Tag Archives: ইয়াহিয়া

ভারতীয় উপমহাদেশে যুদ্ধের ছায়া

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট

দি টাইমস, ১৩ জুলাই, ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এখন পর্যন্ত মুখ না খুললেও মিসেস গান্ধীর সরকারে থাকা এবং সরকারের বাইরে থাকা অনেক ভারতীয়ই মনে করে সামরিক অভিযানের মাধ্যমেই কেবল উদ্বাস্তু-সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। আর এজন্য যুদ্ধের পক্ষে এবং বিপক্ষে ভারতবাসীদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। যুদ্ধবাদীরা মনে করেন ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরিণতির একটি আংশিক ফলাফল হিসেবে ছয় মিলিয়ন উদ্বাস্তুর দায়ভার ভারতকে বহন করতে হচ্ছে। আর শান্তিবাদীরা মনে করেন যুদ্ধের মূল্য কেবল অর্থনৈতিক লাভালাভ দিয়ে যাচাই করা যাবে না; ভারত আক্রমণ করলে চীন পাকিস্তানের পক্ষে এসে দাঁড়াবে। যুদ্ধবাদীরা মনে করছেন বর্তমান পরিস্থিতি পিকিং ভারতীয় সীমানায় অনুপ্রবেশ করার নাটকীয় সিদ্ধান্ত নেবে না। আর যেকোনো সংঘাতে নিজের শক্তি অবহিত করার ঝুঁকি নিতেই হয়।

এই অনিশ্চিত পরিস্থিতি ভারতের নিরাপত্তা অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ ইনস্টিটিউট যুদ্ধের খরচ ও উপযোগিতা, এই অঞ্চলে সামরিক ক্ষমতার ভারসাম্য ও ভারতের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য বিষয়ক একটি সমন্বিত দলিল তৈরী করেছে। দলিলটি একটি আশংকাজনক উপসংহারে পৌঁছেছে যে যুদ্ধ ছাড়া ভারতের আর কোনো বিকল্প নেই। ইনস্টিটিউটের পরিচালক মি. সুব্রামনিয়াম কর্তৃক প্রস্তুতকৃত দলিলটি সিনিয়র সম্পাদক, কর্মকর্তা ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদের সামনে একটি রুদ্ধদ্বার সেমিনারে দলিলটি উপস্থাপিত হয়। দলিলে বলা হয়েছে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ভারত পূর্ব পাকিস্তানের কিছু অংশ দখল করে নেবে যাতে ঐ অংশে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করা যায়। একইসঙ্গে বলা হয়েছে যদি পূর্ব পাকিস্তানের কিছু অংশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা যায় তবে বাংলাদেশের প্রাদেশিক সরকারকে সব ধরনের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা নিয়ে সেখানে স্থাপন করা যাবে।

“এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে নিরাপত্তা পরিষদ দু-দেশকেই যুদ্ধ শেষ করার জন্য আহ্বান জানাতে সভায় বসবে। যুদ্ধ দ্রুত শেষ হবে না বেশ খানিকটা সময় জুড়ে চলতে থাকবে, এটাই হলো ভারতের বিবেচনার বিষয়। এই পর্যায়ে ভারতের উদ্যোগ হবে বাংলাদেশকে বিতর্কের অন্যতম একটি পক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। সত্যি অর্থে, এটাই হলো বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবার ক্ষেত্রে সঠিক পন্থা। এটা পরিস্কার করতে হবে যে বাংলা অঞ্চলে যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্বাক্ষর হবে না, যতক্ষণ না বাংলাদেশের কমান্ডারকে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর করার জন্য একজন স্বাধীন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে। আর বাংলাদেশ সরকারকে এই বিতর্কে একটি স্বীকৃত পক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।”

মি. সুব্রামনিয়ামের উপসংহারের সঙ্গে কেউ সম্মত নাও হতে পারেন। কিন্তু এই দলিলটি ভারতব্যাপী যে অধৈর্যের মনোভাবই পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা নির্দেশ করছে। আর ভারতের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পরিমণ্ডলে যুদ্ধের ব্যাপারটি যে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে, তাও দলিলটি নির্দেশ করছে। উপসংহারে পৌঁছার পূর্বে মি. সুব্রামনিয়াম একটি সশস্ত্র সংঘাতের সব দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন: যুদ্ধের খরচাপাতি, যুদ্ধের বিকল্পসমূহ, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সক্ষমতা, ভারতের পক্ষের ও বিপক্ষের ফ্যাক্টরসমূহ এবং চীনের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা, এসবকিছুই দলিলে বলা হয়েছে।

‘বাংলাদেশ এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা — ভারতের করণীয়’ শীর্ষক দীর্ঘ দলিলে বলা হয়েছে প্রথমবারের মতো জঙ্গি তৎপরতায় যাওয়ার চেয়ে (যা পুরোমাত্রায় যুদ্ধের জন্ম দেবে) ছয় মিলিয়ন উদ্বাস্তুকে আন্তর্জাতিক আর্থিক সাহায্যের আওতায় আনাটা ভালো হবে, এরকম ধারণার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। “উদ্বাস্তুদের সাহায্য করাই কি সমস্যার একমাত্র দিক?” এটা স্পষ্ট যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে তার উপনিবেশ-সদৃশ শাসন চালিয়ে যাবে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধ চলতেই থাকবে। “আর এখানে এই প্রশ্নটার মুখোমুখি ভারতকে হতে হবে যে এসবে অংশ নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় আছে কিনা। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য বাংলার লোকজনের সহানুভূতি পুরোপুরিই আছে। এর ফলে, বাংলার লোকজনকে রক্ষার জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দেবার জন্য ও নানাভাবে সাহায্য করার জন্য ভারতকে বড়ো সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। যদি বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ আন্দোলন চলতে থাকে এবং নেতৃত্ব আরও অধিক বাম-ঘেঁষা হয়ে থাকে তবে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।”

দলিলটিতে এরকম বলা হয়েছে যে, এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রতিরোধকারীদের খুঁজতে নিঃসন্দেহে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত আসবে এবং তখন তাদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ভারতের জন্য কোনো কিছু হতে পারে না। “অপেক্ষা করা ও দেখার নীতি অনুসরণ করলে বাংলাদেশ সীমান্তে সবসময় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হবে এবং যেকোনো সময় পুরোমাত্রায় যুদ্ধের সম্ভাবনা সেখানে থাকবে। বাংলাদেশ বরাবর যেকোনো সময় আমাদের বিশাল বাহিনী নিয়োগ করতে হতে পারে এবং এধরনের নিয়োগের কারণে বাড়তি খরচ গুনতে হবে। বাংলাদেশে পাকিস্তান চার থেকে পাঁচ ডিভিশন সৈন্য স্থায়ীভাবে রাখবে বলে মনে হচ্ছে এবং সেখানে এই প্রক্রিয়া তারা শুরুও করেছে।”

মি. সুব্রামনিয়াম দাবি করেছেন যে যদি উদ্বাস্তুদের ব্যয়ভার বহন করার ব্যাপারটি বৈদেশিক শক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, এরপরও ভারত ব্যাপক নিরাপত্তা-হুমকির মুখোমুখি হবে। দেশের ভেতরে পূর্ব বাঙালিদের জন্য একধরনের প্রতিশ্র“তি-ভাবনা গড়ে তোলার জন্য তিনি সরকারকারকে সর্বপ্রথমে সুপারিশ করেছেন। “এই প্রতিশ্র“তিগুলো দেশের ভেতরে সরকারের প্রতি আস্থা তৈরি করবে এবং দেশের বাইরেও এইসব যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরী হবে তা দূর করবে।” সামনের বছরে অনেকগুলো বড়ো রাজ্যে যে-নির্বাচন হবে, তাতে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস পার্টি যাতে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন না হয়, সেজন্যই এই সুপারিশ করা হয়েছে বলে অনুমান করা যায়।

তিনি আরও বলেছেন যে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের ব্যাপক সমাগম এই স্পর্শকাতর ও বিক্ষুব্ধ রাজ্যটিতে উদ্বেগ তৈরী করবে। দলিলটিতে পূর্ব বাংলার বিপজ্জনক পরিস্থিতির বর্ণনা রয়েছে এবং উদ্বাস্তুদের কেন্দ্র ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লেগে যাবার সম্ভাবনা আছে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি আরও দাবি করেছেন যদি বর্তমান পরিস্থিতির কোনো সমাধান না হয় তবে ভারত ও পাকিস্তানকে, ইতোমধ্যেই মাত্রাতিরিক্ত, প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াতে হবে। “যদি বাংলাদেশের অভ্যুদয় না হয় এবং পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা চালিয়ে যায় তবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উদ্বেগ বাড়তেই থাকবে এবং স্থায়ী হয়ে যাবে। আর এটাই দু-দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা-বাজেটকে বাড়িয়ে তুলবে। বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে কোনো প্রকারে নিয়ন্ত্রণ আনা গেলে, পাকিস্তান কাশ্মিরেও সমস্যা সৃষ্টি করা থেকে বিরত হতে পারে।”

বিশ্বশক্তি ইয়াহিয়া খানকে একটি কার্যকর রাজনৈতিক সমাধান করতে বাধ্য করতে সক্ষম হবে অথবা মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করে ফেলবে এরকম অবাস্তব কল্পনায় না থেকে সুব্রামনিয়াম বলেছেন যে, “এইসব অলীক আশা এখন সুদূরপরাহত।” এটা নিশ্চিত যে পাকিস্তানি অর্থনীতি বাংলাদেশ-অভিযানের খরচ এবং নতুন দুই ডিভিশন সৈন্য বাড়ানোর খরচ অনুমোদন করেছে। পাকিস্তানি শাসকরা পশ্চিম পাকিস্তানে ধীরগতির উন্নয়নের বিনিময়ে হলেও বাংলাদেশের ওপর ঔপনিবেশিক শাসনকে বেছে নিয়েছে। পশ্চিমা শক্তি পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদান বন্ধ রাখার ব্যাপারে যে-প্রতিশ্র“তি ব্যক্ত করেছিল তা পালন করে নি। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও ভারতের উদ্বাস্তু-সমস্যা হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত না হচ্ছে বিশ্বঅর্থনীতির পরিস্থিতি এরকম না যে, এপর্যন্ত তারা যা করেছে তার বেশি কিছু করবে।

