Tag Archives: উদ্বাস্তু

বাংলায় আগ্রাসন: আমাদের অবশ্যই যা করতে হবে

রেগ প্রেন্টিস

দি সানডে টাইমস, ১১ জুলাই, ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

[মি. প্রেন্টিস হলেন সংসদীয় একটি দলের সদস্য যারা সম্প্রতি পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তান সফর করেছেন।]

রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া যে-পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাতে পরিস্থিতি কেবল খারাপই হতে পারে। এটা পাকিস্তান এবং ভারত উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। পূর্ব পাকিস্তানে অবশ্য চরম নিষ্ঠুরভাবে দমন-পীড়ন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই, কারণ সাত কোটি বিক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীর ওপর কয়েক হাজার সৈন্য দিয়ে ক্ষমতা খাটাতে গেলে এছাড়া কোনো উপায় নেই। সৈন্যসংখ্যা খুব কম। তাদের জন্য নানা সরবরাহ ও সাহায্য আসছে ভারতের দক্ষিণাঞ্চল ঘুরে ৩,০০০ মাইল পার হয়ে। দেশটির কোনো কোনো অংশ গেরিলা আক্রমণের জন্য খুবই উপযুক্ত অঞ্চল। গেরিলারা ভারতে আশ্রয় নিতে পারে এবং উদ্বাস্তুদের মধ্য থেকে তাদের নিয়োগসংখ্যা বাড়তে পারে। একাধিক পর্যবেক্ষক মনে করেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ভিয়েতনামের মতো অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে।

ভারতের দিক থেকেও পরিস্থিতি সমানভাবে হতাশাজনক। সীমান্ত-রাজ্যগুলোতে স্থানীয় কর্মকর্তা, ডাক্তার ও নার্সরা বেশিরভাগ শরণার্থীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য খুব সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু এসব ঘটছে এমন একটি দেশে যেটি খুব দরিদ্র এবং এর বেশিরভাগই ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে যা পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম দরিদ্র এবং জনবহুল একটি অঞ্চল। স্থানীয় প্রশাসন অন্যান্য কাজকর্ম বাদ দিয়ে উদ্বাস্তু-সমস্যা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে; স্থানীয় উন্নয়ন-কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে; বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে কারণ সেগুলো উদ্বাস্তুদের দখলে। উদ্বাস্ত-শিবিরগুলোতে বিস্ফোরনোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, মাসের পর মাস অলসভাবে কাটাতে বাধ্য হবার কারণে। স্থানীয় জনগণের মধ্যেও উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে কারণ তারা দেখছে যে উদ্বাস্তুরাই তাদের চাইতে বেশি খাবার পাচ্ছে, এবং তা পাচ্ছে ফ্রি, এদিকে তারা সারা সপ্তাহ জুড়ে কাজ করে মরছে। কিন্তু উদ্বাস্তুদের কাজ দিয়ে এসমস্যার সমাধান করা যাবে না, কারণ ইতোমধ্যেই চরম বেকারত্ব রয়েছে।

বিশ্বকে অবশ্যই এই বোঝার বৃহত্তর অংশ ভাগাভাগি করতে হবে। বাকি বিশ্ব যে-পরিমাণ সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে তাতে ভারতের হিসাব অনুযায়ী ছ-মাসের কাজ চলবে। বেশিরভাগ দেশকে আরো বেশি সাহায্য প্রদানের কথা বলতে হবে এবং ধরে নিতে হবে দীর্ঘ সময়ের জন্য এটা চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সাহায্যের পরিমাণ যতই বেশি হোক না কেন ভারতকে এ-পরিস্থিতির জন্য চরম মূল্যই দেতে হবে এবং যত সময় যাবে তার পরিমাণও বাড়তে থাকবে। এই নিম্নগামী কুণ্ডলীকে উল্টে দেওয়া যাবে তখনই যখন পূর্ব পাকিস্তানের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো রাজনৈতিক সমাধান দেয়া যাবে। তার মানে, সমাধানটি শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। উপনিবেশ উঠে যাবার সময়কার পরিস্থিতির সঙ্গে এর মিল রয়েছে। রাজনৈতিক দলসমূহের নেতৃবৃন্দ, যাদের ওপর জনগণের আস্থা রয়েছে, কেবল তারাই কার্যকর কোনো সমাধান দিতে পারেন। ইয়াহিয়া খানকে অবশ্যই হয় এটা বুঝতে হবে অথবা তার দমননীতি চালিয়ে যেতে হবে, যে-নীতি আজ অথবা কাল ব্যর্থ হবেই।

ধরা যাক, শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পেলেন, আওয়ামী লীগকে মেনে নেয়া হলো, এবং সত্যিকারের আলোচনা শুরু হলো। এর ফলে কী পাওয়া যাবে? যে-ছয় দফার ওপর ভিত্তি করে আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনে জিতেছে, সেই ছয় দফা অনুসারে পূর্ব পাকিস্তান বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বশাসনের সুযোগ চাইবে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেবল পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা থাকবে। অখণ্ড পাকিস্তানের ধারণা টিকে থাকবে কিন্তু পূর্বের প্রাদেশিক সরকার নিজ ভাগ্য নির্মাণে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এটা খুবই সন্দেহজনক যে এই সমাধান আদৌ সম্ভব কিনা। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বহু রক্তপাত হয়েছে এবং তিক্ততা দেখা গেছে।

জরুরি বিষয় নিশ্চয় এরকম: সমাধান যদি শিথিল ফেডারেশনের হয় অথবা (তার চাইতেও এগিয়ে) পূর্ণ স্বাধীনতার, সে-সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা কেবল আওয়ামী লীগেরই। কারণ তারাই পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র আস্থাভাজন প্রতিনিধি। তারা অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের অবশ্যই তা মেনে নিতে হবে। বর্তমানে সামরিক শাসকরা অবশ্য সেরকম কিছু করার মতো মানসিকতায় নেই। তারা গতানুগতিক কথাই বলে যাচ্ছেন। তারা বারংবার বলে যাচ্ছেন যে সেনাবাহিনীকে ‘আইন-শৃঙ্খলা-পরিস্থিতি’র উন্নতি ঘটাতে হবে;
ভারতীয় মদদপুষ্ট কয়েকজন ‘উচ্ছৃঙ্খল’-এর কারণেই এতো সমস্যা দেখা দিচ্ছে; শরণার্থীরা দেশে ফিরে যেতে চায় কিন্তু ভারতীয়রা তাদের যেতে দিচ্ছে না; পূর্ব পাকিস্তানে জনজীবন ‘স্বাভাবিক’ হয়ে আসছে; বিশ্ববাসীর ভারতীয়দের দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়া ঠিক হবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি।

