Author Archives: Webmaster

Pakistanis Retreat to Dacca

The Harvard Crimson, December 10, 1971

Indian spokesmen reported yesterday that thousands of East Pakistani troops were retreating in front of the Indian army’s advance which came within 25 miles of Dacca. East Pakistan’s capital. India claims to have wiped out the last of East Pakistan’s air force during the day.

The Pakistani U.N. delegation told Secretary-General U Thant yesterday that Pakistan accepts the General Assembly’s cease-fire appeal, subject to a call for U.N. observers on both sides.

The East Pakistanis were using sampans, barges and steamers to retreat across the Ganges River into Chittagong, where they hoped to be evacuated. Pakistani forces attempting to escape by river would meet “certain death” at the hands of the Indian Navy.

While Radio Pakistan claimed that Indian invaders had been “blunted on all fronts in East Pakistan,” the Indian Army reported its capture of the Meghna River, 25 miles southeast of Dacca. As Indian forces drew nearer to Dacca, thousands of residents fled the city.

Lt. Gen. Hagjit Singh Aurora, Indian eastern front commander, said yesterday that about 7000 Pakistani troops trying to escape across the Ganges River were under air attack. He said at least one river steamer, carrying an estimated 500 Pakistani troops, had been sunk by Indian aircraft, which made over 100 sorties during the day.

Francis G. Hutchins, assistant professor of Economics, said yesterday that “the conflict seams to be going according to India’s plan of a show, methodical advance on Dacca.” He added that the Pakistanis are probably hoping to make up for their losses on the eastern front with advances in Kashmir, so that if a cease-fire is negotiated. Pakistan will have gained some land in the conflict.

“The Pakistani government, may already have decided to abandon Dacca,” Hutchins said. “The invasion may actually help the Pakistani leaders by allowing them to blame their loss of East Pakistan on India rather than on internal political revolution,” he said.

East Bengal Regiment of Pakistan army in 1971

Mandeep S. Bajwa & Ravi Rikhye


Regimental Flag

  • 1st EBR: Mutinied at Jessore, East Pakistan.
  • 2nd EBR: Mutinied at Joydebpur, East Pakistan.
  • 3rd EBR: Mutinied at Rangpur, East Pakistan.
  • 4th EBR: Mutinied at Comilla, East Pakistan.
  • 5th EBR: Fought in the Ajnala (Punjab) sector in the 1971 War. One of its companies defected en bloc to the Indians, led by their second in command, Subedar Samad Khan. Repatriated to Bangladesh 1975.
  • 6th EBR: Was in the desert sector and was left behind when Pakistan 18th Division concentrated for the Jaisalmer offensive. The battalion was surrounded by a minefield to prevent them from attacking the rear of the Pakistani attack. Repatriated to Bangladesh, 1975.
  • 7th EBR: First posted small parties of its personnel to units of the Frontier Force and later was redesignated 44 FF.
  • 8th EBR: Mutinied at Chittagong, East Pakistan.
  • 9th EBR: Raised under the Mukti Bahani, the Bangladesh liberation army, in 1971.
  • 10th EBR: Raised under the Mukti Bahani, the Bangladesh liberation army, in 1971.
  • 11th EBR: Raised under the Mukti Bahani, the Bangladesh liberation army, in 1971.
  • ভারতীয় উপমহাদেশে যুদ্ধের ছায়া

    পিটার হ্যাজেলহার্স্ট

    দি টাইমস, ১৩ জুলাই, ১৯৭১

    অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

    ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এখন পর্যন্ত মুখ না খুললেও মিসেস গান্ধীর সরকারে থাকা এবং সরকারের বাইরে থাকা অনেক ভারতীয়ই মনে করে সামরিক অভিযানের মাধ্যমেই কেবল উদ্বাস্তু-সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। আর এজন্য যুদ্ধের পক্ষে এবং বিপক্ষে ভারতবাসীদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। যুদ্ধবাদীরা মনে করেন ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরিণতির একটি আংশিক ফলাফল হিসেবে ছয় মিলিয়ন উদ্বাস্তুর দায়ভার ভারতকে বহন করতে হচ্ছে। আর শান্তিবাদীরা মনে করেন যুদ্ধের মূল্য কেবল অর্থনৈতিক লাভালাভ দিয়ে যাচাই করা যাবে না; ভারত আক্রমণ করলে চীন পাকিস্তানের পক্ষে এসে দাঁড়াবে। যুদ্ধবাদীরা মনে করছেন বর্তমান পরিস্থিতি পিকিং ভারতীয় সীমানায় অনুপ্রবেশ করার নাটকীয় সিদ্ধান্ত নেবে না। আর যেকোনো সংঘাতে নিজের শক্তি অবহিত করার ঝুঁকি নিতেই হয়।

    এই অনিশ্চিত পরিস্থিতি ভারতের নিরাপত্তা অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ ইনস্টিটিউট যুদ্ধের খরচ ও উপযোগিতা, এই অঞ্চলে সামরিক ক্ষমতার ভারসাম্য ও ভারতের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য বিষয়ক একটি সমন্বিত দলিল তৈরী করেছে। দলিলটি একটি আশংকাজনক উপসংহারে পৌঁছেছে যে যুদ্ধ ছাড়া ভারতের আর কোনো বিকল্প নেই। ইনস্টিটিউটের পরিচালক মি. সুব্রামনিয়াম কর্তৃক প্রস্তুতকৃত দলিলটি সিনিয়র সম্পাদক, কর্মকর্তা ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদের সামনে একটি রুদ্ধদ্বার সেমিনারে দলিলটি উপস্থাপিত হয়। দলিলে বলা হয়েছে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ভারত পূর্ব পাকিস্তানের কিছু অংশ দখল করে নেবে যাতে ঐ অংশে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করা যায়। একইসঙ্গে বলা হয়েছে যদি পূর্ব পাকিস্তানের কিছু অংশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা যায় তবে বাংলাদেশের প্রাদেশিক সরকারকে সব ধরনের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা নিয়ে সেখানে স্থাপন করা যাবে।

    “এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে নিরাপত্তা পরিষদ দু-দেশকেই যুদ্ধ শেষ করার জন্য আহ্বান জানাতে সভায় বসবে। যুদ্ধ দ্রুত শেষ হবে না বেশ খানিকটা সময় জুড়ে চলতে থাকবে, এটাই হলো ভারতের বিবেচনার বিষয়। এই পর্যায়ে ভারতের উদ্যোগ হবে বাংলাদেশকে বিতর্কের অন্যতম একটি পক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। সত্যি অর্থে, এটাই হলো বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবার ক্ষেত্রে সঠিক পন্থা। এটা পরিস্কার করতে হবে যে বাংলা অঞ্চলে যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্বাক্ষর হবে না, যতক্ষণ না বাংলাদেশের কমান্ডারকে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর করার জন্য একজন স্বাধীন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে। আর বাংলাদেশ সরকারকে এই বিতর্কে একটি স্বীকৃত পক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।”

    মি. সুব্রামনিয়ামের উপসংহারের সঙ্গে কেউ সম্মত নাও হতে পারেন। কিন্তু এই দলিলটি ভারতব্যাপী যে অধৈর্যের মনোভাবই পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা নির্দেশ করছে। আর ভারতের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পরিমণ্ডলে যুদ্ধের ব্যাপারটি যে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে, তাও দলিলটি নির্দেশ করছে। উপসংহারে পৌঁছার পূর্বে মি. সুব্রামনিয়াম একটি সশস্ত্র সংঘাতের সব দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন: যুদ্ধের খরচাপাতি, যুদ্ধের বিকল্পসমূহ, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সক্ষমতা, ভারতের পক্ষের ও বিপক্ষের ফ্যাক্টরসমূহ এবং চীনের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা, এসবকিছুই দলিলে বলা হয়েছে।

    ‘বাংলাদেশ এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা — ভারতের করণীয়’ শীর্ষক দীর্ঘ দলিলে বলা হয়েছে প্রথমবারের মতো জঙ্গি তৎপরতায় যাওয়ার চেয়ে (যা পুরোমাত্রায় যুদ্ধের জন্ম দেবে) ছয় মিলিয়ন উদ্বাস্তুকে আন্তর্জাতিক আর্থিক সাহায্যের আওতায় আনাটা ভালো হবে, এরকম ধারণার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। “উদ্বাস্তুদের সাহায্য করাই কি সমস্যার একমাত্র দিক?” এটা স্পষ্ট যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে তার উপনিবেশ-সদৃশ শাসন চালিয়ে যাবে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধ চলতেই থাকবে। “আর এখানে এই প্রশ্নটার মুখোমুখি ভারতকে হতে হবে যে এসবে অংশ নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় আছে কিনা। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য বাংলার লোকজনের সহানুভূতি পুরোপুরিই আছে। এর ফলে, বাংলার লোকজনকে রক্ষার জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দেবার জন্য ও নানাভাবে সাহায্য করার জন্য ভারতকে বড়ো সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। যদি বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ আন্দোলন চলতে থাকে এবং নেতৃত্ব আরও অধিক বাম-ঘেঁষা হয়ে থাকে তবে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।”

    দলিলটিতে এরকম বলা হয়েছে যে, এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রতিরোধকারীদের খুঁজতে নিঃসন্দেহে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত আসবে এবং তখন তাদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ভারতের জন্য কোনো কিছু হতে পারে না। “অপেক্ষা করা ও দেখার নীতি অনুসরণ করলে বাংলাদেশ সীমান্তে সবসময় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হবে এবং যেকোনো সময় পুরোমাত্রায় যুদ্ধের সম্ভাবনা সেখানে থাকবে। বাংলাদেশ বরাবর যেকোনো সময় আমাদের বিশাল বাহিনী নিয়োগ করতে হতে পারে এবং এধরনের নিয়োগের কারণে বাড়তি খরচ গুনতে হবে। বাংলাদেশে পাকিস্তান চার থেকে পাঁচ ডিভিশন সৈন্য স্থায়ীভাবে রাখবে বলে মনে হচ্ছে এবং সেখানে এই প্রক্রিয়া তারা শুরুও করেছে।”

    মি. সুব্রামনিয়াম দাবি করেছেন যে যদি উদ্বাস্তুদের ব্যয়ভার বহন করার ব্যাপারটি বৈদেশিক শক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, এরপরও ভারত ব্যাপক নিরাপত্তা-হুমকির মুখোমুখি হবে। দেশের ভেতরে পূর্ব বাঙালিদের জন্য একধরনের প্রতিশ্র“তি-ভাবনা গড়ে তোলার জন্য তিনি সরকারকারকে সর্বপ্রথমে সুপারিশ করেছেন। “এই প্রতিশ্র“তিগুলো দেশের ভেতরে সরকারের প্রতি আস্থা তৈরি করবে এবং দেশের বাইরেও এইসব যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরী হবে তা দূর করবে।” সামনের বছরে অনেকগুলো বড়ো রাজ্যে যে-নির্বাচন হবে, তাতে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস পার্টি যাতে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন না হয়, সেজন্যই এই সুপারিশ করা হয়েছে বলে অনুমান করা যায়।