“সমস্যাটির আন্তর্জাতিক একটি চেহারা না-থাকার কারণে বিশ্বশক্তি এখানে কিছু করার ক্ষেত্রে ভারতকে সহায়তা করার চাইতে, নিজেদের বাধাগ্রস্ত মনে করছে। এই বাধা ভারতের পক্ষ থেকেই এসেছে, কারণ বৈদেশিক শক্তি কী করতে পারে সেব্যাপারে ভারত সীমারেখা আরোপ করেছে। এখন ভারতের পক্ষ থেকে এটা ভাবা অবাস্তব হবে যে, বৈদেশিক শক্তি ব্যাপারটিকে আন্তর্জাতিক একটি সমস্যা বলে বিবেচনা করবে। ভারতই সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিক চেহারা নিতে দেয় নি। ফলে, আন্তর্জাতিক চাপে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমন কোনো সুযোগ আর নেই। যারা যুদ্ধের পক্ষপাতী নন তারা এই ব্যাপারগুলো মাথায় রাখেন নি।”

দলিলটি সামরিক শক্তির ভারসাম্য নিয়েও কথা বলেছে। সেখানে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের শহরগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং সেখানে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ভারতীয় বাহিনীর শক্তিমত্তাকে খর্ব করার ক্ষমতা নিয়েও আলোকপাত করা হয়েছে। “পাকিস্তানের মতো দেশের কোনো এয়ারক্র্যাফট-শিল্প নেই, এবং নিজেদের বিমানশক্তিকে রক্ষণাবেক্ষণ করার মতো খুব সামান্যই উপায় তাদের হাতে আছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীকে নিরস্ত্র করার মতো সত্যিকারের ক্ষমতা তাদের নেই। ইসলামাবাদের কয়েকজন বেপরোয়া লোকের পুরো অযৌক্তিক তৎপরতার জবাব দেবার জন্য এটা বলা হচ্ছে না, কিন্তু এধরনের উদ্যোগের প্রভাবের কোনো তাৎপর্য নেই বলে মনে হচ্ছে। পাকিস্তানী নৌবাহিনীর উদ্যোগের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। তাদের মহাসাগরগামী তিনটি সাবমেরিন রয়েছে এবং আরও একটি কয়েকদিনের মধ্যে তাদের সঙ্গে যোগ দেবে বলে জানা গিয়েছে। এছাড়া মনে করা হয় যে, তাদের এক ডজনেরও বেশি, পানির নিচে চলতে পারে এমন, এয়ারক্র্যাফট রয়েছে যা উপকূলীয় খনি-অনুসন্ধান, স্যাবোটাজ করতে এবং যাতে টর্পেডো ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং যেগুলোর টর্পেডো নিক্ষেপের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এই নৌশক্তিগুলোর ক্ষমতা খুবই সীমিত এবং পাকিস্তানের আশেপাশেই এগুলোকে নিয়োজিত রাখতে হবে। নৌ-আক্রমণ থেকে পাকিস্তান কিছু করতে পারবে কিনা এবিষয়ে সন্দেহ আছে। তেলসহ ভারতের বৈদেশিক পণ্যের বেশিরভাগ আসে সমুদ্রপথে। কিন্তু ভারত যেমন পাকিস্তানের পণ্য পরিবহণে ভৌগোলিক কারণে বাধা প্রদান করতে পারবে, পাকিস্তানের সেই সুবিধা নেই। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের শত্র“তা পূর্ব পাকিস্তানে আরও অতিরিক্ত সৈন্য সরবরাহ বন্ধ করতে পারবে এবং সেখানে ইতোমধ্যে নিয়োজিত সৈন্যদের আটকে ফেলা যাবে।”

মি. সুব্রামনিয়াম পাকিস্তানের সঙ্গে আরেকটি সংঘাতের মুহূর্তে তাকে সামরিক সমর্থন কারা দেবে তা নিয়েও আলোকপাত করেছেন। “ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতার পর যুক্তরাষ্ট্র এখানে আবার হস্তক্ষেপ করবে বলে মনে হয় না। সোভিয়েত ইউনিয়নও সেরকম কিছু করতে যাবে না, অন্তঃত পাকিস্তানের সঙ্গে তারা যাবে না। পাকিস্তানের মিত্র সেন্টো, তুরস্ক ও ইরান হয়তো কিছু সরবরাহের মাধ্যমে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুব বেশি সহায়তা করতে উদ্বুদ্ধ করবে না।” এরপর সুব্রামনিয়াম নিরীক্ষা করছেন যুদ্ধবাদী প্রত্যেক ভারতীয়র মনে যে প্রশ্নটা উঁকি দিচ্ছে। ১৯৬৫ সালের মতো এবারও কি চীন হস্তক্ষেপ করবে? ইনস্টিটিউটের হিসেব মতে চীন তিব্বতে ১০০,০০০ সৈন্য নিয়োজিত রেখেছে এবং খুব দ্রুতই তারা সেখানে আরও সৈন্য নিয়োগ করতে সক্ষম।

এরপরও, মি. সুব্রামনিয়াম উপসংহারে পৌঁছাচ্ছেন এই বলে যে চীনের হস্তক্ষেপও এড়ানো যেতে পারে। “যদি আমরা মনে করি যে চীন তার সৈন্যসংখ্যা দ্বিগুণ বাড়াতে পারে, কিন্তু ভারতের উত্তর সীমান্তে যুদ্ধের জন্য তার সামান্য অংশই তারা ব্যবহার করতে পারবে। সত্যিকার অর্থে যে-সৈন্যদের তারা নিয়োজিত করবে, ভারতের উত্তরে যে গিরিখাতগুলো আছে যুদ্ধের জন্য সেগুলো অতিক্রম করতে যে-মাত্রায় অবকাঠামোগত সমর্থন লাগবে, তা বরাদ্দ করতে করতে তাদের সংখ্যা সীমিত হয়ে পড়বে। এর বিপরীতে উত্তর সীমান্তে আমাদের নয় ডিভিশন সৈন্য আছে (চীনা ডিভিশনগুলোর চাইতে আমাদের ডিভিশনগুলো বড়ো)।” এটা ঠিক যে, সীমান্তের প্রতি ইঞ্চি পাহারা দেয়া যাবে না এবং চীনাদের পক্ষ থেকে কিছু আক্রমণ হতে পারে; কিন্তু তারা যদি হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্তও নেয় এরপরও তাদের জন্য এপাশে থাকার ক্ষেত্রে একটা সমস্যা থেকেই যাবে। সেটা হলো, শীতের সময় তুষারে হিমালয়ের গিরিখাতগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। ১৯৬২ সালে, যখন নানা কারণে চীনারা সীমিত একটি প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছিল, থাগলা থেকে পাদদেশে নামতে তাদের পুরো এক মাস সময় লেগেছিল। যখন ভারত ও পাকিস্তানের শত্র“তা চলতে থাকবে, তখন চীন যা ক্ষতি করতে পারে, নেনা ও লাদাখ-এর কিছু অংশে বড়োজোর দুই কি তিন মাস জুড়ে তা করতে পারবে। ১৯৬২ সালে চীন আসামকে যেমন মূল ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে পৃথক করে ফেলেছিল, এবার তা করারও সুযোগ নেই। কারণ যুদ্ধকালে বাংলাদেশের উত্তরাংশ ভারতের দখলে থাকলে বরং আসামের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ আরও ভালো হবে।

“চীনারা গিরিপথ দিয়ে নেমে আসলেও তারা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আসতে পারবে না। উল্টো এপাশে সুসজ্জিত ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে তাদের মোকাবেলা করতে হবে। এছাড়া, এবার ভারতীয় বাহিনীকে ১৯৬২ সালের মতো বিমানবাহিনীকে উত্তর সীমান্তে ব্যবহারের ব্যাপারে কোনো কালক্ষেপণ করা হবে না। যেহেতু তারা এবার তেমন সুবিধা করতে পারবে না, তাই এতো সামরিক ঝুঁকি নিয়ে তারা এ-যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না।” ইনস্টিটিউট হিসেব করেছে যে, “যদি ভারত যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় তবে ৪০,০০০ লোক প্রাণ হারাবে। কিন্তু যারা যুদ্ধবিরুদ্ধ নীতিতে অটল আছেন, তারা এর বাইরে আর কোনো সমাধানও দিতে পারছেন না।”

লাখ লাখ মানুষের যাত্রা

সুনন্দ দত্ত-রায়

দি অবজারভার ১৩ জুন, ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

পূর্ব-পাকিস্তান জুড়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সৈন্যরা যেভাবে দেশটিকে জনমানুষশূন্য করে তুলেছে তা দেখে যেকেউ হতাশ হবে। দেশবিভাগের পর থেকে এই মুসলিম দেশে এক কোটি হিন্দু আশা নিয়ে বেঁচে ছিল এবং এরপর ২৩ বছর ধরে অবিচার ও নিবর্তন ভোগ করেছে, এরপর সবশেষে তারা বুঝতে পেরেছে তাদের একমাত্র আশার প্রতিফলন ভারতেই রয়েছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে এই গণদেশত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত ষাট লাখেরও বেশি মানুষ চলে গিয়েছে। কিছু লোক গিয়েছে সাম্প্রদায়িক ভাবনা থেকে তাদের মহিলাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। বাকিরা গিয়েছে চাকরি হারানোর পরে, জায়গাজমি খোয়ানোর পরে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলেও হাজার হাজার লোক চলে গিয়েছে; অন্যান্যরা ভারতে চলে গিয়েছে কারণ জীবনের অনিশ্চয়তার ভার তারা আর বইতে পারেনি।

গত বছরের কোনো এক সময়ে পূর্ববাংলায় এখনও অবস্থানরত হিন্দুরা আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবের দেয়া প্রতিশ্র“তি অনুসারে সব ধর্মের মানুষের জন্য সমান জীবনের দাবিতে মিছিল করেছে। শেখ মুজিব ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল এবং বর্তমানে জেলে বন্দি আছেন। কিন্তু পাকিস্তানী সৈন্যকে নির্দেশ দেয়া হলো শেখকে শেষ করে দেবার জন্য, সৈন্যদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক যারা আছে, তাদেরও কট্টর হতে উৎসাহিত করা হয়েছে।

কলকাতায় নিযুক্ত বাংলাদেশ-মিশনের (পূর্ব পাকিস্তান-মিশন) প্রধান হোসেন আলি বলেন সামরিক শাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান তার অফিসারদের ডেকে নিয়ে হিন্দু লোকজনকে হত্যা করার জন্য ও হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করার জন্য ও তাদের ফসল নষ্ট করে দেবার জন্য বিশেষ নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরকম নির্দেশ দেয়া হোক বা না হোক, সৈন্যদের কাজকারবার দেখে মনে হয় তেমনই কিছু বলা হয়েছে। কিন্তু যে দেশে হিন্দু ও মুসলমানরা একই পোশাক পরিধান করে, একই খাবার খায়, একই উপভাষায় কথা বলে, বেসামরিক লোকদের সাহায্য ছাড়া ঐ নির্দেশ পালন করা সম্ভব ছিল না।

