Category Archives: বাংলা আর্কাইভ

বিভক্ত পাকিস্তান

নিউ স্টেটসম্যান, ১২ মার্চ, ১৯৭১

ফ্রান্সিস হোপ

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

যখন একটি রাজনৈতিক বোমা ফাটে, তখন বিশ্ব অবাক হয়ে ভাবে কেন শান্তি এতো দীর্ঘ সময় ধরে বিরাজ করছিল? উত্তর আয়ারল্যান্ডের মতো পূর্ব পাকিস্তানে অনেক বছর ধরে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। কিন্তু এটা ছিল শান্ত অস্থিতিশীলতা। এখন এটা বিস্ময়কর মনে হয়, এমনকি অলৌকিক মনে হয়, যে তারা কখনও স্বাধীনতার দাবি স্থগিত রেখেছিল।

এটা বোঝা যাচ্ছে যে ঢাকার শেখ মুজিবুর রহমান ও ইসলামাবাদের ইয়াহিয়া খানের মধ্যে একটা আপসরফা হতে যাচ্ছে এবং এখানে জুলফিকার আলি ভুট্টো আশ্চর্য নিরবতা পালন করছেন। এটা খুবই সম্ভব যে পূর্ব পাকিস্তান সর্বোচ্চ অর্জনের জন্য চেষ্টা চালাবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে; আর এক বা দু-বছরের মাথায় তারা কুর্দিস্তান বা বায়াফ্রার মতো বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে। কিন্তু বিগত ২০ বছর ধরে বিশ্ব যেটাকে এড়িয়ে গেছে, দুই অংশের মধ্যে যে বিরাট পার্থক্য, তাকে আর এড়ানো সম্ভব নয়। দুই অংশের মধ্যে হাজার মাইলের যে-ভৌগোলিক ব্যবধান, তা এই ব্যবধানের ন্যূনতম অংশ।

পাকিস্তান নামটিও পূর্ব অংশকে বাদ দিয়েই গঠিত হয়েছে। এখানে P অর্থ পাঞ্জাব, A অর্থ আফগান, K অর্থ কাশ্মির এবং S অর্থ সিন্ধু। লর্ড কার্জনের বিখ্যাত বঙ্গভঙ্গের সময়ে তাকে আলাদা করা হয়েছিল কিন্তু দেশভাগের সময়ে তাকে ভারত থেকে বের করে দেয়া হয়। তারা পাকিস্তানের ১২ কোটি জনগোষ্ঠীর অর্ধেকরও বেশি, কিন্তু তারা বাস করে দেশটির ছয় ভাগের এক ভাগ অংশে। এটা সমৃদ্ধ কিন্তু অরক্ষিত ভূমি, গত বছরের বন্যা নাটকীয়ভাবে তা দেখিয়ে দিয়েছে: বাংলার মুঘল শাসকরা একে বলেছিলেন ‘খাদ্যে ভরপুর নরক’ হিসেবে। এই অংশটি রাষ্ট্রের কাছ থেকে মোট রাজস্বের এক চতুর্থাংশের এবং উন্নয়ন বাজেটের এক তৃতীয়াংশেরও কম পেয়ে থাকে; আর সব পণ্যের এক চতুর্থাংশ এবং বৈদেশিক সাহায্যের এক পঞ্চমাংশ পেয়ে থাকে। শেষের দুই বরাদ্দ পরিহাস বিশেষ, কারণ বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় পুরোটাই আসে পূর্ব পাকিস্তানের পাট থেকে।

অবশ্যই একটি অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এলাকা সাধারণত দেয় কম, তাই পায়ও কম। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে দ্রব্যমূল্যের দাম বেশি। চালের দাম পশ্চিমের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। আর চাকরি দেয়া হয় খুবই কৃপণ কায়দায়। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির মাত্র ১৫ ভাগ এবং সেনাবাহিনীর চাকরির ১০ ভাগ মাত্র পূর্ব পাকিস্তানীদের দখলে আছে।

ঢাকা থেকে এটা মনে হতেই পারে যে বাংলার মানুষ হলো শোষিত প্রলেতারিয়েত জনগোষ্ঠী, আর অন্যদিকে করাচিতে সামরিক লোকজন অনাবশ্যক বিলাসিতায় ডুবে রয়েছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানীদের আপত্তি নেই, কিন্তু কাশ্মিরকে পুনর্দখল করার জন্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে তারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের মতো অতটা আগ্রহী নয়। কাশ্মির তাদের সমস্যা নয় এবং তারা বুঝতে পারে না কেন এজন্য তাদের কেন্দ্রে পয়সা দিতে হবে। আঞ্চলিক ক্ষোভ আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। গত বছরের নির্বাচন পূর্ব পাকিস্তানকে ক্ষোভ প্রকাশের একটি সুযোগ করে দেয়, আর পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সেটা ছিল কেবল মত প্রকাশের সুযোগ। পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৭টি আসনের মধ্যে ভুট্টোর পিপলস্ পার্টি কেবল ৮৩টি আসন পায়, এবং পূর্বে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ ১৫৩টি আসনের মধ্যে ১৫১টি আসন লাভ করে। কিন্তু এই দুটি জয় তুলনা করার মতো কিছু নয়। ব্রিটিশ রানি ইংরেজ সমাজতন্ত্রী বা স্কটিশ জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে কাকে সংসদে পাঠাবেন, যেক্ষেত্রে স্কটিশরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে?

নানা ধরনের সুবিধার কারণে ভুট্টো একটি ঐক্যবদ্ধ দলের নেতা, যে-দলের পুরো দেশের জন্য কর্মসূচি রয়েছে। শেখ মুজিবও মোটামুটিভাবে তাই। তার সাফল্য আদর্শগত কারণে দ্রুত এসেছে এবং তাকে বামপন্থীদের পাশ কাটাতে হয়েছে, অতিক্রম করে যেতে হয়েছে। বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর অনেকের কাছে তার ছয় দফা এখনও একটি অশুভ বিষয়। সামান্য সম্ভাবনা দেখেও ভুট্টো এবিষয়ে ঝুঁকি নেন এবং ঘোষণা দেন ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ব্যাপারে আগাম নিশ্চয়তা না দিলে তিনি আইনসভার অধিবেশনে যোগ দেবেন না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে সমর্পিত হন এবং অধিবেশন স্থগিত করেন। শেখ মুজিব এর প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন: গান্ধীবাদী এই অহিংস কৌশল ইয়াহিয়া খানকে বাধ্য করে ২৫ মার্চে অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করতে; আইয়ুব খানের সত্যিকারের ক্ষমতা নেবার দিন সেটা। কিন্তু এবার শেখ মুজিবের না বলার পালা। তিনি সামরিক শাসন তুলে নেয়া ও গত সপ্তাহের হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া পর্যন্ত অধিবেশনে বসতে অস্বীকৃতি জানান। এখন আর চুপ করে বসে থাকার সময় নয়। দেশের দুই নির্বাচিত নেতার জনগণের কাছ থেকে পাওয়া পৃথক ধরনের রায়কে একত্রে সংবদ্ধ করা কঠিন, কিন্তু এবার তারা পরিস্কারভাবে কিছু একটা লাভের জন্য অবস্থান নিয়েছেন।

এই মুহূর্তে শেখ মুজিবই হলেন বাড়ির প্রকৃত মালিক। গত সপ্তাহ ছিল তার অহিংস পদ্ধতি ও সত্যিকারের ক্ষমতা প্রদর্শনের কাল। তার নির্দেশ অনুসারে ঢাকা একটি অচল শহরে পরিণত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রতীক হলো নৌকা এবং প্রতিটি বাড়িই কাঠের নৌকা প্রদর্শন করছিল, কিন্তু পরিস্থিতি কাঠের নৌকার সমাবেশের চাইতে বেশি কিছু ছিল। পূর্ব পাকিস্তানী সৈন্য ও পুলিশ আপাতভাবে ইতোমধ্যেই শেখ মুজিবের কাছ থেকে নির্দেশ নিয়ে বসে আছে। সামরিক গভর্নরের বাসার কর্মচারীরা প্রায়ই কাজে ফাঁকি দিচ্ছে এবং সামরিক রীদের রান্না করা খাবার খেয়ে তাকে দিন চালাতে হচ্ছে। ঢাকা বেতার ‘পাকিস্তান বেতারের ঢাকা কেন্দ্র’ নাম পাল্টে ‘ঢাকা সংবাদ কেন্দ্র’ নাম ধারণ করেছে এবং যে-সব কাগজ কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে সংবাদ পরিবেশন করে শেখ সেসব কাগজে কাজ করা থেকে বাঙালিদের বিরত থাকতে বলেছেন।

চলতি তথ্যযুদ্ধ ভয়াবহ, আম্মানের স্মৃতিবহ। গত সপ্তাহের দাঙ্গায় পাকিস্তানের সরকারী সৈন্যরা বেশ কিছু আন্দোলনকারীকে হত্যা করে। পশ্চিম পাকিস্তান নিহতের সংখ্যা ১৭১ স্বীকার করেছে, পূর্ব পাকিস্তান দাবি করছে ৫০০ জন্য মারা গিয়েছে। এছাড়া এই সপ্তাহের প্রথম অর্ধে পশ্চিম পাকিস্তান উচ্ছৃঙ্খল-ছাত্রের-ওপর-রাগান্বিত স্কুলশিক্ষকের মতো ক্রুদ্ধ নিরবতা পালন করছে। অন্য কোনো পন্থায় না গিয়ে ইয়াহিয়া খানই শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে আসতে চেয়েছেন। কাশ্মির থেকে লাহোরে একটি বিমান ছিনতাই করে নিয়ে গেলে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বিবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ভারতের নিষেধাজ্ঞার কারণে পাকিস্তানের যেকোনো বিমানকে ভারত ঘুরে শিলং হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করতে হচ্ছে, তা সেটা প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হোক বা সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য সৈন্যপরিবহণকারী হোক। পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাবৃদ্ধির প্রক্রিয়া সমস্যার মুখোমুখি পড়েছে।

আর ইয়াহিয়া খানকে এখন পূর্ব পাকিস্তানের ছয়দফার চাইতে বেশি কিছূ বিবেচনায় আনতে হবে। সাম্প্রতিক খবরে জানা যায় নতুন ফেডারেল সংবিধানের জন্য আওয়ামী লীগ ৪১ দফার একটি খসড়া করেছেন। এই খসড়া অনুসারে ‘পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্র’ পাঁচটি এলাকায় বিভক্ত হবে: বাংলা, সিন্ধু, পাঞ্জাব, পাখতুনিস্তান ও বেলুচিস্তান। প্রতিটি রাষ্ট্র তার নিজস্ব কৃষি, শিল্প, ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, স্টিল মিল ও যোগাযোগ-ব্যবস্থাসহ নিজেদের মিলিশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবে। উর্দু ও বাংলা সমভাবে সরকারী ভাষা হবে। পৃথক মুদ্রার পূর্বপ্রস্তাব বাদ দেয়া হয়েছে কিন্তু প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে ও পৃথক বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে মুদ্রা, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত ক্ষমতা থাকবে। এখানেও কিছু পার্থক্য দেখা যাবে; নৌবাহিনীর সদর দফতর হবে বাংলায়, সেনাবাহিনীর সদর দফতর হবে পাঞ্জাবে এবং সিন্ধুতে থাকবে বিমানবাহিনীর সদর দফতর। প্রতিটি ক্ষেত্রে আবার নিজস্ব বাহিনী থাকবে।