    তিনি আরও বলেছেন যে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের ব্যাপক সমাগম এই স্পর্শকাতর ও বিক্ষুব্ধ রাজ্যটিতে উদ্বেগ তৈরী করবে। দলিলটিতে পূর্ব বাংলার বিপজ্জনক পরিস্থিতির বর্ণনা রয়েছে এবং উদ্বাস্তুদের কেন্দ্র ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লেগে যাবার সম্ভাবনা আছে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি আরও দাবি করেছেন যদি বর্তমান পরিস্থিতির কোনো সমাধান না হয় তবে ভারত ও পাকিস্তানকে, ইতোমধ্যেই মাত্রাতিরিক্ত, প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াতে হবে। “যদি বাংলাদেশের অভ্যুদয় না হয় এবং পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা চালিয়ে যায় তবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উদ্বেগ বাড়তেই থাকবে এবং স্থায়ী হয়ে যাবে। আর এটাই দু-দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা-বাজেটকে বাড়িয়ে তুলবে। বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে কোনো প্রকারে নিয়ন্ত্রণ আনা গেলে, পাকিস্তান কাশ্মিরেও সমস্যা সৃষ্টি করা থেকে বিরত হতে পারে।”

    বিশ্বশক্তি ইয়াহিয়া খানকে একটি কার্যকর রাজনৈতিক সমাধান করতে বাধ্য করতে সক্ষম হবে অথবা মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করে ফেলবে এরকম অবাস্তব কল্পনায় না থেকে সুব্রামনিয়াম বলেছেন যে, “এইসব অলীক আশা এখন সুদূরপরাহত।” এটা নিশ্চিত যে পাকিস্তানি অর্থনীতি বাংলাদেশ-অভিযানের খরচ এবং নতুন দুই ডিভিশন সৈন্য বাড়ানোর খরচ অনুমোদন করেছে। পাকিস্তানি শাসকরা পশ্চিম পাকিস্তানে ধীরগতির উন্নয়নের বিনিময়ে হলেও বাংলাদেশের ওপর ঔপনিবেশিক শাসনকে বেছে নিয়েছে। পশ্চিমা শক্তি পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদান বন্ধ রাখার ব্যাপারে যে-প্রতিশ্র“তি ব্যক্ত করেছিল তা পালন করে নি। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও ভারতের উদ্বাস্তু-সমস্যা হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত না হচ্ছে বিশ্বঅর্থনীতির পরিস্থিতি এরকম না যে, এপর্যন্ত তারা যা করেছে তার বেশি কিছু করবে।

    “সমস্যাটির আন্তর্জাতিক একটি চেহারা না-থাকার কারণে বিশ্বশক্তি এখানে কিছু করার ক্ষেত্রে ভারতকে সহায়তা করার চাইতে, নিজেদের বাধাগ্রস্ত মনে করছে। এই বাধা ভারতের পক্ষ থেকেই এসেছে, কারণ বৈদেশিক শক্তি কী করতে পারে সেব্যাপারে ভারত সীমারেখা আরোপ করেছে। এখন ভারতের পক্ষ থেকে এটা ভাবা অবাস্তব হবে যে, বৈদেশিক শক্তি ব্যাপারটিকে আন্তর্জাতিক একটি সমস্যা বলে বিবেচনা করবে। ভারতই সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিক চেহারা নিতে দেয় নি। ফলে, আন্তর্জাতিক চাপে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমন কোনো সুযোগ আর নেই। যারা যুদ্ধের পক্ষপাতী নন তারা এই ব্যাপারগুলো মাথায় রাখেন নি।”

    দলিলটি সামরিক শক্তির ভারসাম্য নিয়েও কথা বলেছে। সেখানে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের শহরগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং সেখানে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ভারতীয় বাহিনীর শক্তিমত্তাকে খর্ব করার ক্ষমতা নিয়েও আলোকপাত করা হয়েছে। “পাকিস্তানের মতো দেশের কোনো এয়ারক্র্যাফট-শিল্প নেই, এবং নিজেদের বিমানশক্তিকে রক্ষণাবেক্ষণ করার মতো খুব সামান্যই উপায় তাদের হাতে আছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীকে নিরস্ত্র করার মতো সত্যিকারের ক্ষমতা তাদের নেই। ইসলামাবাদের কয়েকজন বেপরোয়া লোকের পুরো অযৌক্তিক তৎপরতার জবাব দেবার জন্য এটা বলা হচ্ছে না, কিন্তু এধরনের উদ্যোগের প্রভাবের কোনো তাৎপর্য নেই বলে মনে হচ্ছে। পাকিস্তানী নৌবাহিনীর উদ্যোগের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। তাদের মহাসাগরগামী তিনটি সাবমেরিন রয়েছে এবং আরও একটি কয়েকদিনের মধ্যে তাদের সঙ্গে যোগ দেবে বলে জানা গিয়েছে। এছাড়া মনে করা হয় যে, তাদের এক ডজনেরও বেশি, পানির নিচে চলতে পারে এমন, এয়ারক্র্যাফট রয়েছে যা উপকূলীয় খনি-অনুসন্ধান, স্যাবোটাজ করতে এবং যাতে টর্পেডো ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং যেগুলোর টর্পেডো নিক্ষেপের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এই নৌশক্তিগুলোর ক্ষমতা খুবই সীমিত এবং পাকিস্তানের আশেপাশেই এগুলোকে নিয়োজিত রাখতে হবে। নৌ-আক্রমণ থেকে পাকিস্তান কিছু করতে পারবে কিনা এবিষয়ে সন্দেহ আছে। তেলসহ ভারতের বৈদেশিক পণ্যের বেশিরভাগ আসে সমুদ্রপথে। কিন্তু ভারত যেমন পাকিস্তানের পণ্য পরিবহণে ভৌগোলিক কারণে বাধা প্রদান করতে পারবে, পাকিস্তানের সেই সুবিধা নেই। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের শত্র“তা পূর্ব পাকিস্তানে আরও অতিরিক্ত সৈন্য সরবরাহ বন্ধ করতে পারবে এবং সেখানে ইতোমধ্যে নিয়োজিত সৈন্যদের আটকে ফেলা যাবে।”

    মি. সুব্রামনিয়াম পাকিস্তানের সঙ্গে আরেকটি সংঘাতের মুহূর্তে তাকে সামরিক সমর্থন কারা দেবে তা নিয়েও আলোকপাত করেছেন। “ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতার পর যুক্তরাষ্ট্র এখানে আবার হস্তক্ষেপ করবে বলে মনে হয় না। সোভিয়েত ইউনিয়নও সেরকম কিছু করতে যাবে না, অন্তঃত পাকিস্তানের সঙ্গে তারা যাবে না। পাকিস্তানের মিত্র সেন্টো, তুরস্ক ও ইরান হয়তো কিছু সরবরাহের মাধ্যমে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুব বেশি সহায়তা করতে উদ্বুদ্ধ করবে না।” এরপর সুব্রামনিয়াম নিরীক্ষা করছেন যুদ্ধবাদী প্রত্যেক ভারতীয়র মনে যে প্রশ্নটা উঁকি দিচ্ছে। ১৯৬৫ সালের মতো এবারও কি চীন হস্তক্ষেপ করবে? ইনস্টিটিউটের হিসেব মতে চীন তিব্বতে ১০০,০০০ সৈন্য নিয়োজিত রেখেছে এবং খুব দ্রুতই তারা সেখানে আরও সৈন্য নিয়োগ করতে সক্ষম।

    এরপরও, মি. সুব্রামনিয়াম উপসংহারে পৌঁছাচ্ছেন এই বলে যে চীনের হস্তক্ষেপও এড়ানো যেতে পারে। “যদি আমরা মনে করি যে চীন তার সৈন্যসংখ্যা দ্বিগুণ বাড়াতে পারে, কিন্তু ভারতের উত্তর সীমান্তে যুদ্ধের জন্য তার সামান্য অংশই তারা ব্যবহার করতে পারবে। সত্যিকার অর্থে যে-সৈন্যদের তারা নিয়োজিত করবে, ভারতের উত্তরে যে গিরিখাতগুলো আছে যুদ্ধের জন্য সেগুলো অতিক্রম করতে যে-মাত্রায় অবকাঠামোগত সমর্থন লাগবে, তা বরাদ্দ করতে করতে তাদের সংখ্যা সীমিত হয়ে পড়বে। এর বিপরীতে উত্তর সীমান্তে আমাদের নয় ডিভিশন সৈন্য আছে (চীনা ডিভিশনগুলোর চাইতে আমাদের ডিভিশনগুলো বড়ো)।” এটা ঠিক যে, সীমান্তের প্রতি ইঞ্চি পাহারা দেয়া যাবে না এবং চীনাদের পক্ষ থেকে কিছু আক্রমণ হতে পারে; কিন্তু তারা যদি হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্তও নেয় এরপরও তাদের জন্য এপাশে থাকার ক্ষেত্রে একটা সমস্যা থেকেই যাবে। সেটা হলো, শীতের সময় তুষারে হিমালয়ের গিরিখাতগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। ১৯৬২ সালে, যখন নানা কারণে চীনারা সীমিত একটি প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছিল, থাগলা থেকে পাদদেশে নামতে তাদের পুরো এক মাস সময় লেগেছিল। যখন ভারত ও পাকিস্তানের শত্র“তা চলতে থাকবে, তখন চীন যা ক্ষতি করতে পারে, নেনা ও লাদাখ-এর কিছু অংশে বড়োজোর দুই কি তিন মাস জুড়ে তা করতে পারবে। ১৯৬২ সালে চীন আসামকে যেমন মূল ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে পৃথক করে ফেলেছিল, এবার তা করারও সুযোগ নেই। কারণ যুদ্ধকালে বাংলাদেশের উত্তরাংশ ভারতের দখলে থাকলে বরং আসামের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ আরও ভালো হবে।

    “চীনারা গিরিপথ দিয়ে নেমে আসলেও তারা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আসতে পারবে না। উল্টো এপাশে সুসজ্জিত ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে তাদের মোকাবেলা করতে হবে। এছাড়া, এবার ভারতীয় বাহিনীকে ১৯৬২ সালের মতো বিমানবাহিনীকে উত্তর সীমান্তে ব্যবহারের ব্যাপারে কোনো কালক্ষেপণ করা হবে না। যেহেতু তারা এবার তেমন সুবিধা করতে পারবে না, তাই এতো সামরিক ঝুঁকি নিয়ে তারা এ-যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না।” ইনস্টিটিউট হিসেব করেছে যে, “যদি ভারত যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় তবে ৪০,০০০ লোক প্রাণ হারাবে। কিন্তু যারা যুদ্ধবিরুদ্ধ নীতিতে অটল আছেন, তারা এর বাইরে আর কোনো সমাধানও দিতে পারছেন না।”

    হিংস্রতা ও গোঁড়ামির শাসন

    দি সানডে টাইমস, ১১ জুলাই, ১৯৭১

    অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

    [পাঁচ সপ্তাহ আগে সানডে টাইমসে প্রকাশিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে কী নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছিল। আজকের রিপোর্টে পাওয়া যাবে আক্রান্ত দেশটিতে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’-র নামে সেনাবাহিনীর নির্মম অভিযানের চিত্র।]

    গত সপ্তাহে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বারবার বলেছে ‘বিদ্রোহী ও দুষ্কৃতিকারী’-দের বিরুদ্ধে দীর্ঘ অভিযানের পর দেশটিতে ‘স্বাভাবিকতা’ ফিরে এসেছে এবং উদ্বাস্তুরা এখন ভারত থেকে দেশে ফিরে আসতে পারে এবং স্বাভাবিত জীবনযাপন শুরু করতে পারে। ব্যাপকভাবে উদ্বাস্তুরা পালিয়ে গেছে এরকম একটি এলাকা আমি গত সপ্তাহে পরিদর্শন করেছি এবং দেখেছি কথাটি সত্য নয়; বরং ধীরে ধীরে এমন একটি প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে যে তাদের ফিরে আসার সুযোগ আরও কমে যাবে।