পরিবর্তনের সত্যিকারের সম্ভাবনা দু-টি বিষয়ের ওপরে নির্ভর করছে: পূর্ব বাংলাকে ঠাণ্ডা রাখতে তাদের ক্রমাগত ব্যর্থতা ও বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক চাপ। দেশটি রফতানি মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বিরাটা ক্ষতির মুখোমুখি। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের পণ্য রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে না এবং পরিস্থিতির উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, যদিও অন্য দিক থেকে ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে’ বলে দাবি করা হচ্ছে (পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিমের তুলনায় অনেক দরিদ্র কিন্তু তারাই বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ অর্জন করে থাকে)। এবছরের শেষ নাগাদ, সম্ভবত দুর্ভিক্ষ আকারেই, গুরুতর খাদ্যাভাব দেখা দেবে। কারণ কয়েক মাসের মধ্যে যে-ফসল লাগানোর কথা, তা লাগাতে বিঘ্ন দেখা দিয়েছে। যাতায়াত-ব্যবস্থা বিধ্বস্ত হয়ে যাবার কারণে পরিস্থিতি আরও সঙ্গীন হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে পশ্চিমে খরার কারণে কমই ফসল হয়েছে যেখান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বীজসংকটের মোকাবেলা করা হয়ে থাকে।

এসব বিপদের মুখে পশ্চিমা সাহায্যের কনসোর্টিয়াম সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরে অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য নতুনভাবে আবেদন জানাবে না। চলতি প্রকল্পগুলো শেষ হবে কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো সিদ্ধান্তে অবিচল থাকলে বৈদেশিক সাহায্য শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকবে এবং সামনের মাসগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ঘনীভূত হবে। এমনকি স্বাভাবিক সময়ে এধরনের সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য হতো বিরাট আঘাত।

পাকিস্তানের যেসব জেনারেলরা দেশটিকে চালান তারা অর্থনীতি সামন্যই বোঝেন, কিন্তু আজ অথবা কাল কঠোর পরিস্থিতি তাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে বাধ্য করবে। এটাই আমাদের একমাত্র আশা।

আমি বিশ্বাস করি একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতির পক্ষে চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনটি উপায় আছে। প্রথমত, পশ্চিমা শক্তি অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান না-করার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে (ত্রাণসাহায্যের কথা আলাদা, পূর্ব পাকিস্তানে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ এড়াতে জাতিসংঘের সহায়তায় ত্রাণতৎপরতা চালাতে হবে)। রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্যকে ব্যবহার করার বিপক্ষে অনেক যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু এটি একটি সম্পূর্ণ পৃথক পরিস্থিতি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, খুব নিকট ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানে কার্যকর উন্নয়ন প্রকল্প নেবার সম্ভব হবে না। তাই দেশটিকে যেকেনো ধরনের অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়া হলে তা কেবল পশ্চিম পাকিস্তানেই ব্যবহৃত হবে। সাহায্য না-দেয়া বরং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মুক্তি দিতে এবং পূর্ব পাকিস্তানকে দমিয়ে রাখার সম্পদগুলোকে নিঃশেষ করতে কাজ করতে পারে। বৈদেশিক উন্নয়নের সাবেক মন্ত্রীর অভিজ্ঞতা থেকে আমি বিশ্বাস করি রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সাহায্যের বিষয়টি জুড়ে দেয়া ১০০ ভাগের ৯৯ ভাগের ক্ষেত্রেই অনুচিত — কিন্তু এটি হলো সেই ১০০তম ক্ষেত্র। একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য যেকোনো ধরনের ক্ষমতাই ব্যবহার করা উচিত।

দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর প্রক্রিয়াকে শিগগীরই বন্ধ করতে হবে। বিশ্বমত ওয়াশিংটনের সেইসব সিনেটর ও কংগ্রেসসদস্যদের মতোই গড়ে ওঠা উচিত যারা মার্কিন প্রশাসনকে তার নীতিকে পাল্টানোর জন্য বলেছিলেন। পাকিস্তানের সেনাশক্তিকে মদদ দেবার মাধ্যমে হলেও চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের এরকম অবস্থানের কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে না। তৃতীয়ত, সব ধরনের সরকার, সংসদ ও প্রভাবশালী ব্যাখ্যাকারদের সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। এটা পরিস্কার বুঝতে হবে যে বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশার মধ্যেই বিশ্ববাসীর ও সরকারগুলোর প্রত্যাশা নিহিত আছে: আমরা সম্মিলিতভাবে দাবি করছি যে পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের নীতিতে একটা পরিবর্তন আসতে হবে।

আমাদের হয়তো একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান এনে দেবার মতো ক্ষমতা নেই, কিন্তু আমাদের যার যা ক্ষমতা আছে, তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে। কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সময় পার হয়ে গেছে। এখন হলো অবস্থান নেবার সময় এবং নিজেদের সংখ্যা গণনার সময়।

সম্পাদকীয়: হত্যা বন্ধ কর

দি সানডে টাইমস, ১৩ জুন, ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

পূর্ব-পাকিস্তান সম্পর্কিত একটি আর্টিকেলের জন্য মধ্য-পাতার পুরোটা ব্যয় করে সানডে টাইমস একটি ব্যতিক্রমী ও দায়িত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরাই প্রথম এটি করেছি, কারণ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তার প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানে কী করছে, এটি ছিল তার ওপরে পূর্ণমাত্রায় বিশ্বাসযোগ্য, বি¯তৃত এবং প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট। দ্বিতীয়ত, মিলিয়ন মিলিয়ন উদ্বাস্তু কী থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, সে-সম্পর্কে সংবাদটি নিজেই এমন এত ভয়াবহ বর্ণনা দিচ্ছে যে, এসম্পর্কে বিস্তারিত বলা প্রয়োজন। সানডে টাইমস্ রিপোর্টটির যথার্থতার ব্যাপারটি যতদূর সম্ভব খতিয়ে দেখেছে। কিন্তু যেকোনো ক্ষেত্রেই আমাদের প্রতিবেদকদের ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। তিনি এই সংবাদটি বিশ্ববাসীকে জানাবার জন্য পাকিস্তানে নিজের ক্যারিয়ার ও ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন।

গত শরতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সমাপ্তি ঘোষণা করতে চাওয়ার পরেই যে কেবল বর্তমান সংকট শুরু হয়েছে তা নয়। সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাঙ্গা হয়ে ওঠে, কিন্তু নির্বাচনের পর তাকে নিষ্ঠুর হাতে দমন করা হয়। কিন্তু তার অনেক পূর্বে ১৯৪৭ সালে দু’টি অসম অংশ নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে এই অনৈক্য ও অসাম্যের বীজ রোপিত হয়। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জনগোষ্ঠী, সঙ্গতকারণেই, নিজেদের এমন একটি দেশে বৈষম্যের শিকার বলে নিজেদের খুঁজে পেয়েছে, যে-দেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদানই বেশি। এছাড়া বর্তমানের রক্তপাত ও উৎপীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে অবাঙালিদের বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্য বাঙালিদেরও কিছু দায়িত্ব স্বীকার করতে হবে। আমাদের সংবাদটি সে-বিষয়টিও স্পষ্ট করেছে।

