Tag Archives: যুদ্ধাপরাধী

রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাওলানা ইউসুফ – হত্যা নির্যাতনের অসংখ্য অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে

রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাওলানা ইউসুফ – হত্যা নির্যাতনের অসংখ্য অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে

আজাদুর রহমান চন্দন/প্রতীক ইজাজ

জামায়াতে ইসলামীর নতুন ভারপ্রাপ্ত আমির মাওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ একজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী। একাত্তরে তিনিই প্রথম খুলনায় প্রতিষ্ঠা করেন রাজাকার বাহিনী। শান্তি কমিটিরও তিনি ছিলেন খুলনা জেলার আহ্বায়ক। তারই নেতৃত্বে পরিচালিত হতো সেখানকার নয়টি প্রধান নির্যাতন সেল। রাজাকার বাহিনীর ৯৬ ক্যাডার মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাস সেসব সেলে পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পরে মানুষদের ওপর। সেখান থেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হতো শহরের প্রধান চারটি স্থানে।

মাওলানা একেএম ইউসুফ খুলনায় রাজাকার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে নেতৃত্বে দেওয়ার পাশাপাশি দেশ-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার দায়িত্বও পালন করেন। ডা. মালেক মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে তিনি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা ও যুদ্ধপরাধে সক্রিয় সহযোগিতা দেন। ওই কুখ্যাত মন্ত্রীসভায় তিনি ছিলেন রাজ মন্ত্রী।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আইনের অধীনে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় ইউসুফের। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দালালি করার অভিযোগে ’৭২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে মালেক মন্ত্রীসভার সদস্য ও রাজনৈতিক নেতাসহ ৩৭ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। আদালতের রায়ে অন্য অনেকের সঙ্গে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় একেএম ইউসুফের। কিন্তু পরে সরকারের সাধারণ মা ঘোষণার আওতায় সে বছরের ৫ ডিসেম্বর মুক্তি পান মাওলানা ইউসুফ।

গ্যাটকো দুর্নীতির মামলায় গত রোববার জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী গ্রেফতার হওয়ার পরদিন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মাওলানা আবুল কালাম ইউসুফকে দলের ভারপ্রাপ্ত আমির নির্বাচিত করা হয়। কুয়েত থেকে দেশে ফিরে বুধবার তিনি দায়িত্ব নিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বসেন। তার বাড়ি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রাজৈর গ্রামে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় খুলনা জামায়াতের নেতা ছিলেন তিনি। খুলনা জেলা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে ওই সময় তার নাম ছাপা হয় পাকিস্তান অবজারভারসহ বিভিন্ন পত্রিকায়।

ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির তৈরি ‘গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে প্রত্য অথবা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তালিকা’য় একেএম ইউসুফের নাম উঠে এসেছে। ১৯৭২ সালে দালাল আইনে গ্রেফতার হওয়া মালেক মন্ত্রীসভার অপর এক সদস্য দালালির অভিযোগে মাওলানা ইউসুফের জেল খাটার সত্যতা স্বীকার করেছেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীবিরোধী গণআন্দোলনের সময় কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের ’৯৪ সালের ২৬ মার্চ প্রকাশিত দ্বিতীয় দফার তদন্ত প্রতিবেদনে ৮ যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে মাওলানা ইউসুফের নাম পাওয়া গেছে।

মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দলিলপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, একাত্তরের মে মাসে মাওলানা ইউসুফই দেশে প্রথম জামায়াতের ৯৬ জন ক্যাডার নিয়ে খুলনায় রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। খুলনার তৎকালীন ভূতের বাড়ি (বর্তমানে আনসার ক্যাম্পের হেড কোয়ার্টার) ছিল তার রাজাকার বাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং প্রধান নির্যাতন সেল। দুটি প্রধান নির্যাতন সেল ও রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল বর্তমান শিপইয়ার্ড ও খালিশপুরে। এছাড়া পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর মহৃল ক্যাম্প সার্কিট হাউস এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অপর চারটি ঘাঁটি হেলিপোর্ট, নেভাল বেস, হোটেল শাহিন ও আসিয়ানা হোটেলও হয়ে উঠেছিল এই বাহিনীর নির্যাতন সেল। প্রথম তিনটি নির্যাতন সেল পরিচালিত হতো সরাসরি রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে আর পাকিস্তানি বাহিনীর অবশিষ্ট চারটি ঘাঁটি যৌথভাবে পরিচালিত হতো। তবে অধিকাংশ হত্যাকান্ডই সংঘটিত হয়েছে গঙামারি, সার্কিট হাউসের পেছনে ফরেষ্ট ঘাঁটি, আসিয়ানা হোটেলের সামনে ও স্টেশন রোডসহ কিছু নির্দিস্ট স্থানে।

কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালতের কাছে প্রত্যদর্শীরা একাত্তরে খুলনায় মাওলানা ইউসুফের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর নানা যুদ্ধাপরাধের বিবরণ তুলে ধরেন। এদেরই একজন শহীদ আবদুর রাজ্জাকের মা গুলজান বিবি কমিশনকে জানান, একাত্তরের আষাঢ় মাসের একদিন রাজাকার খালেক মেম্বার তার ছেলে রাজ্জাককে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বলে। রাজ্জাক তা প্রত্যাখ্যান করলে সে মাসের ১১ তারিখ সকালে খালেক মেম্বার ও অপর রাজাকার আদম আলী পুনরায় বাসায় এসে রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যায় গুলজান বিবি জানতে পারেন তার ছেলেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ছেলেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য মা গুলজান বিবি রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা একেএম ইউসুফের কাছে যান এবং তার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে করজোড়ে অনুরোধ জানান। সে সময় মাওলানা ইউসুফের সঙ্গে খালেক মেম্বারও ছিল। তারা দু’জনই জানিয়ে দেন, রাজ্জাককে ছাড়ানোর ব্যাপারে কোনো অনুরোধেও কাজ হবে না। পরে গুলজান বিবি তার ছেলেকে আর পাননি। সন্ধান পাননি লাশেরও।

কমিশনের কাছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যদর্শীরা আরো জানান, মাওলানা ইউসুফের কথামতো খালেক মেম্বার ও আদম আলীর মতো আরো কয়েকজন রাজাকার সে সময় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পরে আরো অসংখ্য নারী-পুরুষকে হত্যা করেছে এবং নারী ধর্ষণ করেছে। রাজাকার বাহিনী গঠনের পর মাওলানা ইউসুফ মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা থেকে বহু লোককে জোর করে ধরে নিয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করেছিলেন। যারা রাজি হননি, তাদের মেরে ফেলা হয়েছে। অনেকের লাশও পাওয়া যায়নি। এসব প্রত্যদর্শী প্রাণভয়ে তাদের নাম প্রকাশে অনীহা জানান।

মাওলানা ইউসুফের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকান্ডের অসংখ্য দলিল ও প্রমাণপত্র ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির কাছে রয়েছে বলে কমিটির আহ্বায়ক ডা. এমএ হাসান সমকালকে জানান। তিনি বলেন, ‘মাওলানা ইউসুফের যুদ্ধাপরাধের দালিলিক প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। সে সময় তিনি জামায়াতের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। মন্ত্রিসভায় জামায়াতের যে গুরুত্বপূর্ণ দুই সদস্যকে অন্তর্ভু্ক্ত করা হয়, তাদের মধ্যে মাওলানা ইউসুফ ছিলেন একজন। এখনো তিনি জামায়াতের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি প্রায়ই কুয়েত, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পড়ে থাকেন। কারণ দেশে দলসহ জঙ্গি কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য মুসলিম দেশগুলো থেকে মহৃলত তিনিই অর্থ সংগ্রহ করে থাকেন।’

