তাহ জুড়ে যে প্রবল বাঙালি জাতীয়তাবাদ দেখা দিয়েছে যদিও তার ভবিষ্যত ঘোলাটে বলেই মনে হচ্ছে। যদি এই জাতীয়তাবাদ নিজেকে পরিচালিত করতে পারে তবে এই পশ্চাদপদ ও হতাশ প্রদেশটির জন্য তা মূল্যবান সম্পদই হবে। অবশ্য তারা সবসময়ই বলার জন্য প্রস্তুত থাকে যে তাদের এই পশ্চাদপদতার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান দায়ী। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা সম্ভবত আট কোটি এবং আশংকা করা হচ্ছে কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা চালু করা না গেলে এই সংখ্যা আগামী ২৩ বছরে দ্বিগুণ হবে। নতুন কোনো ভূমি নেই চাষ করার জন্য। এমনকি গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মাঝামাঝি অঞ্চলের কর্দমাক্ত ভূমিতেও ধানচাষ করা হয় এবং শহর দ্রুত সেদিকে ধাবিত হচ্ছে। একমাত্র আশা হলো ইতোমধ্যে উন্নত বীজ উদ্ভাবিত হয়েছে, অধিক সার ব্যবহার করা হয়েছে ও অধিক সারের অর্ডার দেয়া হয়েছে এবং সেচব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।

এখানকার প্রধান রফতানি-পণ্য হলো পাট এবং সিন্থেটিক ফাইবারের আবির্ভাবে তা হুমকির মুখে পড়েছে। ব্যাপক প্রনোদনা সত্ত্বেও শিল্প বিঘ্নিত হয়েছে ও বিনিয়োগ বিফলে গেছে। কেউ নিন্দুকের মতো বলতেই পারেন পূর্বকে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে পশ্চিম খুব কৃপণ হতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর সবচাইতে জনবহুল এই জনগোষ্ঠীর দুর্দশার খানিক উন্নতি ঘটাতে চাইলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পুরো সঞ্চয় ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হবে।

টুকরো হয়ে যাবার আশংকা, পাকিস্তানের স্বপ্ন ছিন্নভিন্ন

দি টাইমস, ১০ মার্চ, ১৯৭১

জেড. এইচ. জাইদি

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

পাকিস্তানের দু-অংশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা কি অবশ্যম্ভাবী? আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস্ পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলি ভুট্টোর মধ্যে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা দেখে অনেক পর্যালোচকের মনেই এখন এই প্রশ্ন। ভুট্টোর আইনসভার অধিবেশন বয়কটের অবিচণ হুমকি, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা পূর্বে তৎপরবর্তী বিক্ষোভ-আন্দোলনের ফলেই এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক বৈরিতা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনা থেকে পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে সৃষ্ট অসন্তোষ থেকেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

দুই অংশের বৈরিতা নতুন কিছু নয়। দেশভাগের পর থেকেই বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি। ভাষা থেকে তারা এর শক্তি পেয়েছে। ১৯৫০-এর দশকে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাইলে তা প্রতিরোধে যারা আত্মত্যাগ করেন তাদের স্মরণ এই জাতীয়তাবাদের শক্তির উৎস। শেষ পর্যন্ত উর্দুর পাশাপাশি বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়, কিন্তু তা অর্জিত হয় রক্তপাতের মাধ্যমে। বিলম্বে প্রদান করা অধিকার বাঙালিদের ক্ষোভ খুব কমই প্রশমিত করতে সমর্থ হয়।

ভাষা-বিতর্ক পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে দ্রুত বেড়ে ওঠা অনুভবের নির্দেশক। তারা মনে করেছে আগে তারা মাড়োয়াড়ী ও পশ্চিমবঙ্গের জোয়াল কাঁধে নিয়েছে, এখন নিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানীদের। দেশভাগের সময়ে অবিভক্ত ভারতে পুরো বেসামরিক প্রশাসনে মাত্র একজন পূর্ব বাংলার মুসলমান কর্মকর্তা ছিলেন। আর ১৯৫৬ সালের পর থেকে পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনে কঠোর কোটা-পদ্ধতিতে লোক নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত প্রশাসনে পূর্ব পাকিস্তানের তিনজন যুগ্ম সচিব, ১০ জন উপ-সচিব এবং ৩৮ জন নিম্ন সচিব রয়েছেন। এর বিপরীতে ঐ পদগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৮, ১২৩ ও ৫১০। বিভাগপূর্ব সময়েই সামরিক বাহিনীতে পাঞ্জাবী ও পাঠানদের প্রাধান্য ছিল, বিভাগপরবর্তী সময়ে তাদের প্রাধান্য আগের চাইতে আরও বেড়েছে। ১৯৫৬ সালের পর থেকে পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি ঘটেছে কিন্তু বৈষম্য থেকেই গেছে।

বেসামরিক, রাজনৈতিক ও সামরিক — ক্ষমতার এই তিন হাতিয়ারের সমাবেশ ঘটেছে পাকিস্তানের তিনটি শহরে, কিন্তু শহর তিনটিই পাঞ্জাব রাজ্যে অবস্থিত। এতে আন্তঃঅংশ বিরোধ বেড়েছে। ১৯৫৫ সালে সিন্ধু, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাব মিলে একটি অংশের সৃষ্টি হবার পর লাহোর পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী হয়। ১৯৫৯ সালে আইয়ুব খানের একক সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের রাজধানী করাচি থেকে ইসলামাবাদে নিয়ে আসেন। এতে দেশের রাজধানী হয় পাঞ্জাবেরই একটি শহর। রাওয়ালাপিন্ডি তো সশস্ত্রবাহিনীর হেডকোয়ার্টার ছিলই।

আইনসভায় এক ইউনিট ব্যবস্থা কেবল আন্তঃপ্রদেশ বিরোধ বাড়িয়েই তোলে নি, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে পরস্পরের শত্রুভাবাপন্ন করে ফেলেছে। দেশভাগের পরপরই যে-আইনসভা গঠিত হয়েছিল সেখানে ৬৯টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিল ৪৪টি। নতুন পদ্ধতিতে এই প্রতিনিধিত্ব পশ্চিম পাকিস্তান দ্বারা নির্ধারিত হতো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সম্প্রতি এই ইউনিট পদ্ধতি ভেঙ্গে তা সংশোধনের উদ্যোগ নেন। তার উদ্যোগ মোতাবেক প্রতিটি প্রদেশ তার জনসংখ্যার ভিত্তিতে আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব করবে। এভাবে ৩১৩টি আসনের জাতীয় আইনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ প্রতিনিধিত্ব থাকবে।

পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষোভের কিছু যথার্থ কারণ আছে। কিন্তু এর সবটাই পশ্চিম পাকিস্তানের কারণে হয় নি। ইতিহাস ও ভূগোল সেখানে অর্থনৈতিক স্থবিরতা এনে দিয়েছে। ভারত বিভাগের পূর্বে পূর্ব বাংলা ছিল সবচেয়ে অনুন্নত এলাকার একটি। কৃষিনির্ভর এই অঞ্চলটি পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়িত অঞ্চলের জন্য কাঁচামালের যোগানদার-ভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পূর্ব বাংলার রফতানি-কেন্দ্র চট্টগ্রামকে প্রতিদ্বন্দ্বী কলকাতার কারণে অনুন্নত রাখা হয়েছে। পূর্বের জেলাগুলো পুরোপুরিভাবে অবহেলা করা হয়েছে ও অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। এই অবস্থা দূর করতে ভাইসরয় লর্ড কার্জনের উদ্যোগে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হয়। কিন্তু এই বিভাগ স্বল্পস্থায়ী হয়। বাঙালি হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং ১৯১১ সালে আবার বাংলা এক হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালে আবার তারা পৃথক হয়ে যায়। আজ দু-অংশই উত্তাল। নিকট ও দূর ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে তা বলা কঠিন। কিন্তু ভারতের একটি অংশ হতে এর কোনো ইচ্ছা নেই। ঐধরনের একত্রীকরণের অসুবিধা কী তা স্পষ্ট। পাকিস্তানে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু ভারতে তারা হবে সাত ভাগের এক ভাগ। পাকিস্তানে তারা অর্থনৈতিক সম্পদের একটি বড়ো অংশের ভাগ পেতে পারে, কিন্তু ভারতে সম্পদের ভাগ পেতে অন্যান্য অনেক অঞ্চলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। এর নতুন পাটকলগুলোকে কলকাতার কলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে, কলকাতা বন্দরের সঙ্গে উন্নয়নশীল চট্টগ্রাম বন্দরকে মোকাবেলা করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে একত্রিত বাংলার আত্মপ্রকাশও একটা ফলাফল হিসেবে কেউ ভাবতে পারেন, কিন্তু তা হবার সম্ভাবনাও খুব কম। ১৯৪৭ সালে শরৎ চন্দ্র বসু ও সোহরাওয়ার্দি এরকম একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু তা কার্যকর হয় নি। কিন্তু পূর্ব বাংলা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে লীন না হবার ব্যাপারে খুবই সচেতন। আর এধরনের একত্রীকরণ করতে হলে পশ্চিমবঙ্গকে ভারত থেকে পৃথক হতে হবে — কিন্তু এধরনের যেকোনো উদ্যোগ ভারত শক্ত হাতে প্রতিরোধ করবে।

পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একমাত্র বিকল্প হলো পূর্ণ স্বাধীনতা অথবা পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে শিথিল ফেডারেশন। পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান নেতৃত্ব স্বাধীনতার ক্ষেত্রে খুব আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। পূর্ব পাকিস্তান ব্যাকুলভাবে যেটা চাচ্ছে সেটা হলো তারা নিজেরাই নিজেদের শাসন করবে — তারা চায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। নিজ শাসন বা স্বরাজ যাই বলুন না কেন, তারা তাই করতে চায়, যদি সম্ভব হয় তবে পশ্চিম পাকিস্তানের সহযোগিতা নিয়েই। যদি পূর্ব পাকিস্তানীদের নিশ্চয়তা দেয়া হয় যে তাদের ঘরের তারাই প্রভু, তবে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে ফেডারেল সরকারব্যবস্থায় অংশ নেবে। সেখানে দুর্বল কেন্দ্র থাকতে হবে এবং কেন্দ্র তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তপে করবে না। ভারত একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র কিন্তু একটি সংবদ্ধ ভূখণ্ড। পাকিস্তান একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র কিন্তু বিভক্ত ভূখণ্ড। এই দুই রাষ্ট্রেরই ভবিষ্যত হলো শিথিল ফেডারেল কাঠামোর। উভয় দেশকেই আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক চেতনাকে সত্যিকারের মর্যাদা দিতে হবে এবং দু-দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। দেশবিভাগ হয়েছিল মুসলমান-অধ্যুষিত প্রদেশগুলোর ওপরে হিন্দু আধিপত্যের ভয় থেকে। পূর্ব পাকিস্তানের ওপরে পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য একইভাবে অমীমাংসিত প্রমাণিত হয়েছে।

১৯৪৭ সালের পূর্বের পাকিস্তান-আন্দোলনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের দাবির মিল রয়েছে। হিন্দির আধিপত্যের বিপরীতে উর্দুকে রক্ষা, আইনসভায় ও চাকরিতে মুসলমানদের অংশভাগ, কংগ্রেসের শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে মতের বিপরীতে মুসলমানদের ফেডারেল কাঠামোর দাবি এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের আরও ক্ষমতার দাবিসহ অনান্য কিছু কারণই ছিল ভারতবিভাগের কারণ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী মুসলিম লীগ আইনসভা বয়কট করেছিল। ইতিহাস কি তার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে?

[ড. জাইদ লন্ডন ইউনিভার্সিটির প্রাচ্য ও আফ্রিকা অধ্যয়ন স্কুলের ইতিহাসের প্রভাষক।]

৭ই মার্চের ভাষণের পরে

দি টাইমস, ৮ মার্চ, ১৯৭১

পল মার্টিন

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক


আপস অথবা সরাসরি সংঘাত: পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিধাগ্রস্ত

ঢাকা, মার্চ ৮। আজ পাকিস্তানের সংকট নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে। কারণ দেশটির উভয় অংশকেই আজ রাজনৈতিক আপস অথবা সরাসরি সংঘাতের মধ্যে একটিকে বেছে নেয়ার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল যে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বক্তৃতা দিয়েছেন, তা থেকে মনে হচ্ছে আপসের কিছু সুযোগ এখনও রয়েছে। তিনি বলেছেন ২৫ মার্চে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আইনসভায় বসতে রাজি হবার ক্ষেত্রে সামরিক সরকারকে অন্তঃত চারটি শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে। গত কয়েক সপ্তাহে ঢাকা এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে যে-উত্তেজনা দেখা গিয়েছে, তা এখনও বলবৎ রয়েছে কিন্তু এরপরও শ্বাস ফেলার সময় তৈরী হয়েছে। বিপদের কথা এই, উভয় পক্ষের সামরিক ও বেসামরিক জঙ্গীরা বিশেষত পূর্বের মুজিববাদী চরমপন্থী ছাত্ররা সংকটকে পুনরায় চরম গভীরে ঠেলে দিতে পারে।

পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যত যে অনিশ্চিত তা বোঝা যাচ্ছে বিদেশী নাগরিকদের মধ্যে যারা দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী তাদের ফিরে যাবার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। প্রথম ব্যাচ হিসেবে জার্মানীদের একটি দল, যাদের মধ্যে দূতাবাসের স্টাফ ও পরিবার রয়েছে এবং কর্মরত অন্যরা আজ ব্যাংককে চলে গেছেন। ব্রিটিশদের মধ্যে দেশে ফিরে যাবেন তাদের জন্য একটি বোয়াক ভিসি টেন এয়ারলাইন অপো করছে আগামীকাল ঢাকা ছাড়ার জন্য। যদিও সবাইকে চলে যাবার ঘোষণা দেয়া হয় নি, তবুও কোনো সরকার সতর্ক হবার প্রয়োজন মনে করছে। বিগত সপ্তাহগুলোর ব্যাপক মিছিল-বিক্ষোভে থেকে অবশ্য বিদেশীদের বিরুদ্ধে কোনো হুমকি দেয়া হয় নি। কিন্তু যেহেতু আইন-কানুন পরিস্থিতি ভালো নয়, তাই এই মনোভাব যে পরিবর্তিত হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

বাঙালিদের জন্য ইস্যুটি খুব পরিস্কার: শেখ মুজিবুর ও তার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে দিতে হবে, যারা পরিস্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে নির্বাচনে জিতেছে, অথবা নির্বাচনটিই প্রহসনে পরিণত হচ্ছে। শেখ পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র কার্যকর শক্তি বলে এতোকিছু সম্ভব হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে শেখের অবস্থান সাংঘাতিক ভালো। ৩ মার্চের সংসদীয় অধিবেশন স্থগিত করার পর আওয়ামী লীগের ডাকে ঢাকায় হরতাল পালিত হচ্ছে।

যদিও প্রদেশজুড়ে প্রয়োজনীয় সেবা পুনরুদ্ধার করা হয়েছে, কিন্তু সব সরকারী-বেসরকারী অফিস, স্কুল ও ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকবে। রাজস্ব প্রদান স্থগিত থাকবে, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ব্যাংকিং লেনদেন বন্ধ থাকবে এবং পরবর্তী নির্দেশ না-দেয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে চালু পশ্চিম পাকিস্তানের একাউন্ট বন্ধ থাকবে। শেখ পশ্চিমের সঙ্গে যে-অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছেন, এর ফলে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা তৈরি করবে। বাঙালিরা বিশ্বাস করে যেহেতু তাদের বেশিরভাগ উৎপাদিত পণ্য পশ্চিম থেকে আসে, তাই বাণিজ্য বন্ধ হলে তারা এর প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাবে।

শেখ আরেক জায়গায় জয়ী হয়েছেন। তার অসহযোগ আন্দোলন কাজে দিচ্ছে। ব্যপারাটা বোঝা গেল, যখন গতকালের বিশাল জনসভায় তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন ঢাকার বেতারকেন্দ্র তা প্রচার করতে রাজি হলো। কিন্তু সময়মতো তা সম্প্রচারিত হয় নি। বিক্ষোভকারীরা এর প্রতিবাদ জানায় এবং বেতারকেন্দ্রে ঘরে-তৈরী-বোমা নিক্ষিপ্ত হয়।

পাকিস্তান: ভাঙ্গন রোধে ইয়াহিয়া সেনাবাহিনী ব্যবহার করবেন

দি অবজারভার, ৭ মার্চ, ১৯৭১

সিরিল ডান

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্তাল কেন্দ্র ঢাকা আজ যে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে তার ফলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধের সূচনা করতে পারে। এর ফলে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানে স্বাধীনতা লাভের ২৫ বছর পর দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানের ৫০-বছর-বয়সী রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল ঘোষণা করেছেন যে আজ ঢাকার পল্টন ময়দানে একটি গণসমাবেশে করবেন। তার আন্দোলনের সেনাপতিরা বলছেন আজ মুজিব একটি ‘ঐতিহাসিক বক্তৃতা’ করবেন, যার অর্থ পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পৃথক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেবেন।