পূর্ব-বাংলায় ‘স্বাভাবিকত্ব ফিরিয়ে আনা’র জন্য গঠিত ‘শান্তি-কমিটি’ এখন কাজগুলো করছে। লিফলেট দিয়ে এবং লাউড-স্পিকারের মাধ্যমে তারা মুসলমানদের আহ্বান করছে হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের সম্পত্তি দখল করার জন্য। আওয়ামী লীগের মুসলমানরা ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শান্তি রক্ষার কাজে যোগ দিতে পারে এবং দেশে থেকে যেতে পারে। যেসব হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভোট দিয়েছে তাদের অবশ্যই চলে যেতে হবে। ফলে ২৫ মার্চের পর থেকে ৪০ লাখ হিন্দু উদ্বাস্তু সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে গিয়েছে। যদি পাকিস্তানী সৈন্যরা পূর্ব বাংলা ছেড়ে চলেও যায়, হিন্দুরা আর ফিরতে চাইবে না। অন্যদিকে ভারতকে বাকি ষাট লাখ হিন্দুকে, যারা এখনও পূর্ববঙ্গে রয়েছে ও তাদের মধ্যে যারা জীবিত থাকবে, তাদের গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

শেখ মুজিবের বাংলাদেশ-আন্দোলনের সময় দু’ধরনের হিন্দু পূর্ববাংলায় ছিল। তাদের একদল ছিল পেশাজীবী লোকজন যাদের জীবন সম্পর্কে পরিকল্পনা ছিল এবং মুহূর্তের নোটিশে দেশত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল। অন্যদল ছিল কৃষকরা যাদের এখন বাধ্য হয়ে যেতে হবে। সফল আইনজীবীরা বাঁশের চাটাইয়ের বা টিনের তৈরী ঘরে থাকতো। ডাক্তাররা নড়বড়ে ঘরে প্র্যাকটিস করতো। তাদের জীবন, ছেলেমেয়ে ও অর্থ সবকিছু নিরাপত্তার জন্য ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হতো। অন্য হিন্দুরা ছিল কৃষক, কামার, জেলে, তাঁতি এবং এরা সবাই নিুবর্ণের হিন্দু ছিল।

বর্তমানে কলকাতায় অবস্থানরত একজন ফেরারী মধ্যবিত্ত হলেন চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার ডিজাইন সেন্টারের প্রধান। তিনি নিশ্চিত যে ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্য ছিল দুই ধর্মের মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলন শেষ করে দেয়া, পুরোপুরি রাজনৈতিক একটি ব্যাপারকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা এবং ভারতীয় মুসলমানদের ওপর পাল্টা আঘাত হানাকে উসকে দেয়া। এধরনের ভারত-পাকিস্তান সংঘাত সৃষ্টি হতে দেখে বিশ্বের হয়তো সামরিক শাসনের প্রকৃত নিপীড়নমূলক ভূমিকা থেকে দৃষ্টি সরে যাবে।

এই পরিকল্পনা হয়তো ভালোভাবে বাস্তবায়িত হতো যদি না হিন্দু উদ্বাস্তুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে নিঃশেষ না হয়ে যেতো। এরপরও ভারতীয় সীমান্ত-শহর বারাসাত ও বসিরহাটে কিছু সাম্প্রদায়িক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। পুলিশের একটি শক্তিশালি দল হিন্দু উদ্বাস্তুদের নিবৃত্ত করতে পেরেছিল। তারা বর্শা, ছুরি, লাঠি হাতে মুর্শিদাবাদ থেকে এখানকার মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করতে এসেছিল। একজন উদ্বাস্তু বলল, “শান্তি-কমিটির লোকজন আমাদের বলেছে ভারতে চলে যেতে কারণ এখানেই নাকি আমাদের সবার জন্য খাদ্য ও জমি আছে। এখন আমরা এখানে মুসলমানদের পাকিস্তানে চলে যেতে বলব”।

এরমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বের শহর সিলেটে হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়িগুলো স্থানীয় মুসলমানরা ন্যূনতম মূল্যে নিলামে তুলেছে। এমনকি ঢাকায় পরিত্যক্ত বাড়িগুলো বণ্টনের একটি আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন হয়েছে। ইয়াহিয়া খানের সরকারের প্রতি আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে ধানী জমি বণ্টন করা হয়েছে। এপরিস্থিতিতে নিরাপদে দেশে ফিরে যাবার জন্য ইয়াহিয়ার প্রস্তাব উদ্বাস্তুদের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন।

হাসান মনে করেন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম দালালরা বাঙালি নয়। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রি নূরুল আমিন পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোর গুরুত্বপূর্ণ অনুসারী। কিন্তু তিনিও সামরিক শাসকদের অধীনে পুতুল সরকারের প্রধান হতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এই প্রত্যাখান অন্তঃত একটি ভুয়া গণতান্ত্রিক সরকারের সম্ভাবনাও নাকচ করে দেয় এবং সামরিক শাসন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ইয়াহিয়া খানের শাসনের প্রতি কেবল মুসলিম লীগ (যারা সবসময় সামরিক শাসনকে সমর্থন করে এসেছে) এবং কট্টর ইসলামী দল জামায়াত-ই-ইসলামী ও নিজামী-ই-ইসলাম-এর লোকজনের আনুগত্য আছে। একত্রে তারা সারা দেশের ১৯ শতাংশেরও কম। তাদের মধ্যে মাত্র শতকরা পাঁচ জন বাঙালি। বাকিরা হলো বিহারি মুসলমান — যারা দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিল এবং পাঞ্জাবী — অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য যারা পূর্ব-পাকিস্তানে গিয়েছিল।

এরকম কিছু ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায় যেখানে বাঙালি মুসলমান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হিন্দুদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এধরনের বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ফিরে যাবার জন্য খুব কমই আশা জাগায়। আমি বিশ্বাস করতে প্রস্তুত আছি যে শেখ মুজিব সাড়ে ছয় কোটি মুসলমান ও এক কোটি হিন্দুদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব ও উদারতার কারণে হিন্দু জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিল। প্রাদেশিক পরিষদের জন্য আওয়ামী লীগের টিকেটে এগারো জন হিন্দু নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে-পরিষদ অবশ্য সামরিক শাসকরা বাস্তবায়িত হতে দেয় নি।

পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমাঞ্চলের জেলা পাবনার জেলাপ্রশাসক আমাকে যা বললেন হিন্দুদের জন্য তা এরচাইতেও আশাপ্রদ ব্যাপার ছিল। জেলাপ্রশাসকের নাম নূরুল কাদের, তিনি কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের অর্থনীতির গ্র্যাজুয়েট। ডিসেম্বরের নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে তিনি এক হিন্দুর কিছু জমিজমা বিক্রির ব্যাপারে কাজ করছিলেন। লোকটি পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে যেতে চাইছিল। কিন্তু যখন শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করলেন তখন লোকটি দেশে থেকে যেতে চাইলো এবং কেমব্রিজের তরুণটি এখন নির্বাসিত বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি সচিবলায় সংগঠিত করার জন্য কাজ করছেন। কিন্তু এই সরকারের একটি জাতীয় পরিচয় ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু এই সরকারের কোনো নেতার শেখ মুজিবের মতো কারিশমা নেই। কিন্তু কাদের মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে পুনরায় মতৈক্যের কোনো সম্ভাবনা নেই। হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ গভীর দাগ ফেলে গেছে। আর এইসব অপরাধের সঙ্গে ব্যাপকমাত্রায় যুক্ত হয়েছে যৌন হয়রানির ঘটনা। কাদের জানালেন যে, এমনকি উচ্চমধ্যবিত্তের মেয়েদের ক্যান্টনমেন্টের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

একজন দাড়িওয়ালা ট্রাভেল-এজেন্ট যুবক, যিনি তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন, তিনি জানালেন, “সেনাবাহিনীর আক্রমণের পূর্বে মাত্র ১৫ শতাংশ লোক স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছিল। এখন মাত্র ১৫ শতাংশ পশ্চিম-পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো প্রকার যৌথতার ব্যাপারে সায় দেবে”। কিন্তু যদি একত্রিত পাকিস্তানের আর কোনো সম্ভাবনা না থাকে, পূর্ব বাংলার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অনেক সময় লাগবে। প্রথম প্রতিরোধ শক্ত হাতে দমন করা হয়েছে। প্রথম প্রতিরোধটি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, বিচ্ছিন্ন এবং কেবল আবেগগত তাড়না থেকে পরিচালিত হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত টেকে নি। এতে অনেক ভুল ছিল; এটা ছিল অতিমাত্রায় আশাবাদযুক্ত। বাঙালিরা ভেবেছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অভ্যস্ত পরোক্ষ অবাধ্যতার মাধ্যমেই পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কঠোর সৈন্য ও নিষ্ঠুর অফিসারদের মোকাবেলা করবে।

দ্বিতীয় পর্বের প্রতিরোধ এখন শুরু হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস্ ও পুলিশ বাহিনীর ২০,০০০ সৈনিক একক নেতৃত্বের অধীনে কাজ করছে। ৮,০০০ কিশোর-তরুণ গেরিলা যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নিচ্ছে। দালালদের শেষ করার জন্য কিলার স্কোয়াড গঠিত হয়েছে। একজন বাংলাদেশী নেতা আমাকে বললেন তিনি সাফল্যের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ “যদি আমরা আমাদের জন্য কাজ করি’’। এর মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানের জন্য কোনো বিদেশী সাহায্যের জন্য অস্বীকৃতি জানালেন। বর্তমানে পূর্বাংশে চার ডিভিশন পাকিস্তানি সৈন্যর জন্য প্রতিদিন এক কোটি রুপি ব্যয় হচ্ছে। পাকিস্তানের জন্য অর্থনৈতিক চাপ নিঃসন্দেহে পাকিস্তানী সৈন্যদের জোর কমিয়ে দেবে, কারণ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ২,৫০০ মাইল পাড়ি দিয়ে সৈন্যদের জন্য ৩০০ টনের সরবরাহ প্রতিদিন আনতে হচ্ছে।

বাংলাদেশের আন্দোলনকারীরা একটু আশাবাদী হতে পারে এজন্য যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কেবল পূর্ব পাকিস্তানে আর সীমাবদ্ধ নেই, পশ্চিম পাকিস্তানেও ছড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বিশিষ্ট পাঠান-নেতা ওয়ালি খানের কথা উল্লেখ করা যায়। মি. ভুট্টো সেনাবাহিনীকে বলছেন রাজনৈতিক সমস্যা রাজনীতিবিদদের সমাধান করতে হবে এবং তিনি শিগগীরই ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলে আসছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের কুখ্যাত ২১ ধনী পরিবারের লোকজন ঠিকই বুঝতে পারছে পূর্ব পাকিস্তানের বাজার হারিয়ে ফেললে কী বিপদ হবে। ইয়াহিয়া খান এখন বুঝতে পারছেন, পশ্চিমের প্রভাবশালী লোকজন এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে পূর্বের যেকোনো সময়ের মতো কঠোর হয়ে উঠবে। রাষ্ট্রপতি হয়তো দমননীতির চূড়ান্ত পর্যায় পার হয়ে এসেছেন। ঢাকায় উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তি একসময় যে-সমাধানের কথা বলেছিল, ইয়াহিয়ার কার্যকলাপ দেখে মনে হচ্ছে তিনি সেদিকেই যাচ্ছেন। কিন্তু ব্যাপার হলো ঢাকা এখন আর সেকথা শুনবে না।