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনের অধীনে মাওলানা ইউসুফের দন্ডাদেশ এবং জেলখাটার সত্যতা স্বীকার করেছেন মালেক মন্ত্রীসভার অপর এক সদস্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সদস্য জানান, ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে তাকে ও মাওলানা ইউসুফসহ মন্ত্রীসভার সবাইকে ’৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। দালাল আইনের অধীনে আদালত তাকেসহ অন্য অনেকের সঙ্গে মাওলানা ইউসুফকেও যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। মাওলানা ইউসুফ হাইকোর্টে আপিলও করেছিলেন। কিন্তু তার রায় বেরুনোর আগেই তৎকালীন সরকারের সাধারণ মা ঘোষণার আওতায় তারা সবাই মুক্তি পেয়ে যান। কিন্তু মাওলানা ইউসুফ কি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়েন এ প্রশ্নের উত্তরে মালেক মন্ত্রীসভার ওই সদস্য আরো বলেন, তখন তার বিরুদ্বে এতসব প্রমাণপত্র উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি বলেই তিনি মুক্তি পান।

এসব বিষয়ে মতামত জানার জন্য গতকাল শুত্রক্রবার জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার মোবাইল ফোনে বারবার চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।

’৭১ সালের ১০ অক্টোবর খুলনার জনসভায়, ২৬ অক্টোবর সিলেটের জনসভায়, ১২ নভেম্বর সাতক্ষীরার রাজাকার শিবির পরিদর্শনকালে এবং ২৮ নভেম্বর করাচিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালেসহ বিভিন্ন সময় তার বক্তৃতা-বিবৃতিতে স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এসব বক্তৃতা-বিবৃতি পরেরদিন দৈনিক বাংলার বাণী, দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধের বিচার : বাংলাদেশ এবং জার্মানি : একটি নিরপেক্ষ পর্যালোচনা

*অস্ট্রেলিয়া থেকে মোবায়েদুর রহমান*

কিছুদিন আগে একটি মহল থেকে যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবী করা হলো তখন বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অবস্খান গ্রহণ করলেন। সেই অবস্খানকে কেন্দ্র করে এই ইস্যুতে একাধিক চিন্তাধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকার প্রধান ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ বলেছেন যে, যুদ্ধাপরাধ তথা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যে কেউ চাইতেই পারেন। সকলের জন্যই আইনের দরজা খোলা আছে। যে কোনো ব্যক্তি আইন আদালতে এই বিচার চাইলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। ড. ফখরুদ্দীনের এই বক্তব্যের পর ঐ মহল থেকে দাবি করা হয় যে, রাষ্ট্রকে বাদী হয়ে এই মামলা করতে হবে। অর্থাৎ কোন কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা হবে সেটা ঠিক করবে রাষ্ট্র। তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষীসাবুদ এবং প্রমাণপত্রও যোগাড় করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এসব দাবির প্রেক্ষিতে আইন ও তথ্য উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন সরকারের অবস্খান এ ব্যাপারে আরো পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেছেন যে, সরকারের প্রধান কাজ হলো নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। নির্বাচনের পর নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বলেন, সরকারের হাতে সময় খুব কম। এই কম সময়ে অন্যান্য কাজ হাতে নিলে মূল কাজ অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সে জন্য সরকার এসব কাজ হাতে নিতে পারবে না। তিনি আরো বলেন যে, নির্বাচনের পর যে নতুন সরকার আসবে তারা সিদ্ধান্ত নেবে যে যুদ্ধাপরাধের বিচার সংক্রান্ত ইস্যুটি তারা টেকআপ করবেন কি করবেন না।

