Tag Archives: ঢাকা

ইয়াহিয়া মেশিনগান-প্রহরায় ঢাকায় উপস্থিত হয়েছেন

দি গার্ডিয়ান, ১৬ মার্চ, ১৯৭১

মার্টিন এডনে

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

ঢাকা, মার্চ ১৫। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাংবিধানিক সংকট সমাধানের জন্য আজ মেশিনগানসহ অর্ধ ডজন সামরিক ট্রাক পেছনে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন। দুই সপ্তাহ ধরে এই সংকটের কারণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান বস্তুত দুইটি পৃথক দেশ হিসেবে বিরাজ করছে। একজন মুখপাত্র জানান প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করবেন যার দল আওয়ামী লীগ পহেলা মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সেবাখাত ও অফিস চলবে কি চলবে না, তার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

তারা কয়েক প্লাটুন রাইফেলধারীর প্রহরাধীন প্রেসিডেন্ট-প্রাসাদে, নাকি দুই মাইল দূরবর্তী শেখ মুজিবের তিন তলার বাসভবনে আলোচনায় মিলিত হবেন তা এখনও নির্ধারিত হয় নি। শেখ মুজিবের এই বাসভবনে সাদা-পোশাক-পরা আওয়ামী লীগের কর্মীরা কোন সেবা চলবে এবং কোনটা চলবে না এসংক্রান্ত জরুরি প্রশ্নের উত্তর দেন। যদিও প্রেসিডেন্ট এবং শেখ মুজিব পরস্পর মিলিত হতে রাজি হয়েছেন কিন্তু বিষটি নিশ্চিত করা হয় নি। এই দুই বাসভবনের মধ্যবর্তী ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের তিনটি ফ্লোর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে — বলা হয়েছে ফ্লোরগুলো রঙ করার জন্যই এটা করা হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট এগুচ্ছেন স্বপ্রণোদিতভাবে। বিমান থেকে নামার পরে তিনি একটি কালো আমেরিকান গাড়িতে চড়ে ঢাকায় আসেন। তার আসার পথে প্রায় এক ব্যটেলিয়ান সৈন্য ব্রেনগানসহ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। গাঢ় রঙের স্যুট পরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গাড়ির পেছন সিটে বসা ছিলেন, বিমানবন্দর ত্যাগ করার সময় তিনি হাত নেড়ে অভিবাদন জানান। কিন্তু প্রেসিডেন্ট-ভবনে প্রধান সামরকি আইন প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা করার সময় তার হাতে ছিল না। কয়েক মিনিট পরে জেনারেল সাহেব রওয়ানা দেন।

প্রেসিডেন্টের আগমণে সপ্তাহখানেকের মধ্যে এটা পরিস্কার হয়ে যাবে কী সাংবিধানিক সমাধান হতে যাচ্ছে। ঢাকায় এক ধরনের স্বস্তি এসেছে এজন্য যে শেষ পর্যন্ত তিনি এলেন এবং অনেকে মনে করছিলেন বাংলার পরিস্থিতি আরও খারাপ হবার বিষয়টি তার অনুমোদনেই হচ্ছিল। বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের ওপরে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার মাধ্যমে গত সপ্তাহের শেষে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা কিছুটা কাটলেও আজ নতুন করে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে স্কুল, আদালত ও সরকারী অফিস বন্ধ থাকবে কিন্তু উপযোগী ও শিল্পসংক্রান্ত সংস্থাগুলো বিধিনিষেধের অধীনে চালু থাকবে।

সবাচাইতে দুঃশ্চিন্তার বিষয় হলো রফতানির অর্থ পূর্ব পাকিস্তানে আসছে না, ব্যাংকগুলো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নগদ অর্থ সংগ্রহ করতে পারছে না। ফলে রফতানি বন্ধ রয়েছে এবং দু’টি ব্যাংক ইতোমধ্যেই বিপদে পড়ে গেছে। একটি প্রচারণা-প্রত্যয় বাঙালিদের মধ্যে এভাবে কাজ করছে যে অনেক পশ্চিম পাকিস্তানী বিপুল অর্থ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার চেষ্টা করছে। জনগণকে তাদের সম্পত্তি কিনতে বারণ করা হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগের দাঙ্গা সাম্প্রদায়িক সংঘাতেও রূপ নেয় এবং এই বিষয়টি বারবার উল্লেখ করা বেসামরিক স্থিতিশীলতার জন্য কোনো শুভ প্রচেষ্টা নয়।