কিন্তু একদিন যদি বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়ও, পাকিস্তান সেনাবাহিনী-সৃষ্ট সফল সাম্প্রদায়িক পারিস্থিতি ও বাঙালি হিন্দুদের ব্যাপকমাত্রায় প্রস্থান, বাংলাদেশকে একটি কেবল মুসলমানের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। এমনকি এখনকার তাজউদ্দীনের মন্ত্রিসভায় কোনো হিন্দু সদস্য নেই। এবং বাংলাদেশের জন্য ভারতীয়দের ব্যাপক সহানুভূতি সত্ত্বেও, এটা একটা দুঃখজনক ব্যাপার যে যেসব হিন্দু কয়েক বছর আগে ভারতে বসতিস্থাপনের জন্য গিয়েছিল তারা বাংলাদেশের জন্য কোনোরকম সহযোগিতা প্রদানের বিরোধী।

সম্পাদকীয়: হত্যা বন্ধ কর

দি সানডে টাইমস, ১৩ জুন, ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

পূর্ব-পাকিস্তান সম্পর্কিত একটি আর্টিকেলের জন্য মধ্য-পাতার পুরোটা ব্যয় করে সানডে টাইমস একটি ব্যতিক্রমী ও দায়িত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরাই প্রথম এটি করেছি, কারণ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তার প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানে কী করছে, এটি ছিল তার ওপরে পূর্ণমাত্রায় বিশ্বাসযোগ্য, বি¯তৃত এবং প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট। দ্বিতীয়ত, মিলিয়ন মিলিয়ন উদ্বাস্তু কী থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, সে-সম্পর্কে সংবাদটি নিজেই এমন এত ভয়াবহ বর্ণনা দিচ্ছে যে, এসম্পর্কে বিস্তারিত বলা প্রয়োজন। সানডে টাইমস্ রিপোর্টটির যথার্থতার ব্যাপারটি যতদূর সম্ভব খতিয়ে দেখেছে। কিন্তু যেকোনো ক্ষেত্রেই আমাদের প্রতিবেদকদের ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। তিনি এই সংবাদটি বিশ্ববাসীকে জানাবার জন্য পাকিস্তানে নিজের ক্যারিয়ার ও ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন।

গত শরতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সমাপ্তি ঘোষণা করতে চাওয়ার পরেই যে কেবল বর্তমান সংকট শুরু হয়েছে তা নয়। সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাঙ্গা হয়ে ওঠে, কিন্তু নির্বাচনের পর তাকে নিষ্ঠুর হাতে দমন করা হয়। কিন্তু তার অনেক পূর্বে ১৯৪৭ সালে দু’টি অসম অংশ নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে এই অনৈক্য ও অসাম্যের বীজ রোপিত হয়। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জনগোষ্ঠী, সঙ্গতকারণেই, নিজেদের এমন একটি দেশে বৈষম্যের শিকার বলে নিজেদের খুঁজে পেয়েছে, যে-দেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদানই বেশি। এছাড়া বর্তমানের রক্তপাত ও উৎপীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে অবাঙালিদের বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্য বাঙালিদেরও কিছু দায়িত্ব স্বীকার করতে হবে। আমাদের সংবাদটি সে-বিষয়টিও স্পষ্ট করেছে।

কিন্তু এসবকিছু বলার পরও, পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে যে পরিকল্পিত, স্বেচ্ছাকৃত নিষ্ঠুর আক্রমণের অভিযোগ রয়েছে, তা কিছুতেই এড়ানো যাবে না। একটি বেসামরিক শাসনব্যবস্থা ও স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ফিরে যাবার কথা ইয়াহিয়া যখন বলেন তখন সেটা তিনি হয়ত সত্যিকার ভাবনা থেকেই বলেন। কিন্তু পাকিস্তানে এপর্যন্ত যা ঘটেছে তারপর কীভাবে পাকিস্তানি সরকার বাঙালি নেতাদের বোঝাতে সক্ষম হবেন যে তারা পরস্পরের ভাই এবং একই জাতিতে অন্তর্ভুক্ত। সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারের প্রতি বাঙালিদের আনুগত্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এবং পশ্চিম-দেশসমূহের কাছে পাকিস্তানী সরকার যে-সাহায্যের আবেদন করেছে, তা যদি অনুমোদিত হয় তা হলে সেই সাহায্যের অর্থ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনীর চলমান অভিযানেই কাজে লাগানো হবে। অবশ্য সাহায্য বন্ধ করে দিলেও পাকিস্তানে বাড়তি মানবীয় ভোগান্তি বেড়ে যাবে।

পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য, ব্রিটেন যার অন্তর্ভুক্ত, সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক ফর্মুলা হলো সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রত্যাহারের মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য ইয়াহিয়া বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং সেসব ক্ষেত্রে দাতারা সাহায্য বরাদ্দ করবে। অবশ্য পূর্ব-পাকিস্তানে ত্রাণকার্যে জাতিসংঘ ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী ত্রাণসংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রণ আনতে চাইলেও এই সত্য অস্বীকার করা যাবে না যে পাকিস্তান একটি স্বাধীন দেশ এবং সে যা না-করতে চাইবে, অন্য কেউ তা তাকে দিয়ে করাতে পারবে না। সবচেয়ে ভালো ও একমাত্র রক্ষাকবচ হলো পাকিস্তান-সরকারের কার্যকলাপের ওপর প্রচার চালিয়ে যাওয়া এবং এই আশা করা যে বিশ্ববিবেকের মতামতের চাপ অবশেষে কোনো প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে।

পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত তা বলা শক্ত। কিন্তু যাই হোক না কেন, এটা অপ্রত্যাশিত যে ভারতে বিরাটসংখ্যক উদ্বাস্তু রয়েছে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই হিন্দু এবং যারা আর পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেতে চায় না। যুদ্ধ ও সহিংসতার এই সময়ে একটা জিনিস খুব স্পষ্ট যে ইয়াহিয়া খান একটি বিরাট ভুল করেছেন এবং এর ভয়াবহ ফলাফল এশিয়া এবং বিশ্বে নতুন করে অস্থিতিশীলতার নতুন একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে; যার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য-সমস্যার মতো জাতিগত ও স্থানিক উপাদান জড়িত রয়েছে। এবং ভবিষ্যতে এখানকার অধিবাসীদের আরও অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হবে।

বাংলাদেশ নতুন আক্রমণের পরিকল্পনা করছে

দি ডেইলি টেলিগ্রাফ, ১২ জুন, ১৯৭১

নরম্যান কিরহ্যাম, কূটনৈতিক প্রতিনিধি

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

চেকোস্লোভাকিয়া ও চীনের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের গেরিলারা পশ্চিম-পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। লন্ডনে আসা রিপোর্ট অনুসারে বলা যায়, পরবর্তী দু-মাসে হঠাৎ-আক্রমণের কৌশল নেয়া হবে।

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে হাজার হাজার বাঙালি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এবং গেরিলারা আশা করছে গোপন অস্ত্র-ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আরও অস্ত্র আসবে। গেরিলাদের ব্যবহৃত অনেক হালকা অস্ত্র চেকোস্লোভাকিয়ার তৈরী, কিন্তু ভারতের নাগা এলাকা থেকে কিছু চীনা অস্ত্রও দেশের ভেতরে নিয়ে আসা হয়েছে যেখানে চীন একটি আন্ডারগ্রাউন্ড বাহিনীকে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছে। পাকিস্তানের যুদ্ধে চীনের নীতি হলো ইয়াহিয়া খানের সরকারকে নৈতিক সমর্থন দেয়া এবং নাগা থেকে বেসরকারীভাবে অস্ত্রের সরবরাহ পিকিংকে বিব্রত অবস্থায় ফেলতে পারে।

ব্রিটিশ বন্দুক

বাংলাদেশের গেরিলারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মজুদ থেকে নিয়ে ব্রিটিশ বন্দুক এবং সেইসঙ্গে হালকা মেশিন-গান, মাইন ও হ্যান্ড গ্রেনেড ব্যবহার করছে। আর নিজেদের তৈরী বিস্ফোরক তো আছেই। তাদের তিনটি হেলিকপ্টার আছে যা এখন পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়নি এবং একটি ফিল্ড-গান আছে; কিন্তু সঙ্গের ভারী যন্ত্রপাতি নেই। তারা বরং চেষ্টা করছে সেনাবাহিনীর সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিতে। তারা গ্রামাঞ্চলে রেলের মালগাড়ি ও সেনা পরিবহনগুলো ধ্বংস করছে। গেরিলারা অনেক জেলা ও প্রদেশের কেন্দ্রগুলোয় নিয়ন্ত্রণ-প্রতিষ্ঠার দাবি করেছে। অনেক শহরে তারা তাদের নিজস্ব কারফিউ জারি করেছে।

এখন পশ্চিম-পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা অঞ্চলে নতুন আক্রমণের আশংকা করছে। ঢাকা বিমানবন্দরের আশপাশ দিয়ে প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বাংলাদেশী অনেক সমর্থক মনে করে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ১০০,০০০ হতে পারে কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অধিক সৈন্য ও সরঞ্জাম আনছে এবং নতুন আক্রমণের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত রয়েছে।

এদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বেসামরিক শাসন-ব্যবস্থা প্রবর্তনের দীর্ঘ প্রতিক্ষীত প্রস্তাবনার গতকালের ভাষণ শুনতে ভালো লাগলেও পূর্ব-পাকিস্তানের আবেগগত প্রয়োজন মেটানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়। গত তিনমাস ধরে প্রদেশটি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে বেঁচে আছে, যেজন্য রাজনৈতিক সমাধানের পথ অনেক দূরে সরে গেছে। এই হতাশা ও ঘৃণার মুখে কী প্রয়োজন? অবশ্যই গতকাল দেয়া সতর্ক-প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতির চাইতে উদারতাই বেশি প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রণয়নকৃত একটি সংবিধানের চাইতে মহানুভবতা বেশি প্রয়োজন।

বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের বাইরে গিয়ে ভবিষ্যতের কোনো পরিকল্পনাই কাজে দেবে না। কেউ কেউ যদি সহযোগিতা করতে প্রস্তুতও হয় এবং তারা যদি দালাল হিসেবে প্রতিপন্ন হয়, তবে শেষ পর্যন্ত তাদের কোনো ক্ষমতাই থাকবে না। পূর্ব-পাকিস্তানে প্রেসিডেন্টের বাণীর কোনো অংশ কেউ প্রচার করতে গেলেই সে দালাল হিসেবে আখ্যা পাবে। পূর্ব-পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে এমন কোনো রাজনৈতিক সমাধানের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। গতকাল ভাষণে এমন কিছু বলা হয়নি যা পোড় খাওয়া মানুষগুলোর মনোভাব পরিবর্তন করতে পারে।

সন্দেহ নেই, গত তিন মাসে যা ঘটেছে তার জন্য দায়ী করা যায় এমন অনেক লোকই আছে। কিন্তু হতভাগ্য বাঙালিরা অবশ্যই এই দায়ভাগ ভারতকে বা ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানকে বিভক্ত করতে চায় এমন কোনো ‘দুস্কৃতিকারী’কে দিতে চাইবে না। সেনাবাহিনীর কুকর্মের পেছনে কোনো সাফাই প্রেসিডেন্টের বক্তৃতায় গাওয়া হয়নি।

সম্ভবত পাকিস্তানের রাজধানীতে যা চিন্তা করা হচ্ছে তার সঙ্গে পুর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত ঘটনার মধ্যে একটা ব্যবধান রয়েছে। যদি বেসামরিক সরকারকে পুনঃস্থাপন করতে হয় তবে সম্পর্কস্থাপন করা প্রয়োজন। কিন্ত সবেক্ষেত্রেই ঘৃণাকে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে-এজেন্টদের নিয়োগ করা হয়েছে সেই বিহারিদের বাঙালিরা ততখানিই অপছন্দ করে যতখানি তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের করে। এরপরও পূর্বের সমর্থন আদায় করতে পেরেছেন এমন কর্মকর্তারা পশ্চিমে আছে। কিন্তু তারা কি ফিরে যেতে পারেন না? তাদের পুনঃনিয়োগের মাধ্যমে এটা কি প্রমাণ করা যায় না যে দমন-পীড়নের নীতি ভুল ছিল? প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একটাই ভাবনা এবং তা হলো সবকিছুর সমাধান রাজনৈতিকভাবে হতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত গত তিন মাসে পূর্ব পাকিস্তানে যা করা হয়েছে তার ফলে সমাধানের সম্ভাবনা আরো কঠিন হয়ে পড়েছে।

এখন যা প্রয়োজন তা হলো বাঙালি জনগণের জন্য ভালো কিছু করার ইচ্ছা যার ফলে তাদের মনে হবে গেরিলা যুদ্ধ বা অন্য যাবতীয় ভোগান্তি তাদের জন্য আরো যুদ্ধাবস্থাই কেবল আনবে, তার চেয়ে শান্তিপূর্ণ আপসই ভালো হবে। তারা এমন কোনো বিবৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে না যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং যার খসড়া সেনাবাহিনীর জেনারেলদের তৈরি করা বলে মনে হবে।

ইয়াহিয়ার শিকার শেষ কয়েক লক্ষ

দি গার্ডিয়ান, ৫ জুন, ১৯৭১

সম্পাদকীয়

পূর্ব-পাকিস্তানের হতভাগ্য লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন খুব দেরিতে এসেছে। রাজনীতি, আমলাতন্ত্র ও দমননীতি ভারতের হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে — যেন ভারতের নিজেরই এধরনের সমস্যা নেই — তাকে একাই ৪০ লক্ষ উদ্বাস্তুর দেখাশোনা করতে হচ্ছে। অনেকের জন্য কলেরা হলো দুর্যোগের চতুর্থ ধাপ –এর আগে তাদের ভাগ্যে ছিল তিন দুর্যোগ: গত নভেম্বরের সাইক্লোন, ইয়াহিয়া খানের সামরিক হত্যাভিযান এবং জনগণের উদ্বাস্তুতে রূপান্তরিত হওয়া। এখনকার সমস্যা হলো পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ব পাকিস্তানের যাদের সাহায্য প্রয়োজন, যত দ্রুত সম্ভব তাদের সাহায্য-প্রদান নিশ্চিত করা।

দুই এলাকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পৃথক। পূর্ব-পাকিস্তানের মতো পশ্চিমবঙ্গের কোথাও চলে যাওয়ার সমস্যা নেই। ভারতকে দ্রুত দেখাতে হবে যে তার একার পক্ষে উদ্বাস্তুদের দেখাশোনা করা সম্ভব না। ভারত বাইরের সহায়তাকে স্বাগত জানিয়েছে। সাহায্য যা আসবে তা দিয়ে হয়তো পুরো প্রয়োজন মিটবে না। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো ভারত-সরকার জাতিসংঘের কাছে সাহায্য-প্রার্থনা করেনি। এই আমলাতান্ত্রিক বাধার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুরা অনেক সহায়তাই পাচ্ছে না।

পূর্ব পাকিস্তানে যাদের হত্য করা হয়নি, কিন্তু এই মুহূর্তে ক্ষুধার্ত রয়েছে, তাদের জরুরিভিত্তিতে খাদ্য প্রয়োজন। কিন্তু ইয়াহিয়া খানকে সরাসরি সাহায্য ব্যতিরেকে তাদের কীভাবে সাহায্য করা হবে? নাইজেরিয়ার বায়াফ্রার জন্য যখন আন্তর্জাতিক সাহায্য দেয়া হয়েছিল তখন জেনারেল গাওন অযৌক্তিকভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন এই বলে যে সাহায্যদানকারীরা তার শাসনপদ্ধতিতে অন্যায় হস্তপে করেছেন। ইয়াহিয়া খান এসবেরই লক্ষণ দেখাচ্ছেন — বলছেন পাকিস্তানের নিজস্ব সংস্থাসমূহ সাহায্য পরিচালনা করে। কিন্তু তিনি এবং দাতারা জানেন, এভাবে সাহায্য দেয়ার অর্থ, সেনাবাহিনীর হাতে তা দেয়া, যে-সেনাবাহিনী দুর্গতদের হত্যাকারীর ভূমিকা পালন করে এসেছে।

সাহায্যদাতারা ইয়াহিয়ার মহত্ত্বের ভান করাটাকে এড়িয়ে চলতে পারেন যদি বিশ্বের অর্থসংস্থাসমূহ তাকে শর্তহীনভাবে নাকচ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। পাকিস্তানের অর্থনীতি এখন খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে এবং অবমূল্যায়ন প্রকট হয়ে উঠেছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও অর্থসংস্থাসমূহের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে এখানে নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে নিশ্চিত করতে হবে যে, ইয়াহিয়া খান যেন বাড়তি কোনো সাহায্য না পান, যা তিনি চাচ্ছেন। ইয়াহিয়া খানকে এটা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে যে-দমননীতি চালিয়ে যাচ্ছেন, তাতে সাহায্য করার জন্য তার পাশে কেউ নেই। পরিতাপের বিষয় এই যে, যখন এই রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা হবে, ইতোমধ্যে আরও উদ্বাস্তু দেশ ছাড়বে এবং খেতে না পেয়ে আরও অনেক মানুষ মারা যাবে।

সূর্যের নিচে মৃতের সারি

নিউ স্টেটসম্যান, ৪ জুন, ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

প্রথম আক্রমণের পর থেকে দুর্ভিক্ষ সবসময় যুদ্ধের একটি অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে, এবং রোগবালাই দুর্ভিক্ষের কঠোর সহযাত্রী হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু অতীতে যা ইতিহাসকে প্রকাশ করার জন্য রেখে দেয়া হয়েছিল তা এখন ঘটছে বলে পৃথিবীর সামনে উপস্থাপিত হচ্ছে। এখন আর কেউ দাবি করতে পারবে না যে পূর্ব বাংলায় কী ঘটছে তা সে জানে না। রঙিন টেলিভিশনে দেখা যাচ্ছে মৃতদেহগুলো সূর্যের আলোয় পচে যাচ্ছে। ছ-মাস আগে পৃথিবীর প্রতিক্রিয়া ছিল স্বয়ংক্রিয় এবং স্বাভাবিক। বন্যার পানি চারিদিকে বাড়তে থাকলে আশা-আকাঙ্ক্ষা, অকার্যকর হলেও, ধরে রাখা যায়। কিন্তু সেনাবাহিনী বন্যার পনি নয়। ছয় মাসের স্বল্প সময়ে চ্যারিটির রাজনীতি আরো অনেক জটিল হয়ে গেছে। জেনারেল ইয়াহিয়ার খানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কেবল উদাসীন ও উদ্দেশ্যপ্রবণ লোকজনই পশ্চিম পাকিস্তানকে নানা ধরনের সাহায্য করতে চাইবে। দু-সপ্তাহ ধরে জেনারেলের ঘনিষ্ঠতম উপদেষ্টা এম এম আহমেদ আমেরিকান সরকার ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের কাছে সুন্দরতম ভবিষ্যতের কথা শুনিয়ে অর্থসাহায্যের জন্য চাপপ্রয়োগ করছেন। তিনি তাদের বলছেন যে তার দেশ হলো অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত। গৃহযুদ্ধের কারণে প্রতিদিন ২০ লাখ ডলার নষ্ট হচ্ছে। যুদ্ধ রফতানি-মুদ্রার সঞ্চয়কে গিলে খাচ্ছে, যার বেশিরভাগই আসে পূর্বাংশ থেকে। এরকম হিসেব করা হয়েছে যে মি. আহমেদ এবং তার প্রভুর ৫০০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন তাদের পশ্চিম-অংশকে রক্ষা করার জন্য। এখানে পূর্ব-অংশের কথা উল্লেখ করা হয় না যেখানে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগর কারণে দেশটি বিধ্বস্ত হয়েছে এবং তার আশু-পরিচর্যা প্রয়োজন।