    যদি কোনো উদ্বাস্তু ঘরে ফিরে যায় তবে সে এমন দৃশ্য দেখবে, যেমন আমি দেখলাম লোটাপাহাড়পুর গ্রামে। এলাকাটি জুড়ে ছনের ছাউনি দেয়া মাটির ঘর। খুলনা থেকে ছয় মাইল উত্তরে অবস্থিত জায়গাটি পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় নদীবন্দর। লোটাপাহাড়পুর যশোর থেকে খুলনামুখী প্রধান সড়কপথের ধারে অবস্থিত। গত সপ্তাহে রাস্তাটি সেনাবাহিনীর সদস্যদের আসা-যাওয়ায় সন্ত্রস্ত হয়ে ছিল। আমেরিকান ট্রাকে বসে থাকা সৈনদের হাতে চীনা অটোমেটিক রাইফেল। আমি সদর রাস্তা থেকে একটি পার্শরাস্তা ধরে যাচ্ছিলাম। ফসলী জমির ফাঁকে ফাঁকে জলাশয়গুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন সবুজ-রূপালি রঙে ছককাটা দাবার বোর্ড।

    এখানে সেখানে এক-দু’জন কৃষক গরু বা মহিষের সাহায্যে জমি চাষ করছে; কিন্তু এরকম জনবহুল একটি দেশে এরকম দৃশ্য খুব কমই দেখা গেছে। এরপর আমি লোটাপাহাড়পুরে পৌঁছাই। দু’পাশে তালগাছের সারি রেখে কর্দমাক্ত রাস্তা ধরে আমি এগুচ্ছিলাম। গ্রামটি আর দশটা পূর্ব পাকিস্তানী গ্রামের মতোই। বন্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য বাড়িগুলো সমতল থেকে একটু উঁচুতে নির্মিত। কিন্তু লুঙিপরা কোনো পুরুষমানুষ, উজ্জ্বল শাড়ি পরা কোনো মহিলা, কলাবাগানের মধ্য দিয়ে ছুটোছুটি করা দুরন্ত শিশু বা ছুটন্ত কুকুরকে দেখা গেল না।

    আমি পূর্ব বাংলার অনেক গ্রাম দেখেছি যেগুলোকে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বা যেগুলোতে খুবই কম মানুষ রয়েছে। এই প্রথম আমি একটা গ্রাম দেখলাম যেটা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি কিন্তু জনমানবশূন্য বলে মনে হলো। দোভাষীর সাহায্যে আমি আশেপাশে দেখলাম। হাতিমুখো দেবতা গণেশের একটা রঙীন ছবি দেখতে পেলাম। তার মানে গ্রামটা হিন্দুদের। কিন্তু গ্রামবাসীরা কেন চলে গেছে? খালি বাড়িগুলোতে এর কোনো সূত্র পাওয়া গেল না। এরপর ভয়ার্ত চোখে ছেঁড়া শাড়ি পরা এক মহিলা এগিয়ে এল। তার সঙ্গে তিন বাচ্চা-কাচ্চা। সে আসলে একজন মুসলমান এবং উদ্বাস্তু। তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। পালাতে পালাতে সে এই উজাড়-হয়ে-যাওয়া গ্রাম খুঁজে পেয়েছে, যেমন আমরা হঠাৎ খুঁজে পেয়েছি। হিন্দুদের ফেলে যাওয়া চাল খেয়ে সে বেঁচে আছে। কিন্তু সে-চালও ফুরিয়ে গেছে এবং বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য তার আর কোনো বুদ্ধিই কাজ করছে না। সে কর্তৃপক্ষের কাছে যেতে চায় না কারণ, তারা হয়তো জেনে যাবে তার স্বামী ‘জয় বাংলা’ ছিল। ‘জয় বাংলা’ হলো নিষিদ্ধ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের স্লোগান।

    এরপর আরও মানুষের সঙ্গে দেখা হলো। এখান থেকে কয়েকশ’ গজ দূরের আরামডাঙা গ্রামের মুসলমান কৃষকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। তারা যে কাহিনী শোনাল তা গত সপ্তাহে শোনা আরও অনেক কাহিনীর মতোই। আলী হামিদ ও শওকত নামের দুজন একই ঢেউটিনের মালিকানা দাবি করছে। এপ্রিলের কোনো এক সময়ে হামিদ দুই ট্রাক ভর্তি পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যের সহযাত্রী হয়ে গ্রামে ফিরে এসেছিল। সৈন্য ও গ্রামবাসীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। সৈন্যরা গুলি ছোঁড়ে এবং ছয়জন গ্রামবাসী মারা যায়। মৃতদের দু-জন ছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলের সদস্য: একজন হলেন কৃষক ইন্দু বাবু এবং অন্যজন তার আত্মীয় স্কুলের হেডমাস্টার প্রফুল্ল বাবু। দু-জনই হিন্দু। সেনাবাহিনী চলে যাবার পরপরই গ্রামের বাকি ১৫০ জন হিন্দু পালিয়ে যায়।

    আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম কেন তারা আমাকে এই কাহিনী বলছে? তারা বললো আমি কাহিনীর শেষ অংশ তখনও শুনতে বাকি। কী হচ্ছে তা জানতে গ্রামের ক-জন মুসলমান এগিয়ে আসে। সৈন্যরা তাদের চারজনকে পাকড়াও করে এবং কোরান থেকে কিছু আবৃত্তি করতে তাদের বলে। চার মুসলমান ভয়ে কাতর হয়ে কেবল শুরু করতে পারে “বিসমিল্লাহ হির রহমানুর রাহিম …”। সৈন্যরা চিৎকার করে ওঠে, “এরা মুসলমান নয়! আমাদের ফাঁকি দেবার জন্য এরা এসব শিখে রেখেছে!” এরপর তারা চারজনকেই গুলি করে হত্যা করে। গ্রামবাসীরা আমাকে জানালো হিন্দু প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাদের কোনো সমস্যা না থাকাই হলো তাদের অপরাধ। ঢেউটিনের মালিকানা এখন হামিদের। সে এখন রাইফেল হাতে ঘোরে এবং গ্রামবাসী মনে করে সে একজন রাজাকার।

    “তারা সবাই আমাদের কাছে সমান”

    হিন্দুদের এলাকায় কী ঘটেছিল? গ্রামবাসীরা চারিদিকের শ্যামল ক্ষেতের দিকে নির্দেশ করে। সেগুলো ছিল দামি ফসল তিসির জমি। জুন মাসে সামরিক কর্তৃপক্ষের কয়েকেজন লোক প্রকৃত মালিকের অনুপস্থিতিতে ২০০০ একর জমির নিলাম ডাকে। এর প্রকৃত দাম একর প্রতি ৩০০ রুপি। কিন্তু সেগুলো বিক্রি হয় একর প্রতি মাত্র দেড় রুপিতে। আর ক্রেতাদের দরদাম করার আর সুযোগ ছিল না। ফসল ফলানোর জন্য তারা লোকজন নিয়োগ দিতে না দিতেই এর বেশিরভাগটা বন্যার পানিতে ডুবে যায়।

    লোটাপাহাড়পুর উদ্বাস্তুদের সম্মন্ধে একটি পরিস্কার চিত্র তুলে ধরে। এখানে কেউই তাদের ফিরে আসার কথা ভাবছে না। কারণ পূর্ব পাকিস্তানে এখনও ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে; কারণ ফিরে আসার সত্যিকার বাধাগুলো এখনও দূর হয়নি। তাদের ঘর-বাড়ি, জমিজমা, ফসল, ক্ষুদ্র ব্যবসা এবং অন্যান্য সম্পদগুলো আইনগতভাবে অন্যদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তুলে দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় শত্র“দের হাতে যারা চায়ই না ওরা ফিরে আসুক। অবশ্য সামরিক কর্তৃপক্ষ ঠিকই ‘অভ্যর্থনা-কেন্দ্র’ ও ‘ট্রানজিট ক্যাম্প’ খুলে বসে আছে।

    আমি ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি বেনাপোলে গেলাম এইসব প্রস্তুতি দেখতে। পুরো খুলনা এলাকার অফিসার ইন-চার্জ লে. কর্নেল শামস্-উজ-জামান সীমান্তের নিকটবর্তী তার সদর দফতরে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। কর্নেল জামান আমাকে বললেন সীমান্তে বহুবার ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে মর্টারের গোলা বিনিময় হয়েছে। তিনি জানান সবসময়ই ভারতীয়রা ব্যাপারটা শুরু করে। তিনি বলেন, “এদের রক্ষা করার জন্য এখানে অবশ্যই আমাদের থাকা প্রয়োজন। এই বাঙালিরা জানেনা কীভাবে লড়াই করতে হয়। এক পর্যায়ে আমি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে আসলাম। আমাদের দেহে রয়েছে যুদ্ধের রক্ত। ক্লাস টেন থেকেই আমি এই রাইফেল ব্যবহার করে আসছি। আমাদের সাহস আছে।” কর্নেল শামস্ আমাকে জানালেন ২৫-২৯ মার্চে খুলনা শহরের ‘নিরাপত্তা’র জন্য যে সামরিক অভিযান শুরু হয়েছিল তার পর থেকেই বিগত তিন মাস ধরে এখানে সৈন্যদের তৎপরতা চলছে। তিনি আমাকে জানালেন যে ‘দুষ্কৃতিকারী ও বিদ্রোহী’-দের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে কেবল এই গত মাসে সৈন্যরা পুরো জেলাকে নিজেদের আয়ত্ত্বে আনতে সক্ষম হয়েছে। মনে হয় শামসই বেসামরিক রাজাকার-দের হাতে পুলিশদের রাইফেল তুলে দেয়ার ব্যবস্থা চালু করেছেন। তিনি এদের সম্পর্কে বললেন, “এরা ভালো লোক, ভালো মুসলমান ও অনুগত পাকিস্তানি।”