পরবর্তীতে সাংবাদিকরা এই ইস্যুতে আইন উপদেষ্টাকে আরো প্রশ্ন করলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, বিগত ৩৬ বছরে কেন এই বিচার করা হয়নি? অনেক সরকার এসেছে এবং অনেক সরকার গেছে। কেউ তো এ ব্যাপারে কিছু করেননি। কিন্তু কেউ এই ইস্যুটি টেকআপ করেননি। ৩৬ বছর একাধিক গণতান্ত্রিক সরকার যে কাজটি করেনি সেই কাজটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে করার জন্য আপনারা চাপ দিচ্ছেন কেন? আইন ও তথ্য উপদেষ্টার এসব মন্তব্যের পর এই ইস্যুটি একটু ভিন্নখাতে প্রবাহিত হয়েছে। তবে এই ব্যাপারে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছেন প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জী। একটি সেমিনারে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। দু’টি পত্রিকায় তার ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছে। ঐসব পত্রিকার প্রতিনিধি দেব মুখার্জীর নিকট থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে জানতে চান। উত্তরে দেব মুখার্জী বলেন, “এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত সৈন্যকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল সেটা তো তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনা না করে এবং তাদের সম্মতি ছাড়া করা হয়নি।” উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান অসংখ্যবার ঘোষণা করেন যে, বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই হবে। এজন্য প্রথমে ১৫ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়। তখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, মিলিশিয়া, রেঞ্জার ও ফন্সান্টিয়ার গার্ড মিলে মোট ৯৩ হাজার নিয়মিত ও অনিয়মিত সৈন্য বুদ্ধিজীবী হিসাবে ভারতের হেফাযতে ভারতে অবস্খান করেছিল। যাই হোক, ১৫ হাজার সৈন্যের বিচার একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে যায়, এই বিবেচনায় তালিকা ছোট করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এভাবে ছোট করতে করতে ১৫ হাজারের স্খানে ১৯৫ জনের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের দায়ে এই ১৯৫ জনের বিচার করাও সম্ভব হয়নি। বাবু দেব মুখার্জীর বক্তব্য অনুযায়ী এই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত পাক সেনাসহ ঐ ৯৩ হাজার পাকিস্তানী যুদ্ধাবন্দীকে বাংলাদেশের সম্মতিক্রমে ভারত পাকিস্তানে ফেরত পাঠায়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, পাকিস্তানের আধা সামরিক বাহিনী, ফন্সন্টিয়ার গার্ড, রেঞ্জার এবং বেসামরিক প্রশাসনের উচ্চপদস্খ পাকিস্তানী অফিসারদের সকলেই নিরাপদে পাকিস্তান ফেরত যাওয়ার পর দেশে পড়ে রইলো কারা? রইলো তারা, যারা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কাটিয়েছেন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে। এরাই সেই হতভাগ্য মানুষ, যাদেরকে পরলোকগত সাংবাদিক জনাব এনায়েতুল্লাহ খান ব্যথিত হৃদয়ে বলেছেন, “সিক্সটি ফাইভ মিলিয়ন কোলাবরেটরস।” অর্থাৎ, সাড়ে ছয় কোটি দালাল।”

