Tag Archives: জয় বাংলা

হিংস্রতা ও গোঁড়ামির শাসন

দি সানডে টাইমস, ১১ জুলাই, ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

[পাঁচ সপ্তাহ আগে সানডে টাইমসে প্রকাশিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে কী নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছিল। আজকের রিপোর্টে পাওয়া যাবে আক্রান্ত দেশটিতে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’-র নামে সেনাবাহিনীর নির্মম অভিযানের চিত্র।]

গত সপ্তাহে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বারবার বলেছে ‘বিদ্রোহী ও দুষ্কৃতিকারী’-দের বিরুদ্ধে দীর্ঘ অভিযানের পর দেশটিতে ‘স্বাভাবিকতা’ ফিরে এসেছে এবং উদ্বাস্তুরা এখন ভারত থেকে দেশে ফিরে আসতে পারে এবং স্বাভাবিত জীবনযাপন শুরু করতে পারে। ব্যাপকভাবে উদ্বাস্তুরা পালিয়ে গেছে এরকম একটি এলাকা আমি গত সপ্তাহে পরিদর্শন করেছি এবং দেখেছি কথাটি সত্য নয়; বরং ধীরে ধীরে এমন একটি প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে যে তাদের ফিরে আসার সুযোগ আরও কমে যাবে।

যদি কোনো উদ্বাস্তু ঘরে ফিরে যায় তবে সে এমন দৃশ্য দেখবে, যেমন আমি দেখলাম লোটাপাহাড়পুর গ্রামে। এলাকাটি জুড়ে ছনের ছাউনি দেয়া মাটির ঘর। খুলনা থেকে ছয় মাইল উত্তরে অবস্থিত জায়গাটি পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় নদীবন্দর। লোটাপাহাড়পুর যশোর থেকে খুলনামুখী প্রধান সড়কপথের ধারে অবস্থিত। গত সপ্তাহে রাস্তাটি সেনাবাহিনীর সদস্যদের আসা-যাওয়ায় সন্ত্রস্ত হয়ে ছিল। আমেরিকান ট্রাকে বসে থাকা সৈনদের হাতে চীনা অটোমেটিক রাইফেল। আমি সদর রাস্তা থেকে একটি পার্শরাস্তা ধরে যাচ্ছিলাম। ফসলী জমির ফাঁকে ফাঁকে জলাশয়গুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন সবুজ-রূপালি রঙে ছককাটা দাবার বোর্ড।

এখানে সেখানে এক-দু’জন কৃষক গরু বা মহিষের সাহায্যে জমি চাষ করছে; কিন্তু এরকম জনবহুল একটি দেশে এরকম দৃশ্য খুব কমই দেখা গেছে। এরপর আমি লোটাপাহাড়পুরে পৌঁছাই। দু’পাশে তালগাছের সারি রেখে কর্দমাক্ত রাস্তা ধরে আমি এগুচ্ছিলাম। গ্রামটি আর দশটা পূর্ব পাকিস্তানী গ্রামের মতোই। বন্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য বাড়িগুলো সমতল থেকে একটু উঁচুতে নির্মিত। কিন্তু লুঙিপরা কোনো পুরুষমানুষ, উজ্জ্বল শাড়ি পরা কোনো মহিলা, কলাবাগানের মধ্য দিয়ে ছুটোছুটি করা দুরন্ত শিশু বা ছুটন্ত কুকুরকে দেখা গেল না।