এই কর্মসূচি অনেকটা ব্রিটেনের অর্থনৈতিক নীতির মতো হতে পারে: অনেক বেশি এবং অনেক বিলম্ব। এটা বর্তমান সামরিক শাসকদের জন্য অনেক বেশি। আর এটা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য অনেক বিলম্বের একটি প্রস্তাব। কারণ তারা ইতোমধ্যে দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশ অমান্য করার ক্ষেত্রে দিন দিন তারা নিজস্ব আস্থা অর্জন করে চলেছে। অধিবেশন স্থগিতের পর প্রতিটি দিনই তাদের প্রত্যাশা বেড়ে চলেছে। শেখ মুজিবের রক্তপাত এড়ানোর জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা কিংবা ইয়াহিয়া খানের বেসামরিক প্রশাসনের হাতে অবিভক্ত পাকিস্তানকে ফিরিয়ে দেয়ার আন্তরিক আকাক্সা দেখে বলা যায় নেতৃবৃন্দ প্রশংসাযোগ্য কাজই করছেন। অনেকে হয়তো পূর্ব পাকিস্তানকে প্রতিবেশীদের সাহায্য নিয়ে পরিণত হওয়া অসমর্থ রাষ্ট্র হিসেবেও মেনে নেবেন (যদিও এধরনের দুর্ভাগ্য কে-বা বরণ করতে চায়?) এবং বহু বছরের অবহেলার ফল নতুন সরকার কাটিয়ে উঠবে। কিন্তু সময় আন্তরিকতাকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। এটা এই মুহূর্তে দেখা খুব কঠিন যে কীভাবে উভয় প অনড় অবস্থান থেকে সরে আসে এবং কীভাবে অধিক সহিংসতা এড়ানো যাবে। এর একটিও যদি না করা যায় তবে ঢাকায় মৃতের সংখ্যা আগামী সপ্তাহে আরও বেড়ে যাবে।

কলকাতা থেকে।

পূর্ব পাকিস্তান ক্ষমতা দেখাচ্ছে

দি গার্ডিয়ান, ১২ মার্চ, ১৯৭১

মার্টিন এডনে

ঢাকা, মার্চ ১১। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি চরম সংকটের মুখে পড়েছে। কারণ আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমানই এখন প্রদেশটির সরকারের মতো কাজ চালাচ্ছেন এবং তার নির্দেশ মতো স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বন্ধ রয়েছে। যদিও অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ আছে — ব্যবসায়ীরা এক মাসে ১,০০০ টাকা ও চাকুরীজীবিরা ১,৫০০ টাকার বেশি তুলতে পারবে না — কিন্তু ব্যাংকগুলো এই চাহিদাটুকুও পূরণ করতে পারছে না, এমনকি তারা একে অপরের চেককেও বিশ্বাস করছে না। পাটকলগুলো আগামী রোববারে পাট কিনতে ও মাসিক বেতন-প্রদান করতে পারেব কিনা তা নিয়েও তারা চিন্তিত। আওয়ামী লীগ গর্ব করে বলছে রফতানি বন্ধ আছে কারণ জাহাজের মালিকরা শুল্ক ধর্মঘটে যোগ দেয় নি।

রোববারে মুজিবের বক্তৃতার পর যে অনুপ্রেরণা কাজ করছিল, প্রেসিডেন্টের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয় তা দেখতে যে-উদ্বিগ্ন প্রতীক্ষা শুরু হয়েছে তা অনুপ্রেরণাকে দূর করে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে কবে আসবেন তা অনিশ্চিত, কিন্তু গুজব শোনা যাচ্ছে যে তিনি আজ রাতেই আসছেন।

দ্রব্যমূল্যের দামের ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে — চালের দাম বেড়েছে শতকরা ২০ ভাগ এবং রান্নার তেলের দাম বেড়েছে শতকরা ৫০ ভাগ। অনেক লোকই ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে গিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এরকম একটি কথাও অনেকে ভাবছেন যে বর্তমানের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারে না। কেউ কেউ বলছেন এসব করে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থই পূরণ করা হচ্ছে। কেবল ব্যবসায়ীরা নয়, অনেক লোকই এখন ভাবছে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়া খুব বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে কিনা। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত পাঁচ লক্ষ বাঙালির সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ নেই।

এরকম কোনো ধারণা দেয়া মুশকিল যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এই প্রদেশটি নিজেকে কতটা স্বাধীন ভাবে যার সঙ্গে কোনো ধরনের ডাক, টেলিফোন বা টেলিগ্রামে যোগাযোগ নেই। একটা রিকশায় করে আমি একটি পানির গাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। গাড়িটির পেছনে ছয় জন লোক ঝুলছিল। তারা বলে উঠলো: “জয় বাংলা”। আমার রিকশাচালক মাথা ঘুরিয়ে বললো: “স্বাধীন বাংলা”। আমি জিজ্ঞেস করলাম এই দু-টি চিৎকারের মধ্যে পার্থক্য কী? রিকশাওয়ালাটা বললো, “কোনো পার্থক্য নেই”।

এখানকার সব বিচারপতি একটি নতুন গভর্নরের অধীনে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এ-হলো বাঙালি ঐক্যের আরেক সাক্ষ্য যার মধ্যে ব্যবসায়ী গর্ব এবং হাওয়ার কাছে সমর্পণের বিচক্ষণতা। এই চেতনার স্রোত সৃষ্টি হয়েছে মুজিবের আহ্বান থেকে। আবার মুজিবেরও কোনো উপায় নেই, তাই তাকে এই চেতনা বহন করতে হচ্ছে। এটা মনে হচ্ছে যে ইয়াহিয়া আসছেন শেখকে কিছু ছাড় দিতে, কিন্তু কোন পর্যন্ত তিনি তা দিতে পারেন তার নানা দিক রয়েছে। এটা পরিস্কার যে মুজিব যদি তার অনুসারীদের সঙ্গে রাখতে চান তবে তাকে অন্তঃত আওয়ামী লীগের ছয় দফা অনুসারে দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে এবং রাজস্ব ও বৈদেশিক বাণিজ্য হাতে রাখতে হবে।

কিন্তু এটা খুবই সন্দেহজনক সেনাবাহিনী এটা মেনে নিবে কিনা। কারণ জাতীয় বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি তারা প্রতি বছর নিয়ে থাকে। শেখের সমর্থকরা এটা দাবি করছেন যে ইয়াহিয়া প্রদেশের মতা আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবের কাছে হস্তান্তর করবেন, কিন্তু এটা একটা আশাবাদী ধারণা মাত্র। এটা জানা কঠিন যে মুজিব কী ধরনের স্বায়ত্তশাসন রফা করবেন, যিনি এখন পর্যন্ত বিশ্বাস করেন স্বাধীনতার সামান্য কম স্বায়ত্তশাসন পেলে থেমে যাওয়া যায়। হয়তো দুই প্রধানমন্ত্রির কনফেডারেশনকে তিনি মেনে নেবেন। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী ঢাকা বিমানবন্দরের কাছাকাছি অপেক্ষা করছে। তারা বিশ্বাস করে আদেশ দেয়া হলে তারা দ্রুতই প্রদেশটিকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে, যদিও বাঙালিরা দূরবর্তী যোগাযোগ-ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটিয়ে চলেছে। অবশ্য তারা এটাও জানে যে এই সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক ফলাফল কত ভয়াবহ হতে পারে।

এখানে দুই ডিভিশন সৈন্য আছে বলে জানা যায় যাদের মধ্যে কিছু আছে বাঙালি। এছাড়া আছে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস্, যারা স্থায়ী সীমান্তরাকারী বাহিনী। তাদের সংখ্যা ২০,০০০-এর কিছু বেশি যারা সেনা ঘাঁটি থেকে দূরে এখানে রয়েছে এবং তাদের হাতে রাইফেলের চাইতে সামান্য শক্তিশালী অস্ত্র রয়েছে। অভিযান শুরু হলে তাদের আনুগত্য বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে। আবার এরকম গুজবও শোনা যাচ্ছে বিমানযোগে আরও সৈন্য আসছে এবং নৌজাহাজে আরও সৈন্য রওয়ানা দিয়েছে। সেনাবাহিনীর ওপর কঠোর নির্দেশ আছে যাতে কোনো ধরনের ঘটনাকে তারা উস্কে না দেয় গত রাতে এখান থেকে উত্তরে কিছু সরবরাহের জন্য যাওয়া চারটি গাড়ির একটি কনভয় জনতার বাধার মুখে পড়লে গুলিবর্ষণ ছাড়াই তার ফিরে যায়। কিন্তু সাধারণভাবে সেনাবাহিনী সাধারণ ঠিকাদারদের মাধ্যমেই বিভিন্ন সরবরাহ পাচ্ছে যদিও চরমপন্থী নেতারা তা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

এখানে আরও একটি কথা হচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট যদি কঠোর পদক্ষেপ নেন তবে তার ফল কী হবে। এর অর্থ পাল্টা উদ্যোগ মুজিবের দিক থেকে না এসে অন্য দিক থেকেও আসতে পারে। কট্টরপন্থীদের কাছে মুজিব কোনো বিপ্লবী নন এবং তার রাজনৈতিক দর্শনও যথেষ্ট অস্পষ্ট। কিছু তথাকথিত গেরিলা-গোষ্ঠী আছে যারা গত কয়েক মাসে গ্রামাঞ্চলে কিছু রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করেছে এবং এরকম একটি ভয় আছে যে পশ্চিমবঙ্গের মতো এখানেও নকশাল আন্দোলন ছড়িয়ে যেতে পারে — বিশেষত মুজিবকে যদি দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। বাঙালিদের সাহসিকতার কথা শোনা গেলেও বৃহদাকারে সংগঠিত কোনো প্রতিরোধের পরিকল্পনার নিদর্শন দেখা যায় নি।

গত কয়েক সপ্তাহ জুড়ে যে প্রবল বাঙালি জাতীয়তাবাদ দেখা দিয়েছে যদিও তার ভবিষ্যত ঘোলাটে বলেই মনে হচ্ছে। যদি এই জাতীয়তাবাদ নিজেকে পরিচালিত করতে পারে তবে এই পশ্চাদপদ ও হতাশ প্রদেশটির জন্য তা মূল্যবান সম্পদই হবে। অবশ্য তারা সবসময়ই বলার জন্য প্রস্তুত থাকে যে তাদের এই পশ্চাদপদতার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান দায়ী। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা সম্ভবত আট কোটি এবং আশংকা করা হচ্ছে কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা চালু করা না গেলে এই সংখ্যা আগামী ২৩ বছরে দ্বিগুণ হবে। নতুন কোনো ভূমি নেই চাষ করার জন্য। এমনকি গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মাঝামাঝি অঞ্চলের কর্দমাক্ত ভূমিতেও ধানচাষ করা হয় এবং শহর দ্রুত সেদিকে ধাবিত হচ্ছে। একমাত্র আশা হলো ইতোমধ্যে উন্নত বীজ উদ্ভাবিত হয়েছে, অধিক সার ব্যবহার করা হয়েছে ও অধিক সারের অর্ডার দেয়া হয়েছে এবং সেচব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।