সাড়ে ছয় কোটি দালাল

উপরোক্ত শিরোনামের লেখাটি মরহুম এনায়েতুল্লা খান সাপ্তাহিক ‘হলিডে’তে ১৯৭৩ সালে স্বনামে লিখেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বাংলাদেশের একটি চিহ্নিত মহল দেশ প্রেমের সোল এজেন্সি নিয়েছেন। কথায় কথায় তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিশেষ করে ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ১৯৭৩ সালে ‘হলিডে’ সম্পাদক আলোচ্য নিবìেধ তাদেরকে ‘নব্য দেশপ্রেমিক’ বলে কটাক্ষ করেছেন। ওরা স্বাধীনতার উষালগ্ন থেকেই প্রতিপক্ষের দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করছেন। আজও তারা হিংসাত্মক ও উস্কানিমূলক ভাষায় সেই অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বাধীনতার পর আবদুল আলিম, আবদুল আহাদ, আবদুল লতিফ, ফেরদৌসি রহমান প্রমুখ স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পীকে রেডিও এবং টিভির কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। তখন মরহুম এনায়েতুল্লা খান ঐ নিবìধটি লেখেন। তিনি বলেন, অকুপেশন পিরিয়ডে অনেক কণ্ঠশিল্পী রেডিও এবং টিভিতে কণ্ঠদান করেন। এজন্য তাদেরকে ‘দখলদার বাহিনীর দালাল’ হিসাবে রেডিও এবং টিভিতে নিষিদ্ধ করা হয়। “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কতিপয় ব্যক্তির এই স্বৈরাচারী (হাইহ্যাণ্ডেডেডনেস) পদক্ষেপ অনেককে আহত করে। এই কাজ এবং এই ধরনের আরো কিছু কাজের ফলে যারা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলেন তারা এবং নয়মাসের ত্রাসের রাজত্বে যারা দেশে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে আস্খার সঙ্কট সৃষ্টি হয়।’ জনাব এনায়েতুল্লা খান খান বলেন, “দেশের অভ্যন্তরে থেকে যারা ঐ যন্ত্রণাদায়ক নয় মাসে অফিসে হাজির হয়ে যেমন কেউ দালাল হয়ে যায় না, তেমনি শুধুমাত্র সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কেউ পূর্ববর্তী ২৪ বছরের দোষ স্খলন করতে পারে না। এ দেশে দখলদারিত্বের সাথে যদি দালালদের সংখ্যা প্রচুর হতো তাহলে দখলদার সরকারকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পুলিশ, আমলা এবং টিভি ও রেডিও শিল্পী আমদানি করতে হতো না। এরপর জনাব খান বলেন, সেই দু:সাহসিক কথা, একটি কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা দরকার। বাধ্য হয়ে অফিস আদালত করা, স্কুল কলেজে যাওয়া, কোনরূপ তদ্বির না করেই ইয়াহিয়া খানের প্রশংসাপত্র পাওয়া, রেডিও টিভিতে কণ্ঠদান কোনোভাবেই দালালী নয়। যদি তাই হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধকালে যে সাড়ে ছয় কোটি মানুষ দেশের অভ্যন্তরে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা সকলেই দালাল এবং দালাল হওয়ার জন্য তারা গর্বিত। ঐ নয় মাসে সমগ্র বাংলাদেশ ছিল একটি বিশাল ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ সকলকে কাজ করতে হতো শৃঙ্খলিত দাসের মত। প্রতিটি মুহূর্ত তারা মৃত্যুভয়ে কাটিয়েছেন।”
এই ছিল এনায়েতুল্লাহ খানের লেখার সংক্ষিপ্তসার। সীমান্ত পারের নিরাপদ আস্তানা থেকে ফিরে এসে যারা দালাল বা যুদ্ধাপরাধী খুঁজে ফিরেছেন এবং ৩৬ বছর পরও খুঁজে ফিরছেন তাদেরকে জনাব খানের এই পটভূমি বিবেচনা করতে হবে।

নুরেমবার্গ বিচার এবং এ দেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সপক্ষে যখন তখন জার্মানির নুরেমবার্গ ট্রয়ালের উদাহরণ দেওয়া হয়। বলা হয় যে, ৫০ বছর পর যদি হিটলারের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে পারে তাহলে ৩৬ বছর পর বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে পারবে না কেন? এ ধরনের কথা কি অজ্ঞতা? নাকি ইচ্ছাকৃত তথ্য বিকৃতি? ইতিহাস সম্পর্কে যাদের ক. খ. গ. জ্ঞানও আছে তারাও বিলক্ষণ জানেন যে, ১৯৩৯ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্যদিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৯৪৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হয়। যুদ্ধ শেষের মাত্র ১ মাস ২০ দিন পর ১৯৪৫ সালের ২০ নভেম্বর থেকে জার্মানির নুরেমবার্গ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়। ১৯৪৬ সালের ১লা অক্টোবর এই বিচার শেষ হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ৫০ বছর পরে নয়, মাত্র ১ মাস ২০ দিন পর এই বিচার শুরু হয়।

নুরেমবার্গে কাদের বিচার হয়েছিল?