    সামরিক কর্তৃপক্ষের হিসেব মতে পূর্ব পাকিস্তানে এখন ৫,০০০ রাজাকার রয়েছে যাদের মধ্যে ৩০০ জনই খুলনা অঞ্চলের। তারা প্রতি দিনে সাত রুপি করে মাইনে পাচ্ছে। তাদের সাত দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যার পুরোটা জুড়ে থাকে পুলিশি লি-এনফিল্ড রাইফেলের মাধ্যমে কীভাবে গুলি করতে হয়, তা শেখানো। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বাড়ি চিনিয়ে দিয়ে সৈন্যদের ‘নিরাপত্তা পরিদর্শন’-এ সাহায্য করা। স্থানীয় ‘শান্তি কমিটি’র অধীনে তারা পরিচালিত। এই শান্তি কমিটিও গঠিত হয়েছে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে। এই লোকগুলো হলো বিগত নির্বাচনে অংশ নেয়া কট্টর ও মুসলমানদের দলের সদস্য যারা মনে করে অস্ত্র দ্বারা হলেও তাদের ধর্ম রক্ষা করতে হবে। এরা নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত এবং এরা অনেকটা অরেঞ্জ লজ, ‘বি স্পেশালস্’ ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের মতো। খুলনা জেলার নির্বাচনী ফলাফল নির্দেশ করে এই শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের অস্ত্রবিবর্জিত রাজনৈতিক ভিত্তি কতটা দুর্বল; বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ খুলনা জেলার আটটি আসনের সবগুলো ও মোট ভোটের শতকরা ৭৫ ভাগ পায়। মুসলিম লীগের তিন অংশ মোট ৩ থেকে ৪ ভাগ এবং মৌলবাদী দল জামাত-ই-ইসলামী ৬ ভাগ আসন পায়। আমি শামস্কে জিজ্ঞেস করলাম তার লোকজন যখন মেশিনগান নিয়ে রাস্তা দখল করে বসে আছে তখন তিনি কীভাবে আসা করেন যে উদ্বাস্তুরা বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ফিরে আসবে? (বেনাপোল হলো কলকাতা থেকে ঢাকাগামী প্রধান সড়ক এবং এই সীমান্তের ওপারেই পশ্চিমবঙ্গে বড়ো বড়ো কয়েকটি উদ্বাস্ত শিবির রয়েছে) তিনি বললেন, সীমান্ত এলাকার নদী বা ধানী জমির ‘অননুমোদিত পথ’ দিয়ে আসতেও তাদের কোনো বাধা নেই। ‘দুষ্কৃতিকারী, বিদ্রোহী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী’রাও ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না, কারণ তিনি সার্বক্ষণিক টহলের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বললেন, “তাদের আসতে দিন, আমরা তাদের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছি।” আমি অবশ্য স্পষ্টভাবে বুঝলাম না তিনি কাদের জন্য অপেক্ষা করছেন, উদ্বাস্তু না ভারতীয় সৈন্য।

    কর্নেল শামস্ তার এক ক্যাপ্টেন অফিসারকে আমার সঙ্গে দিয়ে দিলেন। আমি সীমান্ত থেকে এক মাইল দূরে বেনাপোল উদ্বাস্তু অভ্যর্থনা কেন্দ্রে ফিরে এলাম। মোটা গোঁফওয়ালা ক্যাপ্টেন আমাকে জানালেন, “এখানে আমাদের একটা সমস্যা আছে।” পানিতে ডুবে থাকা বর্ষাতি মাথায় দেয়া বাঙালি কৃষকদের দেখিয়ে তিনি বললেন, “ওদের দেখেন। ওরা সবাইকে আমাদের কাছে একইরকম লাগে। কীভাবে বুঝবো যে ওরা দুষ্কৃতিকারী নয়, সাধারণ মানুষ?” বেনাপোল অভ্যর্থনা কেন্দ্রে কেবল পাঁচটি নিরাশ্রয় কুকুর ছাড়া আর কাউকে দেখা গেল না।

    ক্যাপ্টেন জানালেন সীমান্তের খুব কাছাকাছি হবার কারণে হয়তো কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনি আমাকে সাতক্ষীরার দিকে আরেকটি অভ্যর্থনা কেন্দ্রের কথা শোনালেন। আমি সাতক্ষীরার দিকে গাড়ি চালালাম এবং সেখানে পৌঁছে ১৩ জন উদ্বাস্তুকে পাওয়া গেল। তাদের মধ্যে ৩ জন হিন্দু। ক্যাম্পের ভর্তি বোর্ড-এ গমন ও আগমনের হিসেব লেখা ছিল। আমি যখন ঘুরে-ফিরে দেখছিলাম আমি দু’জন রাজাকারের কাছ থেকে দু’বার মিলিটারি কায়দায় দেয়া স্যালুট পেলাম। তারা বয়সে তরুণ, তাদের হাতে শটগান ছিল। আমাকে বলা হলো তারা এখানে ক্যাম্পটি পাহারা দেবার জন্য নিযুক্ত আছে (কার ভয়ে এই পাহারা? দুষ্কৃতিকারী, বিদ্রোহীদের ভয়ে?)। তারা নিরাপত্তা পরিদর্শনের কাজেও সাহায্য করছে। ক্যাম্পের দায়িত্বে নিযুক্তদের (সাধারণ বাঙালি মিউনিসিপ্যাল কর্মচারী, যাদের আন্তরিকতাকে মেনে নেয়া যায়) আমি জিজ্ঞেস করলাম অজানা সশস্ত্র লোকজন ফিরে আসা উদ্বাস্তুদের রাজনৈতিক মতাদর্শ জিজ্ঞেস করছে কিনা, যেক্ষেত্রে আরও ১০০ জন উদ্বাস্তু আসার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

    লোকগুলোর পরনে ছিল ভালো পোশাক এবং তাদের খাবারদাবারের কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হলো না। তারা সবাই ভারতীয় সীমান্তের ওপাশেই হাসনাবাদ থেকে একই দিনে, একসঙ্গে এসেছে। তারা সেখানে গিয়েও ছিল একই সময়ে এবং ২২ দিন থাকার পর তারা একসঙ্গে ফিরে এসেছে। তাদের কেউই ভারতীয় রেশন কার্ড সংগ্রহ করতে সমর্থ হয় নি। আমি ২,০০০ লোকের জন্য স্কুলঘর ও পাশের বিল্ডিং মিলে তৈরী ক্যাম্পের দায়িত্বে নিযুক্ত লোকদের জিজ্ঞেস করলাম যে-লোকগুলো প্রকৃত অর্থে ভারতীয় সীমান্তের ওপাশে উদ্বাস্তু হিসেবে থাকে নি, তারা এখানে সাহায্য পাবার যোগ্য কিনা। তারা বলল, না।

    সাতক্ষীরা থেকে আমি জেলাসদর খুলনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। যাবার পথে আমি একটা সেতু দেখতে পেলাম যেটি কোনোমতে পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। দশ দিন আগে এক চোরাগুপ্তা হামলায় এটা বিধ্বস্ত হয়েছিল। অনুমান করা হচ্ছে মুক্তিফৌজ একাজ করেছে যারা আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে বলা শোনা যাচ্ছে। স্থানীয় লোকজন আমাকে জানালো, শুনে ভালোই লাগলো, ২৫ জন রাজাকার ব্রিজটির পাহারা দিচ্ছিল, কিন্তু প্রথম গুলির আওয়াজেই তারা পালিয়ে যায়। পরে রাজাকার হাই কমান্ডের সঙ্গে দেখা হলো তাকে এবিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু তিনি তা অস্বীকার করেন।

    গত আদমশুমারির হিসেবে পুরো জেলায় লোকসংখ্যার পরিমাণ ৩০ লাখ। এরমধ্যে চার ভাগের এক ভাগ হয় নিখোঁজ, মৃত অথবা ভারতে পালিয়ে গেছে। স্থানীয় বেসামরিক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে জেলার অর্ধেক জমি চাষ করা হয়নি। ঢাকায় ইস্যুকৃত সরকারী আদেশ মোতাবেক শান্তিকমিটি কর্তৃক নির্বাচিত ‘তত্ত্বাবধায়ক’-দের হাতে পরিত্যক্ত জমি, দোকান-পাট ও সম্পত্তি তুলে দেয়া হবে। বেসামরিক প্রশাসনের সাধারণ কাজকর্ম বন্ধ হয়ে আছে। খুলনা যখন ‘নিরাপদ’ ছিল তখন থেকেই সিনিয়র হিন্দু ম্যাজিস্ট্রেট রাজেন্দ্র লাল সরকার নিখোঁজ রয়েছেন। অনুমান করা যায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। সিনিয়র মুসলমান ম্যাজিস্ট্রেট চৌধুরী সানোয়ার আলীকে সেনাবাহিনী গ্রেফতার করেছে। তিনি এখন কোথায় আছে কেই বলতে পারে না। পুলিশ সুপার আব্দুল আকিব খন্দকাকে বদলি করা হয়েছে এবং ডিসি নূরুল ইসলাম খানকে বদলি করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে।

    পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনে চেয়ারবদলের যে খেলা চলে এ-হলো তারই অংশ। উল্লিখিত বাঙালি অফিসারদের খুব দ্রুততার সঙ্গে পরিবর্তন করা হয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিযুক্ত ৩০০ কেরানির মধ্যে ৬৬ জন ছিল হিন্দু। তাদের মধ্যে কেবল দু-জন এপর্যন্ত টিঁকে আছেন; বাকিরা যদি বেঁচে থাকেনও স্বংক্রিয়ভাবে কর্মচ্যুত করা হয়েছে। আমি অনেক জায়গায় শুনলাম যে সংখ্যালঘু হিন্দুদের চাকরি দেবার সময় ‘কঠোর নিরাপত্তাজনিত বাছাই’ করা হয়ে থাকে এবং কালো তালিকা অনুসরণ করা হয়।

    খুলনায় নৌবাহিনীর আক্রমণ

    সরকারীভাবে ব্যাপারটা অস্বীকার করা হয়েছে। যাহোক গত ফেব্র“য়ারিতে একজন হিন্দু তরুণ অরবিন্দ সেন খুলনা প্রশাসনের একটি কেরানিপদের চাকরির জন্য ৬০০ জন প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে মৌখিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। গত সপ্তাহ পর্যন্ত সে বেকার ছিল, যদিও প্রশাসনে লোকবলের খুবই অভাব। খুলনা বেসামরিক প্রশাসনের কাজকর্ম খুবই ব্যাঘাত ঘটছিল কারণ সামরিকবাহিনীর লোকজন তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের জিনিস চেয়ে খবর পাঠাচ্ছিল। জেলা প্রশাসনের লঞ্চগুলো তারা খাদ্য বিতরণ, বন্যানিয়ন্ত্রণ এবং একই ধরনের কাজকর্মে ব্যবহার করতো (জেলার অর্ধেক জায়গায় পৌঁছতে জলপথ ব্যবহার করতে হয়)। কিন্তু সেনাবাহিনী লঞ্চগুলোতে এখন ৫০টি মেশিনগান স্থাপন করে নদীপথে টহল দিচ্ছে এবং ‘দুষ্কৃতিকারী’-দের খুঁজে বেড়াচ্ছে। বেসামরিক প্রশাসন জরুরি ভিত্তিতে লঞ্চগুলো ফিরে পেতে চাচ্ছে অথবা নতুন লঞ্চ খুঁজছে। কারণ তারা আশংকাজনক রিপোর্ট পেয়েছে যে কৃষকরা তাদের নিচু জমিকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় নিচু বাঁধ নির্মাণ করতে পারে নি। এখন লোনা পানি যদি এই জমিগুলোকে প্লাবিত করে তবে অনেক বছরের জন্য জমিগুলো চাষের অনুপযুক্ত হয়ে যাবে।

    শহরের মাঝে পাকিস্তান নৌবাহিনীর একটি গানবোট পাকিস্তান রিভার সার্ভিসের একটি টাগবোটকে গোলার আঘাতে ডুবিয়ে দেয়। স্থানীয় নৌবাহিনীর প্রধান আলহাজ্জ্ব গুল জারিন আমাকে বলেন যে টাগবোটটিকে ডুবিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না, কারণ দুষ্কৃতিকারীরা এটা দখল করে ফেলেছিল এবং নৌবাহিনীর একটি জাহাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্যোগ নিচ্ছিল। স্থানীয় মাঝিরা বলল সাধারণ একজন ক্রু টাগবোটটিতে ছিল এবং পাল্টা জবাব দেবার কোনো সুযোগ সে পায় নি, ভীষণ শব্দ করে বোটটি নৌঘাঁটি থেকে আসছিল।

