গণহত্যা : এ্যান্থনি মাসকারেনহাস

Genocide_Mascarenhas

দি সানডে টাইমস, ১৩ জুন ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

পাঁচ মিলিয়ন লোক বাস্তুভিটা ছেড়ে কেন পালিয়ে গেছে সে মর্মান্তিক কাহিনী নিয়ে পাকিস্তান থেকে এসেছেন সানডে টাইমসের রিপোর্টার।

মার্চের শেষ থেকে পাকাসেনারা পরিকল্পিতভাবে হাজার হাজার লোককে হত্যা করে চলেছে। মার্চের শেষ থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সংবাদ-ধামাচাপা-দেয়ার পেছনের মর্মান্তিক কাহিনী হলো এই। কলেরা আর দুর্ভিক্ষ নিয়েও ৫০ লক্ষ লোকের পূর্ব পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে ভারতে চলে আসার এই হলো কারণ।

সানডে টাইমসের পাকিস্তান-প্রতিনিধি অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস এই প্রথামবারের মতো নিরবতার পর্দা উন্মোচন করলেন। তিনি সেখানে পাকসেনাদের কীর্তিকলাপ দেখেছেন। তিনি পাকিস্তান ছেড়ে এসেছেন বিশ্ববাসীকে সেসব জানানোর জন্য। সেনাবাহিনী শুধু স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশ ধারণার সমর্থকদেরই হত্যা করছে না। স্বেচ্ছাকৃতভাবে খুন করা হচ্ছে হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান সবাইকে। হিন্দুদের গুলি করে বা পিটিয়ে মারা হচ্ছে তারা কেবল হিন্দু বলেই। জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের রিপোর্টের পেছনেও রয়েছে একটি দারুণ গল্প।

মার্চের শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তানে দুই ডিভিশন পাকসেনা গোপনে পাঠানো হয় বিদ্রোহীদের ‘খুঁজে বের করা’র জন্য। কিন্তু দু-সপ্তাহ পরে পাকিস্তান সরকার আটজন পাকিস্তানী সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানায় পূর্ব পাকিস্তানে উড়ে যাবার জন্য। সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সাংবাদিকদের প্রভাবিত করে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে এই ধারণা দেয়াই এর উদ্দেশ্য ছিল যে, দেশের পূর্বাংশে ‘সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে’। সাতজন সাংবাদিক তাদের কথামতো কাজ করেছেন। কিন্তু তা করেননি একজন — তিনি হলেন করাচির মর্নিং নিউজ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ও সানডে টাইমসের পাকিস্তান-প্রতিনিধি অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস।

১৮ মে মঙ্গলবার তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে এসে হাজির হন লন্ডস্থ দি সানডে টাইমসের কার্যালয়ে। আমাদের জানালেন, পূর্ব বাংলা ছেড়ে ৫০ লক্ষ লোককে কেন চলে যেতে হয়েছে তার পেছনের কাহিনী। তিনি সোজাসাপ্টভাবে জানালেন এই কাহিনী। এই কাহিনী লেখার পর তার পক্ষে আর করাচি ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। তিনি জানালেন তিনি পাকিস্তানে আর ফিরে না-যাবার ব্যাপারে মনস্থির করেছেন; এজন্য তাকে তার বাড়ি, তার সম্পত্তি, এবং পাকিস্তানের সবচেয়ে সম্মানীয় একজন সাংবাদিকের মর্যাদার মায়া ত্যাগ করতে হবে। তার মাত্র একটি শর্ত ছিল: পাকিস্তানে গিয়ে তার স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তানকে নিয়ে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা যেন তার রিপোর্ট প্রকাশ না করি।

সানডে টাইমস রাজি হয় এবং তিনি পাকিস্তানে ফিরে যান। দশ দিন অপেক্ষা করার পর সানডে টাইমসের এক নির্বাহীর ব্যক্তিগত ঠিকানায় একটি বৈদেশিক তারবার্তা আসে। তাতে লেখা ছিল, ‘আসার প্রস্তুতি সম্পন্ন, সোমবার জাহাজ ছাড়বে।’ দেশত্যাগ করার ব্যাপারে স্ত্রী ও সন্তানদের অনুমতি পেতে ম্যাসকারেনহাস সফল হন। তার দেশত্যাগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে তিনি কোনোরকমে একটা রাস্তা পেয়ে যান। পাকিস্তানের ভেতরে যাত্রার শেষ পর্যায়ে তিনি প্লেনে একজন তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাকে দেখতে পান যাকে তিনি ভালোমতোই চিনতেন। এয়ারপোর্ট থেকে একটি ফোনকল তাকে গ্রেফতার করার জন্য যথেষ্ট ছিল। তবে কোনো ফোনকল হয়নি এবং তিনি মঙ্গলবার লন্ডনে এসে পৌঁছান।

পূর্ব পাকিস্তানে ম্যাসকারেনহাস বিশেষ কর্তৃত্ব ও নিরপেক্ষতা সহকারে যা দেখেছেন তা লিখেছেন। তিনি গোয়ার একজন ভদ্র খ্রিস্টান, তিনি হিন্দু বা মুসলমান কোনোটাই নন। জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন পাকিস্তানে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের উদ্ভবের পর থেকেই তিনি পাকিস্তানের পাসপোর্টধারী। তখন থেকে তিনি পাকিস্তানের অনেক নেতার আস্থা অর্জন করেছেন এবং এই রিপোর্ট লিখছেন সত্যিকারের ব্যক্তিগত দুঃখবোধ থেকে।

তিনি আমাদের কাছে বলেন, ‘তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আমাদের জানান সেনাবাহিনী যে বিরাট দেশপ্রেমের কাজ করছে, ব্যাপারটা সেভাবে উপস্থাপন করতে।’ তিনি তার প্রতিবেদনের জন্য যা দেখেছেন এবং রিপোর্ট করেছেন সে-সম্পর্কে কোন সন্দেহই থাকতে পারে না । তাকে একটি রিপোর্ট লেখার অনুমতি দেয়া হয় যা সানডে টাইমসে ২ মে প্রকাশিত হয়। রিপোর্টটিতে কেবল মার্চ ২৫/২৬-এর ঘটনার বিবরণ ছিল, যখন বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে এবং অবাঙালিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এমনকি দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার প্রসঙ্গ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ সেন্সর করেছিল। এ-ব্যাপারটিই তার নীতিবোধকে পীড়া দিচ্ছিল। কিছুদিন পরে, তার ভাষায়, তিনি স্থির করলেন যে, “হয় যা দেখেছি তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিখবো, নয়তো লেখাই বন্ধ করে দেবো; নইলে সততার সঙ্গে আর লেখা যাবে না।” তাই তিনি প্লেনে চেপেছেন এবং লন্ডন চলে এসেছেন।

পূর্ব বাংলা থেকে আসা শরণার্থী ও নিরপেক্ষ কূটনীতিবিদদের মধ্যে যাদের এসব ঘটনা সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা রয়েছে তাদের দ্বারা তার প্রতিবেদন আমরা বিস্তৃতভাবে যাচাই করতে সমর্থ হয়েছি।

শরণার্থীরা কেন পালিয়েছে: সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যাবার পরের বিভীষিকার প্রথম প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা

আবদুল বারী ভাগ্যের ভরসায় দৌড় দিয়েছিল। পূর্ব বাংলার আরো হাজার মানুষের মতো সেও একটা ভুল করে ফেলেছিলো — সাংঘাতিক ভুল –ও দৌড়াচ্ছিলো পাকসেনাদের একটি টহল-সেনাদলের দৃষ্টিসীমার মধ্যে। পাকসেনারা ঘিরে দাঁড়িয়েছে এই চব্বিশ বছরের সামান্য লোককে। নিশ্চিত গুলির মুখে সে থরথরিয়ে কাঁপে। “কেউ যখন দৌড়ে পালায় তাকে আমরা সাধারণত খুন করে ফেলি”, ৯ম ডিভিশনের জি-২ অপারেশনস-এর মেজর রাঠোর আমাকে মজা করে বলেন। কুমিল্লার বিশ মাইল দক্ষিণে মুজাফরগঞ্জ নামে ছোট্ট একটা গ্রামে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। “ওকে আমরা চেক করছি কেবল আপনার খাতিরে। আপনি এখানে নতুন এসেছেন, এছাড়া আপনার পেটের পীড়া রয়েছে।”
“ওকে খুন করতে কেন?” উদ্বেগের সঙ্গে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম।
“কারণ হয় ও হিন্দু, নয়তো বিদ্রোহী, মনে হয় ছাত্র কিংবা আওয়ামী লীগার । ওদের যে খুজছি তা ওরা ভালমতো জানে এবং দৌড়ের মাধ্যমে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে।”
“কিন্তু তুমি ওদের খুন করছো কেন? হিন্দুদেরই বা খুঁজছ কেন?” আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম । রাঠোর তীব্র কন্ঠে বলেন: “আমি তোমাকে অবশ্যই মনে করিয়ে দিতে চাই, তারা পাকিস্তান ধ্বংস করার কী রকম চেষ্টা করেছে। এখন যুদ্ধের সুযোগে ওদের শেষ করে দেয়ার চমৎকার সুযোগ পেয়েছি।”
“অবশ্য,” তিনি তাড়াতাড়ি যোগ করেন, “আমরা শুধু হিন্দুদেরই মারছি। আমরা সৈনিক, বিদ্রোহীদের মতো কাপুরুষ নই। তারা আমাদের রমণী ও শিশুদের খুন করেছে।”

পূর্ব বাংলার শ্যামল ভূমির ওপর ছড়িয়ে দেয়া রক্তের কলঙ্কচিহ্নগুলি আমার চেখে একে একে ধরা পড়ছিল। প্রথমে ব্যাপারটা ছিল বাঙালিদের প্রতি বন্য আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অবাঙালিদের হত্যা। এখন এই গণহত্যা ঘটানো হচ্ছে পাকসেনাদের দ্বারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে। এই সুসংগঠিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হিন্দুরাই শুধু নয়, যারা সাড়ে ৭ কোটি জনসংখ্যার ১০ শতাংশ, বরং হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানরাও। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র, শিক্ষক, আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যসহ সবাই এর মধ্যে রয়েছে। এমন কি ১৭৬,০০০ জন বাঙালি সৈনিক ও পুলিশ যারা ২৬শে মার্চে অসময়োপযোগী ও দুর্বল-সূচনার একটা বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করতে চেয়েছিল, এর ভেতরে তারাও আছে।