এখানকার প্রধান রফতানি-পণ্য হলো পাট এবং সিন্থেটিক ফাইবারের আবির্ভাবে তা হুমকির মুখে পড়েছে। ব্যাপক প্রনোদনা সত্ত্বেও শিল্প বিঘ্নিত হয়েছে ও বিনিয়োগ বিফলে গেছে। কেউ নিন্দুকের মতো বলতেই পারেন পূর্বকে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে পশ্চিম খুব কৃপণ হতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর সবচাইতে জনবহুল এই জনগোষ্ঠীর দুর্দশার খানিক উন্নতি ঘটাতে চাইলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পুরো সঞ্চয় ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হবে।

টুকরো হয়ে যাবার আশংকা, পাকিস্তানের স্বপ্ন ছিন্নভিন্ন

দি টাইমস, ১০ মার্চ, ১৯৭১

জেড. এইচ. জাইদি

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

পাকিস্তানের দু-অংশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা কি অবশ্যম্ভাবী? আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস্ পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলি ভুট্টোর মধ্যে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা দেখে অনেক পর্যালোচকের মনেই এখন এই প্রশ্ন। ভুট্টোর আইনসভার অধিবেশন বয়কটের অবিচণ হুমকি, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা পূর্বে তৎপরবর্তী বিক্ষোভ-আন্দোলনের ফলেই এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক বৈরিতা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনা থেকে পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে সৃষ্ট অসন্তোষ থেকেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

দুই অংশের বৈরিতা নতুন কিছু নয়। দেশভাগের পর থেকেই বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি। ভাষা থেকে তারা এর শক্তি পেয়েছে। ১৯৫০-এর দশকে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাইলে তা প্রতিরোধে যারা আত্মত্যাগ করেন তাদের স্মরণ এই জাতীয়তাবাদের শক্তির উৎস। শেষ পর্যন্ত উর্দুর পাশাপাশি বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়, কিন্তু তা অর্জিত হয় রক্তপাতের মাধ্যমে। বিলম্বে প্রদান করা অধিকার বাঙালিদের ক্ষোভ খুব কমই প্রশমিত করতে সমর্থ হয়।

ভাষা-বিতর্ক পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে দ্রুত বেড়ে ওঠা অনুভবের নির্দেশক। তারা মনে করেছে আগে তারা মাড়োয়াড়ী ও পশ্চিমবঙ্গের জোয়াল কাঁধে নিয়েছে, এখন নিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানীদের। দেশভাগের সময়ে অবিভক্ত ভারতে পুরো বেসামরিক প্রশাসনে মাত্র একজন পূর্ব বাংলার মুসলমান কর্মকর্তা ছিলেন। আর ১৯৫৬ সালের পর থেকে পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনে কঠোর কোটা-পদ্ধতিতে লোক নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত প্রশাসনে পূর্ব পাকিস্তানের তিনজন যুগ্ম সচিব, ১০ জন উপ-সচিব এবং ৩৮ জন নিম্ন সচিব রয়েছেন। এর বিপরীতে ঐ পদগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৮, ১২৩ ও ৫১০। বিভাগপূর্ব সময়েই সামরিক বাহিনীতে পাঞ্জাবী ও পাঠানদের প্রাধান্য ছিল, বিভাগপরবর্তী সময়ে তাদের প্রাধান্য আগের চাইতে আরও বেড়েছে। ১৯৫৬ সালের পর থেকে পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি ঘটেছে কিন্তু বৈষম্য থেকেই গেছে।

বেসামরিক, রাজনৈতিক ও সামরিক — ক্ষমতার এই তিন হাতিয়ারের সমাবেশ ঘটেছে পাকিস্তানের তিনটি শহরে, কিন্তু শহর তিনটিই পাঞ্জাব রাজ্যে অবস্থিত। এতে আন্তঃঅংশ বিরোধ বেড়েছে। ১৯৫৫ সালে সিন্ধু, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাব মিলে একটি অংশের সৃষ্টি হবার পর লাহোর পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী হয়। ১৯৫৯ সালে আইয়ুব খানের একক সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের রাজধানী করাচি থেকে ইসলামাবাদে নিয়ে আসেন। এতে দেশের রাজধানী হয় পাঞ্জাবেরই একটি শহর। রাওয়ালাপিন্ডি তো সশস্ত্রবাহিনীর হেডকোয়ার্টার ছিলই।

আইনসভায় এক ইউনিট ব্যবস্থা কেবল আন্তঃপ্রদেশ বিরোধ বাড়িয়েই তোলে নি, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে পরস্পরের শত্রুভাবাপন্ন করে ফেলেছে। দেশভাগের পরপরই যে-আইনসভা গঠিত হয়েছিল সেখানে ৬৯টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিল ৪৪টি। নতুন পদ্ধতিতে এই প্রতিনিধিত্ব পশ্চিম পাকিস্তান দ্বারা নির্ধারিত হতো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সম্প্রতি এই ইউনিট পদ্ধতি ভেঙ্গে তা সংশোধনের উদ্যোগ নেন। তার উদ্যোগ মোতাবেক প্রতিটি প্রদেশ তার জনসংখ্যার ভিত্তিতে আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব করবে। এভাবে ৩১৩টি আসনের জাতীয় আইনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ প্রতিনিধিত্ব থাকবে।

পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষোভের কিছু যথার্থ কারণ আছে। কিন্তু এর সবটাই পশ্চিম পাকিস্তানের কারণে হয় নি। ইতিহাস ও ভূগোল সেখানে অর্থনৈতিক স্থবিরতা এনে দিয়েছে। ভারত বিভাগের পূর্বে পূর্ব বাংলা ছিল সবচেয়ে অনুন্নত এলাকার একটি। কৃষিনির্ভর এই অঞ্চলটি পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়িত অঞ্চলের জন্য কাঁচামালের যোগানদার-ভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পূর্ব বাংলার রফতানি-কেন্দ্র চট্টগ্রামকে প্রতিদ্বন্দ্বী কলকাতার কারণে অনুন্নত রাখা হয়েছে। পূর্বের জেলাগুলো পুরোপুরিভাবে অবহেলা করা হয়েছে ও অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। এই অবস্থা দূর করতে ভাইসরয় লর্ড কার্জনের উদ্যোগে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হয়। কিন্তু এই বিভাগ স্বল্পস্থায়ী হয়। বাঙালি হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং ১৯১১ সালে আবার বাংলা এক হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালে আবার তারা পৃথক হয়ে যায়। আজ দু-অংশই উত্তাল। নিকট ও দূর ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে তা বলা কঠিন। কিন্তু ভারতের একটি অংশ হতে এর কোনো ইচ্ছা নেই। ঐধরনের একত্রীকরণের অসুবিধা কী তা স্পষ্ট। পাকিস্তানে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু ভারতে তারা হবে সাত ভাগের এক ভাগ। পাকিস্তানে তারা অর্থনৈতিক সম্পদের একটি বড়ো অংশের ভাগ পেতে পারে, কিন্তু ভারতে সম্পদের ভাগ পেতে অন্যান্য অনেক অঞ্চলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। এর নতুন পাটকলগুলোকে কলকাতার কলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে, কলকাতা বন্দরের সঙ্গে উন্নয়নশীল চট্টগ্রাম বন্দরকে মোকাবেলা করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে একত্রিত বাংলার আত্মপ্রকাশও একটা ফলাফল হিসেবে কেউ ভাবতে পারেন, কিন্তু তা হবার সম্ভাবনাও খুব কম। ১৯৪৭ সালে শরৎ চন্দ্র বসু ও সোহরাওয়ার্দি এরকম একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু তা কার্যকর হয় নি। কিন্তু পূর্ব বাংলা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে লীন না হবার ব্যাপারে খুবই সচেতন। আর এধরনের একত্রীকরণ করতে হলে পশ্চিমবঙ্গকে ভারত থেকে পৃথক হতে হবে — কিন্তু এধরনের যেকোনো উদ্যোগ ভারত শক্ত হাতে প্রতিরোধ করবে।

পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একমাত্র বিকল্প হলো পূর্ণ স্বাধীনতা অথবা পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে শিথিল ফেডারেশন। পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান নেতৃত্ব স্বাধীনতার ক্ষেত্রে খুব আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। পূর্ব পাকিস্তান ব্যাকুলভাবে যেটা চাচ্ছে সেটা হলো তারা নিজেরাই নিজেদের শাসন করবে — তারা চায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। নিজ শাসন বা স্বরাজ যাই বলুন না কেন, তারা তাই করতে চায়, যদি সম্ভব হয় তবে পশ্চিম পাকিস্তানের সহযোগিতা নিয়েই। যদি পূর্ব পাকিস্তানীদের নিশ্চয়তা দেয়া হয় যে তাদের ঘরের তারাই প্রভু, তবে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে ফেডারেল সরকারব্যবস্থায় অংশ নেবে। সেখানে দুর্বল কেন্দ্র থাকতে হবে এবং কেন্দ্র তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তপে করবে না। ভারত একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র কিন্তু একটি সংবদ্ধ ভূখণ্ড। পাকিস্তান একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র কিন্তু বিভক্ত ভূখণ্ড। এই দুই রাষ্ট্রেরই ভবিষ্যত হলো শিথিল ফেডারেল কাঠামোর। উভয় দেশকেই আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক চেতনাকে সত্যিকারের মর্যাদা দিতে হবে এবং দু-দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। দেশবিভাগ হয়েছিল মুসলমান-অধ্যুষিত প্রদেশগুলোর ওপরে হিন্দু আধিপত্যের ভয় থেকে। পূর্ব পাকিস্তানের ওপরে পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য একইভাবে অমীমাংসিত প্রমাণিত হয়েছে।

১৯৪৭ সালের পূর্বের পাকিস্তান-আন্দোলনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের দাবির মিল রয়েছে। হিন্দির আধিপত্যের বিপরীতে উর্দুকে রক্ষা, আইনসভায় ও চাকরিতে মুসলমানদের অংশভাগ, কংগ্রেসের শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে মতের বিপরীতে মুসলমানদের ফেডারেল কাঠামোর দাবি এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের আরও ক্ষমতার দাবিসহ অনান্য কিছু কারণই ছিল ভারতবিভাগের কারণ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী মুসলিম লীগ আইনসভা বয়কট করেছিল। ইতিহাস কি তার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে?