জঙ্গী ছাত্ররা আজ ঘোষণা দিয়েছে তারা আজ ‘বাংলাদেশ থেকে সম্পদ পাচার রোধ করা’-র জন্য চেকপোস্ট বসাবে। আজ দুপুরের পূর্বে বিমানবন্দরের একটি চেকপোস্টে একটি স্কুটারকে থামানো হয়। কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় একজন আরোহী একটি বন্দুক বের করে গুলি করে, একজন রিকশাচালক তাতে আহত হয় এবং আরোহী তার সহযোগীদের নিয়ে পালাতে উদ্যত হয়। তাকে ধাওয়া করা হয়, থামানো হয় এবং লাঠি ও ইটের সাহায্যে তাকে আঘাত করা হয়। এই গণপিটুনিতে ১,০০০ থেকে ২,০০০ জনের এক জনতাগোষ্ঠী অংশ নেয়। তাকে রক্তাক্ত ভূমিতে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে হয়। হাসপাতাল থেকে সরকারীভাবে জানানো হয় তারা দু-জন আহতকে ভর্তি করেছে। ঢাকা এই মুহূর্তে কতখানি উত্তপ্ত তার নিদর্শন হিসেবে এই ঘটনাকে ধরা যেতে পারে।

১০ দিন আগে দেয়া বেতার-ভাষণে ইয়াহিয়া যে প্রভুসুলভ মনোভাব প্রদর্শন করেছিলেন তা যদি এখনও বজায় রাখেন তবে সমাধান হবার সম্ভাবনা খুবই কম। আওয়ামী লীগের সদস্যরা বলাবলি করছে যে ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেই ফেলেছেন, কারণ সেখনে তিনি ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। বিগত কয়েক সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট যে-মনোভাব প্রদর্শন করেছেন তার চাইতে যথেষ্ট উদারতা, রাজনৈতিক সমঝোতা ও কৌশলের পরিচয় না দেখান এবং আজকের সেনামোতায়েনের বিপরীতে শেখ মুজিব যদি তার দলের চরমপন্থীদের শান্ত রাখতে না পারেন, তবে ঐতিহাসিক এক সংঘাত অনিবার্য হয়ে দেখা দিবে।

প্রান্তসীমায় টলমল

দি ইকোনমিস্ট, ১৩ মার্চ, ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

এই সপ্তাহের শুরুতে ঢাকার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবার সঙ্গে সঙ্গে এখানে অবস্থিত প্রবাসী নাগরিকেরা তাদের ব্যাগ গোছানো শুরু করে দিয়েছে। ব্রিটিশ সরকারসহ অন্য অনেক দেশ তার দেশের নাগরিকদের অতি প্রয়োজন ছাড়া পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছে। অনেকে মনে করছেন সামরিক শাসন পুনঃপ্রয়োগের ফলে সৃষ্ট দাঙ্গা বোধহয় শেষ হলো। কিন্তু বিদেশীরা মনে করছেন এই শান্ত অবস্থা হয়তো পরিস্থিতি আরও খারাপ হবারই পূর্বলক্ষণ।

এটা সত্যি যে গত রোববারে (৭ মার্চ) শেখ মুজিবের পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার যে ‘ঐতিহাসিক ঘোষণা’ দেবার কথা ছিল তা তিনি দেন নি। ইয়াহিয়া খান রোববার কঠোরভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যে তিনি বা তার সেনাবাহিনী এরকম কোনো ঘোষণাকে সহ্য করবে না, সম্ভবত সেই সতর্কবাণী তাকে ওরকম ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত রাখে। কিন্তু শেখ মুজিব এরপরই কাজের কাজটি করলেন। প্রেসিডেন্ট ২৫ মার্চে আইনসভার অধিবেশনের যে তারিখ ঘোষণা করেন, তার প্রত্যুত্তরে মুজিব জানান যে তিনি বা তার আওয়ামী লীগ অধিবেশনে যোগ দেবে না যদি না চারটি শর্ত মানা হয়। এরমধ্যে দু-টি শর্ত হলো যত দ্রুত সম্ভব সামরিক শাসন উঠিয়ে নিতে হবে এবং জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে — যে-শর্তগুলো প্রেসিডেন্টের মেনে নেয়া প্রায় অসম্ভব। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খুব শিগগীরই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবেন, এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এটাই হয়তো মুজিবের সঙ্গে তার শেষ আলোচনা।