    স্থানীয় শান্তি কমিটি ও রাজাকার হাই কমান্ড ‘স্বাভাবিকতা’ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সফল হয়েছে এমন কোনো নিদর্শনই পাওয়া যায় নি। গত মাসে এদের দু-জন সদস্য জেলা কাউন্সিলের ভাইস-চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার মোল্লা এবং খুলনা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস-চেয়্যারম্যান আব্দুল হামিদ মুখোশধারী সশস্ত্র ব্যক্তির হাতে নিহত হয়। গত এক মাসে ২১ জন স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য নিহত হয়েছে। খুলনা হাসপাতালে বর্তমানে ছুরির আঘাতে আহত ১২ জনের চিকিৎসা চলছে। একটি অপারেশনে সক্রিয় থাকা অবস্থায় আমি একজন রাজাকার কমান্ডার আব্দুল ওয়হাব মহলদার-এর সঙ্গে কথা বলি। তার মতে বিগত কয়েক সপ্তাহে খুলনায় অন্তঃত ২০০ জন রাজাকার ও শান্তিকমিটির সদস্য নিহত হয়েছে। মহলদার বলেন তার নিজের গ্রুপ দু-জন ‘দুষ্কৃতিকারী’-কে হত্যা করেছে।

    পুলিশের কাছে এরকম তথ্য আছে যে দু-জন স্কুলশিক্ষককে কোনো আগাম হুঁশিয়ারি না দিয়েই হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ এধরনের মামলাগুলো পরিচালনা করতে পারছে না কারণ সামরিক এরকম প্রজ্ঞাপন আছে যে রাজাকারদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো সামরিক বাহিনীই তদন্ত করবে। খুলনা বেসামরিক পুলিশ একারণে অবাঙালি শান্তিকমিটি সদস্য মতি উল্লাহর বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনা করতে পারছে না; সেনাবাহিনী শহরের ‘নিরাপত্তা’-র দায়িত্ব নেবার আগের দিন তার কাছে বিস্ফোরক দ্রব্য পাওয়া গিয়েছিল। এর আগে উল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল নির্যাতন ও হুমকি প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের অভিযোগ ছিল। কিন্তু শান্তিকমিটির দায়িত্ব পাবার পর তার জামিন হয়ে যায়। তার বাড়ির পেছনে একদিন বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়; প্রতিবেশীদের অভিযোগ অনুসারে দাঙ্গার সময় ব্যবহারের জন্য সে ডিনামাইট জোগাড় করে রাখছিল। তার মন্দ চরিত্রের জন্য তাকে বন্দুকের লাইসেন্স নেবার জন্য বলা হলে সে তা নিতে অস্বীকার করে। পুলিশ তাকে সন্ত্রাসী ‘গুণ্ডা’ হিসেবেই জানে।

    গণ্ডগোলে ও সেনাবাহিনীর ‘নিরাপত্তা’ অভিযানে ঠিক কতজন লোক মারা গেছে তা আমি শেষ পর্যন্ত স্থির করতে পারলাম না। তিন দিনের কারফিউয়ে ঘরে বন্দি একজন ম্যাজিস্ট্রেট জানালেন তার নদীপার্শস্থ বাড়ি থেকে তিনি, অভিযানের চূড়ান্ত পর্যায়ে, দশ মিনিটের মধ্যে ৪৮টি লাশ ভেসে যেতে দেখেছেন। শহরের অনেক এলাকাই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, কর্তৃপক্ষের ভাষায় এহলো বস্তি নির্মূল অভিযান। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলগামী রাস্তার দু-পাশে এক মাইল জুড়ে সবকিছু সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে।

    কর্নেল শামস্ আমাকে জানান বিদ্রোহীদের সঙ্গে তার একটা জোর লড়াই হয়েছে, কিন্তু তিনি কখনোই ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেন নি। তিনি বলেন ঘরবাড়িগুলোতে বড়ো বড়ো আঘাতের চিহ্ন হয়েছে দুষ্কৃতিকারীদের পেট্রোলবোমা ব্যবহারের কারণে। কর্নেল শামস্ নয়, অন্য একটি সেনা-সূত্র আমাকে জানায় সেনাবাহিনীর অভিযানে কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটেনি, মাত্র সাতজন আহত হয়েছে। সেনাঅভিযানের কালে খুলনা হাসপাতালে গুলির আঘাতে ১৮৪ জন, ছুরিকাঘাত ও বেয়নটের আঘাতে ৭০ জন ভর্তি হয়। লড়াইয়ে বাঙালিদের হাতে যেমন অবাঙালি বিহারীরা নিহত হয়েছে, অবাঙালিদের হাতেও বাঙালিরা নিহত হয়েছে। আর সেনাবাহিনীর গণহত্যা তো রয়েছেই। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হয় এদের মধ্যে কেবল সেনাবাহিনীরই গুলি করার ক্ষমতা রয়েছে। যেকথাটা কখনও নাও জানা যেতে পারে, তা হলো, হতাহত বা ধ্বংসযজ্ঞের কোনো সরকারী তদন্ত হচ্ছে না। অন্যদিকে পাকিস্তান পুলিশকে প্রতিটি গুলির জন্য লিখিত রিপোর্ট রাখতে হয় এবং গুলিটা করতে হয় ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে।

    এমনকি মংলা বন্দরে কী ঘটেছে তাও অস্পষ্ট। বন্দরঘেঁষা ঘরবাড়ি ও বাজারের দোকানপাট পোড়ানো হয়েছে। বন্দরের পাশের ইটের দালানগুলোতে গোলার আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। স্থানীয় পুলিশের প্রধান সাবইন্সপেক্টর হাদি খান একজন অবাঙালি। গত মাসে তার প্রমোশন হয়েছে এবং এধরনের পদে আসার জন্য যে পরীক্ষায় পাশ করতে হয়, তাকে সেধরনের কোনো পরীক্ষাই দিতে হয়নি। আমার দেখা অপেক্ষাকৃত বেশি মারাত্মক এই ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে তিনি বললেন, বাজারের কোনো দোকান থেকে লণ্ঠন উল্টে বা ওরকম কিছু হয়ে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু পিএনএস তিতুমীর-এর কমান্ডার জারিন আমাকে বললেন: ”মংলায় দুষ্কৃতিকারীদের সঙ্গে জোর লড়াই হয়েছে। রাস্কেলগুলো আমাদের বিরুদ্ধে হাতবোমা নিয়ে যুদ্ধ করতে এসেছিল। কিন্তু গোলা নিক্ষেপের সময়ই তা বিস্ফোরিত হয় এবং অর্ধেক এলাকা পুড়ে যায়।”

    স্মৃতিচারণ করে কমান্ডার হেসে উঠলেন। নদীর পাশের ভবনগুলোতে গোলার চিহ্নের কোনো ব্যাখ্যা তিনি আমাকে দিতে পারলেন না। মংলায় আমি এবিষয়ে আর বেশি কিছু অনুসন্ধান করতে পারলাম না কারণ আমার ‘নিরাপত্তা’-র জন্য আমার সঙ্গে সবসময় দু-জন সৈনিক ঘুর ঘুর করছিল। তারা আমার সঙ্গে আঠার মতো লেগে ছিল এবং স্থানীয় জনগণ এজন্য মুখ খুলতে পারছিল না।

    ঘটনাবলী সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দেয়া অদ্ভূত সব ব্যাখ্যা আরও শুনে যাওয়া আমার কাছে ক্লান্তিকর ঠেকছিল। উদ্বাস্তুদের ফিরে আসা প্রসঙ্গে বলা যায় কেবল অতি সাহসী এবং অতি বোকা লোকই এই মুহূর্তে দেশে ফিরে আসতে চাইবে এবং কেউ যদি ফিরেও আসে তবে তাকে স্বাভাবিক অভ্যর্থনা জানানো হবে কিনা সেব্যাপারে খুবই সন্দেহ আছে। কেবল ভারত ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগই উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেরকম হবার কোনো সম্ভাবনা নেই।

    আরও আশংকার কথা, শান্তিকমিটি ও রাজাকারদের দাপটে পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষ ও আন্তরিক বেসামরিক প্রশাসন ক্রমশ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছে; অন্যদিকে কারও কাছে দায়বদ্ধ নয় এরকম ভাড়াটে ইনফরমার, মৌলবাদী ও গুণ্ডাপাণ্ডাদের শাসন চলছে। দীর্ঘকাল আগে উত্তরপশ্চিম সীমান্তে ব্রিটিশরা গ্রাম জ্বালিয়ে, গুলি করে যে জনগণকে হত্যা করে শান্তিপ্রতিষ্ঠার যে কায়দা প্রদর্শন করেছিল সেই পদ্ধতি এই জনবহুল ও শান্তিপূর্ণ পূর্ব পাকিস্তানে আমদানি করা হয়েছে। হিটলার ও মুসোলিনির রাজনৈতিক পদ্ধতি বরং কম ক্ষতিকর হতো।

    বাংলায় আগ্রাসন: আমাদের অবশ্যই যা করতে হবে

    রেগ প্রেন্টিস

    দি সানডে টাইমস, ১১ জুলাই, ১৯৭১

    অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

    [মি. প্রেন্টিস হলেন সংসদীয় একটি দলের সদস্য যারা সম্প্রতি পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তান সফর করেছেন।]

    রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া যে-পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাতে পরিস্থিতি কেবল খারাপই হতে পারে। এটা পাকিস্তান এবং ভারত উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। পূর্ব পাকিস্তানে অবশ্য চরম নিষ্ঠুরভাবে দমন-পীড়ন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই, কারণ সাত কোটি বিক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীর ওপর কয়েক হাজার সৈন্য দিয়ে ক্ষমতা খাটাতে গেলে এছাড়া কোনো উপায় নেই। সৈন্যসংখ্যা খুব কম। তাদের জন্য নানা সরবরাহ ও সাহায্য আসছে ভারতের দক্ষিণাঞ্চল ঘুরে ৩,০০০ মাইল পার হয়ে। দেশটির কোনো কোনো অংশ গেরিলা আক্রমণের জন্য খুবই উপযুক্ত অঞ্চল। গেরিলারা ভারতে আশ্রয় নিতে পারে এবং উদ্বাস্তুদের মধ্য থেকে তাদের নিয়োগসংখ্যা বাড়তে পারে। একাধিক পর্যবেক্ষক মনে করেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ভিয়েতনামের মতো অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে।

    ভারতের দিক থেকেও পরিস্থিতি সমানভাবে হতাশাজনক। সীমান্ত-রাজ্যগুলোতে স্থানীয় কর্মকর্তা, ডাক্তার ও নার্সরা বেশিরভাগ শরণার্থীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য খুব সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু এসব ঘটছে এমন একটি দেশে যেটি খুব দরিদ্র এবং এর বেশিরভাগই ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে যা পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম দরিদ্র এবং জনবহুল একটি অঞ্চল। স্থানীয় প্রশাসন অন্যান্য কাজকর্ম বাদ দিয়ে উদ্বাস্তু-সমস্যা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে; স্থানীয় উন্নয়ন-কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে; বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে কারণ সেগুলো উদ্বাস্তুদের দখলে। উদ্বাস্ত-শিবিরগুলোতে বিস্ফোরনোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, মাসের পর মাস অলসভাবে কাটাতে বাধ্য হবার কারণে। স্থানীয় জনগণের মধ্যেও উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে কারণ তারা দেখছে যে উদ্বাস্তুরাই তাদের চাইতে বেশি খাবার পাচ্ছে, এবং তা পাচ্ছে ফ্রি, এদিকে তারা সারা সপ্তাহ জুড়ে কাজ করে মরছে। কিন্তু উদ্বাস্তুদের কাজ দিয়ে এসমস্যার সমাধান করা যাবে না, কারণ ইতোমধ্যেই চরম বেকারত্ব রয়েছে।