[ড. জাইদ লন্ডন ইউনিভার্সিটির প্রাচ্য ও আফ্রিকা অধ্যয়ন স্কুলের ইতিহাসের প্রভাষক।]

পুরনো পাকিস্তানের সমাপ্তি

দি টেলিগ্রাফ, ১০ মার্চ ১৯৭১

ডেভিড লোশাক

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

ঢাকা। ভারতীয় উপমহাদেশে দেশবিভাগের কোলাহলের মধ্যে জন্ম নেয়া, অযোগ্য রাজনীতিবিদ ও অপরিণামদর্শী জেনারেলদের মাধ্যমে খুঁড়িয়ে চলা, জিন্নাহ-সৃষ্ট, ইসলামের প্রতি অনুরক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র এখন মৃত। গত দুই সপ্তাহের দৃশ্যপট ও নিপীড়নমূলক রাজনীতির পর বলা যায় পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যাওয়াটাই সমাধান হতে পারে। ১২ কোটি পাকিস্তানীর, বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের শোষিত ৭ কোটি বাঙালির দুঃখজনক অতীতের চাইতে মলিন ভবিষৎ অপেক্ষা করছে।

শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণআন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার ফলে যে-সংকট সৃষ্টি হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারকে তা বিপদে ফেলে দিয়েছে। আর যদিও হবার কথা নয় তবু, রক্তপাত ছাড়াই, কোনোক্রমে তার সমাধান হতে পারে। কিন্তু বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের নেতারা যে আপসরফাই করে থাকুন না কেন, দুই জাতিকে একত্রে রাখার যে-নিরীক্ষা করা হয়েছে, তা ব্যর্থ হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে খুবই সাধারণ একটি সত্য যে এখানে দুই জাতি রয়েছে। এদের কোনো সাধারণ স্বার্থ নেই, কোনো পারস্পরিক নির্ভরতা নেই, কোনো সাধারণ ভাষা বা খাদ্যাভ্যাস নেই এবং এমনকি ইসলামও তাদের একত্রে রাখতে পারে না।

শেষ যে-বিষয়টি বোঝার দরকার তা হলো, ইসলাম কোনো ঐক্যের শক্তি নয়। এটা মধ্যপ্রাচ্যে প্রমাণিত হয় নি; এখানেও হচ্ছে না।

ভারতীয় শত্রুতা

দেশটির দুই অংশের মধ্যে অনেক পার্থ্যক্যের সঙ্গে, যার অনেকগুলোই মীমাংসা করা সম্ভব নয়, যোগ হয়েছে এই ভৌগোলিক সত্যটি: দু-টি অংশ এক হাজার মাইলের শত্রুভাবাপন্ন ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন। দুই অংশের মধ্যে আকাশপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে গত মাসে ভারত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে এই পরিস্থিতির আরও অবনমন ঘটে। কোনো আধুনিক রাষ্ট্রই — অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে এবং সবচেয়ে বড়ো কথা ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে — টিকে থাকতে পারে না। পাকিস্তানের নেতারা ২৩ বছরের উদ্বিগ্ন সময়ে স্থিতিশীল, স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করতে ব্যর্থ হবার পেছনে এগুলোই হলো কারণ। একই কারণে পাকিস্তান সবসময়ই রোগগ্রস্ত থেকেছে। কিন্তু এর সমাধান হিসেবে পাকিস্তান দু-টুকরো হয়ে যাচ্ছে যা আবার আগের রোগের চেয়েও মারাত্মক। এখন দীর্ঘদিনের সংঘাত ফুটন্ত কড়াইয়ের পানির মতো ফুটছে, নেতাদের ফিরে আসার আর কোনো উপায় নেই।

দু-জন পাকিস্তানী এবং তার বন্ধুরা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ এই বিভক্তির জন্য দায়ী। গত ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এসবকিছু ঘটছে। বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা দেবার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ফর্মুলা খুব মসৃণভাবে ও সুষ্ঠুভাবে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে।

১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। এই প্রথমবারের মতো পূর্ব পাকিস্তান সরকারব্যবস্থায় তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। এটাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। নির্বাচন অযোগ্য রাজনীতিবিদ ও হঠকারী জেনারেলদের জবাব দেয়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও গরীব মানুষের মিলিওনার নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো ‘ইসলামিক সমাজতন্ত্র’-এর কথা বলে পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮৫টি আসন লাভ করেন। বাঙালিদের প্রিয় জননেতা শেখ মুজিবুরের দল আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ টি আসনের দু-টি ছাড়া সব আসনই লাভ করে। নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের ইস্যুর আবেগকে কাজে লাগিয়ে মুজিব এই সাফল্য পান। এভাবে তিনি ৩০০ আসনের আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন।

এর পরে মনে হয়েছিল রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নে সম্মত হবেন যার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দৃশ্যপট থেকে সরে যাবেন। এক্ষেত্রে আদর্শগত দিক থেকে তাদের বিভক্তি কম ছিল, এবং উভয় নেতাই সংবিধান-ইস্যুতে আপস করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কেবল দুই-দল-ব্যবস্থাই তৈরী করে নি, এটা এমন এক দুই-দল-ব্যবস্থা করে যাতে জনসংখ্যার কারণে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তানকে শাসন করবে এবং বিরোধী দল কখনোই রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এই ফলাফল দুই অংশের মধ্যে পার্থক্য তৈরী করে।

নিজেদের মর্যাদা রক্ষার জন্য এবং উপনিবেশ ঠেকাতে পূর্ব পাকিস্তান প্রায় পুরোমাত্রার স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছে যা আওয়ামী লীগের ‘ছয় দফা’-র ভিত্তিতে চাওয়া হচ্ছে। এর অধীনে নিজেদের রাজস্ব ও ব্যয়, বৈদেশিক সাহায্য, বৈদেশিক বাণিজ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিজেদের অধীনে থাকবে এবং কেবল প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি, এবং সম্ভবত মুদ্রা একটি দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে। পশ্চিম পাকিস্তানে এই প্রস্তাব ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। এটা মি. ভুট্টোর কাছে গৃহীত হয়নি — কেবল এজন্য নয় যে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাতে ব্যাহত হবে — আরও একটি ব্যাপার হলো, তার দর্শন অনুসারে ভারতের সঙ্গে হাজার বছরের যুদ্ধ চালাতে হলে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার দরকার।

ইয়াহিয়ার কাছেও এটা গ্রহণযোগ্য ছিল না। তার মনে হয়েছে এতে পাকিস্তানের সংহতি নষ্ট হবে। এটা পাঞ্জাবী-প্রাধান্যের-সেনাবাহিনীর কাছেও গৃহীত হয় নি। তারা পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্র দিতে চায়, কিন্তু তা এমন কোনো গণতন্ত্র নয় যে, বাঙালি-সংখ্যাগরিষ্ঠতার সেনাবাহিনীবিমুখ সরকারের প্রতি চিরদিনের জন্য তাদের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। আর এটা অগ্রহণযোগ্য ছিল অন্য রাজনৈতিক কারণে। এরকম স্বায়ত্তশাসন পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশকেও অনুপ্রাণিত করবে এবং পাকিস্তানের সংহতি আরও সংকটের মুখে পড়বে। তাই আইনসভা বসার আগেই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।

ভুল পদ্ধতি

এরকম গুরুতর সময়ে ইয়াহিয়া ভুল পথে এগোলেন। ইয়াহিয়া আইনসভার অধিবেশন স্থগিত করলে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। এক সপ্তাহের আন্দোলনের পর তিনি ২৫ মার্চ অধিবেশনের নতুন তারিখ ঘোষণা করেন, কিন্তু তার বেতার ভাষণ শুনে বাঙালিরা তার ইচ্ছার সামঞ্জস্য খুঁজে পায় নি। জেনারেলের চাইতে তিনি সার্জেন্ট মেজরের স্টাইলে পদক্ষেপ নেয়ায় তা পূর্ব পাকিস্তানের অধৈর্য জনতাকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয় এবং স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’-এর ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত থাকার মতো কিছু বলে তাদের আশ্বস্ত করতে পারেন নি। রোববারে শেখ মুজিব এই ঘোষণার কাছাকাছি চলে এসেছেন, সেনাবাহিনীর তড়িৎ ও কঠোর প্রতিক্রিয়া ছাড়াই তিনি এটা করতে পারতেন। সেনাবাহিনী যেকোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতার আন্দোলনকে প্রতিহত করবে, এর অর্থ অনেক রক্ত ঝরবে।

যদি ‘বাংলাদেশ’ স্বাধীনতা লাভও করে, তবে তার নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে এমন একটি অর্থনীতি থেকে যা ইতোমধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত। কিন্তু যদি একে প্রতিহত করা হয় বা দমন করা হয়, তবে ক্রমবর্ধমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাকে কীভাবে হজম করা যাবে? আর দখলদার বাহিনী দিয়ে একটি জাতিকে কীভাবে দমিয়ে রাখা যাবে, যে-বাহিনীর ঘাঁটি এক হাজার মাইল দূরে? যদি পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তবে পশ্চিমেও একইভাবে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হবে, অর্থনৈতিক অবস্থা সেখানেও ভালো নয়।

পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবালী ভারতের সমস্যা-রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও গভীর প্রভাব ফেলবে। মার্কসীয় নেতা জ্যোতি বসু তার নিজস্ব ‘ছয় দফা’ দাবি করে দিল্লি থেকে পৃথক হতে চাইছেন। এসব হচ্ছে কেবল এজন্য নয় যে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় বেশ কিছু চীনা ‘পর্যবেক্ষক’-কে দেখা যাচ্ছে।

৭ই মার্চের ভাষণের পরে

দি টাইমস, ৮ মার্চ, ১৯৭১

পল মার্টিন

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক


আপস অথবা সরাসরি সংঘাত: পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিধাগ্রস্ত

ঢাকা, মার্চ ৮। আজ পাকিস্তানের সংকট নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে। কারণ দেশটির উভয় অংশকেই আজ রাজনৈতিক আপস অথবা সরাসরি সংঘাতের মধ্যে একটিকে বেছে নেয়ার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল যে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বক্তৃতা দিয়েছেন, তা থেকে মনে হচ্ছে আপসের কিছু সুযোগ এখনও রয়েছে। তিনি বলেছেন ২৫ মার্চে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আইনসভায় বসতে রাজি হবার ক্ষেত্রে সামরিক সরকারকে অন্তঃত চারটি শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে। গত কয়েক সপ্তাহে ঢাকা এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে যে-উত্তেজনা দেখা গিয়েছে, তা এখনও বলবৎ রয়েছে কিন্তু এরপরও শ্বাস ফেলার সময় তৈরী হয়েছে। বিপদের কথা এই, উভয় পক্ষের সামরিক ও বেসামরিক জঙ্গীরা বিশেষত পূর্বের মুজিববাদী চরমপন্থী ছাত্ররা সংকটকে পুনরায় চরম গভীরে ঠেলে দিতে পারে।

পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যত যে অনিশ্চিত তা বোঝা যাচ্ছে বিদেশী নাগরিকদের মধ্যে যারা দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী তাদের ফিরে যাবার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। প্রথম ব্যাচ হিসেবে জার্মানীদের একটি দল, যাদের মধ্যে দূতাবাসের স্টাফ ও পরিবার রয়েছে এবং কর্মরত অন্যরা আজ ব্যাংককে চলে গেছেন। ব্রিটিশদের মধ্যে দেশে ফিরে যাবেন তাদের জন্য একটি বোয়াক ভিসি টেন এয়ারলাইন অপো করছে আগামীকাল ঢাকা ছাড়ার জন্য। যদিও সবাইকে চলে যাবার ঘোষণা দেয়া হয় নি, তবুও কোনো সরকার সতর্ক হবার প্রয়োজন মনে করছে। বিগত সপ্তাহগুলোর ব্যাপক মিছিল-বিক্ষোভে থেকে অবশ্য বিদেশীদের বিরুদ্ধে কোনো হুমকি দেয়া হয় নি। কিন্তু যেহেতু আইন-কানুন পরিস্থিতি ভালো নয়, তাই এই মনোভাব যে পরিবর্তিত হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