স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া অনুসারে ইয়াহিয়াকে প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য দেয়াই যায়। পশ্চিমের সঙ্গে ইসলামাবাদ সরকারের সম্পর্ক ভালোই , আগের দু’জন সরকারই সামরিক বাহিনী থেকে আসার পরও। পুঁজিবাদী সরকারসমূহ সাধারণভাবে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষেই রয়েছে। সার্বভৌম দেশমূহের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না-করার জন্য বইতে আইন-কানুন লেখা রয়েছে, এবং তৃতীয় বিশ্বের আন্দোলনসমূহে এই আইন নিন্দাজনকভাবে ভঙ্গ করা হয়। আমরা মুখে স্বীকার করি কোনো পক্ষ অবলম্বন করে তাদের মনে আঘাত দেয়াটা অন্যায় হবে, কিন্তু আমরা আসলে হস্তক্ষেপ করি এবং ক্ষমতার পক্ষেই থাকি। যাহোক, এক্ষেত্রে সচারচরের কায়দা-কানুন ততটা খাটে নি যেমন মি. আহমেদ আশা করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে এব্যাপারে জনগণের অনুভূতি সরকারের পক্ষে যায় নি। এরকম ধারণা তাদের মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছে যে এটা শুধু স্থানীয় একটি সমস্যা নয়, এখানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে। পশ্চিম-পাকিস্তান যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা রাজনৈতিক সমাধান করতে পারছে, সিনেটের পক্ষে তাদের অর্থসাহায্য করা কঠিন হবে।

ইয়াহিয়ার জন্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আদায় শ্রদ্ধা পাবার একটি সার্টিফিকেট হবে। অনেক ধরনের ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে যে তিনি এটা অর্জনের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন। একটি হলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতাসহ বেসামরিক শাসনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া। কিন্তু বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়ে গেছে; ইউরোপীয়দের কাছে ব্যাপারটা রাজনৈতিক অর্থহীনতা লাগতে পারে। রক্ষণশীল হয়ে হিসেব করলেও শতকরা নব্বই ভাগ পূর্ব-পাকিস্তানী এখন বিচ্ছিন্নতাবাদী।

বিশ্বব্যাংকের একটি দল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশে আসবেন এবং এমাসের শেষে তারা ফিরে গিয়ে যে প্রতিবেদন জমা দেবেন তার ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করছে। বর্তমান পাকিস্তান সরকার ইতোমধ্যে অন্তঃত যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে, তা দ্বারা পর্যবেকদের সন্তুষ্ট হওয়া-না-হওয়ার অনেক মূল্য থাকবে। সত্যি কথা বলতে ইয়াহিয়াকে কোনো অর্থ নগদ প্রদান করার অর্থ হবে যুদ্ধকে আরো দীর্ঘস্থায়ী করা। যদি খাদ্যের সরবরাহ করা হয় তবে, পূর্ব-বাঙালিরা মনে করে, এটা প্রথমে দেয়া হবে সেনাবাহিনীকে, এবং বাকি যা থাকবে তা দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

ব্রিটেনের জন্য সমস্যা হলো কায়েমী স্বার্থের রাজনীতির সঙ্গে মানবীয় প্রতিশ্রুতিকে কীভাবে সমন্বয় করা যায়। প্রাথমিক ধারণা অনুসারে যাদের সবচেয়ে বেশি দরকার তাদেরকেই খাদ্য ও চিকিৎসার সরবরাহ দেয়ার মাধ্যমে এই সমন্বয়-সাধন সম্ভব হতে পারে। এখানে দু-টো সুযোগ রয়েছে। প্রথমত, ত্রাণকার্য যেন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়, এব্যাপারে আমাদের জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে এমন নজির আছে যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা এব্যাপারটায় বাধা প্রদান করবে। তবে এখানে সহজ একটা সমাধান আছে। উদ্বাস্তুশিবিরের পাঁচ বা ছয় মিলিয়ন লোককে খাওয়াতে ধনী দেশগুলো সরকারি অনুদান, জাতিসংঘ সংস্থাসমূহ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসমূহের সাহায্য নিতে পারে। ভারত একাই সব সামাল দিতে পারবে না। আরেকটি সম্ভাবনাও আছে। সীমান্ত অঞ্চলে, আরেকবার বিশেষভাবে বলছি, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বাঙালি সরকারের সমর্থকদের মাধ্যমেও সরবরাহের কাজটি করা যেতে পারে।

সূর্যের নিচে শুয়ে থাকা মৃতদেহগুলো শিগগীরই বর্ষার পানিতে তলিয়ে যাবে। বর্তমানের কলেরা মহামারীর পূর্বে পাঁচ লাখ মানুষ ইতোমধ্যে মারা গিয়েছে। পশ্চিমা সাহায্য নিয়ে ইয়াহিয়া কয়েক মাস আরো বেশি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবেন যতক্ষণ না প্রথম শরতে প্রত্যাশিত দুর্ভিক্ষ চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে। তিনি তার ৮০,০০০ সৈন্যের বাহিনীর জন্য নাছোড়বান্দার মতো সাহায্য চাচ্ছেন যারা এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে পদানত রাখার জন্য। তিনি এদের নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন আইয়ূব খানের পদচ্যুতির পর থেকেই, যিনি ছদ্ম বেসামরিক প্রশাসন গঠনের জন্য ফিরে এসেছেন। যদি কিছু নাও হয় ‘বাঙালিদের শিক্ষা দেয়া গেছে’ মনে করে একধরনের আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন। কিন্তু তাকে অনেক কিছু হারাতে হবে, সম্ভবত পশ্চিম পাকিস্তানকেই, যে দেশটিতে অনেক জাতি রয়েছে এবং বিভিন্ন উপাদান দিন দিন অস্থির হয়ে উঠেছে। এমনকি তার চীনা বন্ধুরাও তাকে সাহায্য করতে নাও পারে, স্যামসনের মতো, তার চারপাশেও মন্দিরের সব পিলার ধ্বংস হয়ে পড়বে।

ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রীরা কোনো কিছুতে সাম্রাজ্যবাদের গন্ধ থাকলে তা এড়িয়ে চলতে চায়, যা বোধগম্য কিন্ত বিপজ্জনক। কারো প্রকৃত প্রভাবকে অস্বীকার করে দায়িত্ব এড়ানো খুব সহজ। আমেরিকান বা আইএমএফ-এর সাহায্য-সরবরাহের সঙ্গে ব্রিটেনের সহায়তাকে খুব কমই তুলনা করা হয়। কিন্তু এরপরও ‘পাকিস্তান-জোটের’ ব্যাপারে আমাদের ভিন্ন মতামত রয়েছে। যদি আমরা ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র এবং সৈন্যদের জন্য মাখন কেনা বন্ধ করি, ফ্রান্স, ইটালি, হ্যান্ড, কানাডা ও পশ্চিম জার্মানির মতো অন্যান্য দেশগুলোও আমাদের মতোই পদক্ষেপ নেবে। ভারতীয় উপমহাদেশকে তারা বিশেষ ব্রিটিশ-ভাবনায় গুরুত্ব দেবে।

ইয়াহিয়াকে সাহায্য দিতে অস্বীকার করা নৈতিক ও ব্যবহারিক দিক থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত হবে। তাকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করা কেবল মানবীয় দুর্ভোগের ওপর সীমারোপই হবে না। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাবার সম্ভানাকে তা হ্রাস করবে, যে-যুদ্ধ হবে ভয়াবহ এবং আন্তর্জাতিক সমস্যা যা থেকে বেড়েই চলবে। যদি কোনো দেশ এখন ইয়াহিয়া খান ও তার অনুগত অনুসারীদের সাহায্য প্রদান করে তবে সে-দেশ গণহত্যায় অর্থ প্রদানের অভিযোগ এড়াতে পারবে না

ছবির কৃতজ্ঞতা: ম্যাগনাম ফটোস

ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা: সংকট উত্তরণের আভাস

দি টাইমস, ২০ মার্চ, ১৯৭১

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

করচি, মার্চ ১৯। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আজ ঢাকায় কয়েক দফায় আলোচনা শুরু করেছেন। দেশের সাংবিধানিক সংকটে তারা যে কট্টর অবস্থান নিয়েছিলেন, তা থেকে তারা কিছুটা নমনীয় হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে শেখের তিনজন উপদেষ্টা ড. কামাল হোসেন, মি. তাজউদ্দিন আহমদ ও মি. সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রেসিডেন্টর সহযোগীদের সঙ্গে আজ আলোচনায় বসবেন।

শেখ বলেছেন তিনি যখন আগামীকাল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আবার আলোচনায় বসবেন তখন তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের ছয়জন সহযোগী থাকবেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মনে হয়েছে, মঙ্গলবার আলোচনা শুরু করার পর থেকে তাকে যেকেনো সময়ের চেয়ে সবচেয়ে বেশি শান্ত মনে হয়েছে। এদিকে করাচিত গত রাতে পিপলস্ পার্টির মি. জেড. এইচ. ভুট্টো সতর্ক করে দিয়েছেন যে, যদি ‘ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ নিয়ে আপস করা হয়’ তবে তার দল পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্বের মতোই পশ্চিম পাকিস্তান অচল করে দেবে। এর আগে তিনি ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ও শেখের সঙ্গে আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন তার দল পুরো পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার ‘রক্ষাকর্তা’ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থ ধুলিসাৎ করে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নেবেন না। তিনি বলেন, ‘যদি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সামর্থ্য পরীক্ষা নেয়া হয়ে থাকে, তবে এবার পশ্চিম পাকিস্তানের শক্তি প্রদর্শনের পালা’। প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, তিনটি প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট মুজিবুরের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। প্রস্তাব তিনটি থেকে মনে হচ্ছে কোনো প্রস্তাবই পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

প্রথম প্রস্তাব অনুসারে উভয় অংশে প্রাদেশিক সরকারের হাতে মতা থাকবে এবং সেনাবাহিনী ততক্ষণ পর্যন্ত শাসন কার্যক্রম চালিয়ে যাবে যতক্ষণ না একটি সংবিধান প্রণীত হচ্ছে। শেখ এরকম কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান গ্রহণ করবেন না যাতে তার চূড়ান্ত স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থার কথা নেই। এই প্রস্তাবের বিকল্প হিসেবে ইয়াহিয়া উভয় অংশের নেতাদের কেন্দ্রে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার পরামর্শ দিয়েছেন যা একটি সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত সামরিক সরকারের তদারকিতে চলবে।

স্বায়ত্তশাসনের বিতর্ক এড়ানোর জন্য প্রেসিডেন্ট বলেছেন সংবিধান গঠন না হওয়া পর্যন্ত কোনো প্রাদেশিক সরকারও গঠিত হতে পারবে না। প্রেসিডেন্ট দুই নেতাকে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করতে বলেছেন, এবং তিনি উল্লেখ করেছেন, যদি তা করা হয় তবে প্রদেশে শিগগীরই মতা হস্তান্তর করা হবে। এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিত এটা মনে হবে যে নেতারা এই মুখ-রক্ষার ফর্মুলায় তারা লাফ দিয়ে অবতীর্ণ হবেন, কিন্তু সমস্যা হলো তারা প্রস্তাবগুলোকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছেন।