কিন্তু এসবকিছু বলার পরও, পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে যে পরিকল্পিত, স্বেচ্ছাকৃত নিষ্ঠুর আক্রমণের অভিযোগ রয়েছে, তা কিছুতেই এড়ানো যাবে না। একটি বেসামরিক শাসনব্যবস্থা ও স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ফিরে যাবার কথা ইয়াহিয়া যখন বলেন তখন সেটা তিনি হয়ত সত্যিকার ভাবনা থেকেই বলেন। কিন্তু পাকিস্তানে এপর্যন্ত যা ঘটেছে তারপর কীভাবে পাকিস্তানি সরকার বাঙালি নেতাদের বোঝাতে সক্ষম হবেন যে তারা পরস্পরের ভাই এবং একই জাতিতে অন্তর্ভুক্ত। সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারের প্রতি বাঙালিদের আনুগত্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এবং পশ্চিম-দেশসমূহের কাছে পাকিস্তানী সরকার যে-সাহায্যের আবেদন করেছে, তা যদি অনুমোদিত হয় তা হলে সেই সাহায্যের অর্থ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনীর চলমান অভিযানেই কাজে লাগানো হবে। অবশ্য সাহায্য বন্ধ করে দিলেও পাকিস্তানে বাড়তি মানবীয় ভোগান্তি বেড়ে যাবে।

পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য, ব্রিটেন যার অন্তর্ভুক্ত, সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক ফর্মুলা হলো সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রত্যাহারের মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য ইয়াহিয়া বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং সেসব ক্ষেত্রে দাতারা সাহায্য বরাদ্দ করবে। অবশ্য পূর্ব-পাকিস্তানে ত্রাণকার্যে জাতিসংঘ ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী ত্রাণসংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রণ আনতে চাইলেও এই সত্য অস্বীকার করা যাবে না যে পাকিস্তান একটি স্বাধীন দেশ এবং সে যা না-করতে চাইবে, অন্য কেউ তা তাকে দিয়ে করাতে পারবে না। সবচেয়ে ভালো ও একমাত্র রক্ষাকবচ হলো পাকিস্তান-সরকারের কার্যকলাপের ওপর প্রচার চালিয়ে যাওয়া এবং এই আশা করা যে বিশ্ববিবেকের মতামতের চাপ অবশেষে কোনো প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে।

পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত তা বলা শক্ত। কিন্তু যাই হোক না কেন, এটা অপ্রত্যাশিত যে ভারতে বিরাটসংখ্যক উদ্বাস্তু রয়েছে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই হিন্দু এবং যারা আর পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেতে চায় না। যুদ্ধ ও সহিংসতার এই সময়ে একটা জিনিস খুব স্পষ্ট যে ইয়াহিয়া খান একটি বিরাট ভুল করেছেন এবং এর ভয়াবহ ফলাফল এশিয়া এবং বিশ্বে নতুন করে অস্থিতিশীলতার নতুন একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে; যার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য-সমস্যার মতো জাতিগত ও স্থানিক উপাদান জড়িত রয়েছে। এবং ভবিষ্যতে এখানকার অধিবাসীদের আরও অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হবে।

কীসের জন্য তারা পালিয়ে গেল?

দি ইকোনমিস্ট, ১২ জুন, ১৯৭১

কলকাতা থেকে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির পাঠানো রিপোর্ট

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

‘আমাদের জনসংযোগের যন্ত্র প্রস্তুত ছিল না। আমাদের সেনাবাহিনীর জনসংযোগ-কর্মকর্তারা ২৫ ও ২৬ মার্চে ঢাকায় ছিলেন না, এবং আমরা অবশ্যই সেখানে বিদেশী প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটা ভুল করেছিলাম।’ একজন সিনিয়র পশ্চিম পাকিস্তানি কূটনীতিক এভাবে স্বীকার করলেন যে পূর্ব পাকিস্তানকে তার সরকার যেভাবে মোকাবেলা করেছে তা পুরোপুরি সঠিক ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে কী এমন ঘটেছে যে পৃথিবীর সবচাইতে জনবহুল এবং দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর ৫০ লক্ষ মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে উদ্বাস্তুতে পরিণত হলো?

শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা ২৫ মার্চের রাতে অভিযান চালিয়ে গুলিবর্ষণ করে ও ঢাকার একাংশ ধ্বংস করে ফেলে এবং পরের ছয় মাসে পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ অংশে নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। এর ফলে লাখ লাখ উদ্বাস্তু সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলোতে পালিয়ে যায়। সেনাবাহিনীর মতে মার্চে আওয়ামী লীগের চরমপন্থীরা একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছিল এবং এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত হাজার হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী ও বিহারীরা ( এরা পশ্চিম-পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে সবসময় ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত) বাঙালিদের দ্বারা নিগৃহীত হতো। আর সেনাবাহিনীর সেদিনের দ্রুত পদক্ষেপ সবকিছু রক্ষা করে।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সদস্য এবং পুলিশ ও আধা সামরিক সীমান্তরক্ষীরা সেদিন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। আওয়ামী লীগের নেতারা, যারা ভারতে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন, তারা স্বীকার করেছেন বেশ কিছু পাঞ্জাবী ও বিহারী নিহত হয়েছিল। কিন্তু এটা কোনো পরিকল্পিত ঘটনা ছিল না। কী ঘটতে যাচ্ছে তা বোঝার আগেই অনেক সৈন্য ও পুলিশকে ধরা হয়েছিল, অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়েছিল, হত্যা করা হয়েছিল। শেখ মুজিবকে তার বাসভবন থেকে ধরা হয়েছিল এবং তারা দলের নেতাদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, কেউ অল্পের জন্য পালিয়ে বেঁচেছিলেন। সহিংসতা দুই দিক থেকেই হয়েছিল, এবিষয়ে অল্প হলেও সন্দেহ আছে। কিন্তু মুসলিম ও হিন্দু (এবং খ্রিস্টান), শিক্ষিত ও অশিক্ষিত উদ্বাস্তুর ঢল দেখে বোঝা যায়, জনগোষ্ঠীর প্রধান কেন্দ্রগুলোত নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের জন্য যা করা প্রয়োজন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তার চাইতে বেশি কিছু করেছে।

সেনাবাহিনী কী করেছে? প্রতিটি অভিযানের পর দেখা গেছে গ্রামগুলো পুড়ে ছাই হয়েছে এবং মানুষগুলো মরেছে। একটি ব্যাখ্যা এরকম আছে যে, মাত্র ৭০,০০০ সৈন্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার পুরো পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাইলে এধরনের সহিংসতার পথই নিতে হবে। কিন্তু সত্যি কথা হলো ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য এধরনের নীতি ক্ষতিকর। কারণ রাজনৈতিক সমাধান অস্ত্রের শক্তির ওপর নির্ভর করে না, এখানে মানুষের গণহারে দেশত্যাগের ব্যাপারও রয়েছে। কিছু শিক্ষিত উদ্বাস্তু ব্যাখ্যা দিলেন, ‘সৈন্যদের গুলি করতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য অফিসাররা তাদের বলে যে এটা একটা ধর্মযুদ্ধ। তারা বলেছে যে ইসলামী রাষ্ট্রটি হিন্দু, আওয়ামী লীগ নেতা ও বুদ্ধিজীবিদের কারণে হুমকির সম্মুখিন।’