আমি পূর্ব বাংলার অনেক গ্রাম দেখেছি যেগুলোকে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বা যেগুলোতে খুবই কম মানুষ রয়েছে। এই প্রথম আমি একটা গ্রাম দেখলাম যেটা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি কিন্তু জনমানবশূন্য বলে মনে হলো। দোভাষীর সাহায্যে আমি আশেপাশে দেখলাম। হাতিমুখো দেবতা গণেশের একটা রঙীন ছবি দেখতে পেলাম। তার মানে গ্রামটা হিন্দুদের। কিন্তু গ্রামবাসীরা কেন চলে গেছে? খালি বাড়িগুলোতে এর কোনো সূত্র পাওয়া গেল না। এরপর ভয়ার্ত চোখে ছেঁড়া শাড়ি পরা এক মহিলা এগিয়ে এল। তার সঙ্গে তিন বাচ্চা-কাচ্চা। সে আসলে একজন মুসলমান এবং উদ্বাস্তু। তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। পালাতে পালাতে সে এই উজাড়-হয়ে-যাওয়া গ্রাম খুঁজে পেয়েছে, যেমন আমরা হঠাৎ খুঁজে পেয়েছি। হিন্দুদের ফেলে যাওয়া চাল খেয়ে সে বেঁচে আছে। কিন্তু সে-চালও ফুরিয়ে গেছে এবং বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য তার আর কোনো বুদ্ধিই কাজ করছে না। সে কর্তৃপক্ষের কাছে যেতে চায় না কারণ, তারা হয়তো জেনে যাবে তার স্বামী ‘জয় বাংলা’ ছিল। ‘জয় বাংলা’ হলো নিষিদ্ধ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের স্লোগান।

এরপর আরও মানুষের সঙ্গে দেখা হলো। এখান থেকে কয়েকশ’ গজ দূরের আরামডাঙা গ্রামের মুসলমান কৃষকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। তারা যে কাহিনী শোনাল তা গত সপ্তাহে শোনা আরও অনেক কাহিনীর মতোই। আলী হামিদ ও শওকত নামের দুজন একই ঢেউটিনের মালিকানা দাবি করছে। এপ্রিলের কোনো এক সময়ে হামিদ দুই ট্রাক ভর্তি পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যের সহযাত্রী হয়ে গ্রামে ফিরে এসেছিল। সৈন্য ও গ্রামবাসীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। সৈন্যরা গুলি ছোঁড়ে এবং ছয়জন গ্রামবাসী মারা যায়। মৃতদের দু-জন ছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলের সদস্য: একজন হলেন কৃষক ইন্দু বাবু এবং অন্যজন তার আত্মীয় স্কুলের হেডমাস্টার প্রফুল্ল বাবু। দু-জনই হিন্দু। সেনাবাহিনী চলে যাবার পরপরই গ্রামের বাকি ১৫০ জন হিন্দু পালিয়ে যায়।

আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম কেন তারা আমাকে এই কাহিনী বলছে? তারা বললো আমি কাহিনীর শেষ অংশ তখনও শুনতে বাকি। কী হচ্ছে তা জানতে গ্রামের ক-জন মুসলমান এগিয়ে আসে। সৈন্যরা তাদের চারজনকে পাকড়াও করে এবং কোরান থেকে কিছু আবৃত্তি করতে তাদের বলে। চার মুসলমান ভয়ে কাতর হয়ে কেবল শুরু করতে পারে “বিসমিল্লাহ হির রহমানুর রাহিম …”। সৈন্যরা চিৎকার করে ওঠে, “এরা মুসলমান নয়! আমাদের ফাঁকি দেবার জন্য এরা এসব শিখে রেখেছে!” এরপর তারা চারজনকেই গুলি করে হত্যা করে। গ্রামবাসীরা আমাকে জানালো হিন্দু প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাদের কোনো সমস্যা না থাকাই হলো তাদের অপরাধ। ঢেউটিনের মালিকানা এখন হামিদের। সে এখন রাইফেল হাতে ঘোরে এবং গ্রামবাসী মনে করে সে একজন রাজাকার।

“তারা সবাই আমাদের কাছে সমান”

হিন্দুদের এলাকায় কী ঘটেছিল? গ্রামবাসীরা চারিদিকের শ্যামল ক্ষেতের দিকে নির্দেশ করে। সেগুলো ছিল দামি ফসল তিসির জমি। জুন মাসে সামরিক কর্তৃপক্ষের কয়েকেজন লোক প্রকৃত মালিকের অনুপস্থিতিতে ২০০০ একর জমির নিলাম ডাকে। এর প্রকৃত দাম একর প্রতি ৩০০ রুপি। কিন্তু সেগুলো বিক্রি হয় একর প্রতি মাত্র দেড় রুপিতে। আর ক্রেতাদের দরদাম করার আর সুযোগ ছিল না। ফসল ফলানোর জন্য তারা লোকজন নিয়োগ দিতে না দিতেই এর বেশিরভাগটা বন্যার পানিতে ডুবে যায়।