    বিশ্বকে অবশ্যই এই বোঝার বৃহত্তর অংশ ভাগাভাগি করতে হবে। বাকি বিশ্ব যে-পরিমাণ সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে তাতে ভারতের হিসাব অনুযায়ী ছ-মাসের কাজ চলবে। বেশিরভাগ দেশকে আরো বেশি সাহায্য প্রদানের কথা বলতে হবে এবং ধরে নিতে হবে দীর্ঘ সময়ের জন্য এটা চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সাহায্যের পরিমাণ যতই বেশি হোক না কেন ভারতকে এ-পরিস্থিতির জন্য চরম মূল্যই দেতে হবে এবং যত সময় যাবে তার পরিমাণও বাড়তে থাকবে। এই নিম্নগামী কুণ্ডলীকে উল্টে দেওয়া যাবে তখনই যখন পূর্ব পাকিস্তানের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো রাজনৈতিক সমাধান দেয়া যাবে। তার মানে, সমাধানটি শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। উপনিবেশ উঠে যাবার সময়কার পরিস্থিতির সঙ্গে এর মিল রয়েছে। রাজনৈতিক দলসমূহের নেতৃবৃন্দ, যাদের ওপর জনগণের আস্থা রয়েছে, কেবল তারাই কার্যকর কোনো সমাধান দিতে পারেন। ইয়াহিয়া খানকে অবশ্যই হয় এটা বুঝতে হবে অথবা তার দমননীতি চালিয়ে যেতে হবে, যে-নীতি আজ অথবা কাল ব্যর্থ হবেই।

    ধরা যাক, শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পেলেন, আওয়ামী লীগকে মেনে নেয়া হলো, এবং সত্যিকারের আলোচনা শুরু হলো। এর ফলে কী পাওয়া যাবে? যে-ছয় দফার ওপর ভিত্তি করে আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনে জিতেছে, সেই ছয় দফা অনুসারে পূর্ব পাকিস্তান বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বশাসনের সুযোগ চাইবে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেবল পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা থাকবে। অখণ্ড পাকিস্তানের ধারণা টিকে থাকবে কিন্তু পূর্বের প্রাদেশিক সরকার নিজ ভাগ্য নির্মাণে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এটা খুবই সন্দেহজনক যে এই সমাধান আদৌ সম্ভব কিনা। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বহু রক্তপাত হয়েছে এবং তিক্ততা দেখা গেছে।

    জরুরি বিষয় নিশ্চয় এরকম: সমাধান যদি শিথিল ফেডারেশনের হয় অথবা (তার চাইতেও এগিয়ে) পূর্ণ স্বাধীনতার, সে-সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা কেবল আওয়ামী লীগেরই। কারণ তারাই পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র আস্থাভাজন প্রতিনিধি। তারা অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের অবশ্যই তা মেনে নিতে হবে। বর্তমানে সামরিক শাসকরা অবশ্য সেরকম কিছু করার মতো মানসিকতায় নেই। তারা গতানুগতিক কথাই বলে যাচ্ছেন। তারা বারংবার বলে যাচ্ছেন যে সেনাবাহিনীকে ‘আইন-শৃঙ্খলা-পরিস্থিতি’র উন্নতি ঘটাতে হবে;
    ভারতীয় মদদপুষ্ট কয়েকজন ‘উচ্ছৃঙ্খল’-এর কারণেই এতো সমস্যা দেখা দিচ্ছে; শরণার্থীরা দেশে ফিরে যেতে চায় কিন্তু ভারতীয়রা তাদের যেতে দিচ্ছে না; পূর্ব পাকিস্তানে জনজীবন ‘স্বাভাবিক’ হয়ে আসছে; বিশ্ববাসীর ভারতীয়দের দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়া ঠিক হবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি।

    পরিবর্তনের সত্যিকারের সম্ভাবনা দু-টি বিষয়ের ওপরে নির্ভর করছে: পূর্ব বাংলাকে ঠাণ্ডা রাখতে তাদের ক্রমাগত ব্যর্থতা ও বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক চাপ। দেশটি রফতানি মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বিরাটা ক্ষতির মুখোমুখি। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের পণ্য রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে না এবং পরিস্থিতির উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, যদিও অন্য দিক থেকে ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে’ বলে দাবি করা হচ্ছে (পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিমের তুলনায় অনেক দরিদ্র কিন্তু তারাই বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ অর্জন করে থাকে)। এবছরের শেষ নাগাদ, সম্ভবত দুর্ভিক্ষ আকারেই, গুরুতর খাদ্যাভাব দেখা দেবে। কারণ কয়েক মাসের মধ্যে যে-ফসল লাগানোর কথা, তা লাগাতে বিঘ্ন দেখা দিয়েছে। যাতায়াত-ব্যবস্থা বিধ্বস্ত হয়ে যাবার কারণে পরিস্থিতি আরও সঙ্গীন হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে পশ্চিমে খরার কারণে কমই ফসল হয়েছে যেখান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বীজসংকটের মোকাবেলা করা হয়ে থাকে।

    এসব বিপদের মুখে পশ্চিমা সাহায্যের কনসোর্টিয়াম সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরে অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য নতুনভাবে আবেদন জানাবে না। চলতি প্রকল্পগুলো শেষ হবে কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো সিদ্ধান্তে অবিচল থাকলে বৈদেশিক সাহায্য শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকবে এবং সামনের মাসগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ঘনীভূত হবে। এমনকি স্বাভাবিক সময়ে এধরনের সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য হতো বিরাট আঘাত।

    পাকিস্তানের যেসব জেনারেলরা দেশটিকে চালান তারা অর্থনীতি সামন্যই বোঝেন, কিন্তু আজ অথবা কাল কঠোর পরিস্থিতি তাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে বাধ্য করবে। এটাই আমাদের একমাত্র আশা।

    আমি বিশ্বাস করি একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতির পক্ষে চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনটি উপায় আছে। প্রথমত, পশ্চিমা শক্তি অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান না-করার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে (ত্রাণসাহায্যের কথা আলাদা, পূর্ব পাকিস্তানে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ এড়াতে জাতিসংঘের সহায়তায় ত্রাণতৎপরতা চালাতে হবে)। রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্যকে ব্যবহার করার বিপক্ষে অনেক যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু এটি একটি সম্পূর্ণ পৃথক পরিস্থিতি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, খুব নিকট ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানে কার্যকর উন্নয়ন প্রকল্প নেবার সম্ভব হবে না। তাই দেশটিকে যেকেনো ধরনের অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়া হলে তা কেবল পশ্চিম পাকিস্তানেই ব্যবহৃত হবে। সাহায্য না-দেয়া বরং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মুক্তি দিতে এবং পূর্ব পাকিস্তানকে দমিয়ে রাখার সম্পদগুলোকে নিঃশেষ করতে কাজ করতে পারে। বৈদেশিক উন্নয়নের সাবেক মন্ত্রীর অভিজ্ঞতা থেকে আমি বিশ্বাস করি রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সাহায্যের বিষয়টি জুড়ে দেয়া ১০০ ভাগের ৯৯ ভাগের ক্ষেত্রেই অনুচিত — কিন্তু এটি হলো সেই ১০০তম ক্ষেত্র। একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য যেকোনো ধরনের ক্ষমতাই ব্যবহার করা উচিত।

    দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর প্রক্রিয়াকে শিগগীরই বন্ধ করতে হবে। বিশ্বমত ওয়াশিংটনের সেইসব সিনেটর ও কংগ্রেসসদস্যদের মতোই গড়ে ওঠা উচিত যারা মার্কিন প্রশাসনকে তার নীতিকে পাল্টানোর জন্য বলেছিলেন। পাকিস্তানের সেনাশক্তিকে মদদ দেবার মাধ্যমে হলেও চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের এরকম অবস্থানের কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে না। তৃতীয়ত, সব ধরনের সরকার, সংসদ ও প্রভাবশালী ব্যাখ্যাকারদের সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। এটা পরিস্কার বুঝতে হবে যে বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশার মধ্যেই বিশ্ববাসীর ও সরকারগুলোর প্রত্যাশা নিহিত আছে: আমরা সম্মিলিতভাবে দাবি করছি যে পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের নীতিতে একটা পরিবর্তন আসতে হবে।

    আমাদের হয়তো একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান এনে দেবার মতো ক্ষমতা নেই, কিন্তু আমাদের যার যা ক্ষমতা আছে, তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে। কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সময় পার হয়ে গেছে। এখন হলো অবস্থান নেবার সময় এবং নিজেদের সংখ্যা গণনার সময়।

    পাকিস্তানে গণহত্যা

    দি সানডে টাইমস ২০ জুন, ১৯৭১

    অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

    [গত সপ্তাহে সানডে টাইমস পূর্ব-পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিপীড়ন সম্পর্কিত এন্থনি ম্যাসকারেনহাসের প্রতিবেদন ছাপিয়েছিল। এখন আমাদের হাতে পূর্ব-পাকিস্তান সংশ্লিষ্ট আরও সাম্প্রতিক ও সম্ভবত আরও ভয়ংকর তথ্য রয়েছে। এই তথ্যগুলো এন্থনি ম্যাসকারেনহাসের দেয়া নয়, কিন্তু এসব তথ্য আমরা পেয়েছি শিক্ষায়তনিক ও প্রফেশনাল সূত্র থেকে যাদের দেয়া তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে সংশয় থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই।]

    পূর্ব-পাকিস্তানে সহিংসতার নতুন অভিযান শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার জন্য হানিকর যেকোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি বা যেকোনো রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের অস্তিত্বকে পুরোপুরিভাবে নির্মূল করার জন্যই এই অভিযান। ঢাকায় সেনা সরকার বাংলাদেশী শক্তিকে পরাজতি করার জন্য দুই দফার আদেশ জারি করেছে। প্রথমত, সব সরকারী চাকুরে শিক্ষক লেখক সাংবাদিক ও শিল্পপতিদের চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সম্ভাব্য বিপজ্জনক ব্যক্তিকে ‘নির্মূল’ করে দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ ইতোমধ্যে শিক্ষক, সাংবাদিক ও অন্যান্য প্রভাবশালী বাঙালিদের ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করেছে। সন্দেহভাজন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীলদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তাদের তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে — সাদা, ধূসর ও কালো। সাদাদের কিছু বলা হবে না। ধূসররা তাদের চাকরি হারাবেন বা তাদের জেলে পাঠানো হতে পারে এবং কালোদের হত্যা করা হবে।

    সিভিল সার্ভিসের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু হয়েছে। ৩৬ জন বাঙালি ম্যাজিস্ট্রেটকে হয় হত্যা করা হয়েছে অথবা তারা ভারতে পালিয়ে গেছে। কুমিল্লা, রংপুর, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী, ফরিদপুর ও সিরাজগঞ্জে যখন সেনাবাহিনী প্রবেশ করে তখন কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেট ও এসপিকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করা হয়েছে। ধূসর তালিকার সরকারী কর্মকর্তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে বদলী করা হয়েছে। এদের মধ্যে আছেন পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল তসলিম আহমেদ। ২৫ মার্চের রাতে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় আক্রমণ করে তখন পুলিশ বাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং ১৮ ঘণ্টাব্যাপী এক যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