মৃত, ধৃত অথবা পলাতক বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী ও আওয়ামী নেতাদের হিন্দু দেখতে পেলে সেনাবাহিনী খুশি হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৭ কোটি জনগোষ্ঠীর এক কোটি হিন্দু এবং এরা গণহারে সীমান্ত অতিক্রম করে গেছে। কিন্তু কেবল সেনাবাহিনীই হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়েছে তা নয়। বিহারী ও ডানপন্থী মুসলিম লীগারদের নিয়ে সম্প্রতি গ্রামে গ্রামে গঠিত তথাকথিত শান্তিকমিটির সদস্যরাও হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে, লুট করেছে এবং তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে।

সীমান্তাঞ্চলে যে যে স্থানে সেনাবাহিনীর শক্তি বেশি এবং যে যে স্থানে সেনাবাহিনী তাদের অভিযান চালিয়েছে সেখানকার লোকজনের সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে যাবার হার বেশি। প্রথমে এই পালিয়ে যাবার হার ছিল মোটামুটিভাবে অর্ধেক মুসলমান, অর্ধেক হিন্দু। কিন্তু মে মাসের প্রথম দিকে যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, হিন্দুদের পালিয়ে যাবার হার তখন অনেক বেড়ে যায়। ভারতের যেসব রাজ্যে তারা বেশি পরিমাণে যেতে থাকে, যেমন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা, সেসব রাজ্যে এই আশংকা কাজ করা শুরু হয় যে সীমান্তের ওপারে একজন হিন্দু থাকা পর্যন্ত এই প্রবাহ চলতে থাকবে। প্রথমে উদ্বাস্তুর সংখ্যা শুনে মনে হয়েছে রাজ্যগুলো কেন্দ্রের সাড়া দ্রুত পেতে হয়ত সংখ্যাটি বাড়িয়ে বলছে। কিন্তু জাতিসংঘের স্থানীয় সংস্থাগুলো ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো এই সংখ্যাই যে সঠিক তা গুরুত্বাসহকারে বলেছে। বরং মোট সংখ্যার অর্ধেকরও বেশি ক্যাম্পে অবস্থান করছে বলে সহজে গণনা করা গেছে। বাকিদের সীমান্তে এবং খাবার বিতরণের স্থানে গণনা করা সম্ভব হয়েছে। গত সপ্তাহের মাঝামাঝি ভারতীয় পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে সাম্প্রতিকতম মোট সংখ্যা হলো ৪৭ লক্ষ, যার মধ্যে ২৭ লক্ষ ক্যাম্পে অবস্থান করছে এবং বাকিরা বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের বাসায় অবস্থান করছে অথবা নিজেদের মতো ব্যবস্থা করে নিয়েছে।

ভারতের প্রাথমিক নীতি ছিল উদ্বাস্তুদের সীমান্তের কাছাকাছি সীমাবদ্ধ রাখতে। এখন সেটা আর কার্যকর নেই। ত্রিপুরার জনসংখ্যা এখন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সীমান্ত এলাকায় বেড়ে গিয়েছে, যেসব উদ্বাস্তু ক্যাম্পে নেই তাদের কারণে শ্রমের মজুরি কমে গেছে। কিছু এলাকায়, যেমন পশ্চিমবঙ্গে, নতুন ক্যাম্প স্থাপন করার জন্য খুব সামান্যই স্থান খালি আছে। সহিংসতার হুমকি প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে কারণ ভারতীয় সীমান্তাঞ্চলের বেশিরভাগ লোকই হলো মুসলমান। ক্যাম্পগুলোর প্রশাসননিক সাফল্য ভালোই বলতে হবে, যেক্ষেত্রে সীমান্তঅঞ্চলগুলোতে কাজ করাটাই ম্যজিস্ট্রেটদের জন্য বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে এসেছে। কলেরা মাহামারি বাকি বিশ্বকে হতবাক করে দিলেও, অনেক বৈদেশিক সংস্থাই কলেরা প্রতিরোধের জন্য কয়েক সপ্তাহ যাবত কাজ শুরু করে দিয়েছে। ভারতীয় সরকারের মে মাসের কেনাকাটার তালিকায় ২৫০,০০০টি তাঁবু ও ত্রিপল থাকলেও তাকে বাড়াতে হবে, যদিও কেউই জানে না কখন প্রকৃত দাবিকে স্পর্শ করা যাবে।

যদি ভারতে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে থাকে, তবে পাকিস্তানে অবস্থা অবশ্যই তার চাইতেও খারাপ। এঅঞ্চলের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম থেকে সারা দেশের বিচ্ছিন্ন রয়েছে। শহর এবং গ্রামে জনগণের অসম চলাচল রয়েছে। গত নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষত এখনও সারিয়ে তোলা হয়নি। যানবহনগুলোকে খাদ্য-পরিবহণের পরিবর্তে সৈন্য-পরিবহণের কাজে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক এলাকাতেই বর্ষা-পরবর্তী প্রধান ফসল ধানের বীজ বপন করা হয়নি। পাকিস্তান নীতিগতভাবে পূর্বাংশে জাতিসংঘের সাহায্য গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে। এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পরিবর্তন। একজন কেবল এটাই আশা করতে পারে যে, প্রক্রিয়াটিতে যেন খুব বেশি দেরি না হয়।

বাংলায় মহামারি

দি টাইমস, ৬ জুন, ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

দিনাজপুর সীমান্তে একটি উদ্বাস্তু-শিশু কলেরায় মারা গেল। সীমান্ত-শিবিরগুলোতে এর সংখ্যা ইতোমধ্যে পাঁচ হাজারে উন্নীত হয়েছে। মানচিত্রে প্রদর্শিত উদ্বাস্তুর সংখ্যা থেকে বোঝা যায় আক্রান্তের সংখ্যা মহামারি আকারে অচিন্তনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। কলকাতার লাখ লাখ উদ্বাস্তুকে আঘাত করার জন্য কলেরা খুব দূরে অবস্থান করছে না। গডফ্রে হসন-এর রিপোর্ট।

এক সপ্তাহ আগে বাংলায় নিযুক্ত অক্সফ্যাম-এর মাঠপরিচালক ফরাসী-কানাডীয় রেমন্ড করনইয়ার একটি বার্তা পেয়ে খুব হতোদ্যম হয়ে পড়েন। বার্তাটি আসে ভারতীয় নান মাদার টেরিজার কাছ থেকে কলকাতার দরিদ্রদের নিয়ে যার সেবামূলক কর্মকাণ্ড ইতোমধ্যে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে; মাদার পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য কলকাতা থেকে ৭০ মাইল উত্তরে ও বাংলার সীমান্ত-শহর কৃষ্ণনগরে একটি মেডিকেল টিম পাঠিয়েছেন।