এই সম্ভাবনার কথা বুঝতে পেরে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান — যিনি এখনও সামরিক শাসক হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ মতা ধারণ করেন — গতকাল দুপুরে এক বেতার-ভাষণে দৃঢ়ভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন যে তিনি পাকিস্তানের ভাঙ্গন বরদাশত করবেন না। তিনি তার ভাষণে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হস্তপে করতে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘যাই ঘটে থাকুক না কেন যতণ পর্যন্ত আমি পাকিস্তান-সেনাবাহিনীর প্রধানের দায়িত্বে আছি, পাকিস্তানের সম্পূর্ণ ও পরম অখণ্ডতা রা করবো। এবিষয়ে যেন কোনো সন্দেহ কারো মনে না থাকে। আমি সামান্য কয়েকজন লোককে কোটি মানুষের পাকিস্তান ভূমিকে ধ্বংস করার সুযোগ দিতে পারি না’।

একই সময়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আজ ঢাকায় চরম বিক্ষুব্ধ প্রদর্শনীকে রোধ করার জন্য ও পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করার জন্য দু-টি পদপে গ্রহণ করেছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নির্বাচিতরা ২৫ তারিখে একটি সংবিধান প্রণয়নের জন্য আইনসভার অধিবেশনে বসবেন। সংবিধান অনুসারে মতা সেনাবাহিনীর হাত থেকে জনগণের কাছে হস্তান্তরিত হবার কথা। ডিসেম্বরের ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি আসনেই জয়ী হন কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো সমর্থনই পান নি।

শেখ যখন পুরো পাকিস্তানের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এমন এক ধরনের স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা দিতে চাইলেন যার প্রকৃতি স্বাধীনতার চেয়ে সামান্য দূরবর্তী একটি অবস্থান, তখনই বর্তমান সংকট তৈরী হলো। এর ফলে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রি ও পশ্চিমাংশে বিজয়ী পিপলস্ পার্টির প্রধান মি. জুলফিকার আলি ভুট্টো প্রথম জাতীয় পরিষদের ৩ মার্চ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশন বয়কট করেন। এর পরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘অনির্দিষ্টকাল’-এর জন্য অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন এবং এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পূর্ব পাকিস্তানে তাৎণিকভাবে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যার ঘটনা ঘটে। মৃতের সংখ্যা কত তা কঠোর সেন্সরশিপের কারণে তাৎণিকভাবে জানা যায় নি, তবে গত শুক্রবারে একটি এজেন্সি-প্রতিবেদন থেকে জানা যায় সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে ২,০০০ লোক মারা যায়।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গতকাল এটাও ঘোষাণা করেছেন যে তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পূর্ব পাকিস্তানে যাচ্ছেন। পদপেটি সাহসী, এমনকি বেপরোয়াও বলা যায় একে। পূর্ব পাকিস্তানে এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার পূর্বসূরী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন ঘটিয়েছিল। এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে যাবার মাধ্যমে নিজের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলছেন। তিনি যদি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতবাদীরা ‘সামান্য কয়েকজন’ তবে শিগগীরই তিনি দেখতে পাবেন যে তার জানার মধ্যে গলদ আছে।

এটা শোনা যায় যে সংকট সৃষ্টি হবার পর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আড়াই ডিভিশন সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করছে। তার পর থেকেই এর সংখ্যা বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১০০০ মাইলেরও বেশি ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন।

এটা শোনা যায় যে সংকট শুরু হবার পর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আড়াই ডিভিশন সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করছে। তার পর থেকেই সৈন্যসমাবেশ ক্রমশ বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১০০০ মাইলের ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পূর্বে দু-জন কাশ্মিরী ভারতীয় এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ছিনতাই করে লাহোরে নিয়ে যাবার পর থেকে ভারতীয় ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে পাকিস্তানী বিমান চলাচলের ওপর ভারত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। পাকিস্তানের বিমানগুলোকে তাই পুরো ভারত-সীমান্ত ঘুরে শিলং-এর পথ ধরে আসতে হয়। ভারতীয় প্রতিরামন্ত্রি জগজীবন রাম বলেছেন পাকিস্তানের সংকট সত্ত্বেও এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। শেখ মুজিবুরের স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তানের পরিকল্পনায় স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনীর কথাও রয়েছে। অবশ্য তার অস্তিত্ব এখনও নেই, আর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কেবল একটি রেজিমেন্টেই পূর্ব পাকিস্তানী সদস্য রয়েছে।

গতকাল লন্ডনে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় শেখ মুজিবুর “এখনও একক পাকিস্তানের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন”, কিন্তু “পুরো জনগোষ্ঠীর চাপ রয়েছে যে তিনি যেন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে ‘জাহান্নামে যাও’ বলে বিদায় করে দেন”। শেখ সবসময় বলে এসেছেন যে পূর্ব পাকিস্তান “পশ্চিম পাকিস্তানের একটি অবহেলিত উপনিবেশ এবং তার স্বায়ত্তশাসন পরিকল্পনা এই শোষণ থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করবে”।

আমাদের প্রতিনিধি মৃতের সংখ্যা ‘প্রায় ২০০’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং জানাচ্ছেন এই সংখ্যাটি প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে কম কারণ সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র বিক্ষুব্ধ জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। শেখ তার জনগণকে শান্ত থাকার আবেদন জানিয়েছেন এবং তার নির্দেশ না-দেওয়া পর্যন্ত তারা যেন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ না-করে ও পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। এই মুহূর্তে বাঙালিরা অবশ্য শেখ যা বলবেন তা যাই হোক না কেন করতে রাজি আছে। কিন্তু তাদের মেজাজ বিগড়েও যেতে পারে যদি তিনি তাদের প্রত্যাশা পূরণ না করেন।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন যে সেনাবাহিনী অস্ত্র ব্যবহার করছে। দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন ‘বাংলার নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে’ নগ্নভাবে সেনাবাহিনীকে ব্যাবহার করা হচ্ছে। বিােভ আরও ছড়িয়ে দেবার জন্য তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের কাছে ‘অবিলম্বে’ পূর্ব পাকিস্তানে সেনাভিযান বন্ধের দাবি জানানোর আবেদন জানিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন যে তারা ‘দখলদার বাহিনীর মতো’ আচরণ করছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ওপরে ‘উৎপীড়ন’ বন্ধ করতে ইয়াহিয়ার ওপরে চাপ প্রয়োগের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি অনুরোধ করেছেন এমন তথ্য ভারতীয় বেতার আকাশবাণীতে প্রচার হবার পর তা অস্বীকার করেছেন।

জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ইয়াহিয়া খান বলেন ডিসেম্বরে পাকিস্তানের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পর ‘আমি জনগণের কাছে মতা হস্তান্তরের জন্য যতগুলো পদপে গ্রহণ করেছি তার প্রতিটি কয়েকজন নেতার জন্য বাধাগ্রস্ত হয়েছে’। তিনি বলেন তিনি অধিবেশন স্থগিত করেছেন পরিস্থিতি শান্ত হবার জন্য, কিন্তু তার এই পদপেকে ‘পুরোপুরিভাবে ভুল বোঝা’ হয়েছে। তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানের গণ্ডগোল থামাবার জন্য তিনি সর্বনিু সংখ্যায় সেনাবাহিনী ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্যে ‘আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ও আল্লাহর ওপরে ভরসা রেখে একটি গণতান্ত্রিক জীবনপদ্ধতির দিকে এগিয়ে যাবার’ আহ্বান জানান।

নির্বাচনের পর থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন ভারতবিভাগের আগে, যখন ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করা হচ্ছিল, তখনই পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়েছিল কিন্তু পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘প্রতারণা’ করা হয়েছে। তিনি বলেন ১৯৪০ সালের মার্চে মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবে ‘স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের’ কথা বলা হয়েছিল যেখানে রাষ্ট্রগুলো হবে ‘স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম’।

জাতীয় পরিষদ বসলে যে নতুন সংবিধান প্রণীত হবার কথা সেখানে শেখ যিনি সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধি কেন্দ্রের হাতে কেবল পররাষ্ট্র ও প্রতিরা রাখতে চান। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে রাজস্ব ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কেন্দ্র কোনো খবরদারি করতে পারবে না। তার মতে এই দুইটি ক্ষেত্রে বিশেষত পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক ‘শোষিত’ হয়ে এসেছে। শেখ ইতোমধ্যে ইয়াহিয়ার সঙ্গে একমত হয়েছেন যে প্রাদেশিক রাজস্বের আনুপাতিক একটি অংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিরা-বাজেটে চলে যাবে। কিন্তু বাঙালিদের প্রবল আপত্তি ঐখানে যে তাদের রাজস্বের ৭০ ভাগই সেনাবাহিনী, পররাষ্ট্র ও মুদ্রাবিনিময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