    সন্ত্রাসী শাসনব্যবস্থায় একটি নতুন উপাদান হলো গেস্টাপো-স্টাইলের ধরপাকড়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যাদের দরকার তাদের সবার সামনে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদের ক্যান্টনমেন্টে ডেকে পাঠানো হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। তাদের বেশিরভাগই আরে ফিরে আসেন নি। যেসব গোপন এজেন্টরা এই ধরপাকড়ে সহায়তা করে থাকে তারা ‘রাজাকার’ নামে পরিচিত। রাজাকার প্রত্যয়টি সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয় হায়দ্রাবাদের নিজামের স্বেচ্ছাসেবকদের সম্পর্কে, ভারত ১৯৪৮ সালে রাজ্যটিকে অধিগ্রহণ করতে চাইলে যারা বাধাপ্রদান করে। রাজাকার শব্দের অর্থ হলো রাজার বা রাষ্ট্রের আদেশ পালন করা। ঢাকার রাত ও দিনের বিভিন্ন অংশে এখন সৈন্যরাই রাজত্ব কায়েম করেছে এবং তাদের কাজ হলো “হিন্দু, আওয়ামী লীগার ও ছাত্র”-দের খুঁজে বের করা। সবাইকে একটি পরিচয়পত্র বহন করতে হচ্ছে। যত্রতত্র বসানো চেকপোস্টে গাড়িকে থামানো হচ্ছে।

    যদি চেকপোস্টে কারো পরিচয়পত্র না পাওয়া যায়, ও কেউ যদি জওয়ানদের কথা শুনছে না বলে মনে হয় তবে তাকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। ঢাকায় মাঝে মাঝেই বোমা বিস্ফোরিত হচ্ছে এবং তার পর থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর লোকজন নিরাপত্তাব্যবস্থা কড়াকড়ি করে মূলত ‘দুস্কৃতিকারী’-দের খুঁজে বেড়াচ্ছে, যাদের তারা নাম দিয়েছে মুক্তি ফৌজ (মুক্তিযোদ্ধা)। সেনাবাহিনী যে-এলাকা ‘দুস্কৃতিকারী’-মুক্ত করে ফেলছে সেখানে তাদের পরিবর্তে মিলিশিয়ারা স্থান দখল করছে। এরা সেনাবাহিনীর লোকজনের চাইতেও নিষ্ঠুর, কিন্তু তাদের চাইতে কম নিয়মনিষ্ঠ। তাদের দৈনিক তিন রুপি করে দেয়া হচ্ছে এবং পূর্ব পাকিস্তানে লোভ দেখিয়ে আনা হয়েছে যে, লুটের ভাগ তাদের দেয়া হবে।

    পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সংখ্যালঘু ও বেঁচে-যাওয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালানো হয়েছে। জগন্নাথ কলেজের তরুণ ছাত্র শংকর ২৭ মার্চ কাছাকাছি একটি গ্রামে লুকিয়ে ছিল। তার ঠাটারি বাজারের বাড়িচি কী অবস্থায় আছে তা দেখার জন্য সে দু-মাস পরে একাই ফিরে আসে। অবাঙালিরা তাকে চিহ্নিত করে এবং “হিন্দু, হিন্দু” বলে চিৎকার করে তাড়া করে এবং তাকে ধরে দল বেঁধে মসজিদে নিয়ে গিয়ে তার জিহ্বা কেটে ফেলে। ভোলার ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল আওয়ালের অনুগত সরকারী কর্মকর্তা বলে খ্যাতি ছিল। যখন আওয়ামী লীগের লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে আক্রমণ করে তখন তিনি অবাঙালিদের তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং মুক্তিফৌজ পুলিশ স্টেশনে হামলা করলে স্টেশনের অস্ত্র-শস্ত্র তাদের হাত থেকে রক্ষা করেন। সেনাবাহিনী যখন পহেলা মে আক্রমণ করে তখন তিনি তাদের অভ্যর্থনা জানাতে গিয়েছিলেন। এ-অভিযানে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার তাকে তার দায়িত্ব আবার বুঝে নেবার জন্য নির্দেশ করেন, কিন্তু নির্দেশ পেয়ে তিনি পেছনে ঘুরতে না ঘুরতেই সেপাইয়ের গুলিতে মারা যান।

    ডজন খানেক বাঙালি অফিসারকে পশ্চিম-পাকিস্তানে বদলি করা হয়েছে। তারা তাদের পরিবারকে বিদায় জানিয়েছিলেন এবং করাচির উদ্দেশে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ওঠেন বলে জানা গিয়েছিল। কিন্তু তাদের পরিবারের সদস্যরা সেনাসদরে জানতে গেলে তাদের বলা হয় অফিসাররা চলে গেছে। কিন্তু একজন মেজরের ছিন্নভিন্ন লাশ তার পরিবারকে দিয়ে দেয়া হয় এবং বলা হয় তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

    ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি অফিসার। কিন্তু তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। চট্টগ্রামে বাঙালি সৈন্যরা যখন বিদ্রোহ করে, তখন তিনি তার পাঞ্জাবি সহকর্মীদের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। তার পরিবার তার সম্মন্ধে জানতে চাইলে তাদের বলা হয়, যেকোনো ধরনের জিজ্ঞাসা বিপদ নিয়ে আসতে পারে। ২ জুন রাতে ঢাকার ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় সেনাবাহিনীর জিপ প্রবেশ করে। হক নামের একজন সরকারী কর্মকর্তাকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসা হয় এবং কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। তার স্ত্রী পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বেসরকারী প্রধান শফিউল আজমকে ফোন করেন। তিনি সেনাবাহিনী সদরদপ্তরে ফোন করলে তাকে জানানো হয় হক নামের কাউকে নিয়ে আসা হয়নি।

    রণদা সাহা নামের একজন শিল্পপতিকে বলা হলো তার মির্জাপুরের গ্রামের বাড়িতে সেনা অফিসারদের জন্য উৎসব-সন্ধ্যার আয়োজন করতে। তিনি আয়োজনের ব্যাপারে আলাপ করতে গিয়ে আর ফিরে আসেন নি। সৈন্যরা আমিন নামের একজন বেসামরিক কর্মকর্তার বাড়ি ঘিরে ফেলে। তাকে বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ সৈন্যদের একটি ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয়। তার আর্মি অফিসার ভাই বেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিলেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল এবং বর্তমানে তিনি কুমিল্লার কাছে বাংলাদেশের জন্য প্রতিরোধ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমিন-পরিবার দুই দিন পরে ফিরে আসে আমিনকে ছাড়াই।

    ১৫ নভেম্বর একজন ক্যাপ্টেন ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে দু’জন সৈন্য নিয়ে আসলেন এবং দুই নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে ডাঃ রহমান ও তার সহকর্মীকে নিয়ে গেলেন। তাকে বলা হলো ময়মনসিংহে তাকে কাজ করতে হবে। তাদের খবরাখবর এখন আর জানা যায় না। অন্য সৈন্যরা আমেরিকা পরিচালিত হলিফ্যামিলি হাসপাতালে গেল, কিন্তু সেখানে কোনো শল্যচিকিৎসক ছিলেন না। হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয়া হবে বলে এখন ভাবা হচ্ছে। কারণ বিখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ এম এন হকসহ অনেকেই পালিয়েছেন।

    সিলেট শহরে যখন সেনাবাহিনী প্রবেশ করে তখন প্রধান শল্য-চিকিৎসক ডাঃ শামসুদ্দিন ছাড়া সকলেই সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে গেছেন। ডাঃ শামসুদ্দিনকে অপারেশন থিয়েটারে পাওয়া যায় এবং একজন মেজর তাকে গুলি করে হত্যা করেন। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের অনেক অনেক সিনিয়র বাঙালি অফিসারকেই পাওয়া যাচ্ছে না। এদের মধ্যে আছেন উপমহাব্যবস্থাপক ফজলুল হক এবং প্রধান সেক্টর পাইলট ক্যাপ্টেন সেকেন্দার আলি। সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এয়ারলাইনটি ২,০০০ বাঙালিকে বরখাস্ত করেছে। রাজাকাররা মেজর খালেদ মোশাররফের দুই সন্তানকে আটকে রাখে। বাচ্চা দু-টির বয়স ছিল ছয় ও চার। তাদের মা রক্ষা পেয়েছিলেন এবং এখন ভারতে অবস্থান করছেন। বাচ্চা দু-টিকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং তাদের এরপর গ্রহণ করা হয়।

    নিখোঁজ লোকজনের আত্মীয়রা মনে করেন রাজাকার এবং জুনিয়র সেনা অফিসাররা অবাঙালিদের নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করছে। কিছু পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে কিন্তু টাকা দেবার পরও ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। রাজাকাররা তাদের কর্মকাণ্ড হত্যাকাণ্ড থেকে পতিতা-সরবরাহ পর্যন্ত বি¯তৃত করেছে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে তারা একটি ক্যাম্প চালাচ্ছে যেখান থেকে রাতে কমবয়েসী মেয়েদের সিনিয়র অফিসারদের পাঠানো হয়। তারা তাদের কাজের জন্য মেয়েদের অপহরণও করছে। কেউ কেউ ফিরে আসে নি। একজন প্রথম সারির গায়িকা ফেরদৌসীর বাসায় অফিসাররা প্রবেশ করে, তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান। তার মা একজন পরিচিত জেনারেলের কাছে ফোন করেন এবং তার নিরাপত্তার জন্য মিলিটারি পুলিশ নিয়োগ করা হয়।

    সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা উন্নতি হলো যুক্ত সরকারের বিরুদ্ধে মার্চের প্রথম দিকে শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকা গোয়েন্দা বিভাগের কিছু কর্মকর্তা কাজে ফিরে এসেছেন। এখন তারা সেনাবাহিনীর জন্য ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ লোকদের নাম বলে দিতে বাধ্য। এভাবে ২৫ ও ২৬ মার্চের মতো ভুল লোককে ধরার ব্যাপারাটি আর থাকছে না। ঐ দুই রাতে সেনাবাহিনী ২০ জনেরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষককে হত্যা করেছিল। এদের মধ্যে বাংলা বিভাগের মনিরুজ্জামানের পরিবর্তে পদার্থবিদ্যা বিভাগের মনিরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলা বিভাগের মুনীর চৌধুরীর পরিবর্তে ইংরেজি বিভাগের মি. মোনায়েমকে হত্যা করা হয়েছে। সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খানের প্ররোচনায় কিছু শিক্ষক পহেলা জুন কর্মক্ষেত্রে যোগ দেন কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ কেউ রাজাকারদের হাতে পড়েন।

    সেনা-প্রশাসন খোলাখুলি অনুমোদিত না হলেও রাজাকারদের কর্মকাণ্ড তাদের সবই জানা। কখনো কখনো তারা ভাবনার বিষয়। সম্প্রতি ঢাকার কয়েকশ’ পাটশ্রমিককে কাজে যোগ দিয়ে উৎপাদন শুরুর ব্যাপারে রাজি করানো হয়েছিল। ২৯ মে তাদের তিনজন ট্রেড ইউনিয়নের নেতাকে সেনাবাহিনীর জিপে তোলা হয়। পরের দিন শ্রমিকরা পালিয়ে যায়।