এপ্রিলের শেষ দিকে পূর্ব বাংলায় দশদিনে চোখ আর কানে অবিশ্বাস্য যকিছু আমি দেখেছি ও শুনেছি তাতে এটা ভয়াবহভাবে পরিষ্কার যে এই হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বিচ্ছিন্ন কোনো কার্যকলাপ নয়। পাক সেনাদের দ্বারা বাঙালিদের হত্যাকাণ্ডই অবশ্য একমাত্র সত্য নয়। ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরাই একমাত্র হত্যাকারী ছিল না, পূর্ব পাকিস্তানের সৈন্য ও প্যারামিলিটিারির সদস্যদের বন্য আক্রোশের শিকার হয়েছে অবাঙালিরা। কর্তৃপক্ষের সেন্সর আমাকে এই তথ্য জানানোর সুযোগ দিয়েছে। হাজার হাজার অভাগা মুসলিম পরিবার, যাদের অধিকাংশই ১৯৪৭ সনের দেশ বিভাগের সময় বিহার থেকে শরণার্থী হিশেবে পাকিস্তানে এসেছিল, প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। রমণীরা ধর্ষিত হয়েছে, বিশেষ ধরনের ছুরি দিয়ে কেটে নেয়া হয়েছে তাদের স্তন। এই ভয়াবহতা থেকে শিশুরাও রক্ষা পায়নি। ভাগ্যবানরা বাবা-মার সঙ্গেই মারা গেছে; কিন্তু চোখ উপড়ে ফেলা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিষ্ঠুরভাবে ছিঁড়ে নেয়া হাজার হাজার শিশুর সামনে ভবিষ্যত এখন অনিশ্চিত। চট্টগ্রাম, খুলনা ও যশোরের মতো শহরগুলো থেকে ২০,০০০-এরও বেশি অবাঙালির মৃতদেহ পাওয়া গেছে। নিহতদের সত্যিকারের পরিমাণ, পূর্ব বাংলার সর্বত্র আমি শুনেছি ১০০,০০০-এর মতো হতে পারে; কারণ হাজার হাজার মৃতদেহের কোনো চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

পাক-সরকার ওই প্রথম ভয়াবহতা সম্পর্কে পৃথিবীকে জানতে দিয়েছে। কিন্তু যা প্রকাশ করতে দেয়া হয়নি তা হলো, তাদের নিজেদের সেনাবহিনী যে-হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা ছিল দ্বিতীয় এবং ভয়াবহতম হত্যাকাণ্ড। পাক-কর্মকর্তারা উভয় পক্ষ মিলিয়ে নিহতদের সংখ্যা ২৫০,০০০-এর মতো বলে গণনা করেছে — এর মধ্যে দুর্ভিক্ষ এবং মহামারিতে মৃতদের ধরা হয়নি। দেশের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত প্রদেশে সফল ধ্বংসকাণ্ড চালানোর মাধ্যমে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তান-সমস্যাকে তার নিজস্ব ‘চরম সমাধানের’ দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।

“আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে একেবারে সংশোধন করতে চাই এবং বিচ্ছিন্ন হওয়ার সব হুমকিকে রদ করার জন্য আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, এর অর্থ যদি হয় ২০ লক্ষ লোককে হত্যা করা এবং প্রদেশটিকে ৩০ বছর ধরে কলোনি বানিয়ে রাখা, তবুও,” আমাকে বারবার এ-কথা শুনিয়েছেন ঢাকা ও কুমিল্লার ঊধ্বর্তন সামরিক ও সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ। পূর্ব বাংলায় পাকসেনারা ব্যাপকভাবে ও ভয়াবহভাবে ঠিক এই কাজটিই করে চলেছে।

চাঁদপুর ভ্রমণ শেষে অস্তায়মান সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা ছুটে চলেছি (কারণ, বুদ্ধিমান পাক সেনারা পূর্ব বংলায় ভবনের ভেতরে রাত্রি যাপন করে)। টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজারের পেছন থেকে হঠাৎ এক জওয়ান চেঁচিয়ে উঠল, “একটা লোক দৌড়িয়ে যাচ্ছে, সাহেব।” মেজর রাঠোর মুহূর্তেই গাড়ি থামিয়ে দিলেন, একই সঙ্গে চীনা এলএমজি তাক করলেন দরজার বিপরীতে। দুশো গজেরও কম দূরে হাঁটু-সমান উঁচু ধানক্ষেতের মধ্যে একটা লোককে ছুটে পালাতে দেখা গেল।

“আল্লাহর দোহাই, ওকে গুলি কর না,” আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, “ও নিরস্ত্র। ও একজন গ্রামবাসী মাত্র।”
আমার দিকে বাজেভাবে তাকিয়ে রাঠোর একটা সতর্কতামূলক গুলি করলেন। সবুজ ধানের গালিচায় লোকটা কুঁকড়ে ঢুকে যেতেই দু’জন জওয়ান এগিয়ে গেল তাকে টেনে-হিঁচড়ে আনতে।
বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাতের পর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হল।
“তুমি কে?”
“মাফ করে দিন সাহেব, আমার নাম আব্দুল বারী। ঢাকায় নিউ মার্কেটে দর্জির কাজ করি।”
“মিথ্যে বলবে না। তুমি হিন্দু। না হলে দৌড়াচ্ছিলে কেন?”
“কারফিউয়ের সময় প্রায় হইয়া আসছে, সাহেব, আমি আমার গ্রামে যাইতেছিলাম।”
“সত্য কথা বল। দৌড়াচ্ছিলে কেন?”
প্রশ্নের উত্তর দেবার পূর্বেই তাকে একজন জওয়ান দেহ-তল্লাসী শুরু করল এবং আরেকজন দ্রুত তার লুঙ্গি টেনে খুলল। হাড়জিরজিরে নগ্ন শরীরে সুস্পষ্ট খৎনার চিহ্ন দেখা গেল, যা মুসলমানদের অবশ্যই করতে হয়।

ট্রাকভর্তি মানুষগুলোকে হত্যা করা হয়

অন্তঃতপক্ষে এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ হল যে বারী হিন্দু নয়। তারপরও জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল।
“বল তুমি দৌড় দিয়েছিলে কেন?”
এতক্ষণে ওর চোখ বুনো হয়ে উঠল। ওর শরীরও কাঁপছিল প্রচণ্ডভাবে। সে উত্তর দিতে পরছিল না, সে হাঁটু চেপে ধরল।
“স্যার, মনে হচ্ছে ও ফৌজি।” বারী পা খামচে ধরায় এক জওয়ান মন্তব্য করে। (ফৌজি সৈনিকের উর্দু শব্দ, বাঙালি বিপ্লবীদের পাকসেনারা এই নামে চিহ্নিত করে থাকে।)
“হতে পারে।” আমি শুনলাম রাঠোর হিংস্রভাবে বিড়বিড় করল।
রাইফেলের বাট দিয়ে প্রচণ্ডভাবে পিটিয়ে আব্দুল বারীকে ভীষণ জোরে ছুঁড়ে দেয়া হল একটি দেয়ালের দিকে। তার আর্তনাদের পর কাছের কুঁড়েঘরের আড়াল থেকে এক তরুণকে উঁকি দিতে দেখা গেল। বাংলায় কী যেন চেঁচিয়ে বলল বারী। মাথাটি সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হল। কিছুক্ষণ পরেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে এল এক বুড়ো মানুষ। রাঠোর তাকে খামচে টেনে আনলো।
“এই লোকটাকে তুমি চেন?”
“হ্যাঁ সাহেব। ও আব্দুল বারী।”
“সে কি ফৌজি?”
“না সাহেব। হে ঢাকায় দর্জির কাম করে।”
“সত্যি কথা বল।”
“খোদার কসম, সাহেব, হে দর্জি।”
হঠাৎ নিরবতা নেমে এলো। রাঠোর অপ্রস্তুত হয়ে তাকালে আমি বললাম, “আল্লাহর দোহাই, ওকে যেতে দাও। ওর নির্দোষিতার আর কত প্রমাণ চাও?”
জওয়ানরা তবু সন্তুষ্ট হয় না, তারা বারীকে ঘিরে রাখে। আরো একবার বলার পর রাঠোর বারীকে ছেড়ে দেবার আদেশ দিলেন। ইতোমধ্যে সে ভয়ে জড়োসড়ো ও কুঞ্চিত হয়ে গেছে। তার জীবন বেঁচে গেল। অন্য সবার ভাগ্যে এমন সুযোগ আসে না।

৯ম ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমি ছয়দিন কুমিল্লায় ঘুরেছি। আমি কাছ থেকে দেখেছি গ্রামের পর গ্রাম, বাড়ির পর বাড়ি “অস্ত্র অনুসন্ধান”-এর ছলে খৎনা করা হয়নি এমন লোকদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে। কুমিল্লার সার্কিট হাউসে (বেসামরিক প্রশাসনের হেড কোয়ার্টার) মানুষদের মৃত্যুযন্ত্রণার আর্তরব আমি শুনেছি। কারফিউর নামে আমি দেখেছি ট্রাক বোঝাই লোক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে খুন করার জন্য। সেনাবহিনীর “হত্যা ও অগ্নিসংযোগ মিশন’-এর পাশবিকতার আমি প্রত্যক্ষদর্শী। দেখেছি বিপ্লবীদের খতম করার পর কীভাবে গ্রাম-শহরে ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে।

‘শাস্তিমূলক পদক্ষেপ” নিয়ে কীভাবে পুরো গ্রামকে ধ্বংস¯তূপে পরিণত করা হয়েছে তাও আমি দেখেছি। আর রাত্রিবেলা শুনেছি তাদের সারাদিনব্যাপী চালানো হত্যাকাণ্ডের অবিশ্বাসযোগ্য, বর্বর রোমন্থন। “তুমি কয়টা খতম করেছ?” তাদের উত্তর এখনও আমার স্মৃতিতে জ্বলন্ত।

যেকোনো পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার বলবে এর সবই করা হয়েছে ‘পাকিস্তানের আদর্শ, সংহতি ও অখণ্ডতা অক্ষুণ্ন রাখা’-র জন্য। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে। ভারতের দ্বারা হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত দুই অংশকে একত্রে রাখার জন্য এই তথাকথিত সামরিক কার্যক্রমই আদর্শের পতনকে প্রমাণ করেছে। পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত রাখা সম্ভব একমাত্র কঠোর সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। আর পাকসেনাদল পাঞ্জাবীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যারা ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালিদের অপছন্দ করে, ঘৃণা করে।

পরিস্থিতি এমন অবস্থায় এসেছে যে কিছু বাঙালিকেও পশ্চিম পাকিস্তানী দলের সঙ্গে দেখা গেছে স্বতঃস্ফুর্তভাবে। ঢাকায় এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় এ-রকম আশ্চর্য অদ্ভুত অভিজ্ঞাতার মুখোমুখি হয়েছি আমি। “দুঃখিত”, সে আমাকে বলল, “ছক পাল্টে গেছে। আমি তুমি যে পাকিস্তানকে জানি, তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাকে পেছনেই থাকতে দাও।”

ঘণ্টাখানেক বাদে এক পাঞ্জাবী সেনা-কর্মকর্তা পাকসেনারা পদক্ষেপ নেয়ার আগের অবাঙালিদের ওপর চালানো হত্যাকাণ্ডের কথা বলা আরম্ভ করল। সে আমাকে বলল, “১৯৪৭-এর দেশবিভাগের সময়কার শিখদের চাইতে পাশবিক আচরণ করেছে তারা। কীভাবে আমরা তা ভুলতে বা মাফ করতে পারি?” সেনাবাহিনীর এই উম্মত ধ্বংসকার্যের দু’টো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। একটিকে কর্তৃপক্ষ ‘শুদ্ধি অভিযান’ নামে চিহ্নিত করতে পছন্দ করেন যা মূলত ধ্বংসলীলাকেই নরমভাবে উচ্চারণ করা। অপরটি হল ‘পুনর্বাসন-উদ্যোগ”। পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের বশীভূত উপনিবেশ বানানোর প্রচেষ্টাকে এভাবে বর্ণনা করা হয়। এই ঢালাও অভিব্যক্তি এবং ‘দুষ্কৃতিকারী’ ও ‘হামলাকারী’ হিসেবে বারংবার উল্লেখ বিশ্বকে সন্তুষ্ট রাখার প্রয়াস। কিন্তু প্রচারণার অন্তরালে হত্যা ও উপনিবেশীকরণই হলো বাস্তবতা।