তারা ক্ষুব্ধ এজন্য যে ৩০০,০০০ সৈন্যের পাকিস্তান বাহিনীকে পোষার জন্য তাদের রাজস্ব ব্যয় করতে হয়। আর সেই সেনাবাহিনীর প্রধান কাজ হলো কাশ্মির ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে সংঘাতে নিয়োজিত থাকা। কিন্তু কাশ্মির বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের মতো সংশ্লিষ্টতা বোধ করে না। উপরন্তু বাংলা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে খুবই আগ্রহী যা ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর থেকে বন্ধ হয়ে আছে। যদিও অনেক ভারতীয় পাকিস্তানের অস্তিত্ব নিয়েই খেদ ব্যক্ত করে থাকে কিন্তু পাকিস্তানকে দু-টি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে তাদের আপত্তি নেই। ভারতের সরকারী পর্যবেণ হলো যদি পাকিস্তানের নতুন জাতীয় পরিষদে মুজিবুর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর পে নেতৃত্ব দেন তবে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে যাবে।

ভারত এটাও বিশ্বাস করে যে পূর্ব পাকিস্তান যদি ভেঙ্গে আসে তবে তার অর্থনৈতিক অবস্থার সম্ভবত আরও অবনমন হবে। সেক্ষেত্রে এখনকার জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যর্থতা চিহ্নিত হতে পারে। স্থানীয় সমাজতন্ত্রীরা এতে অস্থির হয়ে উঠবে এবং একসময় পশ্চিমবঙ্গের শক্তিশালী সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে তারা জোট বাঁধতে চাইবে। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা খুব একটা উজ্জ্বল নয়। একসময়ে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক আয় পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বেশি ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি আর সেরকম নেই। পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্বের চাইতে সফলভাবে শিল্পায়ন ঘটানো হয়েছে। ‘ঔপনিবেশিক শোষণের ত্রে’ পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প প্রায় পুরোপুরি পাটের ওপরে নির্ভরশীল।

পূর্ব পাকিস্তান হলো পৃথিবীর মধ্যে প্রথম এলাকা যেখানে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের বাস্তবতা নির্মম আকারে দেখা দিয়েছে। এখানে প্রতি বর্গমাইলে ১,৩০০ জন মানুষ বাস করে ও প্রতি বছর এর এক-তৃতীয়াংশ ভূ-ভাগ বন্যায় প্লাবিত হয় এবং অধিবাসীদের অন্যত্র বসতি স্থাপনেরও সুযোগ নেই। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন যেমন আছে, এঅবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের এককভাবে এগিয়ে যাবার ক্ষমতা নেই।

পূর্ব পাকিস্তানের নেতা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন

দি টাইমস, ৬ মার্চ, ১৯৭১

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

করাচি। বিক্ষোভে উত্তাল পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে এখন দুটি বিকল্প আছে: তিনি এককভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন অথবা তিনি নিজেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকতে পারেন এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সেখানে যোগ দিতে আহ্বান জানাতে পারেন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জেড. এ. ভুট্টো নিশ্চিতভাবেই তাতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানাবেন কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট প্রদেশগুলোর নেতারা শেখ মুজিবুরের সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য প্রস্তুত থাকবেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ দু-দশক ধরে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় প্রাধান্য বিস্তার করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে তারা বুঝতে পেরেছেন যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পাকিস্তানকে একত্রিত রাখতে চাইলে বাঙালির শাসনকেই মেনে নিতে হবে কারণ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আইনসভায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যেসব শান্তিকামী রয়েছেন, যারা মনে করেন যে ক্ষমতায় বাঙালিদের প্রাপ্য ভাগ দেয়া দরকার, তারা পরাস্ত হয়েছেন। আর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে তিনি হয়তো কট্টর পাঞ্জাবীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে এই ভীতি কাজ করছে যে যদি বাঙালিরা ক্ষমতায় আসে তবে সামরিক বাহিনী কর্তন করে তার আকার ছোট করে ফেলা হবে।

সেনাবাহিনীর হাতে এক যুগ ধরে দমন-পীড়নের শিকার হবার কারণে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে যে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হ্রাস করা হবে। তাই এটা পরিস্কার যে পাঞ্জাবীদের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্টকে প্রভাবিত করেছে সংবিধান রচনার পরিষদকে রদ করার জন্য। বোঝা যাচ্ছে এসপ্তাহের প্রথমার্ধে প্রেসিডেন্টকে বোঝানো হয়েছিল অধিবেশন প্রত্যাহার করে নিলে বাঙালিরা সামরিক শৌর্য্যরে কাছে নতজানু হবে। পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস এম আহসান পরে পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টকে অধিবেশন স্থগিত করার বিপরীতে তার পরামর্শ দেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার মন্ত্রিসভার কট্টরপন্থীদের পরামর্শেই কাজ করেন। বাংলায় পরিস্থিতির অধিক অবনতি এডমিরাল আহসানের অবস্থানকেই সত্য প্রমাণ করেছে এবং প্রেসিডেন্টকে এখন পেছনে ফিরে আসতে হবে এবং অধিবেশনের একটি নতুন তারিখ ঘোষণা করতে হবে।

ইয়াহিয়া খানের প্রশাসনের সামরিক পর্যবেক্ষকরাই স্বীকার করেছেন যে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ঠেকিয়ে রাখা খুব কঠিন হবে এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পূর্ব পাকিস্তানের ৭৫ মিলিয়ন মানুষকে বলপূর্বক দমিয়ে রাখা যাবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক কিছু নির্ভর করছে মি. ভুট্টো কী করার সিদ্ধান্ত নেন তার ওপর। যদি ইয়াহিয়া নতুন অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করেন এবং তাতে ভুট্টো যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান তবে পাকিস্তানে গুরুতর আঞ্চলিক সমস্যার সৃষ্টি হবে। এই সংঘাত হবে পাঞ্জাব প্রদেশের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট প্রদেশ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান ও সিন্ধুর মিলিত জোটের যারা পাঞ্জাবের সম্মতি ছাড়াই সংবিধান প্রণয়ন করতে পারবেন।

কিন্তু চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এটা বের করা কঠিন যে শেখ মুজিবুর রহমান এবং মি. ভুট্টো আইনসভায় তাদের পার্থক্য কীভাবে ঘোচাবেন এবং উভয় পাকিস্তানে গৃহীত একটি সংবিধান কীভাবে প্রণয়ন করবেন। বিশ্বে অর্জিত ইতিবাচক যা ভাবমূর্তি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আছে তাকে সঙ্গী করেও ইয়াহিয়ার পে এরকম কোনো সংবিধান অনুমোদন করা সম্ভব নয় যা ভুট্টোর কাছে, পাঞ্জাবের কাছে ও সেনাবাহিনীর কাছে অগ্রহণযোগ্য। বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারভিত্তিক কোনো সংবিধান অনুমোদন করতে প্রেসিডেন্ট যদি ব্যর্থ হন তবে তবে শেখের পক্ষে ঘোষণা দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না যে পশ্চিমাংশ পুরো পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং প্রদেশ দু-টি চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।

পাকিস্তান ভাঙ্গনের মুখোমুখি

দি টাইমস, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

দিল্লি, ২৭ ফেব্রুয়ারি। পশ্চিম পাকিস্তানের ও পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো প্রথমবারের মতো জনঅংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কট করার ফলে মীমাংসার আর কোনো পথ খোলা রইলো না। সত্যিকারের বিপদ এখন দেখা গিয়েছে। ভুট্টো ও পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান অধিবেশন বসার ১২০ দিনের মধ্যে পরস্পরের কাছে সমর্থনযোগ্য ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মাধ্যমে অনুমোদিত একটি সংবিধান প্রণয়ন করবেন বলে কথা ছিল। তেমনটি ঘটার সম্ভাবনা কমই ছিল, কিন্তু এখন যেটা দাঁড়ালো তাতে, তেমন হবার আশা অপসৃত হলো।

এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে যতক্ষণ না প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুই নেতার মধ্যে অধিবেশন বসার তারিখ ৩ মার্চের মধ্যে মধ্যস্থতা করার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করছেন, পাকিস্তানে একটি ব্যাপক আকারের বিচ্ছিন্নতা-আন্দোলন শুরু হবার হুমকির মুখে পড়ছে। কিন্তু সমঝোতা হবার আর কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিব ও তার আওয়ামী লীগ চাচ্ছে ভুট্টো ও তার পিপলস্ পার্টিকে সহ অথবা ছাড়াই অধিবেশন আহ্বান করতে। ৩১৩টি আসনের মধ্যকার ১৬৭ আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নিজেরাই তাদের প্রস্তাবিত চূড়ান্ত-স্বায়ত্তশাসনের সংবিধান পাশ করাতে সম। তাদের প্রস্তাব অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হবে এবং তার হাতে কেবল তিনটি দায়িত্ব থাকবে: প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা।