বাঙালিদের জন্য ইস্যুটি খুব পরিস্কার: শেখ মুজিবুর ও তার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে দিতে হবে, যারা পরিস্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে নির্বাচনে জিতেছে, অথবা নির্বাচনটিই প্রহসনে পরিণত হচ্ছে। শেখ পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র কার্যকর শক্তি বলে এতোকিছু সম্ভব হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে শেখের অবস্থান সাংঘাতিক ভালো। ৩ মার্চের সংসদীয় অধিবেশন স্থগিত করার পর আওয়ামী লীগের ডাকে ঢাকায় হরতাল পালিত হচ্ছে।

যদিও প্রদেশজুড়ে প্রয়োজনীয় সেবা পুনরুদ্ধার করা হয়েছে, কিন্তু সব সরকারী-বেসরকারী অফিস, স্কুল ও ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকবে। রাজস্ব প্রদান স্থগিত থাকবে, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ব্যাংকিং লেনদেন বন্ধ থাকবে এবং পরবর্তী নির্দেশ না-দেয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে চালু পশ্চিম পাকিস্তানের একাউন্ট বন্ধ থাকবে। শেখ পশ্চিমের সঙ্গে যে-অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছেন, এর ফলে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা তৈরি করবে। বাঙালিরা বিশ্বাস করে যেহেতু তাদের বেশিরভাগ উৎপাদিত পণ্য পশ্চিম থেকে আসে, তাই বাণিজ্য বন্ধ হলে তারা এর প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাবে।

শেখ আরেক জায়গায় জয়ী হয়েছেন। তার অসহযোগ আন্দোলন কাজে দিচ্ছে। ব্যপারাটা বোঝা গেল, যখন গতকালের বিশাল জনসভায় তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন ঢাকার বেতারকেন্দ্র তা প্রচার করতে রাজি হলো। কিন্তু সময়মতো তা সম্প্রচারিত হয় নি। বিক্ষোভকারীরা এর প্রতিবাদ জানায় এবং বেতারকেন্দ্রে ঘরে-তৈরী-বোমা নিক্ষিপ্ত হয়।

পাকিস্তান: ভাঙ্গন রোধে ইয়াহিয়া সেনাবাহিনী ব্যবহার করবেন

দি অবজারভার, ৭ মার্চ, ১৯৭১

সিরিল ডান

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্তাল কেন্দ্র ঢাকা আজ যে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে তার ফলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধের সূচনা করতে পারে। এর ফলে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানে স্বাধীনতা লাভের ২৫ বছর পর দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানের ৫০-বছর-বয়সী রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল ঘোষণা করেছেন যে আজ ঢাকার পল্টন ময়দানে একটি গণসমাবেশে করবেন। তার আন্দোলনের সেনাপতিরা বলছেন আজ মুজিব একটি ‘ঐতিহাসিক বক্তৃতা’ করবেন, যার অর্থ পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পৃথক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেবেন।

এই সম্ভাবনার কথা বুঝতে পেরে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান — যিনি এখনও সামরিক শাসক হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ মতা ধারণ করেন — গতকাল দুপুরে এক বেতার-ভাষণে দৃঢ়ভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন যে তিনি পাকিস্তানের ভাঙ্গন বরদাশত করবেন না। তিনি তার ভাষণে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হস্তপে করতে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘যাই ঘটে থাকুক না কেন যতণ পর্যন্ত আমি পাকিস্তান-সেনাবাহিনীর প্রধানের দায়িত্বে আছি, পাকিস্তানের সম্পূর্ণ ও পরম অখণ্ডতা রা করবো। এবিষয়ে যেন কোনো সন্দেহ কারো মনে না থাকে। আমি সামান্য কয়েকজন লোককে কোটি মানুষের পাকিস্তান ভূমিকে ধ্বংস করার সুযোগ দিতে পারি না’।

একই সময়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আজ ঢাকায় চরম বিক্ষুব্ধ প্রদর্শনীকে রোধ করার জন্য ও পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করার জন্য দু-টি পদপে গ্রহণ করেছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নির্বাচিতরা ২৫ তারিখে একটি সংবিধান প্রণয়নের জন্য আইনসভার অধিবেশনে বসবেন। সংবিধান অনুসারে মতা সেনাবাহিনীর হাত থেকে জনগণের কাছে হস্তান্তরিত হবার কথা। ডিসেম্বরের ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি আসনেই জয়ী হন কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো সমর্থনই পান নি।

শেখ যখন পুরো পাকিস্তানের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এমন এক ধরনের স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা দিতে চাইলেন যার প্রকৃতি স্বাধীনতার চেয়ে সামান্য দূরবর্তী একটি অবস্থান, তখনই বর্তমান সংকট তৈরী হলো। এর ফলে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রি ও পশ্চিমাংশে বিজয়ী পিপলস্ পার্টির প্রধান মি. জুলফিকার আলি ভুট্টো প্রথম জাতীয় পরিষদের ৩ মার্চ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশন বয়কট করেন। এর পরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘অনির্দিষ্টকাল’-এর জন্য অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন এবং এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পূর্ব পাকিস্তানে তাৎণিকভাবে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যার ঘটনা ঘটে। মৃতের সংখ্যা কত তা কঠোর সেন্সরশিপের কারণে তাৎণিকভাবে জানা যায় নি, তবে গত শুক্রবারে একটি এজেন্সি-প্রতিবেদন থেকে জানা যায় সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে ২,০০০ লোক মারা যায়।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গতকাল এটাও ঘোষাণা করেছেন যে তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পূর্ব পাকিস্তানে যাচ্ছেন। পদপেটি সাহসী, এমনকি বেপরোয়াও বলা যায় একে। পূর্ব পাকিস্তানে এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার পূর্বসূরী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন ঘটিয়েছিল। এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে যাবার মাধ্যমে নিজের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলছেন। তিনি যদি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতবাদীরা ‘সামান্য কয়েকজন’ তবে শিগগীরই তিনি দেখতে পাবেন যে তার জানার মধ্যে গলদ আছে।

এটা শোনা যায় যে সংকট সৃষ্টি হবার পর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আড়াই ডিভিশন সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করছে। তার পর থেকেই এর সংখ্যা বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১০০০ মাইলেরও বেশি ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন।

এটা শোনা যায় যে সংকট শুরু হবার পর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আড়াই ডিভিশন সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করছে। তার পর থেকেই সৈন্যসমাবেশ ক্রমশ বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১০০০ মাইলের ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পূর্বে দু-জন কাশ্মিরী ভারতীয় এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ছিনতাই করে লাহোরে নিয়ে যাবার পর থেকে ভারতীয় ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে পাকিস্তানী বিমান চলাচলের ওপর ভারত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। পাকিস্তানের বিমানগুলোকে তাই পুরো ভারত-সীমান্ত ঘুরে শিলং-এর পথ ধরে আসতে হয়। ভারতীয় প্রতিরামন্ত্রি জগজীবন রাম বলেছেন পাকিস্তানের সংকট সত্ত্বেও এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। শেখ মুজিবুরের স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তানের পরিকল্পনায় স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনীর কথাও রয়েছে। অবশ্য তার অস্তিত্ব এখনও নেই, আর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কেবল একটি রেজিমেন্টেই পূর্ব পাকিস্তানী সদস্য রয়েছে।

গতকাল লন্ডনে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় শেখ মুজিবুর “এখনও একক পাকিস্তানের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন”, কিন্তু “পুরো জনগোষ্ঠীর চাপ রয়েছে যে তিনি যেন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে ‘জাহান্নামে যাও’ বলে বিদায় করে দেন”। শেখ সবসময় বলে এসেছেন যে পূর্ব পাকিস্তান “পশ্চিম পাকিস্তানের একটি অবহেলিত উপনিবেশ এবং তার স্বায়ত্তশাসন পরিকল্পনা এই শোষণ থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করবে”।

আমাদের প্রতিনিধি মৃতের সংখ্যা ‘প্রায় ২০০’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং জানাচ্ছেন এই সংখ্যাটি প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে কম কারণ সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র বিক্ষুব্ধ জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। শেখ তার জনগণকে শান্ত থাকার আবেদন জানিয়েছেন এবং তার নির্দেশ না-দেওয়া পর্যন্ত তারা যেন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ না-করে ও পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। এই মুহূর্তে বাঙালিরা অবশ্য শেখ যা বলবেন তা যাই হোক না কেন করতে রাজি আছে। কিন্তু তাদের মেজাজ বিগড়েও যেতে পারে যদি তিনি তাদের প্রত্যাশা পূরণ না করেন।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন যে সেনাবাহিনী অস্ত্র ব্যবহার করছে। দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন ‘বাংলার নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে’ নগ্নভাবে সেনাবাহিনীকে ব্যাবহার করা হচ্ছে। বিােভ আরও ছড়িয়ে দেবার জন্য তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের কাছে ‘অবিলম্বে’ পূর্ব পাকিস্তানে সেনাভিযান বন্ধের দাবি জানানোর আবেদন জানিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন যে তারা ‘দখলদার বাহিনীর মতো’ আচরণ করছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ওপরে ‘উৎপীড়ন’ বন্ধ করতে ইয়াহিয়ার ওপরে চাপ প্রয়োগের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি অনুরোধ করেছেন এমন তথ্য ভারতীয় বেতার আকাশবাণীতে প্রচার হবার পর তা অস্বীকার করেছেন।

জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ইয়াহিয়া খান বলেন ডিসেম্বরে পাকিস্তানের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পর ‘আমি জনগণের কাছে মতা হস্তান্তরের জন্য যতগুলো পদপে গ্রহণ করেছি তার প্রতিটি কয়েকজন নেতার জন্য বাধাগ্রস্ত হয়েছে’। তিনি বলেন তিনি অধিবেশন স্থগিত করেছেন পরিস্থিতি শান্ত হবার জন্য, কিন্তু তার এই পদপেকে ‘পুরোপুরিভাবে ভুল বোঝা’ হয়েছে। তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানের গণ্ডগোল থামাবার জন্য তিনি সর্বনিু সংখ্যায় সেনাবাহিনী ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্যে ‘আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ও আল্লাহর ওপরে ভরসা রেখে একটি গণতান্ত্রিক জীবনপদ্ধতির দিকে এগিয়ে যাবার’ আহ্বান জানান।

নির্বাচনের পর থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন ভারতবিভাগের আগে, যখন ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করা হচ্ছিল, তখনই পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়েছিল কিন্তু পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘প্রতারণা’ করা হয়েছে। তিনি বলেন ১৯৪০ সালের মার্চে মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবে ‘স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের’ কথা বলা হয়েছিল যেখানে রাষ্ট্রগুলো হবে ‘স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম’।

জাতীয় পরিষদ বসলে যে নতুন সংবিধান প্রণীত হবার কথা সেখানে শেখ যিনি সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধি কেন্দ্রের হাতে কেবল পররাষ্ট্র ও প্রতিরা রাখতে চান। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে রাজস্ব ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কেন্দ্র কোনো খবরদারি করতে পারবে না। তার মতে এই দুইটি ক্ষেত্রে বিশেষত পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক ‘শোষিত’ হয়ে এসেছে। শেখ ইতোমধ্যে ইয়াহিয়ার সঙ্গে একমত হয়েছেন যে প্রাদেশিক রাজস্বের আনুপাতিক একটি অংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিরা-বাজেটে চলে যাবে। কিন্তু বাঙালিদের প্রবল আপত্তি ঐখানে যে তাদের রাজস্বের ৭০ ভাগই সেনাবাহিনী, পররাষ্ট্র ও মুদ্রাবিনিময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