হিন্দুদের হত্যালীলার যৌক্তিকতা বিষয়ে ১৮ এপ্রিল রেডিও পাকস্তিান থেকে প্রচারিত পূর্ব পাকিস্তানের মিলিটারি গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের বক্তব্য আমি শুনেছি। তিনি বললেন “পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিল, তারা পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতিজ্ঞ। কিন্তু হিংস্র ও আগ্রাসী সংখ্যালঘুরা জীবন ও ধনসম্পদ ধ্বংস করার হুমকি দিয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠদের দমন করেছে, আওয়ামী লীগকে বাধ্য করেছে হিংসাত্মক নীতি গ্রহণ করতে।”

অন্যরা যৌক্তিকতা খোঁজার ব্যাপারে আরো বোধ-বুদ্ধিহীন। “টাকার জোরে হিন্দুরা মুসলমান জনগণকে একেবারে খাটো করে দেখেছে,” কুমিল্লার অফিসার্স মেসে ৯ম ডিভিশনের কর্নেল নাঈম আমাকে জানান। “শুষে পুরো শহরকে ওরা রক্তশূন্য করে ফেলেছে। টাকা অর্থ পণ্য সব ভারতে চলে যায় সীমান্ত পার হয়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজে অর্ধেকরও বেশি নিজেদের লোক ঢুকিয়ে আপন ছেলেদের পড়াশোনার জন্য পাঠিয়ে দেয় কলকাতায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে এসেছে যে বাঙালি সংস্কৃতি আসলে হিন্দু সংস্কৃতি এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রকৃতপক্ষে পরিচালনা করছে কলকাতার মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ীরা। জনগণের কাছে তাদের দেশকে ফিরিয়ে দিতে হলে এবং বিশ্বাসের কাছে জনগণকে ফিরিয়ে আনতে হলে আমাদের তাদের খুঁজে বের করতে হবে।”

অথবা মেজর বশিরের কথাই ধরা যাক। তিনি নিচুপদ পার হয়ে এ পর্যায়ে এসেছেন। কুমিল্লার ৯ম ডিভিশনের এই এসএসও-র নিজস্ব হত্যার খতিয়ান ২৮ বলে দম্ভও আছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে তার আছে একটা নিজস্ব ব্যাখ্যা। “এটা হল শুদ্ধ আর অশুদ্ধর মধ্যে যুদ্ধ”, এক কাপ সবুজ চা খেতে খেতে তিনি আমাকে কথাটা বলেন। “এখানকার লোকদের নাম হয়তো মুসলমানের, পরিচয়ও দেয় হয়তো মুসলমান বলে, কিন্তু মানসিকতায় এরা হিন্দু। আপনার বিশ্বাস হবে না, শুক্রবার এখানকার ক্যান্টনমেন্ট-মসজিদের মৌলবি ফতোয়া দিচ্ছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানীদের খুন করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে। ওই জারজটাকে আমরা খুঁজে বের করেছি, বাদবাকিদেরও খুঁজছি। যারা ওতে অংশ নেয়নি তারা হল খাঁটি মুসলমান। আমরা এমন কি ওদের উর্দু শেখাবো।”

আমি প্রত্যেক জায়গার কর্মকর্তাদের দেখেছি তাদের হত্যালীলার পেছনে কল্পনামিশ্রিত যথেষ্ট যুক্তিও বানিয়ে নেন। কৃতকার্যের বৈধতা নিরূপণের জন্য অনেক কিছুই বলা যেতে পারে, নিজেদের মানসিক সন্তুষ্টির জন্যও সেটা প্রয়োজন, কিন্তু এই মর্মান্তিক ‘সমাধান’-এর মূল কারণটা রাজনৈতিক; বাঙালিরা নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাঞ্জাবীদের আকাক্সক্ষা এবং স্বার্থ সরকারি নীতি-নির্ধারণে প্রাধান্য স্থাপন করেছে — ক্ষমতা হারানোর ব্যাপারটা তাদের কিছুতেই সহ্য হবে না। আর সামরিক বাহিনী এতে ইন্ধন যুগিয়েছে। কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে এই বলে সাফাই গেয়েছে যে, সামরিক বাহিনী হত্যাকাণ্ড শুরুর পূর্বে অবাঙালিদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার পাল্টা জবাব হিসেবে এখনকার পদক্ষেপগুলো নেয়া হচ্ছে। কিন্তু ঘটনাবলী এমনটা বলে না যে চলমান এই গণহত্যা তাৎক্ষণিক ও বিশৃঙ্খল প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসেছে। এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত।

ভদ্র ও আত্মবিশ্বাসী অ্যাডমিরাল আহসানের কাছ থেকে পূর্ব বাংলার গভর্নরপদ এবং পণ্ডিতম্মন্য সাহেবজাদা খানের কাছ থেকে সামরিক ক্ষমতা লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান গ্রহণ করার পরই ‘অনুসন্ধান’-এর পরিকল্পনা শুরু হয়, এটা পরিষ্কার। এটা মার্চের শুরুর দিককার কথা, বাঙালিদের বিরাট প্রত্যাশা এসেম্বলি-সভা স্থগিত হবার পর যখন শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ-আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে উঠেছে। বলা হয়ে থাকে যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের দমন-পীড়নের পক্ষের লোক হিসেবে শীর্ষে অবস্থান করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিমালাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলছিল ঢাকাস্থ পাঞ্জাবী ইস্টার্ন কমান্ড। [এটা অত্যন্ত বাজে ব্যখ্যা যে খানরা এর সঙ্গে জড়িত নয়; খান পাকিস্তানীদের নামের একটি পদবী]

যখন ২৫ মার্চের রাতে পাকসেনারা ঢাকার পথে নামে, পরের দিন সকালে শহর এমনিতেই জনশূন্য ছিল, তাদের সঙ্গে ছিল যাদের শেষ করে দিতে হবে তাদের নামের তালিকা। এতে ছিল হিন্দু আর প্রচুর সংখ্যক মুসলমানের নাম — ছাত্র, আওয়ামী লীগ সমর্থক, অধ্যাপক, সাংবাদিক এবং মুজিবের সহায়তাকারী। মানুষকে বর্তমানে জানানো হচ্ছে যে সৈন্যদের আক্রমণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্রদের আবাসিক ভবন জগন্নাথ হল, রমনা রেসকোর্স মন্দিরের কাছাকাছি অবস্থিত দু’টি হিন্দু কলোনি এবং তৃতীয়ত পুরনো ঢাকার বুকের ওপর শাখারিপট্টিতে। কিন্তু মার্চের ২৬ ও ২৭ তারিখের দিবারাত্রিব্যাপী কারফিউয়ের সময়ে ঢাকা ও নিকটস্থ নারায়নগঞ্জ শিল্প এলাকার হিন্দুদের কেন হত্যা করা হলো তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। কারফিউর সময়ে রাস্তায় চলাচলকারী মুসলিমদেরও কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এই লোকগুলোকে খতম করা হয়েছে পরিকল্পিত অভিযানের মাধ্যমে; হিন্দু দমনের বানোয়াট অভিযোগের ফল এলো আরো বিস্তৃতভাবে, অন্যরকমভাবে।

একটি পেন্সিলের খোঁচা, একটি লোকের ‘নিকাশ’

১৫ই এপ্রিল ঢাকায় ঘোরার সময় ইকবাল হলের ছাদে আমি চারটি ছাত্রের গলিত মাথা পড়ে থাকতে দেখেছি। তত্ত্বাবধায়ক জানান যে, তাদের হত্যা করা হয়েছে ২৫শে মার্চের রাত্রে। দুটো সিঁড়ি এবং চারটি ঘরে প্রচুর রক্তপাতের চিহ্নও আমি দেখেছি। ইকবাল হলের পেছনে একটি বিশাল আবাসিক ভবন সেনাবাহিনীর বিশেষ মনোযোগ পেয়েছিল বলে মনে হল। বিশাল দেয়ালগুলো গুলিতে ঝাঁঝরা এবং সিঁড়িতে বাজে গন্ধের রেশ রয়ে গেছে, যদিও এখানে প্রচুর ডিডিটির গুঁড়ো ছড়ানো হয়েছে। প্রতিবেশীরা জানান ২৩ জন নারী ও শিশুর মৃতুদেহ মাত্র ঘন্টাখানেক আগে সরিয়ে নেয়া হয়েছে গাড়িতে করে। ২৫ তারিখ থেকেই ছাদের ওপর লাশগুলো পচছিল। অনেক প্রশ্নের পর জানা গেল হতভাগ্যরা ছিল কাছের হিন্দু-বাড়ির। এই ভবনে তারা আশ্রয় নিয়েছিল।

এই গণহত্যা সাধন করা হয়েছে নিতান্ত নির্বিকারভাবে। ১৯শে এপ্রিল সকালে কুমিল্লার সামরিক আইন প্রশাসক মেজর আগার অফিসে বসে থাকার সময়ে আমি দেখেছি এ-সমস্ত নির্দেশ কী নির্মমতার সঙ্গে দেয়া হয়। এক বিহারী সাব-ইন্সপেক্টর বন্দিদের একটি তালিকা নিয়ে এল। ওটার দিকে তাকিয়ে নির্বিকারভাবে চারটি নামের পাশে পেন্সিলের খোঁচা দিয়ে আগা বললেন, “সন্ধ্যার সময় এই চারজনকে নিকাশের জন্যে নিয়ে এসো।” তালিকার দিকে তাকিয়ে আবার তিনি পেন্সিলের দাগ বসালেন, “এই চোরটাকেও নিয়ে এসো ওদের সঙ্গে।”

মৃত্যুর ঐ আদেশ দেয়া হলো নারকেলের দুধ খেতে খেতে। আমাকে জানানো হল যে বন্দিদের দুজন হিন্দু, তৃতীয়জন ‘ছাত্র’ এবং চতুর্থজন এক আওয়ামী লীগ নেতা। ‘চোরটি,’ জানা গেলো, নিজ বাড়ীতে তার বন্ধুকে থাকতে দিয়েছিল। পরে সন্ধ্যার দিকে দেখলাম একটি দড়ি দিয়ে হাত-পায়ে শিথিলভাবে বেঁধে সার্কিট হাউজগামী রাস্তা দিয়ে ওদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারফিউর কিছু পরে সন্ধ্যা ছয়টার সময় পাখিদের একটি দল কাছে কোথাও কিচিরিমিচির করছিল, হঠাৎ গুলির তীব্র শব্দে তাদের খেলায় ছেদ পড়ল।

বেলুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আজমতকে নিয়ে প্রায়ই মেসে দুটো ব্যাপার আলোচনা করা হতো। একটি হলো ৯ম ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল শওকত রাজার এডিসি হিসেবে ওর চাকরি। অপরটি নিয়ে ওর সহকর্মীরা ওকে পেয়ে বসতো। জানা গেল আজমত দলের একমাত্র অফিসার যে কোনো ‘খুন’ করেনি। মেজর বশির তাকে নির্মমভাবে খোঁচাতো। “এই যে আজমত,” এক রাতে বশির তাকে বললেন, “কাল আমরা তোমাকে মানুষ করতে যাচ্ছি। কাল দেখব তুমি তাদের কেমন ধাওয়া দিতে পারো। ব্যাপারটা খুবই সোজা।” এই অসামর্থ্যরে জন্যে বশির তার সঙ্গে লেগেই থাকতেন। এসএসও-র চাকরি ছাড়াও বশির হেডকোয়ার্টারে ‘শিক্ষা কর্মকর্তা’ ছিলেন। তাকেই একমাত্র পাঞ্জাবী অফিসার দেখেছি, যে অনর্গল বাংলা বলতে পারতো।

শুনলাম বশিরের কাছে এক দাড়িঅলা একদিন সকালে তার ভাইয়ের খোঁজ নিতে এসেছিল। তার ভাই ছিল কুমিল্লার বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা। কিছুদিন আগে পাকসেনারা তাকে বন্দি করেছিলো। বশির তাকে জানালেন, “দৌড় গ্যায়া, পালিয়ে গেছে।” বুড়ো লোকটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না কীভাবে ভাঙা পা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। আমিও না। এ-ঘটনা বলে লম্বা হাসি দিয়ে মেজর বশির আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন। পরে জেনেছি ওদের নিজস্ব ভাষায় ‘দৌড় গ্যায়া’ মানে হলো, “পালানোর সময় গুলি করে খুন।”

আমি জানতে পারিনি ক্যাপ্টেন আজমত কাউকে খুন করতে পেরেছিলেন কি না। চট্টগ্রামের সত্তর মাইল উত্তরে ফেনীর কাছে কুমিল্লা সড়কে বাঙালি-বিদ্রোহীরা পরিখা খনন করেছিল, সে-এলাকার সব ব্রিজ ও কালভার্ট ধ্বংস করে ৯ম ডিভিশনের চলাচলকে সীমিত করে রেখেছিল। ঢাকায় ইস্টার্ন কমান্ড থেকে একের পর এক বাজে খবর পেয়ে জেনারেল রাজা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বিদ্রোহীদের পালিয়ে যাওয়া রদ করার জন্যে জরুরি হয়ে দাঁড়ায় দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত-অঞ্চল বন্ধ করে দেয়া। অথচ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে এসে পৌঁছানো অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্যে বর্তমানে একমাত্র পথ হিশেবে উন্মুক্ত রাখাও দরকার হয়ে পড়ে। তাই জেনারেল রাজা সহজেই উত্তেজিত হয়ে যান। সেখানে তিনি উড়ে যেতেন প্রায় প্রত্যেক দিনই। ফেনীর ভেঙে পড়া ব্রিজ নিয়ে বকবক করতেন দীর্ঘসময় ধরে। ক্যাপ্টেন আজমত সবসময়ের মতো তখনো জেনারেলের ছায়া। আমি তাকে আর দেখতে পাইনি। পরবর্তী তিন সপ্তাহর জন্যে খোঁচা থেকে আজমত মোটামুটি রক্ষা পেয়েছিল। ফেনী ও সংলগ্ন অঞ্চল ৮ই মে ৯ম ডিভিশন আয়ত্তে আনতে পারলো। বাঙালি বিদ্রোহীরা বোমা ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে এতোদিন সেখানে অবরোধ দিয়ে রেখেছিলো। শেষমেষ তারা সীমান্ত টপকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যায়।

৯ম ডিভিশন হেডকোয়ার্টারের জি-১ লেফটেন্যান্ট কর্নেল আসলাম বেগ ভারি অস্ত্রসহ বাঙালি বিদ্রোহীদের পালিয়ে যাওয়ার খবরে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি বললেন, “ভারতীয়রা তাদের ওখানে একদমই থাকতে দেবে না। ব্যাপারটা তাদের জন্য খুবই বিপজ্জনক হবে। সীমান্ত-অঞ্চলে তারা যত হামলা করবে আমরা তত ভোগান্তির শিকার হব।” পাক-ভারত যুদ্ধের সময় চীন থেকে অস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল বেগ ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় আর্টিলারি অফিসার। তিনি ছিলেন একজন গর্বিত পরিবারের সদস্য। তিনি ফুলও পছন্দ করতেন। আমাকে গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, কুমিল্লায় এর আগের পোস্টিং-এর সময় চীন থেকে আনিয়ে হেড কোয়ার্টারের উল্টোদিকের পুকুরে তিনি টকটকে লাল রঙের বিশাল জলপদ্ম রোপন করেছিলেন। মেজর বশির তাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। বশির আমাকে জানালেন, একবার এক বিদ্রোহী কর্মকর্তাকে ধরা হলো। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ল, তাকে নিয়ে কী করা যায়। অন্যরা যখন নির্দেশ পাবার জন্য টেলিফোনে খোঁজখবর করছেন তিনি সব সমাধান করে ফেললেন, দৌড় গ্যায়া। শুধু ওর পাটুকুই গর্তের বাইরে বের হয়ে ছিল।

পরিব্যাপ্ত শ্যামল সৌন্দর্যের মধ্যে কী পাশবিকতা চলছে, তা কল্পনা করাও অসম্ভব। এপ্রিলের শেষ দিকে আমি যখন সেখানে যাই, তখন কুমিল্লা ধ্বংস¯তূপ। পথের দু’পাশের সবুজ ধানক্ষেত দিগন্তে রক্তিম আভার আকাশে গিয়ে মিশেছে। গুলমোহর, ‘অরণ্যের বহ্নিশিখা’ ফোটার সময় এসে গেছে। গ্রামের আম আর নারকেল গাছগুলো ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে। এমন কি রাস্তার পাশে ছাগলের দৌড়ঝাঁপও প্রমাণ করছিলো প্রকৃতিক বাংলার পূর্ণতা। “পুরুষ আর স্ত্রীগুলোকে আলাদা করার একমাত্র উপায় হলো,” আমাকে ওরা বললো, “মেয়ে ছাগলগুলো গর্ভবতী।”

হত্যা আর অগ্নিকাণ্ড: তাদের শাস্তির নমুনা

পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল অঞ্চল কুমিল্লার জনসংখ্যার ঘনত্ব হলো প্রতি বর্গমাইল ১,৯০০ জন। অথচ কোথাও কোনো মানুষ দেখা গেলো না। ”বাঙালিরা কোথায়?” কিছুদিন আগে ঢাকার রাস্তাঘাট একেবারে নির্জন দেখে সেনাদলের লোকদের আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওদের তৈরী করা উত্তর ছিলো, “সবাই গ্রামে গেছে।” অথচ গ্রামেও কোনো বাঙালি দেখা যাচ্ছিল না। ঢাকার মতো কুমিল্লাও একেবারে জনশূন্য। লাকসাম দিয়ে আসার সময় দশ মাইল পথে হাতে গোনা কয়েকজন কৃষককে দেখলাম। অবশ্য খাকি-পোশাক-পরা পাকসেনারা গম্ভীর মুখে অটোমেটিক রাইফেল হাতে রাস্তায় অবস্থান করছিল। আদেশমাফিক রাইফেল হাতছাড়া করেনি কেউ। ট্রিগার-সুখী কঠিন লোকজন সবসময় রাস্তা পাহারা দিচ্ছে। যেখানে পাকসেনা, সেখানে কোনো বাঙালিকে পাওয়া যাবে না।

রেডিও এবং খবরের কাগজে সামরিক আইন ঘোষণা করা হচ্ছে মুহূর্মুহু — চোরাগোপ্তা হামলার জন্য ধরা পড়লে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। রাস্তা বা ব্রিজ ধ্বংস বা খোঁড়ার চেষ্টা করলে ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলের একশ গজের ভেতর সমস্ত বাড়িকে এর জন্য দায়ী করা হবে এবং সেগুলোর ধ্বংসসাধন করা হবে। কার্যক্ষেত্রে ঘোষণাগুলোর চাইতে ভয়াবহ সব পদক্ষেপে নেয়া হয়েছে। ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ এমন একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বাঙালিরা বেপরোয়া ও সহিংস হতে বাধ্য হয়েছে।

এর যে কী ভয়াবহ অর্থ তা দেখেছি ১৭ এপ্রিল চাঁদপুর যাওয়ার পথে হাজীগঞ্জে। বিদ্রোহীরা, যারা এখনো এ-অঞ্চলে তৎপর, গত রাতে ১৫ ফুট দীর্ঘ একটা ব্রিজ ভেঙে ফেলেছে। মেজর রাঠোরের (জি-২ অপারেশনস্) মাধ্যমে জানা গেলো, তৎক্ষণাৎ এই এলাকায় একদল সেনাদল পাঠিয়ে দেয়া হলো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। ব্রিজের সিকি মাইলব্যাপী অঞ্চলে পেঁচিয়ে ওঠা ঘন ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল তখনও। সাময়িকভাবে কাঠের তক্তা দিয়ে সারানো ব্রিজটি সাবধানে পার হওয়ার সময় দেখলাম ডানদিকের গ্রাম্য বাড়িগুলোতেও আগুন লকলকিয়ে উঠছে।

গ্রামের পেছন দিকে কিছু জওয়ান আগুন ছড়ানোর চেষ্টা করছিল নারকেলের ছোবড়া দিয়ে। এগুলো কাজও দিচ্ছিল ভালো। কারণ সাধারণত রান্নার কাজে এগুলো ব্যবহার করা হয়। পথের অন্যদিকে ধানক্ষেতের ওপারের গ্রামেও আগুনের চিহ্ন দেখা গেল। বাঁশঝাড় আর কুঁড়েঘরগুলো তখনও পুড়ছিল। শত শত গ্রামবাসী পাকসেনা আসার আগের রাতেই পালিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় মেজর রাঠোর বললেন, ”এই দুর্দশাকে তারা নিজেরাই ডেকে এনেছে।” আমি বললাম, “সামান্য কিছু বিদ্রোহীর জন্য নিরপরাধ লোকদের ওপর এটা বড় বেশি নির্মমতা হয়ে গেছে।” তিনি কোনো উত্তর দিলেন না।

কয়েকঘণ্টা পরেই চাঁদপুর থেকে ফেরার সময় আমরা আবার হাজীগঞ্জ দিয়ে আসছিলাম। ‘হত্যা আর অগ্নিকাণ্ড অভিযান’-এর বর্বরতা আমি স্বচক্ষে দেখলাম তখন। দুপুরবেলা সে-এলাকার ওপর দিয়ে বেশ কড়া ঝড় বয়ে গেছে। এখন শহরের ওপর পড়েছে মসজিদের মিনারের ভৌতিক ছায়া। পেছনের খোলা জিপে ক্যাপ্টেন আজহার আর চারজন জওয়ানের ইউনিফর্ম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে চুপসানো। বাঁক নিতেই মসজিদের বাইরে আমরা ট্রাকের একটা বহর থেমে থাকতে দেখলাম। গুনে দেখলাম জওয়ান-ভর্তি সাতটা ট্রাক। বহরটির সামনে ছিল একটা জিপ। দু’জন লোক তৃতীয় একজনের নেতৃত্বে পথের পাশে একশোরও বেশি দোকানের বন্ধ দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। দু’টো কুঠার দিয়ে এই ভাঙার চেষ্টা চলছিল, মেজর রাঠোর তার টয়োটা সেখানে থামালেন।