পশ্চিম পাকিস্তানের মি. জুলফিকার আলি ভুট্টো অবশেষে কোনো রকম পূর্বশর্ত ছাড়াই যে ২৫ মার্চের অধিবেশনে বসতে রাজি হয়েছেন, এখন তার সামান্যই মূল্য রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসনের প্রভাব মুজিবকে একটি নতুন জমিনে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। এমনকি তিনি অপেক্ষাকৃত ধীরে ধীরে সামনে এগুচ্ছেন বলতে হবে, তার আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে যেসব চরমপন্থী লোক রয়েছেন তারা শনিবার রাতে স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব আপাতভাবে আট ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন তাদের এটা বোঝাতে যে, প্রেসিডেন্ট নতুন তারিখের যে-প্রস্তাব দিয়েছেন তার তা গ্রহণ করা উচিত, কিন্তু তিনি অবশ্যই সেক্ষেত্রে শক্ত শর্ত দেবেন।

ঢাকার মতোই কিছু পদক্ষেপ অন্যান্য শহর থেকে এসেছে — কিন্তু এতে সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই। তারা ঢাকা ও অন্যান্য শহর পরিচালনার দায়িত্ব একরকম মুজিবের হাতেই যেন ছেড়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা ছয় দফার প্রতীক ছয়টি রূপালি তকমা-বিশিষ্ট সবুজ টুপি পরে ‘শান্তি রক্ষা’-র কাজ করছে যা পুলিশের চেয়েও ভালো কাজে দিচ্ছে। গত সপ্তাহে পাঁচ দিনের সর্বাত্মক ধর্মঘট মুজিবের জন্য বিরাট সাফল্য ছিল। রোববারে তিনি এ সপ্তাহের প্রতিরোধ-কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির মধ্যে আছে রাজস্ব প্রদান না করা, সরকারী অফিস-আদালত-স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা এবং সব ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করা। তিনি হুমকি দেন যে নতুন সর্বাত্মক ধর্মঘটের মাধ্যমে তিনি এই কর্মসূচিকে সম্প্রসারিত করবেন।

এখন পর্যন্তও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসনের কল্পব্যবস্থা বজায় রাখতে চান। যাত্রীপরিবাহী বিমানগুলোর মাধ্যমে তিনি ঢাকায় সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে চলেছেন এবং ট্যাংকগুলোতে চাকা লাগিয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে রাজপথে লড়াই করার জন্য। কিন্তু জনগণ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তা থেকে এটা বোঝা কঠিন যে শেখ মুজিব কীভাবে অহিংস নীতি কার্যকর করবেন। প্রেসিডেন্টের জন্য বাস্তবানুগ ভাবনা এটা হতে পারে যে এই মুহূর্তেই শেখ মুজিবের সঙ্গে একটি রফা করে ফেলা, কারণ কেবল তিনিই স্বাধীনতার ঘোষণাকে আটকে রেখেছেন।

তাহলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কী মেনে নেবেন? আইনসভা অধিবেশনে যোগ দেবার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের বেঁধে দেয়া চারটি শর্তের মধ্যে দু-টি সহজেই মেনে নেয়া যায়। সেগুলো হলো সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে আনা এবং গত সপ্তাহের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্ত করা। সেনাবাহিনী ব্যারাকে থেকেও এখন যে কাজ করছে তা চালিয়ে নিতে পারবে এবং তদন্তের ফলাফল হয়তো তাদের জন্য খুব খারাপ কিছু হবে না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো সরকারীভাবে সামরিক শাসন উঠিয়ে নেয়া এবং নির্বাচিত বেসামরিক প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। সামরিক শাসন পুরোপুরি ওঠানো সম্ভব নয় যতক্ষণ না তার বিকল্প কিছু দাঁড়াচ্ছে এবং যতক্ষণ না কোনো প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড়াচ্ছে, বেসামরিক সরকার ততক্ষণ পর্যন্ত প্রশাসন চালাতে পারবে না। কিন্তু এই কাজটা আইনসভা অধিবেশন না বসা পর্যন্ত প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। যত দ্রুত অধিবেশন বসবে তত দ্রুত এই কাজটা সমাধা করা যায়।