শেখ উল্লেখ করেছেন তিনি প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে পারেন তখনই যখন অন্যান্য পূর্বশর্ত মেনে নেয়া হবে। কিন্তু শেখ পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট দলগুলোর মধ্যে যারা তার দলের নীতিকে সমর্থন করেন তাদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার অনুরোধ জানাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হচ্ছে। অন্যভাবে বলা যায় সেখানে ভুট্টো এবং তার পিপলস্ পার্টির কোনো স্থান থাকবে না (৩১৩টি আসনের মধ্যে তার ৮৪টি আসন রয়েছে)। এই ধরনের আয়োজনে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের বিরোধী দলে থাকতে হবে। শেখকে তখন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান ও সিন্ধুর আঞ্চলিক দলগুলোকে নিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করতে হবে। এই ধরনের জোট-গঠন মি. ভুট্টো ও তার প্রদেশ পাঞ্জাবকে একাকী করে ফেলবে। এটা কোনো অবাক-করা কিছু নয় যে, মি. ভুট্টো এই প্রস্তাব মেনে নেন নি এবং উভয় অংশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ওপরে তিনি জোরারোপ করছেন।

ইয়াহিয়া মেশিনগান-প্রহরায় ঢাকায় উপস্থিত হয়েছেন

দি গার্ডিয়ান, ১৬ মার্চ, ১৯৭১

মার্টিন এডনে

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

ঢাকা, মার্চ ১৫। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাংবিধানিক সংকট সমাধানের জন্য আজ মেশিনগানসহ অর্ধ ডজন সামরিক ট্রাক পেছনে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন। দুই সপ্তাহ ধরে এই সংকটের কারণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান বস্তুত দুইটি পৃথক দেশ হিসেবে বিরাজ করছে। একজন মুখপাত্র জানান প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করবেন যার দল আওয়ামী লীগ পহেলা মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সেবাখাত ও অফিস চলবে কি চলবে না, তার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

তারা কয়েক প্লাটুন রাইফেলধারীর প্রহরাধীন প্রেসিডেন্ট-প্রাসাদে, নাকি দুই মাইল দূরবর্তী শেখ মুজিবের তিন তলার বাসভবনে আলোচনায় মিলিত হবেন তা এখনও নির্ধারিত হয় নি। শেখ মুজিবের এই বাসভবনে সাদা-পোশাক-পরা আওয়ামী লীগের কর্মীরা কোন সেবা চলবে এবং কোনটা চলবে না এসংক্রান্ত জরুরি প্রশ্নের উত্তর দেন। যদিও প্রেসিডেন্ট এবং শেখ মুজিব পরস্পর মিলিত হতে রাজি হয়েছেন কিন্তু বিষটি নিশ্চিত করা হয় নি। এই দুই বাসভবনের মধ্যবর্তী ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের তিনটি ফ্লোর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে — বলা হয়েছে ফ্লোরগুলো রঙ করার জন্যই এটা করা হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট এগুচ্ছেন স্বপ্রণোদিতভাবে। বিমান থেকে নামার পরে তিনি একটি কালো আমেরিকান গাড়িতে চড়ে ঢাকায় আসেন। তার আসার পথে প্রায় এক ব্যটেলিয়ান সৈন্য ব্রেনগানসহ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। গাঢ় রঙের স্যুট পরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গাড়ির পেছন সিটে বসা ছিলেন, বিমানবন্দর ত্যাগ করার সময় তিনি হাত নেড়ে অভিবাদন জানান। কিন্তু প্রেসিডেন্ট-ভবনে প্রধান সামরকি আইন প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা করার সময় তার হাতে ছিল না। কয়েক মিনিট পরে জেনারেল সাহেব রওয়ানা দেন।

প্রেসিডেন্টের আগমণে সপ্তাহখানেকের মধ্যে এটা পরিস্কার হয়ে যাবে কী সাংবিধানিক সমাধান হতে যাচ্ছে। ঢাকায় এক ধরনের স্বস্তি এসেছে এজন্য যে শেষ পর্যন্ত তিনি এলেন এবং অনেকে মনে করছিলেন বাংলার পরিস্থিতি আরও খারাপ হবার বিষয়টি তার অনুমোদনেই হচ্ছিল। বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের ওপরে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার মাধ্যমে গত সপ্তাহের শেষে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা কিছুটা কাটলেও আজ নতুন করে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে স্কুল, আদালত ও সরকারী অফিস বন্ধ থাকবে কিন্তু উপযোগী ও শিল্পসংক্রান্ত সংস্থাগুলো বিধিনিষেধের অধীনে চালু থাকবে।

সবাচাইতে দুঃশ্চিন্তার বিষয় হলো রফতানির অর্থ পূর্ব পাকিস্তানে আসছে না, ব্যাংকগুলো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নগদ অর্থ সংগ্রহ করতে পারছে না। ফলে রফতানি বন্ধ রয়েছে এবং দু’টি ব্যাংক ইতোমধ্যেই বিপদে পড়ে গেছে। একটি প্রচারণা-প্রত্যয় বাঙালিদের মধ্যে এভাবে কাজ করছে যে অনেক পশ্চিম পাকিস্তানী বিপুল অর্থ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার চেষ্টা করছে। জনগণকে তাদের সম্পত্তি কিনতে বারণ করা হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগের দাঙ্গা সাম্প্রদায়িক সংঘাতেও রূপ নেয় এবং এই বিষয়টি বারবার উল্লেখ করা বেসামরিক স্থিতিশীলতার জন্য কোনো শুভ প্রচেষ্টা নয়।

জঙ্গী ছাত্ররা আজ ঘোষণা দিয়েছে তারা আজ ‘বাংলাদেশ থেকে সম্পদ পাচার রোধ করা’-র জন্য চেকপোস্ট বসাবে। আজ দুপুরের পূর্বে বিমানবন্দরের একটি চেকপোস্টে একটি স্কুটারকে থামানো হয়। কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় একজন আরোহী একটি বন্দুক বের করে গুলি করে, একজন রিকশাচালক তাতে আহত হয় এবং আরোহী তার সহযোগীদের নিয়ে পালাতে উদ্যত হয়। তাকে ধাওয়া করা হয়, থামানো হয় এবং লাঠি ও ইটের সাহায্যে তাকে আঘাত করা হয়। এই গণপিটুনিতে ১,০০০ থেকে ২,০০০ জনের এক জনতাগোষ্ঠী অংশ নেয়। তাকে রক্তাক্ত ভূমিতে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে হয়। হাসপাতাল থেকে সরকারীভাবে জানানো হয় তারা দু-জন আহতকে ভর্তি করেছে। ঢাকা এই মুহূর্তে কতখানি উত্তপ্ত তার নিদর্শন হিসেবে এই ঘটনাকে ধরা যেতে পারে।

১০ দিন আগে দেয়া বেতার-ভাষণে ইয়াহিয়া যে প্রভুসুলভ মনোভাব প্রদর্শন করেছিলেন তা যদি এখনও বজায় রাখেন তবে সমাধান হবার সম্ভাবনা খুবই কম। আওয়ামী লীগের সদস্যরা বলাবলি করছে যে ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেই ফেলেছেন, কারণ সেখনে তিনি ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। বিগত কয়েক সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট যে-মনোভাব প্রদর্শন করেছেন তার চাইতে যথেষ্ট উদারতা, রাজনৈতিক সমঝোতা ও কৌশলের পরিচয় না দেখান এবং আজকের সেনামোতায়েনের বিপরীতে শেখ মুজিব যদি তার দলের চরমপন্থীদের শান্ত রাখতে না পারেন, তবে ঐতিহাসিক এক সংঘাত অনিবার্য হয়ে দেখা দিবে।

প্রান্তসীমায় টলমল

দি ইকোনমিস্ট, ১৩ মার্চ, ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

এই সপ্তাহের শুরুতে ঢাকার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবার সঙ্গে সঙ্গে এখানে অবস্থিত প্রবাসী নাগরিকেরা তাদের ব্যাগ গোছানো শুরু করে দিয়েছে। ব্রিটিশ সরকারসহ অন্য অনেক দেশ তার দেশের নাগরিকদের অতি প্রয়োজন ছাড়া পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছে। অনেকে মনে করছেন সামরিক শাসন পুনঃপ্রয়োগের ফলে সৃষ্ট দাঙ্গা বোধহয় শেষ হলো। কিন্তু বিদেশীরা মনে করছেন এই শান্ত অবস্থা হয়তো পরিস্থিতি আরও খারাপ হবারই পূর্বলক্ষণ।

এটা সত্যি যে গত রোববারে (৭ মার্চ) শেখ মুজিবের পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার যে ‘ঐতিহাসিক ঘোষণা’ দেবার কথা ছিল তা তিনি দেন নি। ইয়াহিয়া খান রোববার কঠোরভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যে তিনি বা তার সেনাবাহিনী এরকম কোনো ঘোষণাকে সহ্য করবে না, সম্ভবত সেই সতর্কবাণী তাকে ওরকম ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত রাখে। কিন্তু শেখ মুজিব এরপরই কাজের কাজটি করলেন। প্রেসিডেন্ট ২৫ মার্চে আইনসভার অধিবেশনের যে তারিখ ঘোষণা করেন, তার প্রত্যুত্তরে মুজিব জানান যে তিনি বা তার আওয়ামী লীগ অধিবেশনে যোগ দেবে না যদি না চারটি শর্ত মানা হয়। এরমধ্যে দু-টি শর্ত হলো যত দ্রুত সম্ভব সামরিক শাসন উঠিয়ে নিতে হবে এবং জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে — যে-শর্তগুলো প্রেসিডেন্টের মেনে নেয়া প্রায় অসম্ভব। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খুব শিগগীরই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবেন, এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এটাই হয়তো মুজিবের সঙ্গে তার শেষ আলোচনা।

পশ্চিম পাকিস্তানের মি. জুলফিকার আলি ভুট্টো অবশেষে কোনো রকম পূর্বশর্ত ছাড়াই যে ২৫ মার্চের অধিবেশনে বসতে রাজি হয়েছেন, এখন তার সামান্যই মূল্য রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসনের প্রভাব মুজিবকে একটি নতুন জমিনে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। এমনকি তিনি অপেক্ষাকৃত ধীরে ধীরে সামনে এগুচ্ছেন বলতে হবে, তার আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে যেসব চরমপন্থী লোক রয়েছেন তারা শনিবার রাতে স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব আপাতভাবে আট ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন তাদের এটা বোঝাতে যে, প্রেসিডেন্ট নতুন তারিখের যে-প্রস্তাব দিয়েছেন তার তা গ্রহণ করা উচিত, কিন্তু তিনি অবশ্যই সেক্ষেত্রে শক্ত শর্ত দেবেন।