অন্যদিকে ভুট্টো কার্যকর কেন্দ্রীয় সরকার চান। বাঙালিরা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে তাদের সাংবিধানিক প্রস্তাবনা পাশ করিয়ে নেয়, তবে সেটা পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি ভুট্টো যদি সংবিধান প্রণয়নে অংশগ্রহণও করেন তারপরও সন্দেহ থেকে যায় যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এমন কোনো সংবিধান অনুমোদন করবেন বা পারবেন যা বাঙালিদের চাপে প্রণীত হয়েছে। অধিবেশন বয়কট সম্পর্কিত ব্যাখ্যা দেবার সময় ভুট্টো এই শংকার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। এসপ্তাহের প্রথম দিকে তিনি পাকিস্তান রেডিওকে বলেছিলেন তিনি সত্যিকার অর্থে সংবিধান প্রণয়ন করতে যাচ্ছেন না … তিনি ঢাকায় যেতে পারেন কেবল এই শর্তে যে বাঙালিরা তাদের চূড়ান্ত স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক ছয় দফার ব্যাপারে আপস করবে।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে পারস্পরিক মিলিত হবার কোনো সম্ভাবনা আর দেখা যাচ্ছে না। শেখ মুজিবুর রহমান বলছেন এবং বলতে থাকবেন যে পাকিস্তানকে যদি একক দেশ হিসেবে টিকিয়ে রাখতে হয় তবে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার ওপরে ভিত্তি করেই সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। তিনি তার ছয়দফা কর্মসূচীর ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। রাজস্ব ও বৈদেশিক বাণিজ্য কি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই থাকবে, না তা প্রাদেশিক সরকারের হাতে যাবে — দুই নেতার মধ্যে সত্যিকারের বিরোধ সেবিষয়েই।

মি. ভুট্টোর জনপ্রিয়তা ভারত-বিরোধী অবস্থানের কারণেই। তিনি চান রাজস্বের ব্যাপারটি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই থাকবে যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি শক্তিশালী প্রতিরা-ব্যবস্থা থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পারেন না তার প্রদেশ কেন ১২০০ মাইল দূরে অবস্থিত কাশ্মিরীদের জন্য প্রতিরা বাজেটের অর্ধেক অংশে অবদান রাখবে। কাশ্মির নিয়ে দিল্লির সঙ্গে পাঞ্জাবের বিরোধের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বন্ধ করে দেবার অধিকার পশ্চিম পাকিস্তানের আছে কিনা সেবিষয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।

এমাসের প্রথম দিকে এক সভায় দু-নেতা জনসম্মুখে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে এই দুই দফায় তাদের মতৈক্য হয় নি এবং ফলে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় তা মি. ভুট্টোকে অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়। মনে করা হচ্ছে শেখ মুজিবুর অবশ্যই নির্ধারিত ৩ মার্চেই অধিবেশন বসতে হবে। যদি সামান্য কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী সংবিধান প্রণয়নে কাজ করেন তবে যেকোনো অর্থেই পূর্ব পাকিস্তানের ইচ্ছা অনুসারেই সংবিধান প্রণীত হবে।

এই পরিস্থিতিতে, এটা আশা করা হচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট সংবিধান অনুমোদন করবেন না এবং হয় শেখ মুজিবুর রহমান অথবা ভুট্টো এককভাবেই স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন।

ঘূর্ণিঝড়-দুর্গতদের এক বছরের সাহায্য প্রয়োজন

দি টাইমস, ২৯ নভেম্বর, ১৯৭০

ম্যক্সওয়েল ব্রেম

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

পাকিস্তানে ঘূর্ণিঝড়ে কি ২০০,০০০ লোক মারা গিয়েছে — যেমন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছেন? অথবা ১০ লাখ — ঘটনাস্থলে উপস্থিতরা যেমন বলছেন? অথবা ২০ লাখ? এসব হল অনুমানের খেলা, যা কোনো কাজে আসে না। বর্তমানে সত্যিকারের প্রশ্ন হলো ত্রাণ বিতরণ এবং বন্যা-উপদ্রুত ব-দ্বীপকে আবার আগের অবস্থায় নিয়ে যাবার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিশ্রম করা যাবে কি না এবং দু’সপ্তাহ আগের দুর্যোগে যারা বেঁচে গিয়েছে তাদের রক্ষা করা যাবে কি না। বেঁচে যাওয়াদের সংখ্যা হবে দুই মিলিয়ন — সংখ্যাটি নির্ভর করছে মৃত্যুর পরিমাণের ওপর। তাদের চোখে এখন অসহায়ত্বের চিহ্ন।

গতকাল বিকেলে আমি হেলিকপ্টার যোগে গত ১২ নভেম্বরের জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত একটি বৃহত্তম দ্বীপ হাতিয়ায় গিয়েছিলাম। বিরাণ সেই ভূখণ্ডে এখনও গবাদিপশু ও মানুষের মৃতদেহের স্তূপ। এখানে সেখানে জীবিতদের দল গাছের নিচে ভিড় করে আছে। তাদের কেউ কেউ ধাবমান জলের দেয়ালের হাত থেকে বাঁচার জন্য গাছে উঠেছিলো। এর ফলে জীবিতদের মধ্যে নারী ও শিশুদের চাইতে শক্ত-সমর্থ পুরুষদের সংখ্যা বেশি।

আমার হেলিকপ্টারটি ছিলো ফরাসী। ওইতে নামের হেলিকপ্টারটি সৌদি আরব থেকে এসেছে। এটি হলো ব্রিটেনসহ আট জাতির সমন্বিত সাহায্যকারী এয়ার-লিফটের একটি, জীবিতদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য যাদের প্রাথমিক পর্যায়ের ত্রাণকার্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। বহির্বিশ্ব থেকে প্রায় প্রতি ঘণ্টায় প্লেন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় খাবার, কাপড়, পানি পরিশোধক যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে আসছে। পাকিস্তানের সৈন্যরা পাহারা দিয়ে চুরির হাত থেকে সেগুলোকে রা করছে। এয়ারপোর্ট থেকে সেগুলোকে সাধারণত হেলিকপ্টারযোগে সামনের সরবরাহ-ডিপোতে নেয়া হচ্ছে এবং এরপর উপকূল ও বন্যায় ভেসে যাওয়া দ্বীপগুলোতে সেগুলোকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

ব্রিটিশ কমান্ডো হেলিকপ্টারগুলো পটুয়াখালী সাপ্লাই কেন্দ্র থেকে প্রায় ৪,৫০০ টন চাল, তেল, ময়দা, বিস্কুট, চিনি, আলু, গুঁড়ো দুধ এবং কাপড়চোপড় নিয়ে উপদ্রুত অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছে। রেডক্রস ও অন্যান্য সংস্থার লোকজনকে সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে। কারণ, দুর্গতদের কাছে রিলিফ একটু দেরিতে হলেও ঠিকঠাকমতো পৌঁছে যাচ্ছে। রিলিফ বিতরণে এখন আর কোনো দেরি হচ্ছে না এবং রিলিফ সরবরাহেও কোনো ঘাটতি নেই।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার সরকারের ‘ভুল ও বিলম্ব’-এর কথা স্বীকার করেছেন এবং আন্তর্জাতিক সাড়াকে অভূতপূর্ব বর্ণনা করেছেন। তিনি অবশ্য বিদেশী সাহায্যের কতদিন পর্যন্ত প্রয়োজন রয়েছে সে-ব্যাপারে নিরব রয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে অন্তঃত এক বছরের জন্য সাহায্য প্রয়োজন হবে, কারণ সর্বগ্রাসী সমুদ্র ব-দ্বীপের কৃষিজ-ভূমিকে ধ্বংস করে ফেলেছে। পাকিস্তান বিশ্বব্যাংকের কাছে ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ডের জরুরি উন্নয়ন প্রস্তাবনা পেশ করেছে। একটি কানাডীয় সংস্থা দ্রুত-জরিপের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারকে ঘূর্ণিঝড়-উপদ্রুত এলাকাকে “স্বাভাবিক” করে তোলার জন্য দু’বছরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার পরামর্শ দিয়েছে। এটা নিশ্চিত যে আরো বেশি কিছু সময়ের প্রয়োজন হবে। একটি ব্যাপার হল, ৩০ মাইলব্যাপী উপদ্রুত-এলাকায় কোনো বাড়িঘরই দাঁড়িয়ে নেই। দ্বিতীয়ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত জমিজমা পূর্বের উৎপাদন-ক্ষমতায় ফিরে যেতে তিন বছর সময় নেবে। ব্যাপক সেচকার্যের প্রয়োজন রয়েছে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা পুনরায় চালু করতে হবে। এবং কৃষিজ ভূমিকে সমুদ্রের হাত থেকে রা করার জন্য নতুন বাঁধ নির্মাণের বিরাট দায়িত্ব সামনে রয়েছে। মাটি দিয়ে তৈরি ১৬ ফুট উঁচু পুরনো বাঁধ ভেসে গেছে। ডাচ-সরকার দ্রুত ও সহজে বাঁধ নির্মাণের পদ্ধতি বের করার জন্য একটি টিম পাঠাচ্ছে।