এর ফলে নতুন আইনসভা সার্বভৌম একটি প্রতিষ্ঠান হবে এবং নতুন সংবিধানে প্রেসিডেন্টের ভেটো দেবার মতা বিলোপ করবে; কিন্তু সেই ক্ষমতা ইতোমধ্যে অকার্যকর হয়ে পড়েছে কারণ শেখ মুজিব খুব সহজেই এমনকি সামরিক শাসনকে উপেক্ষা করতে পারেন। পূর্ব পাকিস্তানের ছয় দফা পরিকল্পনা তখন নতুন সংবিধানে প্রায় নিশ্চিতভাবেই লিখিত হবে। এই ধরনের শিথিল ফেডারেশন — যেমন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মনে করেন — পাকিস্তানের সমাপ্তি ঘটাবে; কিন্তু একমাত্র বাস্তবানুগ বিকল্প হলে পুরোপুরি বিচ্ছিন্নতা। যদি প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে বলপূর্বক দমনপ্রক্রিয়া চালান তবে তাতে সফল হবার সামান্যই সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তার জাতির উদ্দেশ্যে শনিবারে দেয়া ভাষণে তিনি সেই পথেই যাবেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি যদি তা করেন তবে এই কমনওয়েলথভুক্ত দেশটিতে নতুন একটি গৃহযুদ্ধের সূচনা হবে যা বিশেষত ব্রিটেনের জন্য সমস্যাজনক হয়ে দেখা দেবে। পাকিস্তানের সঙ্গে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক অন্য খাতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

বায়াফ্রার যুদ্ধে ব্রিটেন নাইজেরিয়ার সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল যেগুলো বিচ্ছিন্নতবাদীদের নির্মূল করতে ব্যবহৃত হয়েছিল। পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধকে কেন ব্রিটেনের ভিন্নভাবে দেখা উচিত তার কারণ রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান এমন এলাকা যার সীমান্ত ইতোমধ্যে রয়েছে। বায়াফ্রার জন্য দাবিকৃত ভূখণ্ডে জেনারেল ওজুকুর যে-সমর্থন ছিল শেখ মুজিবের তার চাইতে অনেক বেশি সমর্থন রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের ৭০ মিলিয়ন বাঙালিরা কেবল পশ্চিম পাকিস্তানীদের থেকে সাংস্কৃতিকভাবেই আলাদা নয়, তারা কেবল আত্মসচেতন ও দৃঢ়চেতা জাতি হিসেবেই বিকাশ লাভ করে নি, পাকিস্তানের পুরো জনগোষ্ঠীর মধ্যে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কোনো ব্রিটিশ সরকারেরই উচিত হবে না, পাকিস্তানের সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়া — আর ব্রিটেন পাকিস্তানের মূল অস্ত্রসরবরাহকারীও নয়।

বিভক্ত পাকিস্তান

নিউ স্টেটসম্যান, ১২ মার্চ, ১৯৭১

ফ্রান্সিস হোপ

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

যখন একটি রাজনৈতিক বোমা ফাটে, তখন বিশ্ব অবাক হয়ে ভাবে কেন শান্তি এতো দীর্ঘ সময় ধরে বিরাজ করছিল? উত্তর আয়ারল্যান্ডের মতো পূর্ব পাকিস্তানে অনেক বছর ধরে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। কিন্তু এটা ছিল শান্ত অস্থিতিশীলতা। এখন এটা বিস্ময়কর মনে হয়, এমনকি অলৌকিক মনে হয়, যে তারা কখনও স্বাধীনতার দাবি স্থগিত রেখেছিল।