লোটাপাহাড়পুর উদ্বাস্তুদের সম্মন্ধে একটি পরিস্কার চিত্র তুলে ধরে। এখানে কেউই তাদের ফিরে আসার কথা ভাবছে না। কারণ পূর্ব পাকিস্তানে এখনও ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে; কারণ ফিরে আসার সত্যিকার বাধাগুলো এখনও দূর হয়নি। তাদের ঘর-বাড়ি, জমিজমা, ফসল, ক্ষুদ্র ব্যবসা এবং অন্যান্য সম্পদগুলো আইনগতভাবে অন্যদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তুলে দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় শত্র“দের হাতে যারা চায়ই না ওরা ফিরে আসুক। অবশ্য সামরিক কর্তৃপক্ষ ঠিকই ‘অভ্যর্থনা-কেন্দ্র’ ও ‘ট্রানজিট ক্যাম্প’ খুলে বসে আছে।

আমি ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি বেনাপোলে গেলাম এইসব প্রস্তুতি দেখতে। পুরো খুলনা এলাকার অফিসার ইন-চার্জ লে. কর্নেল শামস্-উজ-জামান সীমান্তের নিকটবর্তী তার সদর দফতরে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। কর্নেল জামান আমাকে বললেন সীমান্তে বহুবার ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে মর্টারের গোলা বিনিময় হয়েছে। তিনি জানান সবসময়ই ভারতীয়রা ব্যাপারটা শুরু করে। তিনি বলেন, “এদের রক্ষা করার জন্য এখানে অবশ্যই আমাদের থাকা প্রয়োজন। এই বাঙালিরা জানেনা কীভাবে লড়াই করতে হয়। এক পর্যায়ে আমি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে আসলাম। আমাদের দেহে রয়েছে যুদ্ধের রক্ত। ক্লাস টেন থেকেই আমি এই রাইফেল ব্যবহার করে আসছি। আমাদের সাহস আছে।” কর্নেল শামস্ আমাকে জানালেন ২৫-২৯ মার্চে খুলনা শহরের ‘নিরাপত্তা’র জন্য যে সামরিক অভিযান শুরু হয়েছিল তার পর থেকেই বিগত তিন মাস ধরে এখানে সৈন্যদের তৎপরতা চলছে। তিনি আমাকে জানালেন যে ‘দুষ্কৃতিকারী ও বিদ্রোহী’-দের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে কেবল এই গত মাসে সৈন্যরা পুরো জেলাকে নিজেদের আয়ত্ত্বে আনতে সক্ষম হয়েছে। মনে হয় শামসই বেসামরিক রাজাকার-দের হাতে পুলিশদের রাইফেল তুলে দেয়ার ব্যবস্থা চালু করেছেন। তিনি এদের সম্পর্কে বললেন, “এরা ভালো লোক, ভালো মুসলমান ও অনুগত পাকিস্তানি।”