বার্তায় বলা হয়েছিল, “প্লিজ, স্যালাইন পাঠান; শিবিরে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে”। বাংলায় এক শতাব্দী জুড়ে কলেরা রয়েছে। কলকাতায় প্রতি বছরে কলেরায় ২,০০০ লোক মারা যায়। কিন্তু স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞরা পুরোপুরি বুঝতে পারেন না, স্বাভাবিক সময়ে এটা কেন ঘাপটি মেরে থাকে। মাদার টেরিজার বার্তার অর্থ হলো সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়ে এটা আবির্ভূত হয়েছে। শিবিরগুলোতে জড়ো হওয়া মানুষগুলোর অনেকেরই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় রয়েছে, দূষিত পানি ব্যবহার করছে এবং চিকিৎসা-সুবিধা বঞ্চিত। দেশত্যাগ করে আসা উদ্বাস্তুদের বেশিরভাগেরই পানিবাহিত ব্যাক্টেরিয়ার-মাধ্যমে-ছড়িয়ে-পড়া রোগ প্রতিরোধ করার মতা নেই। গত সপ্তাহের শেষে দেখা দেয়া কলেরার মহামারি আকারে রূপলাভ করাটা নিশ্চিতই ছিল।

কলেরায় আক্রান্তের ভয়াবহ পাতলা পায়খানা হয় ও বমি হয়, যার ফলে মারাত্মক পানিশূন্যতা দেখা দেয়। বমির ফলে তরল খাবার খাওয়া যায় না, তাই স্যালাইন-পানি দেহে ঢোকানোর মাধ্যমে পানিশূন্যতা রোধ করতে হয়। যদি এই পদ্ধতি দ্রুত প্রয়োগ করা যায়, এমনকি এন্টিবায়োটিক ছাড়াই, একজন সবল দেহের লোকের বেঁচে যাবার সম্ভাবনা থাকে।

মাদার টেরিজার বার্তা পাবার তারা এক ঘণ্টা মধ্যেই করনোইয়ার ও তার সহকারীরা কলকাতা থেকে ৩৫০ বোতল স্যালাইন সংগ্রহ করতে সম হন, এবং কৃষ্ণনগরের উদ্দেশে ট্রাক বোঝাই করে পাঠান। পরের দিন পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যমন্ত্রি ডাঃ আবেদিন জানান, প্রতিদিন ১,০০০ বোতল স্যালাইন দরকার কিন্তু সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৮০০ বোতল। এ-পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, প্রয়োজনের তুলনায় সরবরহ কমই রয়েছে।

খাদ্য, ওষুধ ও প্রতিষেধক-এর ঘাটতি

সোমবার পশ্চিম-বাংলার স্বাস্থ্য বিষয়ক পরিচালক ডাঃ সাহার নদীয়া ও কৃষ্ণনগর জেলার ‘ব্যাপক’ মহামারির কথা বলছিলেন। সপ্তাহান্তে কলেরায় তিনশ পঞ্চাশ জন মারা গেছে বলে সরকারি হিসেব পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার সারা বাংলায় ৯০০ জন মারা গেছে ও বুধবার এই সংখ্যা ১৩০০-তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এই সংখ্যা কেবল ক্যাম্পসমূহের হিসাব। অর্ধেকে মানুষ ক্যাম্পের বাইরে রয়েছে; এবং যখন ক্যাম্পে এই অসুখ দেখা দেয় তখন ক্যাম্পের বাইরের হাজার হাজার মানুষ ভয়ে ক্যাম্প এলাকা থেকে পালিয়ে যায়, আর সঙ্গে নিয়ে যায় কলেরার জীবাণু।

ভৌগোলিকভাবে রোগজীবাণু যেভাবে ছড়াচ্ছে, তাতে ভারতীয় সরকার বলতে চাইছে যে, পূর্ব-পাকিস্তানের ভেতর থেকে রোগটি বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে। বুধবার ইউনিসেফ জানিয়েছে ভারতীয় রাজ্য আসাম ও ত্রিপুরাতেও কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। রাজ্য দু-টি নদীয়া থেকে বহু দূরে অবস্থিত এবং পূর্ব-পাকিস্তানের ভূখণ্ড দ্বারা প্রায় বিচ্ছিন্ন। বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গ সরকার অক্সফ্যামের কাছে জানতে চাইছিল ৪০ লাখ কলেরা-প্রতিষেধক দিয়ে কত ভাগ রোগীর চিকিৎসা করানো যাবে। শুক্রবার ভারত-সরকার জেনেভায় অবস্থিত ক্যাথোলিক রিলিফ সার্ভিসেস-এর কাছে আশি টন বিভিন্ন ওষুধ চেয়ে পাঠিয়েছে এবং কলকাতার অক্সফ্যাম-অফিস অক্সফোর্ডে টেলেক্স করেছে প্লেন ভর্তি করে স্যালাইন পাঠানোর জন্য।

স্যালাইন ইঞ্জেকশন ও এন্টিবায়োটিক দিয়েই কেবল কলেরা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যদি তা সময়মতো ধরা পড়ে ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা-পরিস্থিতি ন্যূনতমভাবে নিরাপদ থাকে। প্রতিষেধক দিয়েও একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, অবশ্য এ-পদ্ধতি শতকরা ষাট ভাগ ক্ষেত্রে কার্যকর। সুকো ইন্টারন্যাশনালের তৈরী নতুন জেট ইঞ্জেকশন প্রতিষেধক-যন্ত্র দিয়ে গণহারে প্রতিষেধক প্রয়োগ করা সম্ভব। যন্ত্রটি দিয়ে এক ঘণ্টায় একজন চিকিৎসাকর্মী ৪০০ জনকে ভ্যাক্সিন দিতে পারবেন, যেেেত্র যন্ত্রটি ছাড়া একজন ডাক্তারের ঐ পরিমাণ কাজ করতে সারাদিন লেগে যাবে।