এটা বোঝা যাচ্ছে যে ঢাকার শেখ মুজিবুর রহমান ও ইসলামাবাদের ইয়াহিয়া খানের মধ্যে একটা আপসরফা হতে যাচ্ছে এবং এখানে জুলফিকার আলি ভুট্টো আশ্চর্য নিরবতা পালন করছেন। এটা খুবই সম্ভব যে পূর্ব পাকিস্তান সর্বোচ্চ অর্জনের জন্য চেষ্টা চালাবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে; আর এক বা দু-বছরের মাথায় তারা কুর্দিস্তান বা বায়াফ্রার মতো বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে। কিন্তু বিগত ২০ বছর ধরে বিশ্ব যেটাকে এড়িয়ে গেছে, দুই অংশের মধ্যে যে বিরাট পার্থক্য, তাকে আর এড়ানো সম্ভব নয়। দুই অংশের মধ্যে হাজার মাইলের যে-ভৌগোলিক ব্যবধান, তা এই ব্যবধানের ন্যূনতম অংশ।

পাকিস্তান নামটিও পূর্ব অংশকে বাদ দিয়েই গঠিত হয়েছে। এখানে P অর্থ পাঞ্জাব, A অর্থ আফগান, K অর্থ কাশ্মির এবং S অর্থ সিন্ধু। লর্ড কার্জনের বিখ্যাত বঙ্গভঙ্গের সময়ে তাকে আলাদা করা হয়েছিল কিন্তু দেশভাগের সময়ে তাকে ভারত থেকে বের করে দেয়া হয়। তারা পাকিস্তানের ১২ কোটি জনগোষ্ঠীর অর্ধেকরও বেশি, কিন্তু তারা বাস করে দেশটির ছয় ভাগের এক ভাগ অংশে। এটা সমৃদ্ধ কিন্তু অরক্ষিত ভূমি, গত বছরের বন্যা নাটকীয়ভাবে তা দেখিয়ে দিয়েছে: বাংলার মুঘল শাসকরা একে বলেছিলেন ‘খাদ্যে ভরপুর নরক’ হিসেবে। এই অংশটি রাষ্ট্রের কাছ থেকে মোট রাজস্বের এক চতুর্থাংশের এবং উন্নয়ন বাজেটের এক তৃতীয়াংশেরও কম পেয়ে থাকে; আর সব পণ্যের এক চতুর্থাংশ এবং বৈদেশিক সাহায্যের এক পঞ্চমাংশ পেয়ে থাকে। শেষের দুই বরাদ্দ পরিহাস বিশেষ, কারণ বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় পুরোটাই আসে পূর্ব পাকিস্তানের পাট থেকে।

অবশ্যই একটি অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এলাকা সাধারণত দেয় কম, তাই পায়ও কম। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে দ্রব্যমূল্যের দাম বেশি। চালের দাম পশ্চিমের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। আর চাকরি দেয়া হয় খুবই কৃপণ কায়দায়। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির মাত্র ১৫ ভাগ এবং সেনাবাহিনীর চাকরির ১০ ভাগ মাত্র পূর্ব পাকিস্তানীদের দখলে আছে।

ঢাকা থেকে এটা মনে হতেই পারে যে বাংলার মানুষ হলো শোষিত প্রলেতারিয়েত জনগোষ্ঠী, আর অন্যদিকে করাচিতে সামরিক লোকজন অনাবশ্যক বিলাসিতায় ডুবে রয়েছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানীদের আপত্তি নেই, কিন্তু কাশ্মিরকে পুনর্দখল করার জন্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে তারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের মতো অতটা আগ্রহী নয়। কাশ্মির তাদের সমস্যা নয় এবং তারা বুঝতে পারে না কেন এজন্য তাদের কেন্দ্রে পয়সা দিতে হবে। আঞ্চলিক ক্ষোভ আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। গত বছরের নির্বাচন পূর্ব পাকিস্তানকে ক্ষোভ প্রকাশের একটি সুযোগ করে দেয়, আর পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সেটা ছিল কেবল মত প্রকাশের সুযোগ। পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৭টি আসনের মধ্যে ভুট্টোর পিপলস্ পার্টি কেবল ৮৩টি আসন পায়, এবং পূর্বে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ ১৫৩টি আসনের মধ্যে ১৫১টি আসন লাভ করে। কিন্তু এই দুটি জয় তুলনা করার মতো কিছু নয়। ব্রিটিশ রানি ইংরেজ সমাজতন্ত্রী বা স্কটিশ জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে কাকে সংসদে পাঠাবেন, যেক্ষেত্রে স্কটিশরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে?