সামরিক কর্তৃপক্ষের হিসেব মতে পূর্ব পাকিস্তানে এখন ৫,০০০ রাজাকার রয়েছে যাদের মধ্যে ৩০০ জনই খুলনা অঞ্চলের। তারা প্রতি দিনে সাত রুপি করে মাইনে পাচ্ছে। তাদের সাত দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যার পুরোটা জুড়ে থাকে পুলিশি লি-এনফিল্ড রাইফেলের মাধ্যমে কীভাবে গুলি করতে হয়, তা শেখানো। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বাড়ি চিনিয়ে দিয়ে সৈন্যদের ‘নিরাপত্তা পরিদর্শন’-এ সাহায্য করা। স্থানীয় ‘শান্তি কমিটি’র অধীনে তারা পরিচালিত। এই শান্তি কমিটিও গঠিত হয়েছে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে। এই লোকগুলো হলো বিগত নির্বাচনে অংশ নেয়া কট্টর ও মুসলমানদের দলের সদস্য যারা মনে করে অস্ত্র দ্বারা হলেও তাদের ধর্ম রক্ষা করতে হবে। এরা নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত এবং এরা অনেকটা অরেঞ্জ লজ, ‘বি স্পেশালস্’ ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের মতো। খুলনা জেলার নির্বাচনী ফলাফল নির্দেশ করে এই শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের অস্ত্রবিবর্জিত রাজনৈতিক ভিত্তি কতটা দুর্বল; বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ খুলনা জেলার আটটি আসনের সবগুলো ও মোট ভোটের শতকরা ৭৫ ভাগ পায়। মুসলিম লীগের তিন অংশ মোট ৩ থেকে ৪ ভাগ এবং মৌলবাদী দল জামাত-ই-ইসলামী ৬ ভাগ আসন পায়। আমি শামস্কে জিজ্ঞেস করলাম তার লোকজন যখন মেশিনগান নিয়ে রাস্তা দখল করে বসে আছে তখন তিনি কীভাবে আসা করেন যে উদ্বাস্তুরা বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ফিরে আসবে? (বেনাপোল হলো কলকাতা থেকে ঢাকাগামী প্রধান সড়ক এবং এই সীমান্তের ওপারেই পশ্চিমবঙ্গে বড়ো বড়ো কয়েকটি উদ্বাস্ত শিবির রয়েছে) তিনি বললেন, সীমান্ত এলাকার নদী বা ধানী জমির ‘অননুমোদিত পথ’ দিয়ে আসতেও তাদের কোনো বাধা নেই। ‘দুষ্কৃতিকারী, বিদ্রোহী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী’রাও ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না, কারণ তিনি সার্বক্ষণিক টহলের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বললেন, “তাদের আসতে দিন, আমরা তাদের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছি।” আমি অবশ্য স্পষ্টভাবে বুঝলাম না তিনি কাদের জন্য অপেক্ষা করছেন, উদ্বাস্তু না ভারতীয় সৈন্য।

কর্নেল শামস্ তার এক ক্যাপ্টেন অফিসারকে আমার সঙ্গে দিয়ে দিলেন। আমি সীমান্ত থেকে এক মাইল দূরে বেনাপোল উদ্বাস্তু অভ্যর্থনা কেন্দ্রে ফিরে এলাম। মোটা গোঁফওয়ালা ক্যাপ্টেন আমাকে জানালেন, “এখানে আমাদের একটা সমস্যা আছে।” পানিতে ডুবে থাকা বর্ষাতি মাথায় দেয়া বাঙালি কৃষকদের দেখিয়ে তিনি বললেন, “ওদের দেখেন। ওরা সবাইকে আমাদের কাছে একইরকম লাগে। কীভাবে বুঝবো যে ওরা দুষ্কৃতিকারী নয়, সাধারণ মানুষ?” বেনাপোল অভ্যর্থনা কেন্দ্রে কেবল পাঁচটি নিরাশ্রয় কুকুর ছাড়া আর কাউকে দেখা গেল না।

ক্যাপ্টেন জানালেন সীমান্তের খুব কাছাকাছি হবার কারণে হয়তো কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনি আমাকে সাতক্ষীরার দিকে আরেকটি অভ্যর্থনা কেন্দ্রের কথা শোনালেন। আমি সাতক্ষীরার দিকে গাড়ি চালালাম এবং সেখানে পৌঁছে ১৩ জন উদ্বাস্তুকে পাওয়া গেল। তাদের মধ্যে ৩ জন হিন্দু। ক্যাম্পের ভর্তি বোর্ড-এ গমন ও আগমনের হিসেব লেখা ছিল। আমি যখন ঘুরে-ফিরে দেখছিলাম আমি দু’জন রাজাকারের কাছ থেকে দু’বার মিলিটারি কায়দায় দেয়া স্যালুট পেলাম। তারা বয়সে তরুণ, তাদের হাতে শটগান ছিল। আমাকে বলা হলো তারা এখানে ক্যাম্পটি পাহারা দেবার জন্য নিযুক্ত আছে (কার ভয়ে এই পাহারা? দুষ্কৃতিকারী, বিদ্রোহীদের ভয়ে?)। তারা নিরাপত্তা পরিদর্শনের কাজেও সাহায্য করছে। ক্যাম্পের দায়িত্বে নিযুক্তদের (সাধারণ বাঙালি মিউনিসিপ্যাল কর্মচারী, যাদের আন্তরিকতাকে মেনে নেয়া যায়) আমি জিজ্ঞেস করলাম অজানা সশস্ত্র লোকজন ফিরে আসা উদ্বাস্তুদের রাজনৈতিক মতাদর্শ জিজ্ঞেস করছে কিনা, যেক্ষেত্রে আরও ১০০ জন উদ্বাস্তু আসার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