এই ধ্বংসযজ্ঞ একটি বড়ো রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এটা অস্বীকার করা জরুরি হয়ে পড়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত ও ভারত দ্বারা বিভক্ত কেন্দ্রীয় সরকার পূর্বের ধ্বংসলীলা মোকাবেলায় উদাসীনতা ও অবহেলার পরিচয় দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানীরা বলছে যে, বহির্বিশ্ব থেকে খাদ্য, হেলিকপ্টার ও অর্থ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসার আগেই এসেছে, এবং ৪.৪ মিলিয়ন পাউন্ড ত্রাণের জন্য বরাদ্দ ঘোষণা করতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ১০ দিন সময় লেগেছে। এছাড়া, প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছে যে, মৃতদের সৎকারের জন্য পাকিস্তানী সৈন্যদের পরিবর্তে ব্রিটিশ নাবিকদের ব্যবহার করা হয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ, যে-অংশ পাকিস্তানের ১১০ মিলিয়ন জনগণের মধ্যে পশ্চিমের তুলনায় দরিদ্রতম, এধরনের অভিযোগ এনে পশ্চিম পাকিস্তানের দলগুলোকে বিব্রত করার প্রচারাভিযানে নেমেছে। একটি সাংবিধানিক আইনপরিষদের জন্য পাকিস্তানে এখন থেকে আট দিনের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা। সর্ব-পাকিস্তানী আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা আশি ভাগ ভোট পাবার কথা।

তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে ঘূর্ণিঝড়-দুর্গতদের অবহেলা ও বঞ্চনার জন্য অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শেখ একজন জাতীয়তাবাদী যিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের জন্য স্বায়ত্তশাসন চান। কেন্দ্রীয় সরকারের এই ব্যর্থতা শেখকে অনেকখানি সাহায্য করতে এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করতে বাধ্য।

গতকাল প্রথমবারের মতো ঢাকায় এরকম পোস্টার দেখা গেছে যাতে বলা রয়েছে, ‘সব নির্বাচিত সদস্যকে অবশ্যই রাওয়ালাপিন্ডি (পশ্চিমের রাজধানী) থেকে নয়, ঢাকা থেকে শাসনকার্যের দাবি করতে হবে’। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মনে হয় এই বিরোধিতার মোকাবেলায় নামবেন। তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যদি নবনির্বাচিত আইনপরিষদ এমন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে যা তার ঠিক করে দেয়া মূলনীতর সঙ্গে না মেলে, তবে সামরিক শাসন চলতে থাকবে। মূলনীতিগুলোর একটি হলো পূর্ব পাকিস্তানের শুধু সীমিত স্বায়ত্তশাসন থাকা উচিত।

অনুবাদকের নোট: এই রিপোর্টে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে এতবড়ো একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার কতখানি অবহেলা প্রদর্শন করেছে, যেহেতু দুর্যোগটি পূর্ব পাকিস্তানে।

অনুবাদকের বাছাই: “পূর্ব পাকিস্তানীরা বলছে যে, বহির্বিশ্ব থেকে খাদ্য, হেলিকপ্টার ও অর্থ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসার আগেই এসেছে, এবং ৪.৪ মিলিয়ন পাউন্ড ত্রাণের জন্য বরাদ্দ ঘোষণা করতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ১০ দিন সময় লেগেছে। এছাড়া, প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছে যে, মৃতদের সৎকারের জন্য পাকিস্তানী সৈন্যদের পরিবর্তে ব্রিটিশ নাবিকদের ব্যবহার করা হয়েছে।”

সমস্যাটা কোথায়?

দি ইকোনমিস্ট, ২৮ নভেম্বর, ১৯৭০

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

১২ ও ১৩ নভেম্বরের সাইক্লোন পাকিস্তানের আবহাওয়াবিদদের অসতর্ক রাখেনি। বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ২৫০ মাইল বেগে আঘাত হানার আগের দিন কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকার পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও রাডার স্টেশনগুলো তাদের কাজ করে যাচ্ছিল। আমাদের পাকিস্তান-প্রতিনিধি জানিয়েছেন যে আবহাওয়াবিদরা ১৬ ঘণ্টা পূর্বে ‘হারিকেন ডেঞ্জার’ সতর্কবার্তা এবং তার আট ঘণ্টা পরে ‘হারিকেন গ্রেট ডেঞ্জার’ সতর্কবার্তা ইস্যু করেছিলো। কেউ সেটা শোনেনি কেন? আংশিকভাবে এটা হল সেই বালকের গল্প যে নেকড়ে এসেছে বলে চিৎকার করতো। তিন সপ্তাহ আগে ২৩ অক্টোবরে একই অঞ্চলে কম ক্ষমতাম্পন্ন আরেকটা সাইক্লোন আঘাত করেছিলো। সেসময় রেডিও সম্প্রচার বন্ধ রেখে বারবার সাইক্লোনের পূর্বাভাস জানানো হয়েছিলো এবং উপকূলবর্তী লোকজনকে উঁচু স্থানের সরে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। সেবার সাইক্লোন সীমিত কিছু অঞ্চলে আঘাত হেনেছিলো এবং মাত্র ৩০০ জন মারা গিয়েছিলো। মৃতের হার পূর্ববর্তী বিপর্যয়ের তুলনায় কমই ছিলো। কিন্তু ১২ নভেম্বরে সতর্কবার্তা প্রচার করা সত্ত্বেও গতবার যারা বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিলো তারা আবার বাড়ি ছেড়ে যেতে চায়নি।

কিন্তু অফিসিয়াল অসতর্ককতা ও অবহেলাও ছিলো। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ২৫০ মাইল বেগে ঘুর্ণিঝড় ধেয়ে আসার চিত্র পাবার পরে দু’ভাবে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছিলো: সমুদ্রজাহাজের জন্য চালনা সমুদ্রবন্দরে সর্বোচ্চ ১০ নম্বর মহাবিপদসংকেত ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে সর্বোচ্চ ৯ নম্বর মহাবিপদসংকেত এবং জনগণের জন্য একটি বর্ণনা পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু উপকূল থেকে দূরবর্তী দ্বীপসমূহের কাছে সাইক্লোন চলে আসার পর বিপদসংকেত প্রত্যাহার করে নেয়া হয় এই ভেবে যে, জাহাজসমূহ ইতোমধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে গেছে। সতর্কবার্তা সাধারণ আবহাওয়া-প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছিল এবং অনুষ্ঠানসমূহ যথারীতি প্রচার হচ্ছিল। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের অনেকেই বিষয়টিকে ততটা ভয়াবহ ভাবেনি।

সাইক্লোনের এমন গতি আগে দেখ যায়নি; দিক পরিবর্তন করে এবং শক্তি সঞ্চয় করে এটি পূর্ববঙ্গের উপকূলে ২৪ ঘণ্টা আগে আঘাত হানে। কিন্তু এই অপ্রত্যাশিত আঘাতের পরেও সাইক্লোনের সঙ্গে ধেয়ে আসা জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা এবং গভীরতা পরিমাপের ব্যর্থতার কোনো ব্যাখ্যা আবহাওয়াবিদরা দেননি। চট্টগ্রামের ভূ-কম্পন-পরিমাপ স্টেশন জলোচ্ছ্বাসের উপরিভাগের রেকর্ড পরিমাপ করতে সমর্থ হয়েছিলো।

পাকিস্তানের একটি হিসেব মতে, যদি জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস দেয়া হতো তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অন্তঃত অর্ধেক কম হতো। জলোচ্ছ্বাসের আঘাতের বারো ঘণ্টা পরে যখন অনেক লোক ইতোমধ্যে মারা গিয়েছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের আবহাওয়া-বিশারদরা প্লাবিত দ্বীপ হাতিয়া থেকে দুর্যোগের ওয়ারলেস-বর্ণনা বন্ধ করে দেন ‘ফেব্রিকেশন’ হিসেবে। তারা ভুল ধারণা নিয়ে ছিরলন যে, স্বল্প উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস রাত্রি শেষে দেখা যাবে। কিন্তু সত্য হলো পূর্ণিমার কারণে বঙ্গোপসাগরে উঁচু ঢেউয়ের জলোচ্ছ্বাস হয়েছিলো।