“তোমরা এখানে কী করছ?”
তিনজনের মধ্যে লম্বা লোকটা, যে ভাংচুরের তত্ত্বাবধান করছিল, আমাদের দিকে চেঁচিয়ে উঠল, “মোটু, আমরা কী করছি বলে তোমার মনে হয়?” কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে, মেজর রাঠোর মিষ্টি একটা হাসি দিলেন। আমাকে জানালেন তিনি হলেন তার পুরনো দোস্ত ইফতি — টুয়েলভথ ফ্রন্ট্রিয়ার্স ফোর্স রাইফেলের মেজর ইফতিখার।
রাঠোর বললেন, “আমি ভেবেছিলাম কেউ লুট করছে।”
“লুট? না না।” জবাব দিল ইফতিখার, “আমরা শুধু খুন করছি আর আগুন জ্বালাচ্ছি।”
হাত নাড়িয়ে তিনি বোঝালেন যে এসব তিনি ধ্বংস করবেন।
“ক’জনকে ধরতে পেরেছ?” রাঠোর জিজ্ঞেস করলেন।
ইফতিখার ভ্রূঁ নাচিয়ে হাসলেন।
“বল।” রাঠোর আবার জিজ্ঞেস করলেন। “ক’জনকে ধরেছ?”
“মাত্র বারোজন।” তিনি জবাব দিলেন, “আল্লাহর রহমতে আমরা ওদের পেয়েছি। লোকদের ধাওয়া করার জন্য না পাঠালে তো ওরা পালিয়েই যেত।”
মেজর রাঠোরের উৎসাহে ইফতিখার তার ঘটনার বর্ণনা শুরু করলেন বিস্তৃতভাবে। কীভাবে হাজীগঞ্জে ব্যাপক অন্বেষণের পর একটা বাড়িতে লুকিয়ে থাকা বারোজন হিন্দুকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন তা রসিয়ে বললেন। তাদের সবাইকে ‘নিকাশ করে দেয়া হয়েছে।’ এখন মেজর ইফতেখার এখন ব্যস্ত তার দ্বিতীয় অভিযানে, অগ্নিকাণ্ডে।

ইতোমধ্যে একটি দোকানের দরজা ভেঙে ফেলা হয়েছে। বাংলায় দোকানটিতে লেখা আছে ‘মেডিকেল এন্ড স্টোরস’। বাংলা লেখার নিচে সেই সাইনবোর্ডে ইংরেজিতে লেখা আছে ‘অশোক মেডিকেল এন্ড স্টোরস’। তার নিচে লেখা ছিল ‘প্রোপাইটর এ এম বোস”। তালা মেরে অন্যান্যদের মতো জনাব বোসও হাজীগঞ্জ থেকে পালিয়েছেন। দোকানের সামনে ছিল একটা প্রদর্শন কক্ষ। ওষুধ, কফ সিরাপ, ম্যাঙ্গো স্কোয়াসের বোতল, ইমিটেশনের অলঙ্কার, রঙিন পোশাকের প্যাকেট ইত্যাদি অনেক কিছু ওতে সাজানো ছিল। ইফতিখার লাথি মেরে সব ভাঙ্গতে লাগলেন। তিনি কিছু চটের ব্যাগ নিলেন। অন্য একটি তাক থেকে নিল কিছু প্লাস্টিকের খেলনা আর রুমালের বাণ্ডিল। তারপর মেঝেতে সব জড়ো করে টয়োটায় বসা এক জওয়ানের কাছ থেকে দেশলাই নিয়ে এলেন। ওই জওয়ানের মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি ভালোই ছিল। সে গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে দৌড় দিয়ে দোকানে ঢুকে একটা ছাতা বের করে আনল। ইফতিখার তাকে বেরিয়ে যাওয়ার আদেশ করলেন।

লুট করা, তিনি মনে করিয়ে দিলেন, নিয়মবিরুদ্ধ। এরপর দ্রুত আগুন ধরিয়ে দিলেন ইফতিখার। চটের জ্বলন্ত স্তূপ তিনি ছুঁড়ে দিলেন দোকানের এক কোণে, অন্য কোণে কাপড়ের বাণ্ডিল। মুহূর্তেই দোকানটি দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। মিনিটখানেকর মধ্যেই একটি দোকান পরে তেলের দোকানে আগুন পৌঁছলে বন্ধ শাটারের পেছনে আগুনের আওয়াজ শোনা গেল। এ-সময়ে ঘনায়মান অন্ধকার দেখে রাঠোর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। আবার আমাদের যাত্রা শুরু হল। পরদিন দেখা হতেই মেজর ইফতিখার আমাকে বললেন, “আমি মাত্র ষাটটা ঘর জ্বালিয়েছি। বৃষ্টি না এলে সবগুলোই শেষ করে করে ফেলতাম।”

মুজাফফরগঞ্জের কয়েক মাইল দূরে এক গ্রামে আমাদের থামানো হলো। দেখা গেল একজন মাটির দেয়ালের সঙ্গে কুঁকড়ে রয়েছে। এক জওয়ান সর্তক করে দিল যে সে ফৌজি হতে পারে। কিন্ত কিছুক্ষণ সর্তক নিরীক্ষণের পর বোঝা গেলো, সে একটি মিষ্টি হিন্দু মেয়ে। আর খোদাই জানে কার জন্য মেয়েটি নিরবে অপেক্ষা করছিল। এক জওয়ান দশ বছর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলে কাজ করার সুবাদে কিছু বাজারী বাংলা রপ্ত করেছিলো। সে মেয়েটিকে গ্রামে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলো। ওখানে বসে থেকেই মেয়েটি কী যেন বিড়বিড় করল। তখন তাকে দ্বিতীয়বার নির্দেশ দেয়া হল। তবু চলে আসার পরও সে ওখানেই বসে রইল। আমাকে জানানো হল, “মেয়েটির যাওয়ার জায়গা নেই — না আছে পরিবার না আছে ঘর।”

হত্যা ও অগ্নিকাণ্ড অভিযানের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মেজর ইফতিখারও একজন। বিদ্রোহীদের খুঁজে বের করার নামে হিন্দু ও ‘দুষ্কৃতিকারীদের’ (বিপ্লবীদের অফিসিয়াল পরিভাষা) অবাধে খুন করার এবং আশপাশের সবকিছু জ্বালিয়ে দেবার অনুমতি তারা পেয়েছে। এই টিঙটিঙে পাঞ্জাবী অফিসারটি নিজের কাজ নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন। কুমিল্লার সার্কিট হাউজে ইফতিখারের সঙ্গে যাবার সময় তিনি তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি দিলেন।

“আমি এক বুড়োকে পেয়েছিলাম”, তিনি বললেন। “হারামজাদার দাড়ি ছিলো, আর ভান করছিলো পাক্কা মুসলমানের মতো। এমনকি নিজের নাম বলল আব্দুল মান্নান। কিন্তু মেডিক্যাল ইন্সপেকশনে পাঠাতেই ওর খেল খতম হয়ে গেল।” ইফতিখার বলে যাচ্ছিলেন, “আমি তাকে তক্ষুণি সেখানে শেষ করে ফেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার লোকেরা বললো — এরকম জারজের জন্যে তিনটা গুলি দরকার। তাই আমি তাকে একটা গুলি করলাম গোপনাঙ্গে, একটা পেটে। তারপর মাথায় গুলি করে তাকে খতম করে দিলাম।”

আমি যখন চলে আসি তখন তাকে নেতৃত্ব-ক্ষমতা প্রদান করে উত্তর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়েছে। আবারো তার অভিযান হত্যা আর অগ্নিকাণ্ড।

আতঙ্কে মুহ্যমান হয়ে বাঙালিদের দুটো প্রতিক্রিয়া হয়। যারা পালাতে পারে তারা সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হয়। পাকসেনার উপস্থিতিতে যারা পালাতে পারে না তারা বশ্য ক্রীতদাসের মতো আচরণ করে — যা তাদের কপালে দুর্ভোগ ছাড়া অন্য কিছুই বয়ে আনে না। চাঁদপুর ছিল প্রথমটির উদাহরণ।

মেঘনা নদীবন্দর সংলগ্ন এই অঞ্চল আগে ব্যবসা-কেন্দ্র হিসেবে খুবই বিখ্যাত ছিল। রাত্রিবেলা নদীর পাড়ে ভেড়ানো হাজারো নৌকা আলোয় আলোয় এক রূপকথার রাজ্য বানিয়ে ফেলে। চাঁদপুর জনমানবহীন হয়ে পড়ে ১৮ই এপ্রিলে। না ছিল মানুষ, না কোনো নৌকা। বড়জোর এক শতাংশ মানুষ সেখানে ছিল। বাদবাকিরা, বিশেষ করে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধাংশ হিন্দুরা, পালিয়ে গিয়েছিল। ওরা পালিয়ে গেলেও বাড়িতে, দোকানে, ছাদে হাজার হাজার পাকিস্তানী পাতাকা উড়ছিল। মনে হচ্ছিল জনমানুষ ছাড়াই জাতীয় দিবস উদযাপিত হচ্ছে। হিংস্র দৃষ্টি থেকে বাঁচবার জন্যেই ছিল এই ব্যবস্থা। এই পতাকা ছিল তাদের আত্মরক্ষার উপায়।

কীভাবে যেন তারা জেনেছে পাকিস্তানী পতাকা ওড়ালে পাকসেনাদের হিংস্র ও নির্মম ধংসাত্মক তৎপরতা থেকে রক্ষা পওয়া যাবে। পতাকা কীভাবে বানানো হচ্ছে সেদিকে কোনো খেয়াল রাখা হয়নি, কোনো রকমে একটা চাঁদতারা থাকলেই যথেষ্ট। ওগুলোর রঙ, কাঠামো গড়ন তাই হয়েছে বিচিত্র। সবুজের জায়গায় কোনোটার জমি নীল। তারা যে বাংলাদেশী পতাকার মালমশলা দিয়ে এই পতাকা বানিয়েছে এটা নিশ্চিত। সবুজের জায়গায় সর্বত্র দেখা গেছে নীল পতাকা। চাঁদপুরের মতো একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে হাজীগঞ্জ, মুজাফফরগঞ্জ, কসবা আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কিন্তু পতাকা উড়েছে — ভৌতিক পতাকা।

একটি ‘কুচকাওয়াজ’ ও একটি চেনা ইশারা

আরেক ক্রীতদাসসুলভ বশ্যতা দেখা গেছে লাকসামে। পরদিন সকালে যখন আমি শহরে ঢুকি তখন বিপ্লবীমুক্ত হয়ে গেছে। দেখতে পেলাম শুধু পাকসেনা এবং আক্ষরিক অর্থে হাজার হাজার পাকিস্তানী পতাকা। সেখানকার মেজর ইন-চার্জ পুলিশ-স্টেশনে ঘাঁটি গেড়েছিলেন, মেজর রাঠোর সেখানে আমাদের নিয়ে গেলেন। আমার সহকর্মী পাক-টিভির একজন ক্যামেরাম্যান একটা প্রচারণা-ফিল্মের কাজে লাকসামে এসেছেন, ‘স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে’ নামের নিয়মিত এই সিরিজ প্রতিদিন স্বাগত- কুচকাওয়াজ আর ‘শান্তিসভার’ খবর প্রচার করতো।