লোকগুলোর পরনে ছিল ভালো পোশাক এবং তাদের খাবারদাবারের কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হলো না। তারা সবাই ভারতীয় সীমান্তের ওপাশেই হাসনাবাদ থেকে একই দিনে, একসঙ্গে এসেছে। তারা সেখানে গিয়েও ছিল একই সময়ে এবং ২২ দিন থাকার পর তারা একসঙ্গে ফিরে এসেছে। তাদের কেউই ভারতীয় রেশন কার্ড সংগ্রহ করতে সমর্থ হয় নি। আমি ২,০০০ লোকের জন্য স্কুলঘর ও পাশের বিল্ডিং মিলে তৈরী ক্যাম্পের দায়িত্বে নিযুক্ত লোকদের জিজ্ঞেস করলাম যে-লোকগুলো প্রকৃত অর্থে ভারতীয় সীমান্তের ওপাশে উদ্বাস্তু হিসেবে থাকে নি, তারা এখানে সাহায্য পাবার যোগ্য কিনা। তারা বলল, না।

সাতক্ষীরা থেকে আমি জেলাসদর খুলনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। যাবার পথে আমি একটা সেতু দেখতে পেলাম যেটি কোনোমতে পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। দশ দিন আগে এক চোরাগুপ্তা হামলায় এটা বিধ্বস্ত হয়েছিল। অনুমান করা হচ্ছে মুক্তিফৌজ একাজ করেছে যারা আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে বলা শোনা যাচ্ছে। স্থানীয় লোকজন আমাকে জানালো, শুনে ভালোই লাগলো, ২৫ জন রাজাকার ব্রিজটির পাহারা দিচ্ছিল, কিন্তু প্রথম গুলির আওয়াজেই তারা পালিয়ে যায়। পরে রাজাকার হাই কমান্ডের সঙ্গে দেখা হলো তাকে এবিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু তিনি তা অস্বীকার করেন।

গত আদমশুমারির হিসেবে পুরো জেলায় লোকসংখ্যার পরিমাণ ৩০ লাখ। এরমধ্যে চার ভাগের এক ভাগ হয় নিখোঁজ, মৃত অথবা ভারতে পালিয়ে গেছে। স্থানীয় বেসামরিক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে জেলার অর্ধেক জমি চাষ করা হয়নি। ঢাকায় ইস্যুকৃত সরকারী আদেশ মোতাবেক শান্তিকমিটি কর্তৃক নির্বাচিত ‘তত্ত্বাবধায়ক’-দের হাতে পরিত্যক্ত জমি, দোকান-পাট ও সম্পত্তি তুলে দেয়া হবে। বেসামরিক প্রশাসনের সাধারণ কাজকর্ম বন্ধ হয়ে আছে। খুলনা যখন ‘নিরাপদ’ ছিল তখন থেকেই সিনিয়র হিন্দু ম্যাজিস্ট্রেট রাজেন্দ্র লাল সরকার নিখোঁজ রয়েছেন। অনুমান করা যায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। সিনিয়র মুসলমান ম্যাজিস্ট্রেট চৌধুরী সানোয়ার আলীকে সেনাবাহিনী গ্রেফতার করেছে। তিনি এখন কোথায় আছে কেই বলতে পারে না। পুলিশ সুপার আব্দুল আকিব খন্দকাকে বদলি করা হয়েছে এবং ডিসি নূরুল ইসলাম খানকে বদলি করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে।

পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনে চেয়ারবদলের যে খেলা চলে এ-হলো তারই অংশ। উল্লিখিত বাঙালি অফিসারদের খুব দ্রুততার সঙ্গে পরিবর্তন করা হয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিযুক্ত ৩০০ কেরানির মধ্যে ৬৬ জন ছিল হিন্দু। তাদের মধ্যে কেবল দু-জন এপর্যন্ত টিঁকে আছেন; বাকিরা যদি বেঁচে থাকেনও স্বংক্রিয়ভাবে কর্মচ্যুত করা হয়েছে। আমি অনেক জায়গায় শুনলাম যে সংখ্যালঘু হিন্দুদের চাকরি দেবার সময় ‘কঠোর নিরাপত্তাজনিত বাছাই’ করা হয়ে থাকে এবং কালো তালিকা অনুসরণ করা হয়।

খুলনায় নৌবাহিনীর আক্রমণ

সরকারীভাবে ব্যাপারটা অস্বীকার করা হয়েছে। যাহোক গত ফেব্র“য়ারিতে একজন হিন্দু তরুণ অরবিন্দ সেন খুলনা প্রশাসনের একটি কেরানিপদের চাকরির জন্য ৬০০ জন প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে মৌখিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। গত সপ্তাহ পর্যন্ত সে বেকার ছিল, যদিও প্রশাসনে লোকবলের খুবই অভাব। খুলনা বেসামরিক প্রশাসনের কাজকর্ম খুবই ব্যাঘাত ঘটছিল কারণ সামরিকবাহিনীর লোকজন তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের জিনিস চেয়ে খবর পাঠাচ্ছিল। জেলা প্রশাসনের লঞ্চগুলো তারা খাদ্য বিতরণ, বন্যানিয়ন্ত্রণ এবং একই ধরনের কাজকর্মে ব্যবহার করতো (জেলার অর্ধেক জায়গায় পৌঁছতে জলপথ ব্যবহার করতে হয়)। কিন্তু সেনাবাহিনী লঞ্চগুলোতে এখন ৫০টি মেশিনগান স্থাপন করে নদীপথে টহল দিচ্ছে এবং ‘দুষ্কৃতিকারী’-দের খুঁজে বেড়াচ্ছে। বেসামরিক প্রশাসন জরুরি ভিত্তিতে লঞ্চগুলো ফিরে পেতে চাচ্ছে অথবা নতুন লঞ্চ খুঁজছে। কারণ তারা আশংকাজনক রিপোর্ট পেয়েছে যে কৃষকরা তাদের নিচু জমিকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় নিচু বাঁধ নির্মাণ করতে পারে নি। এখন লোনা পানি যদি এই জমিগুলোকে প্লাবিত করে তবে অনেক বছরের জন্য জমিগুলো চাষের অনুপযুক্ত হয়ে যাবে।

শহরের মাঝে পাকিস্তান নৌবাহিনীর একটি গানবোট পাকিস্তান রিভার সার্ভিসের একটি টাগবোটকে গোলার আঘাতে ডুবিয়ে দেয়। স্থানীয় নৌবাহিনীর প্রধান আলহাজ্জ্ব গুল জারিন আমাকে বলেন যে টাগবোটটিকে ডুবিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না, কারণ দুষ্কৃতিকারীরা এটা দখল করে ফেলেছিল এবং নৌবাহিনীর একটি জাহাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্যোগ নিচ্ছিল। স্থানীয় মাঝিরা বলল সাধারণ একজন ক্রু টাগবোটটিতে ছিল এবং পাল্টা জবাব দেবার কোনো সুযোগ সে পায় নি, ভীষণ শব্দ করে বোটটি নৌঘাঁটি থেকে আসছিল।

স্থানীয় শান্তি কমিটি ও রাজাকার হাই কমান্ড ‘স্বাভাবিকতা’ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সফল হয়েছে এমন কোনো নিদর্শনই পাওয়া যায় নি। গত মাসে এদের দু-জন সদস্য জেলা কাউন্সিলের ভাইস-চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার মোল্লা এবং খুলনা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস-চেয়্যারম্যান আব্দুল হামিদ মুখোশধারী সশস্ত্র ব্যক্তির হাতে নিহত হয়। গত এক মাসে ২১ জন স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য নিহত হয়েছে। খুলনা হাসপাতালে বর্তমানে ছুরির আঘাতে আহত ১২ জনের চিকিৎসা চলছে। একটি অপারেশনে সক্রিয় থাকা অবস্থায় আমি একজন রাজাকার কমান্ডার আব্দুল ওয়হাব মহলদার-এর সঙ্গে কথা বলি। তার মতে বিগত কয়েক সপ্তাহে খুলনায় অন্তঃত ২০০ জন রাজাকার ও শান্তিকমিটির সদস্য নিহত হয়েছে। মহলদার বলেন তার নিজের গ্রুপ দু-জন ‘দুষ্কৃতিকারী’-কে হত্যা করেছে।