নানা ধরনের সুবিধার কারণে ভুট্টো একটি ঐক্যবদ্ধ দলের নেতা, যে-দলের পুরো দেশের জন্য কর্মসূচি রয়েছে। শেখ মুজিবও মোটামুটিভাবে তাই। তার সাফল্য আদর্শগত কারণে দ্রুত এসেছে এবং তাকে বামপন্থীদের পাশ কাটাতে হয়েছে, অতিক্রম করে যেতে হয়েছে। বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর অনেকের কাছে তার ছয় দফা এখনও একটি অশুভ বিষয়। সামান্য সম্ভাবনা দেখেও ভুট্টো এবিষয়ে ঝুঁকি নেন এবং ঘোষণা দেন ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ব্যাপারে আগাম নিশ্চয়তা না দিলে তিনি আইনসভার অধিবেশনে যোগ দেবেন না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে সমর্পিত হন এবং অধিবেশন স্থগিত করেন। শেখ মুজিব এর প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন: গান্ধীবাদী এই অহিংস কৌশল ইয়াহিয়া খানকে বাধ্য করে ২৫ মার্চে অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করতে; আইয়ুব খানের সত্যিকারের ক্ষমতা নেবার দিন সেটা। কিন্তু এবার শেখ মুজিবের না বলার পালা। তিনি সামরিক শাসন তুলে নেয়া ও গত সপ্তাহের হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া পর্যন্ত অধিবেশনে বসতে অস্বীকৃতি জানান। এখন আর চুপ করে বসে থাকার সময় নয়। দেশের দুই নির্বাচিত নেতার জনগণের কাছ থেকে পাওয়া পৃথক ধরনের রায়কে একত্রে সংবদ্ধ করা কঠিন, কিন্তু এবার তারা পরিস্কারভাবে কিছু একটা লাভের জন্য অবস্থান নিয়েছেন।

এই মুহূর্তে শেখ মুজিবই হলেন বাড়ির প্রকৃত মালিক। গত সপ্তাহ ছিল তার অহিংস পদ্ধতি ও সত্যিকারের ক্ষমতা প্রদর্শনের কাল। তার নির্দেশ অনুসারে ঢাকা একটি অচল শহরে পরিণত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রতীক হলো নৌকা এবং প্রতিটি বাড়িই কাঠের নৌকা প্রদর্শন করছিল, কিন্তু পরিস্থিতি কাঠের নৌকার সমাবেশের চাইতে বেশি কিছু ছিল। পূর্ব পাকিস্তানী সৈন্য ও পুলিশ আপাতভাবে ইতোমধ্যেই শেখ মুজিবের কাছ থেকে নির্দেশ নিয়ে বসে আছে। সামরিক গভর্নরের বাসার কর্মচারীরা প্রায়ই কাজে ফাঁকি দিচ্ছে এবং সামরিক রীদের রান্না করা খাবার খেয়ে তাকে দিন চালাতে হচ্ছে। ঢাকা বেতার ‘পাকিস্তান বেতারের ঢাকা কেন্দ্র’ নাম পাল্টে ‘ঢাকা সংবাদ কেন্দ্র’ নাম ধারণ করেছে এবং যে-সব কাগজ কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে সংবাদ পরিবেশন করে শেখ সেসব কাগজে কাজ করা থেকে বাঙালিদের বিরত থাকতে বলেছেন।