তারা ক্ষুব্ধ এজন্য যে ৩০০,০০০ সৈন্যের পাকিস্তান বাহিনীকে পোষার জন্য তাদের রাজস্ব ব্যয় করতে হয়। আর সেই সেনাবাহিনীর প্রধান কাজ হলো কাশ্মির ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে সংঘাতে নিয়োজিত থাকা। কিন্তু কাশ্মির বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের মতো সংশ্লিষ্টতা বোধ করে না। উপরন্তু বাংলা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে খুবই আগ্রহী যা ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর থেকে বন্ধ হয়ে আছে। যদিও অনেক ভারতীয় পাকিস্তানের অস্তিত্ব নিয়েই খেদ ব্যক্ত করে থাকে কিন্তু পাকিস্তানকে দু-টি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে তাদের আপত্তি নেই। ভারতের সরকারী পর্যবেণ হলো যদি পাকিস্তানের নতুন জাতীয় পরিষদে মুজিবুর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর পে নেতৃত্ব দেন তবে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে যাবে।

ভারত এটাও বিশ্বাস করে যে পূর্ব পাকিস্তান যদি ভেঙ্গে আসে তবে তার অর্থনৈতিক অবস্থার সম্ভবত আরও অবনমন হবে। সেক্ষেত্রে এখনকার জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যর্থতা চিহ্নিত হতে পারে। স্থানীয় সমাজতন্ত্রীরা এতে অস্থির হয়ে উঠবে এবং একসময় পশ্চিমবঙ্গের শক্তিশালী সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে তারা জোট বাঁধতে চাইবে। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা খুব একটা উজ্জ্বল নয়। একসময়ে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক আয় পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বেশি ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি আর সেরকম নেই। পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্বের চাইতে সফলভাবে শিল্পায়ন ঘটানো হয়েছে। ‘ঔপনিবেশিক শোষণের ত্রে’ পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প প্রায় পুরোপুরি পাটের ওপরে নির্ভরশীল।

পূর্ব পাকিস্তান হলো পৃথিবীর মধ্যে প্রথম এলাকা যেখানে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের বাস্তবতা নির্মম আকারে দেখা দিয়েছে। এখানে প্রতি বর্গমাইলে ১,৩০০ জন মানুষ বাস করে ও প্রতি বছর এর এক-তৃতীয়াংশ ভূ-ভাগ বন্যায় প্লাবিত হয় এবং অধিবাসীদের অন্যত্র বসতি স্থাপনেরও সুযোগ নেই। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন যেমন আছে, এঅবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের এককভাবে এগিয়ে যাবার ক্ষমতা নেই।

পূর্ব পাকিস্তানের নেতা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন

দি টাইমস, ৬ মার্চ, ১৯৭১

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

করাচি। বিক্ষোভে উত্তাল পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে এখন দুটি বিকল্প আছে: তিনি এককভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন অথবা তিনি নিজেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকতে পারেন এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সেখানে যোগ দিতে আহ্বান জানাতে পারেন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জেড. এ. ভুট্টো নিশ্চিতভাবেই তাতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানাবেন কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট প্রদেশগুলোর নেতারা শেখ মুজিবুরের সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য প্রস্তুত থাকবেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ দু-দশক ধরে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় প্রাধান্য বিস্তার করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে তারা বুঝতে পেরেছেন যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পাকিস্তানকে একত্রিত রাখতে চাইলে বাঙালির শাসনকেই মেনে নিতে হবে কারণ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আইনসভায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যেসব শান্তিকামী রয়েছেন, যারা মনে করেন যে ক্ষমতায় বাঙালিদের প্রাপ্য ভাগ দেয়া দরকার, তারা পরাস্ত হয়েছেন। আর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে তিনি হয়তো কট্টর পাঞ্জাবীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে এই ভীতি কাজ করছে যে যদি বাঙালিরা ক্ষমতায় আসে তবে সামরিক বাহিনী কর্তন করে তার আকার ছোট করে ফেলা হবে।

সেনাবাহিনীর হাতে এক যুগ ধরে দমন-পীড়নের শিকার হবার কারণে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে যে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হ্রাস করা হবে। তাই এটা পরিস্কার যে পাঞ্জাবীদের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্টকে প্রভাবিত করেছে সংবিধান রচনার পরিষদকে রদ করার জন্য। বোঝা যাচ্ছে এসপ্তাহের প্রথমার্ধে প্রেসিডেন্টকে বোঝানো হয়েছিল অধিবেশন প্রত্যাহার করে নিলে বাঙালিরা সামরিক শৌর্য্যরে কাছে নতজানু হবে। পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস এম আহসান পরে পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টকে অধিবেশন স্থগিত করার বিপরীতে তার পরামর্শ দেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার মন্ত্রিসভার কট্টরপন্থীদের পরামর্শেই কাজ করেন। বাংলায় পরিস্থিতির অধিক অবনতি এডমিরাল আহসানের অবস্থানকেই সত্য প্রমাণ করেছে এবং প্রেসিডেন্টকে এখন পেছনে ফিরে আসতে হবে এবং অধিবেশনের একটি নতুন তারিখ ঘোষণা করতে হবে।

ইয়াহিয়া খানের প্রশাসনের সামরিক পর্যবেক্ষকরাই স্বীকার করেছেন যে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ঠেকিয়ে রাখা খুব কঠিন হবে এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পূর্ব পাকিস্তানের ৭৫ মিলিয়ন মানুষকে বলপূর্বক দমিয়ে রাখা যাবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক কিছু নির্ভর করছে মি. ভুট্টো কী করার সিদ্ধান্ত নেন তার ওপর। যদি ইয়াহিয়া নতুন অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করেন এবং তাতে ভুট্টো যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান তবে পাকিস্তানে গুরুতর আঞ্চলিক সমস্যার সৃষ্টি হবে। এই সংঘাত হবে পাঞ্জাব প্রদেশের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট প্রদেশ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান ও সিন্ধুর মিলিত জোটের যারা পাঞ্জাবের সম্মতি ছাড়াই সংবিধান প্রণয়ন করতে পারবেন।

কিন্তু চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এটা বের করা কঠিন যে শেখ মুজিবুর রহমান এবং মি. ভুট্টো আইনসভায় তাদের পার্থক্য কীভাবে ঘোচাবেন এবং উভয় পাকিস্তানে গৃহীত একটি সংবিধান কীভাবে প্রণয়ন করবেন। বিশ্বে অর্জিত ইতিবাচক যা ভাবমূর্তি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আছে তাকে সঙ্গী করেও ইয়াহিয়ার পে এরকম কোনো সংবিধান অনুমোদন করা সম্ভব নয় যা ভুট্টোর কাছে, পাঞ্জাবের কাছে ও সেনাবাহিনীর কাছে অগ্রহণযোগ্য। বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারভিত্তিক কোনো সংবিধান অনুমোদন করতে প্রেসিডেন্ট যদি ব্যর্থ হন তবে তবে শেখের পক্ষে ঘোষণা দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না যে পশ্চিমাংশ পুরো পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং প্রদেশ দু-টি চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।

পাকিস্তান ভাঙ্গনের মুখোমুখি

দি টাইমস, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

দিল্লি, ২৭ ফেব্রুয়ারি। পশ্চিম পাকিস্তানের ও পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো প্রথমবারের মতো জনঅংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কট করার ফলে মীমাংসার আর কোনো পথ খোলা রইলো না। সত্যিকারের বিপদ এখন দেখা গিয়েছে। ভুট্টো ও পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান অধিবেশন বসার ১২০ দিনের মধ্যে পরস্পরের কাছে সমর্থনযোগ্য ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মাধ্যমে অনুমোদিত একটি সংবিধান প্রণয়ন করবেন বলে কথা ছিল। তেমনটি ঘটার সম্ভাবনা কমই ছিল, কিন্তু এখন যেটা দাঁড়ালো তাতে, তেমন হবার আশা অপসৃত হলো।

এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে যতক্ষণ না প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুই নেতার মধ্যে অধিবেশন বসার তারিখ ৩ মার্চের মধ্যে মধ্যস্থতা করার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করছেন, পাকিস্তানে একটি ব্যাপক আকারের বিচ্ছিন্নতা-আন্দোলন শুরু হবার হুমকির মুখে পড়ছে। কিন্তু সমঝোতা হবার আর কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিব ও তার আওয়ামী লীগ চাচ্ছে ভুট্টো ও তার পিপলস্ পার্টিকে সহ অথবা ছাড়াই অধিবেশন আহ্বান করতে। ৩১৩টি আসনের মধ্যকার ১৬৭ আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নিজেরাই তাদের প্রস্তাবিত চূড়ান্ত-স্বায়ত্তশাসনের সংবিধান পাশ করাতে সম। তাদের প্রস্তাব অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হবে এবং তার হাতে কেবল তিনটি দায়িত্ব থাকবে: প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা।

অন্যদিকে ভুট্টো কার্যকর কেন্দ্রীয় সরকার চান। বাঙালিরা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে তাদের সাংবিধানিক প্রস্তাবনা পাশ করিয়ে নেয়, তবে সেটা পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি ভুট্টো যদি সংবিধান প্রণয়নে অংশগ্রহণও করেন তারপরও সন্দেহ থেকে যায় যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এমন কোনো সংবিধান অনুমোদন করবেন বা পারবেন যা বাঙালিদের চাপে প্রণীত হয়েছে। অধিবেশন বয়কট সম্পর্কিত ব্যাখ্যা দেবার সময় ভুট্টো এই শংকার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। এসপ্তাহের প্রথম দিকে তিনি পাকিস্তান রেডিওকে বলেছিলেন তিনি সত্যিকার অর্থে সংবিধান প্রণয়ন করতে যাচ্ছেন না … তিনি ঢাকায় যেতে পারেন কেবল এই শর্তে যে বাঙালিরা তাদের চূড়ান্ত স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক ছয় দফার ব্যাপারে আপস করবে।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে পারস্পরিক মিলিত হবার কোনো সম্ভাবনা আর দেখা যাচ্ছে না। শেখ মুজিবুর রহমান বলছেন এবং বলতে থাকবেন যে পাকিস্তানকে যদি একক দেশ হিসেবে টিকিয়ে রাখতে হয় তবে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার ওপরে ভিত্তি করেই সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। তিনি তার ছয়দফা কর্মসূচীর ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। রাজস্ব ও বৈদেশিক বাণিজ্য কি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই থাকবে, না তা প্রাদেশিক সরকারের হাতে যাবে — দুই নেতার মধ্যে সত্যিকারের বিরোধ সেবিষয়েই।

মি. ভুট্টোর জনপ্রিয়তা ভারত-বিরোধী অবস্থানের কারণেই। তিনি চান রাজস্বের ব্যাপারটি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই থাকবে যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি শক্তিশালী প্রতিরা-ব্যবস্থা থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পারেন না তার প্রদেশ কেন ১২০০ মাইল দূরে অবস্থিত কাশ্মিরীদের জন্য প্রতিরা বাজেটের অর্ধেক অংশে অবদান রাখবে। কাশ্মির নিয়ে দিল্লির সঙ্গে পাঞ্জাবের বিরোধের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বন্ধ করে দেবার অধিকার পশ্চিম পাকিস্তানের আছে কিনা সেবিষয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।