এখন সবাই অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে — আবহাওয়াবিদরা প্রাদেশিক সরকারকে, সরকার স্থানীয় এজেন্সিকে এবং স্থানীয় এজেন্সি আবহাওয়া অফিসকে। দায়িত্বে অবহেলা করা সেসব লোকদের কেউ কেউ তাদের দোষ এভাবে ঢাকছিলো যে, সাইক্লোন আঘাত করার আগের ঘণ্টায় তারা অনুপস্থিত থাকার কারণ, সারাদিন রোজা রেখে তারা ইফতারি করতে গিয়েছিলো। সাইক্লোন আঘাতের ২৪ ঘণ্টা পরেই কেবল দুর্যোগের প্রকৃত মাত্রা বোঝা গিয়েছিলো। শনিবার সকালে ঢাকার একটি পত্রিকা লিখল ‘শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়’। ১৪ তারিখেই মৃতের সংখ্যা অনুমানভিত্তিতে বলা হয়েছে ২০০,০০০। কিন্তু মৃতের সংখ্যা সঠিকভাবে ও যাচাই করে ঘোষণা দিতে অনেক সময় লেগেছে। ১৩ তারিখে সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা বলা হযেছে ৫০ হাজার। তখন থেকে এখন পর্যন্ত সরকারি হিসেব দ্রুত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৫,০০০-এ। সরকারি হিসেবে ক্রমে সত্যের ছোঁয়া লাগায় পশ্চিম পাকিস্তান এবং সারা বিশ্ব ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো কী ধরনের ধ্বংসলীলা চলেছে।

ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রাথমিক সাহয্য ছিলো মাত্র ৩০,০০০ পাউণ্ড। এই পরিমাণ পরে বেড়ে দাঁড়ায় এক মিলিয়ন পাউণ্ডে। একটি প্রকাশিত আবেদনপত্রে আরো এক মিলিয়ন পাউণ্ডের আশা করা হয়েছে যা ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ত্রাণ-উদ্যোগ। লীগ অফ রেডক্রস সোসাইটি এবং জাতিসংঘের কাছে সাহায্যের জন্য পাকিস্তানের আবেদনের পর ভালো সাড়া পাওয়া গিয়েছে — বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের কাছ থেকে। প্রথম সমস্যা ছিলো পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত সাহায্য পাঠানো। সাহায্যের পরিমাণ ভালোই ছিলো; এবং তার বিরাট অংশ ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পৌঁছেছে। কিন্তু আংশিকভাবে সেখানে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছতে অনেক সময় লেগে যায় — ঢাকা এয়ারপোর্টে অবতরণ করতে দেরি হবার কারণে। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ প্রথমে বাণিজ্যিক ফ্লাইটগুলো বাতিল করতে রাজি হয়নি।

জীবিত সব দুর্গতদের জন্য এখন যথেষ্ট পরিমাণ খাবার, কাপড় ও পরিচর্যার সংস্থান ঢাকায় প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু তার খুব সামান্যই গত সপ্তাহের শেষে রেডক্রসের মাধ্যমে দুর্গতদের পৌঁছেছে। ত্রাণসামগ্রী বহনকারী সব প্লেন দ্রুত এয়ারপোর্টে নামতে সরকারকে রাজি করাতে বেশ সময় লেগে যায়। উপদ্রুত ব-দ্বীপে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ একটি বিরাট মাথাব্যথার বিষয়। ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া হাতেগোনা কয়েকটি রাস্তায় এখন নরম পলি জমে আছে এবং জলপথে চলাচলকারী প্রায় সব নৌকাই ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন খুব প্রয়োজন হেলিকপ্টারের এবং ইঞ্জিল-চালিত নৌকার। কিন্তু পাকিস্তান আর্মি বা এয়ারফোর্সের কাছে তা যথেষ্ট আছে বলে মনে হচ্ছে না।

একটি সামরিক সরকারের জন্য এ-ধরনের মহাদুর্যোগে কিছু সুবিধা থাকার কথা। তাদের প্রশিতি যথেষ্ট লোক থাকার কথা এবং তাদের দ্রুতগতির যানবাহন থাকার কথা। কিন্তু সারা সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানের পাঁচটি ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন শুধু আংশিকভাবে সক্রিয় হয়েছে। যখন নভেম্বরের ১৬ তারিখে সামরিক বাহিনী ত্রাণকার্যের আদেশ পেল, ৫,০০০ লোক জীবিতদের কলেরা এবং টাইফয়েডের প্রতিষেধক দেয়া, মৃতদের কবর দেয়া এবং রাস্তাঘাট পুননির্মাণে নিজেদের নিয়োজিত রাখলো। কিন্তু পাকিস্তান-সেনাবাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসন এবং রেডক্রসের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ছিল। কিছু ব্রিটিশ উদ্ধার-বিমান ঢাকায় কিছু অলস সময় কাটালো, রেডক্রস না সেনাবাহিনী তাদের পরিচালনা করবে এ-বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হবার কারণে। এ-সপ্তাহের মঙ্গলবার আর্মিকে একটা বড় মতা দেয়া হলো, রিলিফ কমিশনার হিসেবে একজন বেসামরিক লোককে সরিয়ে একজন সেনাবাহিনীর লোককে সেখানে বসানো হয়েছে। এবার কিছু কাজ হওয়া উচিত।

অনেক লোককে অবাক করেছে যে বিষয়টি, সেটা হল, পাকিস্তান এয়ার-ফোর্সের ২৫টি হেলিকপ্টার থাকা সত্ত্বেও শুধু একটিকে দুর্গতদের ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেবার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এটা ঠিক যে হেলিকপ্টারগুলোর বেশিরভাগই বেশি ওজন নিতে পারে না। কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করলে খুবই কাজে দিত। পূর্ব পাকিস্তানের রিলিফ কমিশনার জানিয়েছেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হেলিকপ্টার আনতে গেলে ভারত তাদের দেশের ওপর দিয়ে উড়ে আসতে সেগুলোকে অনুমতি দিত না। পাকিস্তান-বিমানবাহিনীর বেশিরভাগ স্টেশন পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত। ভারত বলেছে তাদের অনুমতির জন্য কখনোই জিজ্ঞেস করা হয়নি। মূল ব্যাপার হল, যেহেতু পাকিস্তানের হেলিকপ্টারগুলো সামরিক হেলিকপ্টার এবং সেগুলো আসার পথে ভারতে অবতরণ করতে হতো, তাই পাকিস্তান কর্তৃপ সেগুলোকে ত্রাণের কাজে ব্যবহার করতে দিতে চায়নি। এখন ব্রিটিশ হেলিকপ্টার এবং এসল্ট-নৌকাগুলো বঙ্গোপসাগরের জাহাজ থেকে পরিচালিত হচ্ছে, এবং আমেরিকান হেলিকপ্টারগুলো আসতে শুরু করেছে। এবারে হয়তো রিলিফ বিতরণের কাজটি ঠিকঠাকমতো এগুবে। আশার কথা এই যে, বেঁচে যাওয়া হতভাগ্যদের অনেকেই তাদের কাছে রিলিফ পৌঁছার আগে ক্ষুধা, রোগ ও ঠাণ্ডায় মারা যায়নি।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বুধবার দু’দিনের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন ব-দ্বীপ অঞ্চলে হেলিকপ্টার-ট্যুর দেবার উদ্দেশ্যে, দু’সপ্তাহ পরের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে। রাওলাপিন্ডির সরকার এটাকেই ভেবেছেন পূর্ববঙ্গের জন্য যথেষ্ট করা হচ্ছে। সাইকোনের পূর্বে অধিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচনী ইস্যু। এখন পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে ত্রাণ-বিতরণে এবং ‘মানবেতিহাসে বৃহত্তম প্রাকৃতিক-দুর্যোগ মোকাবেলায়’ ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছে। এগারোটি দল নির্বাচন বাতিল করার দাবি জানিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সম্ভাব্য বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনের সময় নিয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করেনি। কিন্তু পিকিংপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি তাদের প্রার্থীদের নাম প্রত্যাহারের জন্য বলেছে। নির্বাচন-স্থগিত-হবার-ঘোষণা কিছু দলের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ, তদের অনেকে খেলাপি হবার জোর সম্ভাবনা আছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে কেউই খুব পরিষ্কারভাবে কিছু ভাবছে না।