বাংলায় এখন বিপুল পরিমাণ চিকিৎসা-যন্ত্রপাতি পাঠানো হয়েছে। অবশ্য ত্রাণকর্মীরা জানেন যতই বিপুল শোনাক না কেন, প্রয়োজনের তুলনায় তা নগন্য এবং কিছু কিছু এসেছে খুব দেরীতে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ৩০টি জেট ইঞ্জেকশন মেশিন সামনে আসছে; কিন্তু তাতে একটি মাত্র মেশিন দিয়ে দশটি ক্যাম্পের কাজ সারতে হবে। বেশিরভাগ কলেরা-প্রতিষেধক ব্রিটিশদের কাছে রয়েছে যা গতকাল পাঠানো হয়েছে; এই সংখ্যা হলো ৯০৩,০০০। এই সংখ্যার পরও চারজন উদ্বাস্তুর জন্য একটি মাত্র ভ্যাক্সিন বরাদ্দ হবে। আর উদ্বাস্তুরাই কেবল কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে, ব্যাপারটা এমনও নয়।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সব উদ্বাস্তুদের জন্য ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য রেশনের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু তার পরিমাণ অবশ্যই বেশি নয়: প্রতি লোকের জন্য প্রতিদিন এক রুপি বা এক শিলিং-এরও কম। প্রায় ৫৫ পয়সা যায় চাল ও ডালের জন্য এবং বাকিটা দিয়ে রান্নার তেল ও জ্বালানি কিনতে। সীমান্ত পার হবার সময় অনেক উদ্বাস্তুই পাঁচ বা ছয়দিন খেতে পায় নি; উপোস করা লোকজনের জন্য এই রেশন ন্যূনতম কিন্তু বাঙালিদের জন্য অনেক। এরকম ঘটনাও ঘটেছে যে ভারতীয় জনগণ অভিযোগ করেছে, সরকার দেশবাসীর চাইতে উদ্বাস্তুদের সবকিছু বেশি দিচ্ছে।

উদ্বাস্তুদের রেশন-গ্রহণের পূর্বে তালিকাভুক্ত হতে হয়। ভারতীয় সরকার তাই জানে উদ্বাস্তুর সংখ্যা কত এবং তারা কোথায় অবস্থান করছে। ত্রাণকার্য বিঘ্নিত হবার পেছনে একটা বাধা হলো উদ্বাস্তুরা পূর্ব পাকিস্তানের আশপাশে বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কলকাতার নিচের গাঙ্গেয় সমতল থেকে এক হাজার মাইল উত্তরে, হিমালয় পাদদেশের ভারী বর্ষণের এলাকা আসামী পাহাড়াঞ্চল হয়ে, আবার নিচে বার্মা সীমান্তের বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত উদ্বাস্তুদের অবস্থান।

উদ্বাস্তুরা এই সীমান্ত এলাকা জুড়ে সমানভাবে রয়েছে। জেলা ও রাজ্যসমূহকে ঘড়ির কাঁটার দিকে বিচার করলে গত সপ্তাহের শেষে যেরকম হিসেব পাওয়া গেছে তা হলো, দক্ষিণ-পূর্বের চব্বিশ পরগণা জেলায় ৪২০,০০০ জন; উত্তরের নদীয়া জেলায় ৪৫০,০০০ জন; মুর্শিদাবাদে ১,২০০,০০০ জন, যেখানে গঙ্গাই সীমান্ত হিসেবে কাজ করছে এবং যেখানে পার হওয়া কঠিন; মাদলদহে ৩০০,০০০; এবং পশ্চিম দিনাজপুরের সমতলে ১,২০০,০০০ জন। পূর্ব-পাকিস্তানের উত্তরে কুচবিহারে অন্তঃত ৭০০,০০০ জন উদ্বাস্তু রয়েছে; হিমালয়ের রেলস্টেশন দার্জিলিং থেকে বহু দূরে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বের ভারতীয় রাজ্য আসামে ৩০০,০০০ জন উদ্বাস্তু রয়েছে; মেঘালয়ে আছে ৪৫০,০০০ জন; এবং ভারতীয় রাজ্যসমূহের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত রাজ্য ত্রিপুরায় রয়েছে ৭০০,০০০ উদ্বাস্তু, যে-রাজ্যের নিজস্ব লোকসংখ্যাই ছিল ১,৫০০,০০০ জন।

উদ্বাস্তুদের মোট সংখ্যা এভাবে দাঁড়াচ্ছে অন্তঃত ৪,৬৬০,০০০ জন: কারণ কিছু সচ্ছল লোক কলকাতা বা ছোট শহরগুলোতে প্রবেশ করতে পেরেছে যাদের রেশনের জন্য তালিকাভুক্তির প্রয়োজন নেই। এবং উদ্বাস্তুর সংখ্যা প্রতিদিন ১০০,০০০ করে বাড়ছে। কিন্তু এই বিশাল সংখ্যা পুরো সমস্যার অর্ধেকও নির্দেশ করে না। অনেক পশ্চিমা ত্রাণ-কর্মকর্তা মনে করেন, পূর্ব-পাকিস্তানে একজন হিন্দু অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত এই দেশত্যাগের প্রক্রিয়া চলবে। এই প্রকিয়া শুরু হবার পূর্বে, পূর্ব-পাকিস্তানে মোট হিন্দুর সংখ্যা ছিল এক কোটি।

পূর্ব-পাকিস্তানে সমস্যা শুরু হবার পর থেকে উদ্বাস্তুদের তিনটি ঢেউ সীমান্তে এসে পড়ে। ২৫ মার্চে পশ্চিম-পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আক্রমণ করার পরপরই এক দফায় প্রধানত হিন্দুরা (এবং বাঙালিরাও) উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই প্রথম দফায় কিছু মুসলমানও উদ্বাস্তু হয়। দ্বিতীয় ঢেউটি আসে মে মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিকে; এবং তৃতীয় ঢেউটি আসে গত সপ্তাহান্তে। উভয় ক্ষেত্রেই উদ্বাস্তুদের বেশিরভাগই ছিল হিন্দু। উদ্বাস্তুদের চোখে-মুখে ভয়-ভীতির সব চিহ্নই রয়েছে। দি সানডে টাইমস্ হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড-এর বাংলাভাষী রিপোর্টারদের মাধ্যমে অনেক উদ্বাস্তুর সাক্ষাৎকারের আয়োজন করে।

বর্ষা শুরু হবার পর নতুন বিপদ

সংবাদপত্রের ব্যবস্থাপনা-সম্পাদক অভীক সরকার বললেন, উদ্বাস্তুরা “ব্যর্থ বিপ্লবের নিষ্ঠুর স্মৃতি” নিয়ে এসেছে―যে বিপ্লব ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য―এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহিংসতার জন্যও। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ভারতীয় সাংবাদিকরা যেমন বলে থাকে, গণহত্যার এই ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে। মি. সরকার লিখছেন, “একটি ভারত-বিরোধী পরিকল্পিত প্রচারণা এখানে চালানো হয়েছে এবং সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে না-যাবার কোনো পথ সেনাবাহিনী রাখে নি। নিষ্ঠুরতার একটি বড়ো অংশ হলো হিন্দুদের উদ্বাস্তুতে পরিণত করা”।

প্রতিবেদকরা যা বারবার লিখছেন তার দুটো উদাহরণ পাওয়া গেল। ৮০ বছরের শরৎ দাস বললেন, একদিন তার চল্লিশ বছর বয়েসী ছেলে, যে পেশায় মুচি, কাজ থেকে বাড়ি ফেরে নি। তিনি বললেন তার সন্তানকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। সুধারানি ঘোষ বললেন তার স্বামীকে মুসলিম লিগের কর্মীরা বাড়ি থেকে ডেকে রাস্তায় নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে। এই কাহিনীগুলো অভিযোগ পুরোপুরিভাবে প্রমাণিত করে না। কিন্তু এগুলো এটা অন্তঃত প্রমাণ করে উদ্বাস্তুরা ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছে এবং যতদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় থাকবে ততদিন তারা দেশে ফিরে যাবে না। একজন উদ্বাস্তুকে জিজ্ঞেস করা হলো সে কেন ফিরে যাবে না। সে বলল “আমি তখনই ফিরে যাবো যখন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হবে।” কোনো সন্দেহ নেই, সে সংখ্যাগরিষ্ঠ উদ্বাস্তুর কথাই বলেছে।