পুলিশের কাছে এরকম তথ্য আছে যে দু-জন স্কুলশিক্ষককে কোনো আগাম হুঁশিয়ারি না দিয়েই হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ এধরনের মামলাগুলো পরিচালনা করতে পারছে না কারণ সামরিক এরকম প্রজ্ঞাপন আছে যে রাজাকারদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো সামরিক বাহিনীই তদন্ত করবে। খুলনা বেসামরিক পুলিশ একারণে অবাঙালি শান্তিকমিটি সদস্য মতি উল্লাহর বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনা করতে পারছে না; সেনাবাহিনী শহরের ‘নিরাপত্তা’-র দায়িত্ব নেবার আগের দিন তার কাছে বিস্ফোরক দ্রব্য পাওয়া গিয়েছিল। এর আগে উল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল নির্যাতন ও হুমকি প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের অভিযোগ ছিল। কিন্তু শান্তিকমিটির দায়িত্ব পাবার পর তার জামিন হয়ে যায়। তার বাড়ির পেছনে একদিন বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়; প্রতিবেশীদের অভিযোগ অনুসারে দাঙ্গার সময় ব্যবহারের জন্য সে ডিনামাইট জোগাড় করে রাখছিল। তার মন্দ চরিত্রের জন্য তাকে বন্দুকের লাইসেন্স নেবার জন্য বলা হলে সে তা নিতে অস্বীকার করে। পুলিশ তাকে সন্ত্রাসী ‘গুণ্ডা’ হিসেবেই জানে।

গণ্ডগোলে ও সেনাবাহিনীর ‘নিরাপত্তা’ অভিযানে ঠিক কতজন লোক মারা গেছে তা আমি শেষ পর্যন্ত স্থির করতে পারলাম না। তিন দিনের কারফিউয়ে ঘরে বন্দি একজন ম্যাজিস্ট্রেট জানালেন তার নদীপার্শস্থ বাড়ি থেকে তিনি, অভিযানের চূড়ান্ত পর্যায়ে, দশ মিনিটের মধ্যে ৪৮টি লাশ ভেসে যেতে দেখেছেন। শহরের অনেক এলাকাই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, কর্তৃপক্ষের ভাষায় এহলো বস্তি নির্মূল অভিযান। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলগামী রাস্তার দু-পাশে এক মাইল জুড়ে সবকিছু সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে।

কর্নেল শামস্ আমাকে জানান বিদ্রোহীদের সঙ্গে তার একটা জোর লড়াই হয়েছে, কিন্তু তিনি কখনোই ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেন নি। তিনি বলেন ঘরবাড়িগুলোতে বড়ো বড়ো আঘাতের চিহ্ন হয়েছে দুষ্কৃতিকারীদের পেট্রোলবোমা ব্যবহারের কারণে। কর্নেল শামস্ নয়, অন্য একটি সেনা-সূত্র আমাকে জানায় সেনাবাহিনীর অভিযানে কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটেনি, মাত্র সাতজন আহত হয়েছে। সেনাঅভিযানের কালে খুলনা হাসপাতালে গুলির আঘাতে ১৮৪ জন, ছুরিকাঘাত ও বেয়নটের আঘাতে ৭০ জন ভর্তি হয়। লড়াইয়ে বাঙালিদের হাতে যেমন অবাঙালি বিহারীরা নিহত হয়েছে, অবাঙালিদের হাতেও বাঙালিরা নিহত হয়েছে। আর সেনাবাহিনীর গণহত্যা তো রয়েছেই। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হয় এদের মধ্যে কেবল সেনাবাহিনীরই গুলি করার ক্ষমতা রয়েছে। যেকথাটা কখনও নাও জানা যেতে পারে, তা হলো, হতাহত বা ধ্বংসযজ্ঞের কোনো সরকারী তদন্ত হচ্ছে না। অন্যদিকে পাকিস্তান পুলিশকে প্রতিটি গুলির জন্য লিখিত রিপোর্ট রাখতে হয় এবং গুলিটা করতে হয় ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে।