সে কীভাবে এটা করে ভেবে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, কিন্তু মেজর জানালেন জিনিসটা মোটেও সুমধুর নয়। “হারামজাদারা এর চেয়ে বেশি মাত্রায় এসে ব্যাপারটাকে দর্শনীয় করে তুলতে পারে। আমাকে বিশ মিনিট সময় দাও।” ৩৯তম বেলুচ ল্যাফটেন্যান্ট জাবেদের ওপর ভার পড়েছিল জনতাকে একত্রিত করার। তিনি দাড়িওয়ালা বুড়ো একজন লোককে ডাকলেন। তাকে আনা হয়েছে বানানো সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্যে। লোকটি, পরে জানিয়েছিলেন তার নাম মৌলানা সৈয়দ মোহাম্মদ সাইদুল হক, বললেন তিনি একজন “খাঁটি মুসলিম লীগার; আওয়ামী লীগের লোক নন”। (১৯৪৭ সনে স্বাধীন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলো মুসলিম লীগ।) খুশি করার জন্যে তিনি আগ্রহের সাঙ্গে আরো জানালেন, “বিশ মিনিটের মধ্যে আমি আপনাদের অবশ্যই অন্তঃতপক্ষে ষাটজন লোক জোগাড় করে দেব।” জাবেদকে তিনি বললেন, “দু’ঘন্টা সময় দিলে দুশো জন লোক জোগাড় করতে পারব।”

মৌলানা সাইদুল হকের সাচ্চা জবান। মেজরের দেয়া চমৎকার নারকেলের দুধে যেই চুমুক দিয়েছি, অমনি দূর থেকে আওয়াজ ভেসে এলো — “পাকিস্তান জিন্দাবাদ!” “পাকসেনা জিন্দাবাদ!” “মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ!” ( জিন্দাবাদ হলো ‘চিরজীবী হোক’-এর উর্দু শব্দ।) কিছুক্ষণ পরেই তাদের কুচকাওয়াজ করে আসতে দেখা গেল। ওদের মধ্যে বুড়ো অসুস্থ লোক আর হাঁটুসমান ছেলেপিলে মিলিয়ে পঞ্চাশজন মানুষ ছিল। সবাই পাকিস্তানী পতাকা উঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছিল। লেফটেন্যান্ট জাভেদ আমাকে একটি চেনা ইশারা দিলেন। মিনিটখানেকর মধ্যে কুচকাওয়াজটি একটি জনসভায় পরিণত হল, একটি মাইক জোগাড় হয়ে গেল, বক্তৃতা করতে আগ্রহীর সংখ্যা বাড়তে থাকল।

সৈনিকদের উদ্দেশ্যে স্বাগত ভাষণ দেয়ার জন্যে সামনে ঠেলে দেয়া হল মাহবুব-উর রহমানকে। ‘এন এফ কলেজের ইংরেজি ও আরবির অধ্যাপক এবং মুসলিম লীগের আজীবন সদস্য’ হিসেবে তিনি নিজের পরিচয় দিলেন। পরিচয় দেয়ার পরে তিনি নিজস্ব কায়দায় বলা শুরু করলেন, “পাঞ্জাবী ও বাঙালিরা পাকিস্তানের জন্যে একত্র হয়েছে। আমাদের রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। কিন্তু হিন্দু ও আওয়ামী লীগারদের কারণে আমরা সন্ত্রাসের কবলে পড়েছি এবং আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম ধ্বংসের দিকে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে পাঞ্জাবী সৈনিকেরা আমাদের রক্ষা করেছে। তারা বিশ্বের সেরা সৈনিকদল এবং মানবতার নায়ক। আমরা হৃদয়ের অতল গভীর থেকে তাদের শ্রদ্ধা করি ও ভালোবাসি।” এবং এভাবেই সে বেশ কিছুক্ষণ চালিয়ে গেল।

‘সভা’শেষে মেজরকে জিগ্যেস করলাম ভাষণ সম্পর্কে তিনি কী ভাবছেন। ”উদ্দেশ্য সফল হয়েছে” তিনি বললেন, “কিন্তু এই হারামজাদাকে আমি মোটেই বিশ্বাস করি না। তার নামও আমার তালিকায় রাখব।”

পূর্ব বাংলার যন্ত্রণা এখনও শেষ হয়নি। সবচেয়ে খারাপ সময় এখনও আসেনি। ‘বিশুদ্ধি অভিযান’ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত পাকসেনারা ফিরে না-আসার ব্যাপারে দৃঢপ্রতিজ্ঞ। আর এই কাজের অর্ধেক মাত্র এখন পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ৯ম ও ১৬শ, এই দুই ডিভিশন পাক সেনাকে বাঙালি বিদ্রোহী ও হিন্দুদের খুঁজে বের করার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঠানো হয়েছে। পাকিস্তানের মতো দেশের জন্য এই পরিমাণ যথেষ্ট কার্যকরী। পশ্চিম থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে ২৫০০০-এরও বেশি লোক। ২৮শে মার্চ দুই ডিভিশন সৈন্যকে ৪৮ ঘন্টার নোটিশ দেয়া হয়েছিল রওয়ানা হবার জন্য। খরিযান ও মুলতান থেকে করাচিতে তাদের আনা হয়েছিলো ট্রেনে করে। হালকা বেড রোল ও সামরিক র‌্যাকসাকসহ জাতীয় এয়ারলাইন পিআইএ-র বিমানে তাদের নিয়ে আসা হয়েছে ঢাকায় (তাদের অস্ত্রশস্ত্র সমুদ্রপথে পাঠানো হয়েছিল)। পিআইয়ের সাতটি বোয়িং বিমান আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বাতিল করে সিলোন দিয়ে দীর্ঘ ১৪ দিন ধরে তাদের পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে এসেছে। এয়ার-ফোর্সের কিছু ট্রান্সপোর্ট-এয়ারক্র্যাফট এব্যাপারে সাহায্য করেছে।

পাকসেনারা তৎক্ষণাৎই পূর্ব-কমাণ্ডের ১৪শ ডিভিশনের অস্ত্রপাতি নিয়ে তৎপরতায় নেমে গেছে। কুমিল্লা থেকে নিয়ন্ত্রিত ৯ম ডিভিশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো পূর্ব-সীমান্ত বন্ধ করে দিতে― যাতে বিপ্লবীরা তাদের চলাফেরা ও সরঞ্জাম-সরবরাহ না-করতে পারে। যশোর হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে মিলে ১৬শ ডিভিশনও প্রদেশের পশ্চিম সীমান্তে একই ধরনের কাজে ন্যস্ত ছিলো। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহের ভেতরে তারা এই কাজ সম্পন্ন করে ফেলে। যেসব বিপ্লবী ভারতে পালাতে পারেনি―ইস্পাত আর আগুনের বৃত্তে তারা বন্দি হয়ে পড়ে―দুই সেনা ডিভিশন তাদের জন্যে ব্যাপক চিরুনি-অপারেশন কর্মসূচী গ্রহণ করে। কাজেই নিঃসন্দেহে আশংকা করা যায়, সীমান্তের সহিংসতা এখন মধ্যাঞ্চালে শুরু হবে। এটি হবে আরো বেদনাদায়ক। মানুষদের পালানোর আর কোনো পথ থাকবে না।

৯ম ডিভিশনের জি-১-এর পুষ্পপ্রেমিক লেফটেন্যান্ট জেনারেল বেগ ২০শে এপ্রিল ধারণা পোষণ করেছিলেন যে এই অনুসন্ধান কর্মসূচী দু’মাস অর্থাৎ জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় নেবে। কিন্তুু এই পরিকল্পনা বিফলে গেছে বলে মনে হচ্ছে। গেরিলা কায়দা গ্রহণকারী এই বিপ্লবীদের সামরিক কর্মকর্তারা যত সহজে দমন করবেন বলে আশা করেছিলেন, বাস্তবে তা ঘটেনি। বিচ্ছিন্ন ও আপাত অসংগঠিত গেরিলারা পরিকল্পিতভাবে রাস্তা ও রেলপথের ধ্বংসসাধন করে পাক সেনাদের কাবু করে ফেলছে। কারণ এর ফলে তাদের যাতায়াত-ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ৯ম ডিভিশনের কাজও অনাকাক্সিক্ষতভাবে পিছিয়ে গেছে এজন্যে। এদিকে তিন মাসব্যাপী ঝড়বাদলের মৌসুম চলে আসায় সামরিক কার্যক্রম বন্ধ হবার যোগাড় হয়েছে।

বর্ষাকালের জন্যে পাক সরকার মে-র দ্বিতীয় সপ্তাহে চীনের কাছ থেকে নয়টি বৃষ্টিরোধক গানবোট নিয়ে এসেছে। বাদবাকিগুলোও আসার পথে। আশি টনী, ব্যাপক গোলাবর্ষণ-ক্ষমতাধারী এই গানবোটগুলো বিমান বাহিনী ও আর্টিলারীর সৈনিকদের এখন পর্যন্ত ব্যবহারের জন্যে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি এলে এগুলো কাজ করবে না। এই বোটগুলোবে সহায়তা করবে কয়েকশ দেশীয় পরিবহণ যা সেনাবাহিনীর ব্যবহারের জন্য ইস্যু ও পরিবর্তিত করা হয়েছে। সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের খোঁজে জলপথেও বেরুতে চায়।

পূর্ব বাংলার উপনিবেশীকরণ

বণ্টন-ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠেছে। পূর্ব পাকিস্তানের সতেরোটির মধ্যে তেরোটি জেলাতেই খাদ্যের অভাব আছেÑযা পূরণ করা হয় চাল ও গমের পর্যাপ্ত আমদানির মাধ্যমে। গৃহযুদ্ধের জন্যে এবছর আর তা সম্ভব হচ্ছে না। ছয়টি বড়ো ও সহস্রাধিক ছোটোখাটো ব্রিজ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, অনেক রাস্তাঘাটও অতিক্রমের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। রেল-যোগাযোগও একই ভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, যদিও সরকার বলছে যে সবকিছু “প্রায় স্বাভাবিক’’। ৭ই মে পর্যস্ত তৎপরতা চালিয়ে বিপ্লবীরা চট্রগ্রাম সমুদ্র-বন্দর থেকে উত্তর পর্যন্ত সড়ক ও রেল যোগাযোগ, বিশেষ করে ফেনীর মতো বিশিষ্ট সড়ক, জংশন ধ্বংস করে দিয়েছে। খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না এই ধ্বংসকাণ্ডের জন্যে। স্বাভাবিক সময়ে চট্রগ্রাম থেকে অন্যান্য এলাকায় নৌপথে ১৫ শতাংশ খাদ্য সরবরাহ করা হয়। বাকি ৮৫ ভাগ সরবরাহ করা হয় সড়ক ও রেলপথে। এমনকি নৌপথের পূর্ণ যোগাযোগ ও তৎপরতা গ্রহণ করা গেলেও চট্টগ্রাম গুদামে জমা খাদ্য মজুতের ৭০ শতাংশ খাদ্য সরবরাহ সম্ভব হবে না।