ঢাকার মতোই কিছু পদক্ষেপ অন্যান্য শহর থেকে এসেছে — কিন্তু এতে সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই। তারা ঢাকা ও অন্যান্য শহর পরিচালনার দায়িত্ব একরকম মুজিবের হাতেই যেন ছেড়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা ছয় দফার প্রতীক ছয়টি রূপালি তকমা-বিশিষ্ট সবুজ টুপি পরে ‘শান্তি রক্ষা’-র কাজ করছে যা পুলিশের চেয়েও ভালো কাজে দিচ্ছে। গত সপ্তাহে পাঁচ দিনের সর্বাত্মক ধর্মঘট মুজিবের জন্য বিরাট সাফল্য ছিল। রোববারে তিনি এ সপ্তাহের প্রতিরোধ-কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির মধ্যে আছে রাজস্ব প্রদান না করা, সরকারী অফিস-আদালত-স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা এবং সব ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করা। তিনি হুমকি দেন যে নতুন সর্বাত্মক ধর্মঘটের মাধ্যমে তিনি এই কর্মসূচিকে সম্প্রসারিত করবেন।

এখন পর্যন্তও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসনের কল্পব্যবস্থা বজায় রাখতে চান। যাত্রীপরিবাহী বিমানগুলোর মাধ্যমে তিনি ঢাকায় সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে চলেছেন এবং ট্যাংকগুলোতে চাকা লাগিয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে রাজপথে লড়াই করার জন্য। কিন্তু জনগণ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তা থেকে এটা বোঝা কঠিন যে শেখ মুজিব কীভাবে অহিংস নীতি কার্যকর করবেন। প্রেসিডেন্টের জন্য বাস্তবানুগ ভাবনা এটা হতে পারে যে এই মুহূর্তেই শেখ মুজিবের সঙ্গে একটি রফা করে ফেলা, কারণ কেবল তিনিই স্বাধীনতার ঘোষণাকে আটকে রেখেছেন।

তাহলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কী মেনে নেবেন? আইনসভা অধিবেশনে যোগ দেবার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের বেঁধে দেয়া চারটি শর্তের মধ্যে দু-টি সহজেই মেনে নেয়া যায়। সেগুলো হলো সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে আনা এবং গত সপ্তাহের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্ত করা। সেনাবাহিনী ব্যারাকে থেকেও এখন যে কাজ করছে তা চালিয়ে নিতে পারবে এবং তদন্তের ফলাফল হয়তো তাদের জন্য খুব খারাপ কিছু হবে না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো সরকারীভাবে সামরিক শাসন উঠিয়ে নেয়া এবং নির্বাচিত বেসামরিক প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। সামরিক শাসন পুরোপুরি ওঠানো সম্ভব নয় যতক্ষণ না তার বিকল্প কিছু দাঁড়াচ্ছে এবং যতক্ষণ না কোনো প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড়াচ্ছে, বেসামরিক সরকার ততক্ষণ পর্যন্ত প্রশাসন চালাতে পারবে না। কিন্তু এই কাজটা আইনসভা অধিবেশন না বসা পর্যন্ত প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। যত দ্রুত অধিবেশন বসবে তত দ্রুত এই কাজটা সমাধা করা যায়।

এর ফলে নতুন আইনসভা সার্বভৌম একটি প্রতিষ্ঠান হবে এবং নতুন সংবিধানে প্রেসিডেন্টের ভেটো দেবার মতা বিলোপ করবে; কিন্তু সেই ক্ষমতা ইতোমধ্যে অকার্যকর হয়ে পড়েছে কারণ শেখ মুজিব খুব সহজেই এমনকি সামরিক শাসনকে উপেক্ষা করতে পারেন। পূর্ব পাকিস্তানের ছয় দফা পরিকল্পনা তখন নতুন সংবিধানে প্রায় নিশ্চিতভাবেই লিখিত হবে। এই ধরনের শিথিল ফেডারেশন — যেমন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মনে করেন — পাকিস্তানের সমাপ্তি ঘটাবে; কিন্তু একমাত্র বাস্তবানুগ বিকল্প হলে পুরোপুরি বিচ্ছিন্নতা। যদি প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে বলপূর্বক দমনপ্রক্রিয়া চালান তবে তাতে সফল হবার সামান্যই সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তার জাতির উদ্দেশ্যে শনিবারে দেয়া ভাষণে তিনি সেই পথেই যাবেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি যদি তা করেন তবে এই কমনওয়েলথভুক্ত দেশটিতে নতুন একটি গৃহযুদ্ধের সূচনা হবে যা বিশেষত ব্রিটেনের জন্য সমস্যাজনক হয়ে দেখা দেবে। পাকিস্তানের সঙ্গে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক অন্য খাতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

বায়াফ্রার যুদ্ধে ব্রিটেন নাইজেরিয়ার সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল যেগুলো বিচ্ছিন্নতবাদীদের নির্মূল করতে ব্যবহৃত হয়েছিল। পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধকে কেন ব্রিটেনের ভিন্নভাবে দেখা উচিত তার কারণ রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান এমন এলাকা যার সীমান্ত ইতোমধ্যে রয়েছে। বায়াফ্রার জন্য দাবিকৃত ভূখণ্ডে জেনারেল ওজুকুর যে-সমর্থন ছিল শেখ মুজিবের তার চাইতে অনেক বেশি সমর্থন রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের ৭০ মিলিয়ন বাঙালিরা কেবল পশ্চিম পাকিস্তানীদের থেকে সাংস্কৃতিকভাবেই আলাদা নয়, তারা কেবল আত্মসচেতন ও দৃঢ়চেতা জাতি হিসেবেই বিকাশ লাভ করে নি, পাকিস্তানের পুরো জনগোষ্ঠীর মধ্যে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কোনো ব্রিটিশ সরকারেরই উচিত হবে না, পাকিস্তানের সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়া — আর ব্রিটেন পাকিস্তানের মূল অস্ত্রসরবরাহকারীও নয়।

মুজিব ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি

দি গার্ডিয়ান, ১৩ মার্চ, ১৯৭১

মার্টিন এডনে

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

ঢাকা, মার্চ ১২। শেখ মুজিব আজ ঘোষণা দিয়েছেন যে পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে একবার ও শেষবারের মতো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক। যে-দলটি পূর্ব বাংলার সত্যিকারের সরকার হিসেবে কাজ করছে সেই আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব আমাকে বললেন: ‘আমি ব্যাপারটা সমাধা করতে আলোচনায় বসতে রাজি আছি। আমি যা বলেছি, পষ্ট করেই বলেছি। আমার নাগরিকেরা স্বাধীন নাগরিক হিসেবে একটি স্বাধীন দেশে বাস করতে চায়।’ ব্যাপারগুলো বিস্তারিতভাবে জানতে চাইলে, যেমন প্রতিরক্ষা বাজেটের ব্যাপারটা — যা আলোচনার একটি বিষয় হতে যাচ্ছে, তিনি বলেন: ‘দ্বিধাগ্রস্ত হবার আর কোনো সুযোগ নেই, আমি আমার জনগণের রক্তের বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।’ তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে চান কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন: ‘তারা যদি আমাদের অংশ হিসেবে থাকতে বলে, তবে ভাইয়ের মতো একসঙ্গে থাকাই ভালো হবে।’

মুজিব বাঙালিদের ঐক্যের কথা জোর দিয়ে বলেন — যে-ঐক্য গত সপ্তাহজুড়ে প্রদর্শিত হয়েছে। তিনি দাবি করেন তাদের মগ্নতা ও নিয়মানুবর্তিতা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে তাদের সাহায্য করবে। তিনি অভিযোগ করেন পূর্ব বাংলার সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে উপনিবেশের মতো ব্যবহার করা হয়েছে। সৌদি আরব ও চেকাস্লাভিকিয়া থেকে পাঠানো হেলিকপ্টার বাঙালিরা কখনো দেখে নি। বন্যা নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক সহায়তার সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ ‘রাতদিন কাজ করেছে এমনকি কোনো খাবার ছাড়াই’ এবং তিনি যদি বলেন তো ছাত্ররাও মাঠ পর্যায়ে যাবে। তিনি বলেন: ‘আমরা একটি নিয়মানুবর্তী জাতি; আপনি কি তা লক্ষ করেন নি?’

তিনি জোরারোপ করেন যে যদি রোববারের জনসভায় সেনাবাহিনী তাদের বিপে নামতো তবে জনগণ তা প্রতিহত করতে প্রস্তুত ছিল। ‘আমাদের জনগণ মৃত্যুকে বরণ করে নেবে। তারা প্রতিদিন ঘুর্ণিঝড়ে, বন্যায়, কলেরায়, অনাহারে মারা যায়। আমরা আরেক বার মরবো এবং সবার জন্য মরবো।’ পূর্ব পাকিস্তানের মর্যাদা যদি পরিবর্তিত হয় তবে তার পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তার উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানান, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বমতের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি স্পষ্টতই সচেতন।

পাকিস্তানের অখণ্ডতা রায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধাবস্থান নেয়া ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ছাপা হওয়া একটি প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য অংশ এখানকার একটি পত্রিকায় গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়েছে। এখানকার অর্থনীতি সংকটে পতিত হবার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ বাণিজ্যিক বিনিময়ের ওপরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা খানিকটা শিথিল করেছে। দীর্ঘণ ব্যাংক খোলা রাখা অনুমোদন করা হয়েছে, অর্থ বিনিময় ও মাল খালাসের সীমা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পণ্য পরিবহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের জন্য সপ্তাহে ১০,০০০ রুপি পর্যন্ত অর্থ গ্রহণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বন্দর কর্তৃপকে সব ধরনের কাজ চালিয়ে যাবার জন্য বলা হয়েছে। শিল্পোন্নয়ন কর্পোরেশনের কারখানাগুলো চালু হয়েছে এবং কৃষিজ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কাজ চালিয়ে যাবার জন্য বলা হয়েছে।

রয়টার্স-এর সংযুক্তি: প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আজ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকার পথে করাচিতে আসছেন। প্রেসিডেন্ট তার যাত্রা গোপন রেখেছেন। ওদিকে ঢাকার ১৭২ মাইল পশ্চিমে একটি জেলখানায় দাঙ্গা বেধে গেলে রীদের গুলিতে দু-জন বন্দি মারা গেছে এবং ২২ জন আহত হয়েছে। লোহার রড ও অন্য অস্ত্রের আঘাতে ৩০ জন পুলিশও আহত হয়েছে। গতকাল রাতে বরিশাল জেলে ২০০ জন বন্দি রীদের ওপরে চড়াও হলে দাঙ্গা বেধে যায়। পুলিশ বলেছে বন্দিদের জেলখানার মূল গেট ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু তাদের মধ্য থেকে ২২ জন জেলখানার উঁচু দেয়াল অতিক্রম করে পালিয়েছে। বর্তমান আন্দোলন চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের জেলখানা থেকে প্রায় ৩৮৫ জন বন্দি পালিয়েছে।