খাদ্য, বন্যা এবং দুর্ভিক্ষের দেশ

দি গার্ডিয়ান, ১৬ নভেম্বর, ১৯৭০

কলিম সিদ্দিকী

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

বঙ্গোপসাগরের দিকে ধাবমান নদী গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র সৃষ্ট ব-দ্বীপে ছোট ছোট দ্বীপ ও অসংখ্য খালবিল নিয়ে কলকাতার পূর্ব দিকে দেশটি অবস্থিত। এই নদীমাতৃক দৃশ্যপটে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ তিনটি জিনিস নিয়ে বেঁচে থাকে — বন্যা, খাদ্য ও দুর্ভিক্ষ — তিনটিই সমানভাবে বিখ্যাত। দেশটির বেশিরভাগ অংশ সমতল ও নিচু যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১.৫ থেকে ২.০ ফুট উঁচু।

সমুদ্র সাধারণত গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র থেকে জল গ্রহণ করে। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ সে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, বদ্বীপের উপরিতলটি ভাসিয়ে নেয়। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা হয় ২০ ফুটের মতো, কখনো কখনো এমনকি ৫০ ফুটের মতো। একেকটি জলোচ্ছ্বাস এসে, বিগত জলোচ্ছ্বাসের পর মানুষ যা বিনির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিল, তার সবকিছু ধ্বংস করে ফেলে।

প্রকাশিত

বদ্বীপ অংশটি পূর্ব পাকিস্তানের ৭০ মিলিয়ন লোকের শতকরা ৮০ ভাগ ধারণ করে যেটি হল বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল — প্রতি বর্গমাইলে এখানে ১২০০ লোক বাস করে। বঙ্গোপসাগরের দয়ায় মাত্র তিন থেকে পাঁচ মিলিয়ন লোক এর করাল থাবায় সরাসরি আক্রান্ত হয়। কিন্তু এই জনগোষ্ঠী পৃথিবীর সবচাইতে দরিদ্রদের একটি যেখানে মাথাপিছু আয় মাত্র ২০০ রুপি। (পাকিস্তানের গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ৪১৮ রুপি বা প্রায় ৩০ পাউন্ড যদি সেখানে তুলনামূলকভাবে ধনী পশ্চিম পাকিস্তানকে যোগ করা হয়।)

উদ্ধারকারীরা এবং সরকার সাধারণত এত দেরিতে উপদ্রুত অঞ্চলে পৌঁছে যে জনগণের জন্য তাদের আর তেমন কিছু করার থাকে না। তারা উপদ্রুত এলাকার সমস্যাগুলোকে সমাধান-অযোগ্য মনে করেন, পূর্বের অভিজ্ঞতা মনে করে কাঁধ ঝাঁকান এবং ঢাকা বা ইসলামাবাদে ফিরে যান। আরেকটা জলোচ্ছ্বাস না আসা পর্যন্ত তাদের আর দেখা পাওয়া যায় না। এরপর ফ্যাশন্যাবল একটি সংবাদ শোনা যায় — ‘সাইক্লোনের কারণে সব যোগাযোগ-ব্যবস্থা বিঘ্নিত।’ তারা বড়োজোর এরকম কিছু করতে পারেন যে, হেলিকপ্টার ও বিমানে করে তারা উড়তে থাকবেন, নিচের ধ্বংসলীলা দেখবেন এবং সম্ভবত যেখানে জনমানুষের অস্তিত্ব দেখতে পাবেন সেখানে খাদ্য ফেলবেন। সত্যি কথা হল, এ-অঞ্চলে আধুনিক কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থাই নেই যা বিঘ্নিত হতে পারে। সবচেয়ে ভালো অবস্থায় এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যেতে পরের নৌকাটি পেতে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়।

কর্তৃত্ব

ভূগোল অবশ্য এলাকাটির একমাত্র সমস্যা নয়। ইতিহাস জুড়ে বাংলা হল ভারতীয় মূল ভূখণ্ডে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের সীমান্তভূমি। বাংলা সবসময় দূরবর্তী শাসনকর্তা দ্বারা শাসিত হয়েছে, এবং মজার ব্যাপার হল ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পরে শাসনকর্তারা ইতিহাসের সবচেয়ে দূরবর্তী শাসনকর্তায় পরিগণিত হন।

কিছু পরস্পরবিরোধিতা পরীক্ষা করা যাক। ব্রিটিশরা পাটশিল্প প্রবর্তন করেছিল, কিন্তু দেশবিভাগের কারণে সে মিলগুলো কলকাতায় থেকে গেল। পূর্ব পাকিস্তানে অনেক নতুন জুটমিল স্থাপন করা হয়, কিন্তু সরকার প্রবর্তিত কৃষিজ-পণ্যের মূল্য-নির্ধারণী-নীতি ঢাকা ও চট্টগ্রামের উদ্যোক্তাদের হাতে চাষীদের শোষিত হবার প্রক্রিয়াটি বন্ধ করার ব্যাপারে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের অপেক্ষাকৃত উন্নত নগর অঞ্চলের শিল্পায়ন উন্নয়নের কাজ হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের পাটনির্ভর অর্থনীতির উদ্বৃত্ত ব্যবহার করে। পূর্ব থেকে পশ্চিমে সম্পদ স্থানান্তরের বার্ষিক পরিমাণ ২৫০ মিলিয়ন রুপি। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে, বিশেষত ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরাচার চালু হবার পর থেকে এ-অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান ক্ষতির পরিমাণ বিশাল।

এই সম্পদের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা-নিয়ন্ত্রণের খরচে কম বরাদ্দ হয়। কয়েক বছর থেকে এ-সমস্যা নিয়ে গবেষণারত বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে ২০টি বহুমুখী প্রকল্প এই সমস্যার বৃহত্তর সমাধান দিতে পারে যার আনুমানিক খরচ হবে ৮০০ মিলিয়ন ডলার।

অর্জন

বিদেশী গাড়ি (প্রধানত জাপানি এবং জার্মানি), রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডশনার, এবং অন্যান্য ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে পাকিস্তান যা খরচ করে, তার তুলনায় এই খরচ একটি নতুন পরিপ্রেক্ষিতের জন্ম দেয়। পাকিস্তান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রায় ২০% সুদে ব্যয় করে ৫ বিলিয়ন ডলারের অধিক বিদেশী ঋণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। যেকোনোভাবেই কোনো দৃঢ়চেতা সরকার অভ্যন্তরীণ মুদ্রা-সম্পদের সমস্যায় পড়তে পারে না। এসব কারণে বিশ্বব্যাংক প্রস্তাবিত বাঁধ বা খাল নির্মাণকর্ম নাও করা যেতে পারে, যদিও কোনো বৈদেশিক সাহায্য ছাড়াই একটি বাঁধ-ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। এটা ইচ্ছার ব্যর্থতা, অর্থের নয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক প্রয়োজনীয় ৮০০ মিলিয়ন ডলার দেবে না; কারণ মৃত্যু ও ধ্বংসের এই মাত্রা একটি রাজনৈতিক ইস্যু নয়। সিন্ধুর পানি নিয়ে ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা নিয়ে বিশ্বব্যাংক এবং পশ্চিমা শক্তিগুলো অবশ্য ‘শান্তিরক্ষায় এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ’ করেছিল।

তবে এখন কিছু নিদর্শন দেখা যাচ্ছে, যাতে বোঝা যাচ্ছে যে, বর্তমান সরকার সমস্যাগুলোকে একটু গুরুত্বসহকারে দেখছে। প্রত্যেক বক্তৃতায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান বন্যা-নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি একমাত্র যে পদেক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছেন তা হলো: ‘আমার নির্দেশনা অনুযায়ী পরিকল্পনা কমিশন এই কর্মসূচীতে আর্থিকভাবে সাহায্য করার জন্য বন্ধুভাবাপন্ন সব দেশ থেকে সহায়তা সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে। আমি নিশ্চিত যে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য জরুরি এই সমস্যা সমাধানের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবে।’

আমন্ত্রণ

কিন্তু প্রেসিডেন্ট সমস্যার ভয়াবহতাকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে ভাবেননি। সমস্যা সমাধানে অভ্যন্তরীণ সম্পদের ব্যবহার এবং অন্তঃত বিষয়টিকে কম ধ্বংসাত্মক হবার ব্যবস্থা করা সরকারের এজেন্ডার মধ্যে আসেনি। ইয়াহিয়া খান বলেন: ‘এই উপলক্ষে আমাদের বিশেষ একটি তহবিল গঠনের ইচ্ছা আছে, বন্ধুভাবাপন্ন দেশসমূহকে এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাসমূহকে সাহায্য প্রদান করার আহ্বান জানানো হবে এবং যাতে পাকিস্তান নিজেই যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ প্রদান করবে।’

বিশ্বসংস্থা ও দেশসমূহ ইয়াহিয়া খানের আবেদনে সাড়া দিবে কি না তা এখন দেখার বিষয়। কিন্তু পাকিস্তানের জন্য তার চাইতে বড় আকাঙ্ক্ষার বিষয়, বেসামরিক ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া — এ-মুহূর্তে সমুদ্রের জলে ভেসে গেছে।