ভারতীয় সরকার সরকারীভাবে তাদের ‘উদ্বাস্তু’ বলার পরিবর্তে ‘স্থানান্তরকারী’ বললেও পুরো ব্যাপারটা থেকে উদ্ভূত সমস্যাকে এড়াতে পারছে না। পাঁচ মিলিয়ন উদ্বাস্তুর কারণে ইতোমধ্যেই প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এরপরও আরো পাঁচ মিলিয়ন উদ্বাস্ত সীমান্ত অতিক্রম করবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। কিন্তু ভারতীয় সরকারের মনোভাব বাস্তবানুগ না হলেও তা সহজেই বোধগম্য। উদ্বাস্তুরা যে দলে দলে এসেছে তা ভারতের অপরাধ নয়। এসবকিছুর কারণ হলো, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে তার কারণেই সমস্যাগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। তার চাইতেও বড়ো কথা হলো, পাকিস্তানি সরকার এবং সেনাবাহিনীই এসবকিছুর জন্য দায়ী।

কিন্তু, ভারত-সরকারের ওপরেও নানা দিক থেকে উদ্বাস্তু-সমস্যা নিয়ে নানা ধরনের চাপ রয়েছে, এবং যদি সম্ভব হয়, ভারত-সরকারকে এসমস্যা থেকে মুক্ত হতে হবে। স্থানীয় ভারতীয় জনগণ ইতোমধ্যে অভিযোগ করেছে যে, উদ্বাস্তুরা কাজকর্ম খোঁজা শুরু করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিবিদরা ইতোমধ্যে সতর্ক হয়ে গেছেন যে, উদ্বাস্তু-শিবিরগুলো হয়ত নকশালপন্থীদের আখড়া হয়ে যাবে; নকশালপন্থীদের কর্মকাণ্ডের নিদর্শনও এরমধ্যে দেখা গেছে― ক্যাম্পগুলোতে রাজনৈতিক খুনোখুনি হয়েছে।

ভারতীয় সরকার এই জনবিস্ফোরণকে মোকাবেলা করার জন্য ব্যাপক পদপে নিয়েছে, যদিও কেন্দ্রীয় বা রাজ্য-সরকারের হাতে সম্পদ খুব সীমিত। বিশেষ করে ত্রিপুরা সরকার বিরাট সব পদপে নিয়েছে: ২৬টি স্থায়ী শিবিরে তারা কাজ করা শুরু করে দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বেসরকারী ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে যারা ট্রাকের বহর দিয়ে সীমান্ত-শিবিরগুলোতে খাদ্য পৌঁছে দেবে। অক্সফ্যাম ছাড়াও বেশ কিছু বেসরকারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিজ নিজ পদ্ধতিতে কাজ করে যাচ্ছে: পশ্চিমবঙ্গ রেডক্রস, ইউনিসেফ, ওয়ার অন ওয়ান্ট, সেভ দ্য চিলড্রেন ফান্ড, ক্যাথোলিক রিলিফ সার্ভিসেস, দি ক্রিশ্চিয়ান এজেন্সি ফর সোশ্যাল এইড, ক্রিশ্চিয়ান এইড, কেয়ার এবং চার্চসমূহ। কিন্তু বেশিরভাগ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মকর্তারা সম্ভবত রেমন্ড কোরনয়ারের গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যকে মেনে নেবেন, “স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো যা করছে, তা হলো, একটি বালতিতে এক ফোঁটা পানি”। সংস্থাগুলোর অবদানকে এভাবে হিসেব করা যাবে যে, যখন শত শত ডাক্তারের প্রয়োজন তখন তিনজন এখানে, চারজন ওখানে কাজ করছে; আর যেখানে লাখ লাখ লোক ক্ষুধার্ত, তখন হাজার লোককে খাওয়ানো যাচ্ছে।

দুর্ভাগ্যবশত, বিশ্বের সরকারগুলো সময়মতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় নি। তিন সপ্তাহ আগেই উ থান্ট জাতিসংঘের উদ্বাস্তু-কমিটিতে জরুরিভিত্তিতে বিশেষ সাহায্য প্রদানের জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। জাতিসংঘের দেয় তথ্যানুসারে কেবল চারটি দেশ সাহায্য দিয়েছে বা প্রতিশ্র“তি প্রদান করেছে। আবেদনটির পরপরই ব্রিটেন প্রাথমিক সাহায্য হিসেবে এক মিলিয়ন পাউন্ড প্রদান করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ২.৫ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছে যার মধ্যে ৫০০,০০০ ডলার ইতোমধ্যে জাতিসংঘ-কমিটিকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। কানাডা ২ মিলিয়ন ডলার প্রদান করার প্রতিশ্র“তি দিয়েছে খাদ্য- ও স্বাস্থ্য- সংক্রান্ত সাহায্য হিসেবে, এবং পশ্চিম-জার্মানি ১ মিলিয়ন ডয়েস মার্ক দিয়ে শুরু করতে চেয়েছে। জাতিসংঘের অন্য ১৫০টি দেশের কেউই সাড়া দেয় নি― যদিও, সত্যি কথা বললে, সুইডেন সাহায্য দিয়েছে কিন্তু তা দিয়েছে রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে।

রেমন্ড কোরনেয়ার বলেন, “যদি বর্ষা শুরু হয়, আপনি আশা করতে পারেন না যে লোকজন বাইরে খোলা আকাশের নিচে দু-দিন ধরে থাকবে”। লাখ লাখ লোকই খোলা আকাশে নিচে ঘুমায়। উদ্বাস্তুদের মাত্র অর্ধেকই ক্যাম্পের ভেতরে থাকতে পারে। ভরা বর্ষা শুরু হবার আগে আশ্রয়-কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, সম্ভবত, কেবল ভারতীয় সেনাবাহিনীরই আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হবার কারণে সেনাবাহিনী সীমান্তগুলো পাহারা দিতে ব্যস্ত রয়েছে। বর্ষা আসার আগে যদি কলেরাকে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, মহামারি শুরু হয়ে যাবে; বন্যা হলে বা জলভাগের উচ্চতা বেড়ে গেলে ব্যাক্টেরিয়া দ্রুত বিস্তার লাভ করবে। এভাবে বর্ষা নতুন একটি বিপদ ডেকে নিয়ে আসবে: সেটা হলো টাইফয়েড। খুব সামান্যই টাইফয়েডবিরোধী সিরাম পাঠানো হয়েছে। বাংলার দুর্ভোগ কেবল বর্ষাতেই থেমে থাকবে না। পূর্ব পাকিস্তানে বর্ষার পূর্বেই ধানের বীজ রোপন করা হয়ে থাকে। কিন্তু যুদ্ধ ও দেশত্যাগের কারণে লাখ লাখ কৃষক এই বসন্তে কোনো কোনো ধান চাষ করতে পারে নি। আক্রমণ, নিপীড়ন এবং মৃত্যুর পর চতুর্থ যে অশুভ শক্তি পূর্ব বাংলায় আসবে, তা হলো, দুর্ভিক্ষ।