যুদ্ধাপরাধী হিসাবে নুরেমবার্গে যাদের বিচার হয়েছিল তারা কারা? কোন ধরনের কোর্টে তাদের বিচার হয়েছিল? সম্মানিত পাঠক ভাইদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, ৬টি সরকারি সংস্খা এবং ২৪ জন উচ্চ পদস্খ সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে চার্জশীট প্রণয়ন করা হয়। যেসব সংস্খার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয় সেগুলো হচ্ছে (১) হিটলারের মন্ত্রিসভা, (২) নাৎসী দলের শীর্ষ নেতৃমণ্ডলী (৩) এসএস বা দলীয় পুলিশ ও এসডি (নিরাপত্তা পুলিশ) (৪) গেস্টাপো (৫) দি এসএ এবং (৬) সেনাবাহিনী এবং জেনারেল স্টাফের হাইকমান্ড। যে ২৪ ব্যক্তিকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, হেড অব চ্যান্সেলারী মার্টিন বোরম্যান, এ্যাডমিরাল অব দি ফ্লিট এবং হিটলারের মনোনীত উত্তরাধিকারী ডেনিজ কার্ল, অধিকৃত পোল্যান্ডের গভর্নর জেনারেল ফ্রাঙ্ক ফন্সান্স, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফিন্সক উইহ্যহেন, প্রুশিয়ান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেবম্যান গোরিং, মিলিটারী কমান্ডের প্রধান এবং হিটলারের কৌশলগত উপদেষ্টা আলফেন্সড জড্ল্, নিরাপত্তা পুলিশের প্রধান আরনেস্ট ক্যালটান রুনার, সেনাবাহিনীর ফিল্ড মার্শাল উইলহ্যাম কেউটেল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভন রিবেনট্রপ, অধিকৃত এলাকাসমূহের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী আনফেন্সড রোজেনবার্গ, শ্রমিকদের সংগঠক ফিন্সটজ সকেল অধিকৃত নেদারল্যান্ডের কমিশনার আর্থার ইনকোয়াট, সেমিটিক বিরোধী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়াস ট্রিচার প্রমুখ।
নুরেমবার্গ বিচারের আদালত গঠিত হয় তৎকালীন ৪টি বৃহৎশক্তি হতে গৃহীত তিনজন করে প্রতিনিধি নিয়ে। এরা হলেন একজন বিচারপতি, একজন বিকল্প বিচারপতি এবং একজন প্রসিকিউটর। এভাবে আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইংল্যান্ড এবং ফন্সান্স প্রতিটি দেশের তিনজন করে প্রতিনিধি নিয়ে মোট ১২ সদস্য বিশিষ্ট আদালত গঠিত হয়। আদালতের নাম দেয়া হয় ‘আন্তর্জাতিক মিলিটারী ট্রাইব্যুনাল’ আমেরিকার তরফ থেকে মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি রবার্ট জ্যাকসনকে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান আমেরিকার তরফ থেকে চিফ প্রসিকিউটর মনোনীত করেন।

নুরেমবার্গ ট্রায়ালের পাশাপাশি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিদাররা কি বলছেন? যারা মূল অপরাধী অর্থাৎ পাকবাহিনী, তারা সকলেই সহি সালামতে দেশে ফিরে গেছেন। নুরেমবার্গে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয় সেগুলো ছিল সরকারি পুলিশ সংস্খা, সরকারি গোয়েন্দা সংস্খা, মিলিটারীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, হিটলারের মন্ত্রিসভার সমস্ত সদস্য ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশে সেখানে পুলিশ, মিলিটারী বা ৯ মাসের মন্ত্রিসভার কোনো সদস্যের উল্লেখ নেই, নুরেমবার্গ ট্রায়ালে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী প্রধানকে আসামী করা হয়েছিল। ৩৬ বছর পর বাংলাদেশে পাক আর্মির কোন সদস্যকে দূরের কথা, একজন সিপাহীর বিচার করাও সম্ভব নয়। নুরেমবার্গে দুই লক্ষ এফিডেভিট পর্যালোচনা করা হয় এফিডেভিট এক হাজার ব্যক্তির টেস্টিমোনি গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশে যাদের বিচারের কথা বলা হচ্ছে তারা নুরেমবার্গ ট্রায়ালের কোন ক্যাটাগরিতেই পড়েন না। তাহলে আওয়ামী ও বাম ঘরানা যুদ্ধাপরাধের নামে কাদের বিচার করতে চান? কিভাবে বিচার করতে চান?