অন্য দুটো কারণও এর সঙ্গে যোগ করা দরকার। প্রথমত দুর্ভিক্ষের মোকাবেলার জন্যে লোকজন খাদ্যশস্য নিজেদের কাছেই মজুত করে রেখেছে। এই অবস্থা আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। অপরটি হলো দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে জনসাধারণকে ওয়াকিবহাল করার ব্যাপারে পাক সরকারের অস্বীকৃতি। পূর্ব বাংলার সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ১৮ই এপ্রিল এক বেতারভাষণে বলেন যে খাদ্যশস্যের সরবরাহের ব্যাপরে তিনি ওয়াকিবহাল আছেন। তখন থেকে সরকারি সব কায়দা ব্যবহার করা হয়েছে খাদ্য-সংকটের তথ্য গোপন করার ব্যাপারে। এর কারণ হল, এসবের পূর্বে সাইক্লোনের কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের মতো দুর্ভিক্ষে বিপুল বৈদেশিক সাহায্যের প্রবাহ তৈরি হবে এবং বণ্টন-ব্যবস্থা দেখতে পরিদর্শন-দল আসবে। তা হলে হত্যাকাণ্ডের খবর বিশ্ববাাসীর কাছে গোপন রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। সেজন্যে বিশুদ্ধি অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত ক্ষুধার কারণে লোকের মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করা হয়েছে। কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান জনাব কারনির সঙ্গে কিছুদিন আগে এই সমস্যা নিয়ে কথা হয়েছিল। করাচীতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুসজ্জিত অফিসে দুর্ভিক্ষ প্রসঙ্গে নির্দয়ের মতো তিনি বলেন, ‘এই দুর্ভিক্ষ তাদের স্যাবোটাজের ফল। কাজেই, তাদের মরতে দাও। মনে হয় এতে বাঙালিদের বোধোদয় হবে।’

সামরিক সরকারের পূর্ব বাংলা-নীতি আপাতভাবে এত স্ববিরোধী ও আত্মবিনাশী ছিলো যে শাসকরা নিজেরাই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। প্রথমদিকে বলপ্রয়োগের ভ্রান্ত নীতি গ্রহণ করে সরকার অযৌক্তিকভাবে ও বোকার মতো জল ঘোলা করে ফেলেছে। এর আপাত কিছু কারণ ছিলো। একদিকে, এটা সত্যি যে সন্ত্রাসের তীব্রতা হ্রাস হয়নি। কিন্তু দমননীতি পূর্ব বাংলার বিক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একারণে প্রতিদিন সরকারের হাজার হাজার শত্র“ গড়ে উঠছে এবং পাকিস্তানকে ঠেলে দিচ্ছে বিচ্ছিন্নতার পথে।

অন্যদিকে, কোনো সরকারই সচেতন হতে পারে নি যে এই নীতিমালা ব্যর্থ হতে পারে (পূর্ব বাংলাকে অনির্দিষ্টভাবে আটকে রাখার জন্য যথেষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানী নেই)। দৃঢ় প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কারণে এবং বৈদেশিক উন্নয়ন সহযোগিতায় বিশেষত আমেরিকার কঠোর বিবেচনার কারণে, যত দ্রুত সম্ভব একটি রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের ২৫শে মে-র সংবাদ-সম্মেলন জানান দেন যে তিনি বিষয়গুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এবং তিনি বলেন যে মধ্য জুনে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের ব্যাপারে তিনি তার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করবেন।

এসবকিছু এটাই নির্দেশ করছে যে, পাকিস্তানের সামরিক সরকার স্ববিরোধী আচরণ করছে এবং দেশের ২৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে তীব্র সঙ্কটের সমাধানে উল্টোপথে হাঁটা শুরু করেছে। এটি হল বি¯তৃতভাবে ফুটে ওঠা চিত্র। কিন্তু এটা কি সত্য? আমার ব্যক্তিগত মত হল এসব সত্য নয়। পশ্চিম পাকিস্তানে নেতারা কী বলেন, আর পূর্বে কাজে কী করেন এই দুইটি চিত্রই আমার সরাসরি দেখার দুঃখজনক সুযোগ হয়েছে। আমি মনে করি সরকারের র্প্বূ বাংলার নীতিতে সত্যিকার অর্থে কোনো স্ববিরোধ নেই। পূর্ব বাংলায় উপনিবেশীকরণ প্রক্রিয়া চলেছে। এটা আমার কোনো স্বে^চ্ছাচারী মতামত নয়। বাস্তবতা নিজেই সে কথা বলছে।

পূর্ব বাংলা বিচ্ছিন্নতাবাদের সমস্ত চিহ্ন বিলোপ করাই পাক সামরিক বাহিনীর প্রথম বিবেচনা ছিল এবং এখনো আছে। ২৫শে মার্চ থেকে সরকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে চলমান দমননীতির মাধ্যমে এবং যেকোনো উপায়ে এই সিদ্ধান্ত বজায় রেখে চলেছে। ঠাণ্ডা মাথায় এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং ঠাণ্ডা মাথায় সেদিকে এগুচ্ছেও। পূর্ব বাংলায় ধ্বংসলীলা চলার সময় কোনো অর্থপূর্ণ ও বাস্তবায়নযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়। জটিল প্রশ্ন হল: হত্যাকাণ্ড কি আদৌ থামবে ? ৯ম ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল শওকত রাজা ১৬ এপ্রিল কুমিল্লায় আমাদের প্রথম সাক্ষাতে এর উত্তর দিয়েছিলেন।

‘‘তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো’’, তিনি বললেন, ‘‘আমরা মানুষ আর অর্থ দুদিক থেকেই ব্যাপক আর ব্যয়বহুল অভিযান খামোখা গ্রহণ করিনি। আমরা এটাকে একটা দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছি এবং তা শেষ করতে যাচ্ছি। আধাখেচরা করে শেষ করলে রাজনীতিবিদরা এটাকে আবার খুঁচিয়ে তুলবে। তিন চার বছর পর পরই এই সমস্যাটিকে উঠতে দিতে সামরিক বাহিনী নারাজ। সেনাবাহিনীর অন্য প্রয়োজনীয় কাজ আছে। আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিতে পারে, আমরা যে পরিকল্পনা নিয়েছি, তা পুরোপুরি সম্পন্ন করতে পারলে এরকম অভিযানের আর প্রয়োজন হবে না।” কর্মরত তিন ডিভিশনাল কমান্ডারের মধ্যে মেজর জেনারেল শওকত রাজা অন্যতম। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন তিনি। তাকে নিশ্চয় অসংলগ্ন কথা বলার জন্য ঐ পদে রাখা হয়নি।

লক্ষ্যণীয় যে, পূর্ব বাংলায় আমার দশ দিনের সফরে প্রতিটি সামরিক কর্মকর্তার মুখে মেজর জেনারেল শওকত রাজার কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। আর রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জানেন যে যুদ্ধক্ষেত্রে যারা সৈন্য পরিচালনা করছেন তারাই পাকিস্তানের নিয়তির নিয়ন্তা। সামরিক অভিযানই সেনা কর্মকর্তাদের মতৈক্যের প্রমাণ দেয়। যেকোনো মাত্রায়ই এটা একটা প্রধান কাজ। এটা এমন একটা বিষয় যার সুইচ বৃহত্তম ফলাফল ছাড়া অফ বা অন করা যাবে না।

সামরিক বাহিনী তাদের কাজ করে যাচ্ছে

সামরিক বাহিনী ইতোমধ্যে হত এবং আহতের বিরাট পাহাড় গড়েছে। ঢাকায় ব্যক্তিগতভাবে শুনেছি যে সাধারণ মানুষের চেয়ে অফিসারদের বেশি হত্যা করা হয়েছে এবং হতাহতের পরিমাণ ১৯৬৫ সনের সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধকে অতিক্রম করে গেছে। সেনাবাহিনী অবশ্যই এসব ‘জীবনোৎসর্গ’কে রাজনৈতিক সমাধানের খাতিরে, যার প্রচেষ্টা অতীতে বারবার ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে, পাত্তা দেবে না। তারা যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এ অবস্থায় তা স্থগিত করলে তা আত্মবিনাশী হয়ে উঠবে। এর মানে এটাই দাঁড়াবে যে, বাঙালি বিপ্লবীদের সঙ্গে তাতে আরো সঙ্কট তৈরি হবে। প্রচণ্ড আক্রোশ এখন দু’পক্ষেই তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

আলোচনা সাপেক্ষে সমঝোতাও এখন সম্ভব নয়। এখন সম্পূর্ণ জয় বা পরাজয়ই হল একমাত্র সমাধান। সময় এখন, বিচ্ছিন্ন অসংগঠিত আধুনিক অস্ত্রহীন বিপ্লবীদলের নয়, পাকসেনাদের পক্ষে। কিন্তু অন্যান্য শর্ত যেমন বৃহৎ শক্তিদের দ্বন্দ্ব, পরিস্থিতির চেহারা পুরো পাল্টে দিতে পারে। তবে বর্তমান অবস্থায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দিক থেকে লক্ষ্যার্জনের ব্যাপারে তাদের কোনো সন্দেহ নেই। তাই বর্তমান ক্ষয়ক্ষতি তাদের কাছে সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ইতোমধ্যেই প্রচুর অর্থ খরচ হয়ে গেছে পূর্ব বাংলায় অভিযান চালাতে গিয়ে, এবং এই ক্রমবর্ধমান ব্যয় ভারই পাক সরকারের প্রতিজ্ঞার পরীক্ষা করছে। তহবিলের ব্যাপক খরচাপাতি এটা স্পষ্ট করে যে সৈন্যদল ব্যবহারের ক্ষেত্রে হিসেব-নিকেশ করে কাজে নামা সেনাবাহিনীর সকল স্তরেই প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ব্যাপারে অনুমোদন ও সমর্থন রয়েছে। ২৫,০০০ পাকসেনাকে পূর্ব বাংলায় নিয়ে যাবার মতো সাহসী ও ব্যয়বহুল উদ্যোগ শুধু শুধু নেয়া হয়নি। ৯ম ও ১৬শ ডিভিশন দু’টো পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক মজুত হিসেবে রাখা হয়েছিলো । বর্তমানে তাদের নবনিযুক্তি ঘটেছে প্রচণ্ড খরচের মাধ্যমে।