চলতি তথ্যযুদ্ধ ভয়াবহ, আম্মানের স্মৃতিবহ। গত সপ্তাহের দাঙ্গায় পাকিস্তানের সরকারী সৈন্যরা বেশ কিছু আন্দোলনকারীকে হত্যা করে। পশ্চিম পাকিস্তান নিহতের সংখ্যা ১৭১ স্বীকার করেছে, পূর্ব পাকিস্তান দাবি করছে ৫০০ জন্য মারা গিয়েছে। এছাড়া এই সপ্তাহের প্রথম অর্ধে পশ্চিম পাকিস্তান উচ্ছৃঙ্খল-ছাত্রের-ওপর-রাগান্বিত স্কুলশিক্ষকের মতো ক্রুদ্ধ নিরবতা পালন করছে। অন্য কোনো পন্থায় না গিয়ে ইয়াহিয়া খানই শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে আসতে চেয়েছেন। কাশ্মির থেকে লাহোরে একটি বিমান ছিনতাই করে নিয়ে গেলে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বিবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ভারতের নিষেধাজ্ঞার কারণে পাকিস্তানের যেকোনো বিমানকে ভারত ঘুরে শিলং হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করতে হচ্ছে, তা সেটা প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হোক বা সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য সৈন্যপরিবহণকারী হোক। পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাবৃদ্ধির প্রক্রিয়া সমস্যার মুখোমুখি পড়েছে।

আর ইয়াহিয়া খানকে এখন পূর্ব পাকিস্তানের ছয়দফার চাইতে বেশি কিছূ বিবেচনায় আনতে হবে। সাম্প্রতিক খবরে জানা যায় নতুন ফেডারেল সংবিধানের জন্য আওয়ামী লীগ ৪১ দফার একটি খসড়া করেছেন। এই খসড়া অনুসারে ‘পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্র’ পাঁচটি এলাকায় বিভক্ত হবে: বাংলা, সিন্ধু, পাঞ্জাব, পাখতুনিস্তান ও বেলুচিস্তান। প্রতিটি রাষ্ট্র তার নিজস্ব কৃষি, শিল্প, ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, স্টিল মিল ও যোগাযোগ-ব্যবস্থাসহ নিজেদের মিলিশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবে। উর্দু ও বাংলা সমভাবে সরকারী ভাষা হবে। পৃথক মুদ্রার পূর্বপ্রস্তাব বাদ দেয়া হয়েছে কিন্তু প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে ও পৃথক বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে মুদ্রা, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত ক্ষমতা থাকবে। এখানেও কিছু পার্থক্য দেখা যাবে; নৌবাহিনীর সদর দফতর হবে বাংলায়, সেনাবাহিনীর সদর দফতর হবে পাঞ্জাবে এবং সিন্ধুতে থাকবে বিমানবাহিনীর সদর দফতর। প্রতিটি ক্ষেত্রে আবার নিজস্ব বাহিনী থাকবে।

এই কর্মসূচি অনেকটা ব্রিটেনের অর্থনৈতিক নীতির মতো হতে পারে: অনেক বেশি এবং অনেক বিলম্ব। এটা বর্তমান সামরিক শাসকদের জন্য অনেক বেশি। আর এটা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য অনেক বিলম্বের একটি প্রস্তাব। কারণ তারা ইতোমধ্যে দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশ অমান্য করার ক্ষেত্রে দিন দিন তারা নিজস্ব আস্থা অর্জন করে চলেছে। অধিবেশন স্থগিতের পর প্রতিটি দিনই তাদের প্রত্যাশা বেড়ে চলেছে। শেখ মুজিবের রক্তপাত এড়ানোর জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা কিংবা ইয়াহিয়া খানের বেসামরিক প্রশাসনের হাতে অবিভক্ত পাকিস্তানকে ফিরিয়ে দেয়ার আন্তরিক আকাক্সা দেখে বলা যায় নেতৃবৃন্দ প্রশংসাযোগ্য কাজই করছেন। অনেকে হয়তো পূর্ব পাকিস্তানকে প্রতিবেশীদের সাহায্য নিয়ে পরিণত হওয়া অসমর্থ রাষ্ট্র হিসেবেও মেনে নেবেন (যদিও এধরনের দুর্ভাগ্য কে-বা বরণ করতে চায়?) এবং বহু বছরের অবহেলার ফল নতুন সরকার কাটিয়ে উঠবে। কিন্তু সময় আন্তরিকতাকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। এটা এই মুহূর্তে দেখা খুব কঠিন যে কীভাবে উভয় প অনড় অবস্থান থেকে সরে আসে এবং কীভাবে অধিক সহিংসতা এড়ানো যাবে। এর একটিও যদি না করা যায় তবে ঢাকায় মৃতের সংখ্যা আগামী সপ্তাহে আরও বেড়ে যাবে।

কলকাতা থেকে।