ত্রাণকর্মীরা অপোকৃত নিকবর্তী বিপদ মোকাবেলায় ব্যস্ত রয়েছে। কলকাতায় কলেরা ছড়িয়ে পড়ছে। এই মারি এমন একটি শহরে ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে যার জনসংখ্যা কতো তা কেউ জানে না― এবছরে সম্ভবত আট মিলিয়িন এবং এদশকের শেষে ১২ মিলিয়ন। শহরটির তিন-চতুর্থাংশেই সুয়ারেজ বা চলমান পানি-ব্যবস্থায় ঘাটতি আছে। প্রতি বর্ষায় এখানে জলাবদ্ধতা হয়। ভারতীয় সরকার শহরটিতে কলেরার অনুপ্রবেশে খুবই উদ্বিগ্ন। দমদম এয়ারপোর্টের একেবারে শেষ মাথায় অন্তঃত ৩০,০০০ উদ্বাস্তু এসে আসন গেড়েছে। শহরের আরও কাছাকাছি, উত্তরাংশে অবস্থিত শান্তি-শহরে আরেকটি উদ্বাস্তু-কলোনি আছে যেখানে আরো কয়েক হাজার বেশি উদ্বাস্ত আছে।

শহর থেকে খুব সম্প্রতি ঘুরে আসা অক্সফ্যামের দুর্যোগ-ব্যস্থাপনা-কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার মাইকেল ব্ল্যাকম্যান বলেন, “আমি মনে করি কলকাতায় যদি কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, তবে খোদা না করুক, এটা লন্ডনের মহা-প্লেগ হয়ে দেখা দিবে। রেমন্ড করোনেয়ার বলেন, “সে’স্ট উন ফিউ দি ফরেস্ট (এটা হবে দাবানলের মতো)। এটা কতটা ভয়ংকর হবে তা বলার মতো কোনো যথার্থ ভাষা আমার জানা নেই। কলকাতায় ঘিরে যদি এটা একবার ছড়িয়ে পড়ে, উভয় বাংলার গোটা জনগোষ্ঠীই ধ্বংস হবার মুখে পড়বে”। উভয় বাংলায় ১১০ মিলিয়ন মানুষ রয়েছে, যা গোটা মানবগোষ্ঠীর শতকরা তিন ভাগের সমান।

ইয়াহিয়ার শিকার শেষ কয়েক লক্ষ

দি গার্ডিয়ান, ৫ জুন, ১৯৭১

সম্পাদকীয়

পূর্ব-পাকিস্তানের হতভাগ্য লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন খুব দেরিতে এসেছে। রাজনীতি, আমলাতন্ত্র ও দমননীতি ভারতের হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে — যেন ভারতের নিজেরই এধরনের সমস্যা নেই — তাকে একাই ৪০ লক্ষ উদ্বাস্তুর দেখাশোনা করতে হচ্ছে। অনেকের জন্য কলেরা হলো দুর্যোগের চতুর্থ ধাপ –এর আগে তাদের ভাগ্যে ছিল তিন দুর্যোগ: গত নভেম্বরের সাইক্লোন, ইয়াহিয়া খানের সামরিক হত্যাভিযান এবং জনগণের উদ্বাস্তুতে রূপান্তরিত হওয়া। এখনকার সমস্যা হলো পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ব পাকিস্তানের যাদের সাহায্য প্রয়োজন, যত দ্রুত সম্ভব তাদের সাহায্য-প্রদান নিশ্চিত করা।

দুই এলাকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পৃথক। পূর্ব-পাকিস্তানের মতো পশ্চিমবঙ্গের কোথাও চলে যাওয়ার সমস্যা নেই। ভারতকে দ্রুত দেখাতে হবে যে তার একার পক্ষে উদ্বাস্তুদের দেখাশোনা করা সম্ভব না। ভারত বাইরের সহায়তাকে স্বাগত জানিয়েছে। সাহায্য যা আসবে তা দিয়ে হয়তো পুরো প্রয়োজন মিটবে না। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো ভারত-সরকার জাতিসংঘের কাছে সাহায্য-প্রার্থনা করেনি। এই আমলাতান্ত্রিক বাধার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুরা অনেক সহায়তাই পাচ্ছে না।

পূর্ব পাকিস্তানে যাদের হত্য করা হয়নি, কিন্তু এই মুহূর্তে ক্ষুধার্ত রয়েছে, তাদের জরুরিভিত্তিতে খাদ্য প্রয়োজন। কিন্তু ইয়াহিয়া খানকে সরাসরি সাহায্য ব্যতিরেকে তাদের কীভাবে সাহায্য করা হবে? নাইজেরিয়ার বায়াফ্রার জন্য যখন আন্তর্জাতিক সাহায্য দেয়া হয়েছিল তখন জেনারেল গাওন অযৌক্তিকভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন এই বলে যে সাহায্যদানকারীরা তার শাসনপদ্ধতিতে অন্যায় হস্তপে করেছেন। ইয়াহিয়া খান এসবেরই লক্ষণ দেখাচ্ছেন — বলছেন পাকিস্তানের নিজস্ব সংস্থাসমূহ সাহায্য পরিচালনা করে। কিন্তু তিনি এবং দাতারা জানেন, এভাবে সাহায্য দেয়ার অর্থ, সেনাবাহিনীর হাতে তা দেয়া, যে-সেনাবাহিনী দুর্গতদের হত্যাকারীর ভূমিকা পালন করে এসেছে।

সাহায্যদাতারা ইয়াহিয়ার মহত্ত্বের ভান করাটাকে এড়িয়ে চলতে পারেন যদি বিশ্বের অর্থসংস্থাসমূহ তাকে শর্তহীনভাবে নাকচ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। পাকিস্তানের অর্থনীতি এখন খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে এবং অবমূল্যায়ন প্রকট হয়ে উঠেছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও অর্থসংস্থাসমূহের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে এখানে নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে নিশ্চিত করতে হবে যে, ইয়াহিয়া খান যেন বাড়তি কোনো সাহায্য না পান, যা তিনি চাচ্ছেন। ইয়াহিয়া খানকে এটা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে যে-দমননীতি চালিয়ে যাচ্ছেন, তাতে সাহায্য করার জন্য তার পাশে কেউ নেই। পরিতাপের বিষয় এই যে, যখন এই রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা হবে, ইতোমধ্যে আরও উদ্বাস্তু দেশ ছাড়বে এবং খেতে না পেয়ে আরও অনেক মানুষ মারা যাবে।