এমাসের প্রথম দিকে এক সভায় দু-নেতা জনসম্মুখে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে এই দুই দফায় তাদের মতৈক্য হয় নি এবং ফলে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় তা মি. ভুট্টোকে অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়। মনে করা হচ্ছে শেখ মুজিবুর অবশ্যই নির্ধারিত ৩ মার্চেই অধিবেশন বসতে হবে। যদি সামান্য কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী সংবিধান প্রণয়নে কাজ করেন তবে যেকোনো অর্থেই পূর্ব পাকিস্তানের ইচ্ছা অনুসারেই সংবিধান প্রণীত হবে।

এই পরিস্থিতিতে, এটা আশা করা হচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট সংবিধান অনুমোদন করবেন না এবং হয় শেখ মুজিবুর রহমান অথবা ভুট্টো এককভাবেই স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন।

বাংলার সঙ্কটকাল

দি টাইমস, ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেবেন এবং স্বায়ত্তশাসন প্রসঙ্গে তার অবস্থান তিনি পরিবর্তন করতে পারবেন না। তার দলে এবং তার বামের দলগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিম থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হবার দাবি প্রতি ঘণ্টায় আরও জোরালো হয়ে উঠছে। পূর্ব পাকিস্তানকে সারা বিশ্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে, কিন্তু জনগণ ও বিক্ষোভকারীদের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সেই শাসকের প্রতীকে পরিণত হয়েছে যাদের তারা ছুঁড়ে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই সেনাবাহিনীর এক তৃতীয়াংশ ও পুরো পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা হলো বাঙালি; তাই করাচির পে বেশিদিন মতা ধরে রাখা সম্ভব হবে না, ক্ষমতাবৃদ্ধির জন্য সামনের সময়ে যাই করা হোক না কেন। এরপরও এখন পর্যন্ত এটা নিশ্চিত নয় যে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে।

এখনও এরকম একটি সম্ভাবনা আছে যে শেখ মুজিবুর রহমান দু-টি পৃথক আঞ্চলিক সংবিধান তৈরীর আহ্বান জানাতে সমর্থ হবেন, যেখানে প্রতিটি অংশই কেন্দ্রীয় সার্বভৌম কেন্দ্রীয় কর্তৃপরে বিধান পরিত্যাগ করবে এবং যার শাসনপ্রণালী ও শাসনএলাকা আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে ঠিক করা হবে। শেখ মুজিব তার দলকে গ্রহণ করতে বা গ্রহণ করানোর চেষ্টা করতে বড়জোর এইটুকুই করতে পারেন। ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়েছে। কিন্তু ঢাকায় যাবার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানিয়ে মি. ভুট্টো জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে প্রভাবিত করেন। এই ব্যাপারটি আওয়ামী লীগ ও বাঙালিদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে।

বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ভারত-বিরোধী মনোভাব তৈরী হবার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ভুট্টোর অবস্থান সুসংহত হয়। পূর্ব পাকিস্তানীরা দেখলো নির্বাচনে হারার পরও পশ্চিম পাকিস্তানীরা মতা দখল করে রাখতে চাচ্ছে এবং নির্বাচন-পরবর্তী আলোচনায় পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবি মেনে নিচ্ছে না। তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব বছরের পর বছর ধরে বেড়ে উঠেছে। বিগত বন্যায় করাচির অমনোযোগিতার পর ডিসেম্বরের নির্বাচনে তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় নিশ্চিতভাবেই চান না যে ইতিহাস তাকে তেমন মুসলিম নেতা হিসেবে চিহ্নিত করুক যিনি পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দু-টুকরা করেছেন। মি. ভুট্টোই তাকে সেই দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তার হাত যদি শক্ত হয়েই থাকে এবং বিভক্তি যদি পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে না হয়ে থাকে তবে ভারত ও পাকিস্তান কঠোর সমস্যার সম্মুখিন হবে। পূর্ব পাকিস্তানে যখন ওলটপালট ঘটে চলেছে তখন পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন হতে যাচ্ছে যেখানে সমাজতান্ত্রিক সরকার গঠিত হবার জোর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের পুরোমাত্রার ‘বাংলাদেশ’-রাষ্ট্রের দাবিকে এখন পর্যন্ত অবাস্তব বলেই মনে হচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধিতা করে যে সহিংসতা ও উত্তেজনা চালু রয়েছে তার পাল্টা জবাব হিসেবে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপরে আঘাত আসতে পারে। আবার দুই বঙ্গের মধ্যে ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাসের ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে যা নয়া দিল্লিকে চিন্তিত করে তুলতে পারে।

যে-মুসলিম লীগের মাধ্যমে পাকিস্তানের স্বাধীনতা এসেছিল, আওয়ামী লীগ হলো পূর্ব পাকিস্তানে মৃতপ্রায় সেই মুসলিম লীগেরই উত্তরসুরী। দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে আওয়ামী লীগ জাতীয়তাবাদী ও আঞ্চলিক। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী মুসলিম লীগ হলো নিষিদ্ধ পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির বিকল্প একটি মাওবাদী সংগঠন — ছাত্র, ট্রেড ইউনিয়ন ও কৃষকদের মধ্যে যার কর্মকাণ্ড বিস্তৃত। সীমান্তের অপর পাশে, কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী) নির্বাচনে জিততে যাচ্ছে। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া নকশাল জঙ্গীদের সঙ্গে একত্রে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে যাতে নির্বাচনে একটি কমিউনিস্ট-বিজয় নিশ্চিত হয়। মস্কোপন্থী অংশটি ব্যাপকভাবে অকার্যকর। উভয় বাংলায় একই ধরনের পদেক্ষেপের উদ্দেশ্য হাসিল করতে গিয়ে আসলে একটি সাধারণ হতাশা ও স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে (অবশ্য শিল্প ও উন্নয়মূলক পদক্ষেপ যা কিছু দেখা যাচ্ছে তা ভারতীয় অংশেই হচ্ছে)।

মিসেস গান্ধী ভারতের আঞ্চলিকতাবাদ ও সমন্বয়হীনতার প্রবণতাকে উল্টে দিতে সমর্থ হতে পারেন। এছাড়া চীন বাংলা-পরিস্থিতির সুবিধা নিতে পারে, যদিও পিকিং দৃশ্যপট থেকে দূরেই রয়েছে বলে মনে হতে পারে। কোন পাকিস্তান চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে সেটা একটা প্রশ্ন। পূর্ব পাকিস্তান মনোভঙ্গির দিক থেকে অনেক কিছুই মেনে নিতে চাইবে, বিশেষত ভারতের কাছ থেকে সাহায্য নিলে (ভারতের পেছনে থাকবে সোভিয়েত ইউনিয়ন), কাশ্মির বিষয়ক ঝগড়ায় নিজেকে প্রত্যহার করে নেবে। আবার বিভক্ত পাকিস্তানেও, একটি অংশ কাশ্মির নিয়ে চীনের সঙ্গে সহযোগিতা করবে এবং অন্য অংশটি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পৃথক থাকার জন্য চীনের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। ভারতের জন্য, ভারতীয় মহাসাগর এলাকার জন্য, রাশিয়া ও চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতার জন্য, বাংলার সমস্যা সত্যিই গুরুতর।

পাকিস্তানে সহিংসতা ও বিচ্ছিন্নতার দৃশ্যপট

দি টাইমস, ১৫ জানুয়ারি, ১৯৭১

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট

অনুবাদ:
ফাহমিদুল হক

”পাকিস্তানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে আজ দেশটি সবচাইতে বিপজ্জনক ও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি”

১২০০ মাইলের ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও কিন্তু ইসলামী ঐক্যের মাধ্যমে যুক্ত পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব বাংলার ভূখণ্ডদ্বয় ২৩ বছর পূর্বে একটি একক পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। দু-অংশের স্পর্শকাতর সম্পর্ক গত দু-দশকে উন্নতির চাইতে অবনতিই বেশি হয়েছে। পাকিস্তানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে আজ দেশটি সবচাইতে বিপজ্জনক ও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। কারণ দেশটির দু-প্রদেশের নবনির্বাচিত নেতাদ্বয় পরস্পরের কাছে গ্রহণযোগ্য সংবিধানের রূপরেখা প্রণয়ণের জন্য মিলিত হচ্ছেন।

পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ ভাগ্য নির্ভর করছে তিনজন ব্যক্তির ওপরে: পূর্ব পাকিস্তানের অনলবর্ষী জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান; প্রখ্যাত আইনজীবী ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রি জুলফিকার আলি ভুট্টো, যিনি পশ্চিম পাকিস্তানের মুকুটহীন সম্রাট; এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, যাকে সংবিধান প্রণয়ণের কাজটি সারতে হবে। ভুট্টো এবং মুজিব উভয় নেতাই ১৩ কোটি পাকিস্তানীকে নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন যে সংবিধান প্রণয়ণের ব্যাপারে তারা একটি আপস-মীমাংসায় পৌঁছবেন, কিন্তু সংবিধানের মৌলিক কাঠামো নিয়ে তারা পরস্পর-বিরোধী অবস্থাই গ্রহণ করেছেন। সত্যিকার অর্থে উভয় নেতাই মনে করেন আপস করলে করতে হবে উনাকে এবং তার নিজের প্রত্যাশামতো সংবিধান প্রণীত হবে। শেখ মুজিব এমন একটি সংবিধান চান যার কারণে পাকিস্তান শিথিল ফেডারেশনের পাঁচটি রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যাবে এবং প্রাদেশিক সরকারগুলো এমন স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে যার মাত্র স্বাধীনতার চেয়ে সামান্য কম। যদি শেখের মতো করে সব কিছু হয় তবে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা-ব্যবস্থা ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে আর কিছুই থাকবে না।

অন্যদিকে মি. ভুট্টো কার্যকর কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে যার হাতে অর্থনৈতিক বিষয়াবলী ও রাজস্বসংক্রান্ত সবকিছুসহ প্রধান সবকিছুই থাকবে। দুই নেতাকে অনেক কিছুতেই একমত হতে হবে, কিন্তু সংবিধান প্রণয়ণ করতে চাইলে দুটি বিষয়ে একমত হতে হবে: বৈদেশিক বাণিজ্য ও রাজস্ব কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে না প্রাদেশিক সরকারের হাতে? এই দুই বিষয়ে যদি দুই নেতার আপসের কোনো সুযোগ থাকে তবে সেটা ছোটই; দুই ইস্যুর পেছনেই রয়েছে ইন্দো-পাকিস্তান সম্পর্ক ও কাশ্মির-প্রসঙ্গে উভয় নেতার আবেগগত ও পরস্পরবিরোধী অবস্থান। এছাড়া, উভয় নেতাই জানেন যে রাজস্ব অথবা বৈদেশিক বাণিজ্যে যদি তারা বড়ো ছাড় দেন তবে নিজ নিজ রাজনৈতিক ক্ষেত্রও ত্যাগ করতে হবে।

এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ৩১০,০০০ বর্গমাইল এলাকার ৫৭ মিলিয়ন মানুষের পশ্চিম পাকিস্তান বিগত দু-দশকে নাটকীয়ভাবে উন্নতি করেছে; কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া, ৫৫,০০০ বর্গমাইল এলাকার জলাবদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে ৭৩ মিলিয়ন মানুষ ঠাসাঠাসি করে বাস করে এবং পৃথিবীর অন্যতম পশ্চাদপদ ভূখণ্ড হিসেবে থেকে গিয়েছে। ভুল হোক আর সঠিক হোক, পূর্ব পাকিস্তানীরা বিশ্বাস করে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন ঘটেছে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থ ব্যয় করে। তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কাশ্মির নিয়ে ভারতের সঙ্গে সংঘাতের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানে অনেক বেশি অর্থ ব্যয়িত হয়ে থাকে। শেখ ও তার সমর্থকরা মনে করেন কাশ্মিরিদের তাদের নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করার অধিকার আছে এবং পূর্ব বাংলা এবিষয়ে আবেগ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে খুবই দূরে অবস্থান করছে। তাই তারা পশ্চিম পাকিস্তানের উত্তর অংশে বিপুল পরিমাণে সেনামোতায়েনের জন্য প্রতিরা বাজেটের শতকরা ৫০ ভাগে কেন অবদান রেখে যাবে তার কেনো কারণ দেখে না (পাকিস্তানের বাজেটের প্রায় অর্ধেক প্রতিরা খাতে ব্যয়িত হয়)।

বৈদেশিক বাণিজ্যের কথাও বলতে হয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য ১৯৬৫ সালের পর থেকে বন্ধ রয়েছে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানকে চীন থেকে টনপ্রতি ১৭২ রুপি হারে কয়লা কিনতে হচ্ছে। একই পরিমাণের কয়লা ভারত থেকে কিনলে ৫০ রুপি খরচ হতো। শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদে বসলে ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিই সম্ভবত থাকবে তার এবং তার সংবিধানকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে পরিচালিত করতে পারবেন। বৈদেশিক বাণিজ্য ও রাজস্ব বিষয়ে তিনি নিজেকে প্রত্যাহার করবেন কিনা তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ রয়েছে। একজন দলীয় কর্মীর মতে: ‘মনে রাখবেন এই ভোট ছিল সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার জন্য ভোট। শেখ মুজিবই কেবল স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতির কারণে স্বাধীনতাকে আটকে রেখেছেন।’ শেখও একইভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ: ‘ছয় দফা নিয়ে কোনো আপস নয়।’

কিন্তু ১,২০০ মাইলের ওপারে ভুট্টো বলছেন অন্য কথা: ‘ছয় দফার সবগুলো আমি গ্রহণ করতে পারি না। দেশটি দু-বছরও টিকবে না।’ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রি রাজস্ব ও বিশেষত বাণিজ্য প্রসঙ্গে আপস করবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। মি. ভুট্টো রাজনৈতিকভাবে বিখ্যাত হয়েছেন ভারতের বিরুদ্ধে হাজার বছরের যুদ্ধের প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করার মাধ্যমে। তাসখন্দ চুক্তির পর থেকে তিনিই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির প্রবক্তা বলে স্বীকৃত। তিনি দৃঢ়ভাবে মনে করেন ভারত-পাকিস্তান-সম্পর্ক ততণ স্বাভাবিক হবে না যতণ না ভারত অন্যান্য প্রান্তিক প্রশ্ন আলোচনার পূর্বে কাশ্মির-বিতর্কের সমাধান করছে। তিনি যথার্থই বলেন, ছয় দফা কাশ্মির বিতর্ককে চিরকালের জন্য ভারতের পক্ষে নিয়ে যাবে। অন্যদিকে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য-সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী এবং কাশ্মির ইস্যুর সমাধান ‘পর্যায়ক্রমে’ করতে চায়।

বেশিরভাগ পাঞ্জাবী মনে করে পূর্ব পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য পুনরায় শুরু করবে এবং বৈদেশিক বাণিজ্য যদি প্রদেশের হাতে যায় তবে ভুট্টোর বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের নীতিকেই মেনে নেওয়া হবে। মি. ভুট্টো জানিয়েছেন তিনি ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের বিষয়টি মেনে নেবেন যদি মুজিবুর রহমান কাশ্মির ইস্যুকে একটি জাতীয় ইস্যু হিসেবে মেনে নেন। কিন্তু ব্যাপারটা মুজিবের জন্য স্ববিরোধিতা হবে। কারণ ভুট্টোর কথা মেনে নিলে মুজিবকে পাঞ্জাবে বিপুল পরিমাণে সেনা মোতায়েনে রাজি হতে হবে এবং তার ছয় দফা কর্মসূচীর উদ্দেশ্য তাতে ব্যাহত হবে।

মি. ভুট্টো মনে করেন রাজস্বের বিষয়টি ততটা বড়ো হবে না যদি মুজিব সংবিধানে এরকম একটি ধারা যোগ করতে রাজি হন যা নিশ্চিত করবে যে কেন্দ্রীয় সরকার তার অর্থনৈতিক সমর্থনের জন্য প্রাদেশিক সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরে নির্ভর করতে হবে না। মূলত পশ্চিমা প্রদেশ বিশেষত পাঞ্জাব শেখের রাজস্ব-ফর্মুলার বিরোধিতা করছে। তারা মনে করেন প্রদেশগুলো যদি প্রতিরা খাতে অবদান রাখতে অস্বীকৃতি জানায় তবে কাশ্মির ইস্যুটি মুলতবি রাখা হবে। মুজিবুর রহমানের ফর্মুলা যদি কেন্দ্রের থলেতে অর্থ যোগান না দেয়, তার তত্ত্বানুসারে প্রতিটি প্রদেশের অর্থ ভবিষ্যতে সৈন্যবল বাড়ানোর জন্য তার নিজ প্রদেশেই ব্যয়িত হবে।

এটা সমভাবে সন্দেহজনক যে মি. ভুট্টো এধরনের ফর্মুলা মেনে নিবেন কিনা। এটা অবশ্যই সত্যি যে পাঞ্জাবে তার শক্তিশালী রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে উঠেছে ভারতবিরোধিতার মাধ্যমে, তার সমাজতান্ত্রিক নীতির মাধ্যমে নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের এই নতুন নেতা এসব ইস্যুর কোনোটির সঙ্গেই আপস করা কঠিন হবে। একজন কর্মী জানালেন, ‘আমরা পাঞ্জাবীরা কাশ্মির নিয়ে অনেক রক্ত দিয়েছি এবং মি. ভুট্টো যদি কাশ্মির নিয়ে ভারতের কাছে কোনো ছাড় দেন তবে তাকে প্রাণদণ্ড দেয়া হবে।’

পরের ধাক্কাটি হবে সংবিধান কি এককক্ষবিশিষ্ট, না দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। বিদ্যমান কাঠামো অনুসারে সংসদের আসনগুলো জনসংখ্যা অনুসারে প্রদেশগুলোর জন্য বরাদ্দ। এবং এজন্য বৃহৎ জনগোষ্ঠীর পূর্ব পাকিস্তান সংসদে এমনিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে থাকে। স্বভাবতই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সুবাদে পূর্ব পাকিস্তান সংসদে যে সুবিধা পেয়ে থাকে, সেকারণেই তারা এককবিশিষ্ট সংসদ চাইবে। আরেকটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখা দরকার, এরকম একটি ধারণা গড়ে উঠছে যে শেখ যদি আপসের জন্য প্রস্তুত না হয়ে থাকেন, তবে পশ্চিম পাকিস্তানীরা দরিদ্র পূর্ব পাকিস্তানীদের ছাড়াই ভালো থাকবে।

সবকিছু নির্ভর করছে এই দুই নেতা তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে রাজনৈতিক ঝুঁকি নিবেন কিনা এবং এইসব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আপস করবেন কিনা। আপাতত সেরকম কোনো সম্ভাবনা নেই। যদি তারা কোনো বোঝাপড়ায় আসতে ব্যর্থ হন তবে, ঘটনাপরম্পরা পর্যবেণ করে এরকম ধরে নেয়া যায় যে পাকিস্তান অবশ্যম্ভাবীরূপে বিচ্ছিন্নতার দিকে এগিয়ে যাবে। যদি পশ্চিমাংশ এবং পূর্বাংশ কোনোটিই ছাড় দিতে রাজি না হয়, এটা খুবই স্বাভাবিক যে উভয়াংশের বৃহত্তর মতৈক্যের ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন সম্ভব নয়। এর ফলে মি. ভুট্টোকে সাংবিধানিক সংসদে ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। এই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে দুই প্রদেশের মধ্যে সরাসরি সংঘাতই দেখা দেবে এবং সম্পর্কের আরও অবনতি হবে বলে অনুমান করা যায়। ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ তুলে ধরার মাধ্যমে আরও বড়ো নেতা হয়ে উঠতে পারেন, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে সংসদের মাধ্যমে নিজেদের সংবিধান বের করে নিয়ে আসতে সম।

এবং এর ফল যা দাঁড়াবে তাতে দেশের পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। বাঙালিরা স্বাভাবিক কারণেই বলবে যে সংবিধান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই রচিত হয়েছে এবং পাশ হয়েছে। পরিভাষাগত দিক থেকে তারা হয়তো ঠিকই বলবে, কিন্তু সংবিধানটি সত্যিকার অর্থে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ভুট্টোর কথামতো এটা প্রেসিডেন্টকে একটি বেদনাদায়ক দ্বিধার মধ্যে ফেলে দেবে। প্রেসিডেন্টের জন্য এমন কোনো সংবিধান অনুমোদন করা সহজ হবে না যা একটি প্রদেশের পুরোটাই তা প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু মুজিবকৃত কোনো সংবিধান প্রেসিডেন্ট অনুমোদন না করলে তাতে মুজিবের কী প্রতিক্রিয়া হবে তা সহজেই অনুমেয়। বাঙালিরা যুক্তি দেবে যে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আইনসভা কর্তৃক প্রণীত কোনো সংবিধান পশ্চিম প্রদেশ প্রতিহত করেছে। এই পরিস্থিতিতে মুজিবের কর্মীরা মনে করেন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সকল প্রকার আপসপ্রচেষ্টা বাতিল করা ছাড়া শেখের আর কোনো বিকল্প নেই। তারা নতুন একটি নির্বাচনে অংশ না নিতেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

আওয়ামী লীগের একজন কর্মী জানালেন, ‘আরেকটি নির্বাচনের কী মানে? মনে রাখবেন, এই নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাধীনতার পে গণরায় দেয়া হয়েছে। আমরা যদি আমাদের স্বায়ত্তশাসন পাই তবে শেখ সাহেব স্বাধীনতা নাও চাইতে পারেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট যদি সংবিধানে সই করতে না চান তবে শেখকে পরের প্লেনেই ঢাকা ফিরে আসতে হবে এবং ফিরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হবে।’ তিনি জোরালোভাবেই কথাগুলো বললেন। বামপন্থী থেকে ডানপন্থী, কৃষক থেকে বুদ্ধিজীবী — পূর্ব পাকিস্তানের সবারই সার্বজনীন মতামত হলো এই। এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া কী হয় তার ওপরে। ব্যাপারটি অদৃশ্যমান ও পূর্বানুমানভিত্তিক, কিন্তু এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে সেনাবাহিনী যদি চায় তবে এই পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করতে পারে। এর মানে হলো ৭৩ মিলিয়ন বাঙালিকেই গ্রেফতার করা, এবং এর ফলে পাকিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়া দীর্ঘস্থায়ী সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতায় নিমজ্জিত হবে।