চীন কারাকোরাম মহাসড়ক দিয়ে বিপুল অস্ত্রসাহায্য পাঠিয়েছে। সম্প্রতি এই অস্ত্রবন্যা হ্রাস পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে; পাকিস্তানের সামরিক সরকারের প্রতি প্রতিশ্র“তির ব্যাপারে তাদের হয়তো দ্বিতীয় কোনো ভাবনার উদয় হয়েছে। কিন্তু এরপরও বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের তলানি থেকে এক মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের অস্ত্র ইউরোপীয় অস্ত্র বিক্রেতাদের কাছ থেকে কিনতে পাক-সরকার বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি। ঢাকা, রাওয়ালপিন্ডি ও করাচিতে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে তারা সমস্যা সমাধানের উপায় দেখছে পূর্ব বাংলা অভিযান দ্রুত শেষ করে ফেলার মধ্যে ও ভয়ংকর আক্রমণের মাধ্যমে। এই উদ্দেশ্য সফলের জন্য প্রয়োজনীয় টাকার পরিমাণ সরকারি অন্যান্য সব খরচের ওপরে অবস্থান করছে। উন্নয়ন সত্যিকার অর্থে থেমে গেছে। একবাক্যে বলা যায়, রাজনৈতিক কোনো সমাধান সরকার যদি আন্তরিকভাবে চাইতো তা হলে পূর্ব বাংলার অপারেশন পরিত্যাগ করতো, কিন্তু সরকার তা থেকে সামরিকভাবে প্রতিশ্র“তবদ্ধ হয়ে অনেক দূরে অবস্থান করছে। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া এখন বসে আছেন বাঘের পিঠে। তবে তার পিঠে ওঠার আগে অনেক হিসাব-নিকাশও করেছেন।

কাজেই সামরিক সেনাদের সহজে প্রত্যাহার করা হচ্ছে না। ঢাকার ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারে সরকারের পূর্ব বাংলা নীতি সম্পর্কে আমি জানলাম । এর তিনটি সূত্র আছে:

(১) বাঙালিরা নিজেদের ‘অবিশ্বস্ত’ হিসেবে প্রমাণিত করেছে এবং তারা অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা শাসিত হবে।
(২) ইসলামী পদ্ধতিতে বাঙালিদের পুনরায় শিক্ষা দিতে হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রবণতা দূর করতে ‘জনগণের ইসলামিকরণ’ (অফিসিয়াল পরিভাষায় এরকমই বলা হয়ে থাকে) করতে হবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে শক্তিশালী ধর্মীয় বন্ধন তৈরী করতে হবে।
(৩) হত্যা ও দেশত্যাগের মাধ্যমে যখন হিন্দুরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তখন তাদের সম্পত্তি সুযোগবঞ্চিত বাঙালি মুসলমানদের মন জয় করতে সোনালি পুরস্কার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এটা ভবিষ্যতের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করবে।

এই নীতিমালা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে সুপারিশ করা হয়েছে। প্রকাশ্য বিদ্রোহের অপরাধে সরকারি আদেশবলে প্রতিরক্ষাবাহিনীতে আর কোনো বাঙালির নিয়োগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর যেসব সিনিয়র অফিসার জড়িত ছিলেন না ‘আগাম-সতর্কতা হিসেবে’ তাদের গুরুত্বহীন জায়গায় বদলি করা হয়েছে। বাঙালি ফাইটার-পাইলট, যাদের মধ্যে কারো কারো পাঁচ বা ততোধিক শত্রু-বিমান ধ্বংসের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের গ্রাউন্ডে পাঠানো এবং বিমান-পরিচালনাবহির্ভূত কাজকর্মে নিযুক্তির মাধ্যমে মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। এমনকি দেশের দু’অংশের মধ্যে যাত্রী-পরিবহনে পরিচালিত পিআইয়ের বিমানক্রুদেরকেও বাঙালিমুক্ত করা হয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস হলো কেবল বাঙালিদের নিয়ে আধাসামরিক বাহিনী; বিদ্রোহ সমাপ্তি না আসা পর্যন্ত তাদের বাতিল করে দেয়া হয়েছে। বিহারী ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বেচ্ছকর্মীদের নিয়ে সিভিল ডিফেন্স ফোর্স নামে নতুন বাহিনী গঠন হয়েছে। পুলিশে নিযুক্তির ব্যাপারেও বাঙালির জায়গায় বিহারীদের নেয়া হচ্ছে। এগুলো তত্ত্বাবধান করছেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঠানো ও সেনাবাহিনী কর্তৃক অনুমোদিত কর্মকর্তাগণ। চাঁদপুরের এপ্রিল মাসের শেষদিকে পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন একজন মিলিটারি-পুলিশ-মেজর। শত শত পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারি কর্মচারী ডাক্তার এবং রেডিও, টিভি, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন কলাকৌশলীদের পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে। এদর সবাইকেই দেয়া হয়েছে এক বা দুই ধাপ প্রমোশনের লোভ। অবশ্য এই বদলী করা হয়েছে বাধ্যতামূলকভাবে। সরকারি কর্মকর্তাদের দেশের যে কোনো স্থানে ইচ্ছেমত বদলী করার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সাম্প্রতিককালে একটি নির্দেশনামা জারি করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অনুসন্ধান’

আমাকে বলা হয়েছে যে ভবিষ্যতে ডেপুটি কমিশনার বা পূর্ব বাংলার কমিশনারদের নেয়া হবে হয় বিহারী নয়তো পূর্ব পাকিস্তানী সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে। জানা গেছে যে, জেলা ডেপুটি কমিশনাররা আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, যেমন কুমিল্লায়, এসব ডেপুটি কমিশনারদের ধরা হয়েছে এবং গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কুমিল্লার সেই বিশেষ কর্মকর্তাটি ‘শেখ মুজিবের লিখিত নির্দেশ ছাড়া’ পেট্রল ও খাদ্য সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানানোয় পাকসেনাদের রোষে নিপতিত হন ২০ মার্চ।

সরকার পূর্ব বাংলার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপরও হিংস্র হয়ে উঠেছে। ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে ঘোষণা করে সেগুলোতে ‘অনুসন্ধান’ করার আদেশ দেয়া হয়। অনেক অধ্যাপক পালিয়ে গেছেন; গুলিতে মারা গেছেন কেউ কেউ। তাদের স্থানে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নতুন নিযুক্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বাঙালি কর্মকর্তাদের স্থানান্তরিত করা হয়েছে প্রশাসনিক ও পররাষ্ট্রীয় সংবেদনশীল পদ থেকে। সবকিছু এই সময়ে চরম সীমায় এসে ঠেকেছে। তবে প্রশাসন যেমন চায়, এই উপনিবেশীকরণ প্রক্রিয়া স্পষ্টত তার অর্ধেকও কাজে দেয়নি। কুমিল্লার সামরিক আইন প্রশাসক মেজর আগা আমাকে এর বহু প্রমাণ আমাকে দেখিয়েছেন। বিপ্লবীদের দ্বারা বিধ্বস্ত ব্রিজ ও রাস্তা মেরামতে তিনি স্থানীয় বাঙালি নির্বাহী প্রকৌশলীদের কাছ থেকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিলেন। কাজগুলো লাল ফিতায় বন্দি হয়ে আছে এবং ব্রিজগুলো তেমনই পড়ে আছে। “আপনি আশা করতে পারেন না যে ওরা কাজ করবে।” তিনি আমাকে বলেন, “কারণ ওদেরই আমরা হত্যা করেছি, ধ্বংস করেছি ওদেরই দেশ। তাদের দিক থেকে চিন্তা করলে তাই দাঁড়ায়, এবং আমরা এর দাম দিচ্ছি।”

বেলুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন দুররানি ছিলেন কুমিল্লা-বিমানবন্দরে পাহারারত কোম্পানির দায়িত্বে। এসব সমস্যা মোকাবেলায় তার ছিল নিজস্ব কায়দা। কন্ট্রোল টাওয়ারে কর্মরত বাঙালিদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ওদের বলে দিয়েছি সন্দেহজনক কিছূ করছে এরকম মনে হলেও তাদের গুলি করে মারা হবে।” দুররানি তার কথা ও কাজে এক। কিছুদিন আগে রাতে বিমান-বন্দরের আশে-পাশে ঘোরাফেরা করছিল এমন এক বাঙালিকে তিনি গুলি করে মেরে ফেলেছেন। “সে একজন বিপ্লবী হতে পারতো” আমাকে তিনি বললেন। দুররানির আরকটি বিষয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বিমানবন্দরের আশেপাশের গ্রামে অভিযান চালানোর সময় তিনি নিজেই ‘৬০ জনেরও বেশি মানুষকে’ খতম করেছিলেন।

পূর্ব বাংলার উপনিবেশীকরণের রূঢ় বাস্তবতাকে নির্লজ্জ ছদ্ম-পোশাক দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। ইয়াহিয়া খান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান কয়েক সপ্তাহ ধরে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের কার্যকলাপের জন্য রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলাফল অবশ্য আদৌ সন্তোষজনক নয়। সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার বাঙালি আইনজ্ঞ মৌলভী ফরিদ আহমেদ এবং জামাতে ইসলামের গোলাম আজম ও ফজলুল কাদের চৌধুরীর মতো লোকদের যাদের প্রত্যেকে গত সাধারণ নির্বাচনে প্রচণ্ড মার খেয়েছিলেন। একমাত্র উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি নূরুল আমিনের সমর্থনই ধর্তব্য। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে নির্বাচিত দু’জনের মধ্যে তিনি একজন। এছাড়াও বয়ষ্ক এই মুসলিম লীগার পূর্ব বাংলার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। তার বয়স এখন সত্তর। কিন্তু নূরুল আমিনও সতর্কভাবে তার মতামত দিচ্ছেন। তিনি আজ পর্যন্ত শুধু দুটো বিবৃতি দিয়েছেন যার বিষয়বস্তু হল ‘ভারতের হস্তক্ষেপ’।

এসব ‘দালাল’ বাঙালিদের রোষানলে পড়েছেন। ফরিদ আহমেদ ও ফজলুল কাদের চৌধুরী এসব থেকে সতর্ক হয়ে চলেছেন। ফরিদ আহমেদ তার বাড়ির দরজা-জানালা সবসময় বন্ধ করে রাখেন। দরজার ফাঁক দিয়ে যাদের সনাক্ত করতে পারেন, তারাই কেবল ভেতরে ঢোকার অনুমতি পাচ্ছেন।

একটি বিশেষ অকার্যকর পদ্ধতির মাধ্যমে সরকার জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদের জন্য নির্বাচিত ৩১ জন আওয়ামী লীগ নেতার ক্ষুব্ধ মৌনতা আদায় করেছে। পরিবার ছাড়া আর সকলের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের আটকে রাখা হয়েছে আসন্ন ‘প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের’ অভিষেকের জন্য। যদিও তারা এখন নিজেদের ছাড়া আর কারও প্রতিনিধিত্ব করছেন না।

বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবান দর্জি আব্দুল বারীর বয়স ২৪ বছর। পাকিস্তানের বয়সও আব্দুল বারীর সমান। বলপ্রয়োগ করে সামরিক বাহিনী দেশটিকে একত্রিত রাখতে পারবে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে যা করা হয়েছে তার অর্থ দাঁড়ায় একটাই; তা হল, ১৯৪৭ সালে দু’টি সমান অংশের মুসলিম জাতির সমন্বয়ে একটি দেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন মানুষের ছিল, সেটা এখন মৃত। পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবিরা আর পূর্ব বাংলার বাঙালিরা একই জাতির অভিন্ন জাতি হিসেবে নিজেদের ভাবার সম্ভাবনা এখন সুদূরপরাহত। বাঙালিদের এখন একটাই ঝাপসা ভবিষ্যৎ আছে: উপনিবেশের অসুখী অবদমন থেকে বিজয়ী হিসেবে নিজেদের উত্তরণ।