এমনকি মংলা বন্দরে কী ঘটেছে তাও অস্পষ্ট। বন্দরঘেঁষা ঘরবাড়ি ও বাজারের দোকানপাট পোড়ানো হয়েছে। বন্দরের পাশের ইটের দালানগুলোতে গোলার আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। স্থানীয় পুলিশের প্রধান সাবইন্সপেক্টর হাদি খান একজন অবাঙালি। গত মাসে তার প্রমোশন হয়েছে এবং এধরনের পদে আসার জন্য যে পরীক্ষায় পাশ করতে হয়, তাকে সেধরনের কোনো পরীক্ষাই দিতে হয়নি। আমার দেখা অপেক্ষাকৃত বেশি মারাত্মক এই ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে তিনি বললেন, বাজারের কোনো দোকান থেকে লণ্ঠন উল্টে বা ওরকম কিছু হয়ে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু পিএনএস তিতুমীর-এর কমান্ডার জারিন আমাকে বললেন: ”মংলায় দুষ্কৃতিকারীদের সঙ্গে জোর লড়াই হয়েছে। রাস্কেলগুলো আমাদের বিরুদ্ধে হাতবোমা নিয়ে যুদ্ধ করতে এসেছিল। কিন্তু গোলা নিক্ষেপের সময়ই তা বিস্ফোরিত হয় এবং অর্ধেক এলাকা পুড়ে যায়।”

স্মৃতিচারণ করে কমান্ডার হেসে উঠলেন। নদীর পাশের ভবনগুলোতে গোলার চিহ্নের কোনো ব্যাখ্যা তিনি আমাকে দিতে পারলেন না। মংলায় আমি এবিষয়ে আর বেশি কিছু অনুসন্ধান করতে পারলাম না কারণ আমার ‘নিরাপত্তা’-র জন্য আমার সঙ্গে সবসময় দু-জন সৈনিক ঘুর ঘুর করছিল। তারা আমার সঙ্গে আঠার মতো লেগে ছিল এবং স্থানীয় জনগণ এজন্য মুখ খুলতে পারছিল না।

ঘটনাবলী সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দেয়া অদ্ভূত সব ব্যাখ্যা আরও শুনে যাওয়া আমার কাছে ক্লান্তিকর ঠেকছিল। উদ্বাস্তুদের ফিরে আসা প্রসঙ্গে বলা যায় কেবল অতি সাহসী এবং অতি বোকা লোকই এই মুহূর্তে দেশে ফিরে আসতে চাইবে এবং কেউ যদি ফিরেও আসে তবে তাকে স্বাভাবিক অভ্যর্থনা জানানো হবে কিনা সেব্যাপারে খুবই সন্দেহ আছে। কেবল ভারত ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগই উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেরকম হবার কোনো সম্ভাবনা নেই।

আরও আশংকার কথা, শান্তিকমিটি ও রাজাকারদের দাপটে পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষ ও আন্তরিক বেসামরিক প্রশাসন ক্রমশ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছে; অন্যদিকে কারও কাছে দায়বদ্ধ নয় এরকম ভাড়াটে ইনফরমার, মৌলবাদী ও গুণ্ডাপাণ্ডাদের শাসন চলছে। দীর্ঘকাল আগে উত্তরপশ্চিম সীমান্তে ব্রিটিশরা গ্রাম জ্বালিয়ে, গুলি করে যে জনগণকে হত্যা করে শান্তিপ্রতিষ্ঠার যে কায়দা প্রদর্শন করেছিল সেই পদ্ধতি এই জনবহুল ও শান্তিপূর্ণ পূর্ব পাকিস্তানে আমদানি করা হয়েছে। হিটলার ও মুসোলিনির রাজনৈতিক পদ্ধতি বরং কম ক্ষতিকর হতো।