    ৬০ লাখ শরণার্থীর ফিরে আসার সমস্যাটির সমাধান খুবই কঠিন। ঢাকা, যশোর, রংপুর, ঈশ্বরদী, খুলনা ও চট্টগ্রামে তাদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট অবাঙালিরা দখল করে নিয়েছে। সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে তারা মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকা পরিস্কার করে ফেলেছে। তাদের চলে যাবার জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যারা থেকে গিয়েছে তাদের প্রত্যেককে হত্যা করা হয়েছে। এই দুটি আবাসিক এলাকা ঢাকার ১৫ বর্গ কিলেমিটার জায়গা জুড়ে বি¯তৃত। যশোরে আওয়ামী লীগের নেতা ও জাতীয় পরিষদের সদস্য মশিউর রহমানের বাড়ি সেনাবাহিনী ঘিরে ফেলেছিল এবং অবাঙালি বেসামরিক লোকরা গিয়ে প্রত্যেককে হত্যা করেছে। দোতলার জানালা দিয়ে ১০ বছর বয়সী এক কিশোর লাফ দিয়েছিল এবং শূন্যে থাকা অবস্থায়ই একজন সেপাই তাকে হত্যা করে।

    দেশবিভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে আসা শরণার্থীদের জন্য কাজ করে এরকম সংগঠন হলো ‘শান্তি কমিটি’, যারা রাজাকার সমর্থিত। তারা বাঙালিদের রেখে যাওয়া বাড়ি ও দোকানপাট ‘বরাদ্দ’ নেয়ার জন্য আবেদনপত্রের আহ্বান জানিয়ে সংবাদপত্রে নোটিশ দিচ্ছে। চট্টগ্রামে লালদীঘি ও রিয়াজউদ্দিন বাজারের দোকানপাটের তালা ভেঙ্গে সেনাবাহিনী সেগুলো অবাঙালিদের হাতে তুলে দিয়েছে। দখল নেয়া সকল সম্পত্তিতে এখন পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা উর্দুতে সাইনবোর্ড ঝুলছে।

    গ্রামে বাড়িগুলো বিতরণ করা হয়েছে ডানপন্থী দল জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের সদস্যদের মধ্যে, যারা গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। সন্দেহভাজন আওয়ামী লীগের সমর্থক ও হিন্দুদের ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। ঢাকাস্থ ব্রিটিশ ন্যাশনাল ও গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যারা এআদেশের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

    প্রধান রেলওয়ে, বন্দর ও ডকগুলোতে বাঙালিদের কাজ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পহেলা মে তারিখে যখন চট্টগ্রামের ৫,০০০ ডক শ্রমিক কাজে যোগ দিতে ফিরে আসে তখন তাদের তাড়িয়ে দেয়া হয়। স্থাপনাগুলো এখন সেনাবাহিনীর সদস্য ও অবাঙালিদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। চট্টগ্রামের সিনিয়র রেলওয়ে কর্মকর্তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং শ্রমিক-কলোনি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ঢাকা, ঈশ্বরদী ও সৈয়দপুরে কোনো বাঙালি ঢোকার সাহস পাচ্ছে না। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে বাঙালিদের স্থান পূরণ করতে ২৫০ জন বন্দর-কর্মীকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা হয়েছে। তিন হাজার পাঞ্জাবী পুলিশ এখন ঢাকায় টহল দিচ্ছে এবং ঢাকার বাইরে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের খাইবার রাইফেলস্ ও পশ্চিম পাকিস্তান বর্ডারের রেঞ্জাররা একই কাজ করছে।

    পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের বিদ্রোহী ১০,০০০ আধা-সামরিক সদস্য হয় সীমান্ত অতিক্রম করে চলে গিয়েছে অথবা গ্রামে লুকিয়ে আছে। যারা ১৫ মে একটি সাধারণ ক্ষমার ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় আত্মসমর্পন করেছিল, তাদের চোখ ও হাত পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় খোলা ট্রাকে করে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। কিছুদিন পরে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে শত শত শবদেহ ভাসতে দেখা যায় যাদের চোখ হাত বাঁধা ছিল। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের নাম পরিবর্তন করে এখন রাখা হয়েছে পাকিস্তান ডিফেন্স ফোর্স এবং শত শত বিহারীকে সেখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের এখন পিলখানায় বন্দুক ও মেশিনগানসহকারে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

    ২৮ মে ঢাকার খিলগাঁওয়ে একটি অবাঙালি দোকানো বোমা বিস্ফোরিত হলে ১০০ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। মতিঝিলে একজন অবাঙালি তার প্রতিবেশীর কাছ থেকে ১০,০০০ রুপি (প্রায় ৬০০ পাউন্ড) দাবি করে এবং ২৪ ঘন্টার মধ্যে এই অর্থ প্রদান করা না হলে সেনাবাহিনীর কাছে ধরিয়ে দেয়া হবে বলে হুমকি দেয়া হয়। ঢাকার স্টেডিয়াম মার্কেটের একজন রেডিও ও ক্যামেরা বিক্রেতা গত ১২ মে তার দোকানের জিনিসপত্র চুরি হয়ে গেলে সে ঘটনাটি সামরিক আইন সদর-দফতরে জানায়। সেই রাতে কারফিউর সময় তার দোকানে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়।

    বেগম মাজেদা নামের একজন গৃহিণী রাস্তার একটি ট্যাপ থেকে পানি নিচ্ছিল। দু’জন পাঞ্জাবি পুলিশ চেষ্টা করছিল তাকে ট্রাকে উঠিয়ে নেয়ার জন্য। গৃহিণীটি চিৎকার দিলে পাঞ্জাবি পুলিশ দু’জনকে লাঠি ও পাথর দিয়ে মারধর করা হয়। সেরাতে পুরো বাসাবো এলাকায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ঢাকার রাস্তায় এখন হাতঘড়ি পরাও ঝুঁকিপূর্ণ এবং রেডিও ও টেলিভিশন এখন সবাই ঘরের কোণায় লুকিয়ে রাখে। সৈন্যরা লুট করা ট্রান্সিসটর, টেলিভিশন সেট ও ঘড়ি রাস্তায় ৩ পাউন্ড থেকে ৬ পাউন্ডে বিক্রি করছে।

    কর্নেল বারী নামের একজন অফিসার পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকে এক কোটি টাকা (৮৩৩,০০০ পাউন্ড) জমা করেছেন। এখন শহরগুলোকে সাফ করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কারণ মে মাসে বিদেশী সাংবাদিকদের একটি ছোট দল ঢাকা সফর করার কথা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জগন্নাথ ও ইকবাল হল থেকে মৃতদেহ সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়া শাঁখারিপট্টি, ঠাঁটারিবাজার, শান্তিনগর ও রাজারবাগে শেল নিক্ষেপের কারণে সৃষ্ট গর্তগুলোকে পূরণ করা হয়েছে। স্কুল ও কলেজগুলোকে আবার খুলে দেয়া হয়েছে কিন্তু খুব কম ছাত্রই সেখানে রয়েছে। যুদ্ধের পূর্বে একটি স্কুলের ছাত্রসংখ্যা ছিল ৮০০ জন, কিন্ত আবার খুলে দেবার পর সেখানে ছাত্র আছে মাত্র ১০ জন। ১৬ থেকে ২৬ বছরের বেশিরভাগ তরুণ জনগণ সীমান্ত অতিক্রম করে চলে গেছে মুক্তিফৌজ প্রশিক্ষণ-শিবিরে যোগ দেবার জন্য। তাদের মধ্যে এই ভয় ব্যাপকভাবে কাজ করছে যে পূর্ব পাকিস্তানে তরুণ অবস্থায় থাকা অর্থ মৃত্যুবরণ করা …।

    লাখ লাখ মানুষের যাত্রা

    সুনন্দ দত্ত-রায়

    দি অবজারভার ১৩ জুন, ১৯৭১

    অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

    পূর্ব-পাকিস্তান জুড়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সৈন্যরা যেভাবে দেশটিকে জনমানুষশূন্য করে তুলেছে তা দেখে যেকেউ হতাশ হবে। দেশবিভাগের পর থেকে এই মুসলিম দেশে এক কোটি হিন্দু আশা নিয়ে বেঁচে ছিল এবং এরপর ২৩ বছর ধরে অবিচার ও নিবর্তন ভোগ করেছে, এরপর সবশেষে তারা বুঝতে পেরেছে তাদের একমাত্র আশার প্রতিফলন ভারতেই রয়েছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে এই গণদেশত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত ষাট লাখেরও বেশি মানুষ চলে গিয়েছে। কিছু লোক গিয়েছে সাম্প্রদায়িক ভাবনা থেকে তাদের মহিলাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। বাকিরা গিয়েছে চাকরি হারানোর পরে, জায়গাজমি খোয়ানোর পরে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলেও হাজার হাজার লোক চলে গিয়েছে; অন্যান্যরা ভারতে চলে গিয়েছে কারণ জীবনের অনিশ্চয়তার ভার তারা আর বইতে পারেনি।

    গত বছরের কোনো এক সময়ে পূর্ববাংলায় এখনও অবস্থানরত হিন্দুরা আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবের দেয়া প্রতিশ্র“তি অনুসারে সব ধর্মের মানুষের জন্য সমান জীবনের দাবিতে মিছিল করেছে। শেখ মুজিব ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল এবং বর্তমানে জেলে বন্দি আছেন। কিন্তু পাকিস্তানী সৈন্যকে নির্দেশ দেয়া হলো শেখকে শেষ করে দেবার জন্য, সৈন্যদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক যারা আছে, তাদেরও কট্টর হতে উৎসাহিত করা হয়েছে।

    কলকাতায় নিযুক্ত বাংলাদেশ-মিশনের (পূর্ব পাকিস্তান-মিশন) প্রধান হোসেন আলি বলেন সামরিক শাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান তার অফিসারদের ডেকে নিয়ে হিন্দু লোকজনকে হত্যা করার জন্য ও হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করার জন্য ও তাদের ফসল নষ্ট করে দেবার জন্য বিশেষ নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরকম নির্দেশ দেয়া হোক বা না হোক, সৈন্যদের কাজকারবার দেখে মনে হয় তেমনই কিছু বলা হয়েছে। কিন্তু যে দেশে হিন্দু ও মুসলমানরা একই পোশাক পরিধান করে, একই খাবার খায়, একই উপভাষায় কথা বলে, বেসামরিক লোকদের সাহায্য ছাড়া ঐ নির্দেশ পালন করা সম্ভব ছিল না।

    পূর্ব-বাংলায় ‘স্বাভাবিকত্ব ফিরিয়ে আনা’র জন্য গঠিত ‘শান্তি-কমিটি’ এখন কাজগুলো করছে। লিফলেট দিয়ে এবং লাউড-স্পিকারের মাধ্যমে তারা মুসলমানদের আহ্বান করছে হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের সম্পত্তি দখল করার জন্য। আওয়ামী লীগের মুসলমানরা ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শান্তি রক্ষার কাজে যোগ দিতে পারে এবং দেশে থেকে যেতে পারে। যেসব হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভোট দিয়েছে তাদের অবশ্যই চলে যেতে হবে। ফলে ২৫ মার্চের পর থেকে ৪০ লাখ হিন্দু উদ্বাস্তু সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে গিয়েছে। যদি পাকিস্তানী সৈন্যরা পূর্ব বাংলা ছেড়ে চলেও যায়, হিন্দুরা আর ফিরতে চাইবে না। অন্যদিকে ভারতকে বাকি ষাট লাখ হিন্দুকে, যারা এখনও পূর্ববঙ্গে রয়েছে ও তাদের মধ্যে যারা জীবিত থাকবে, তাদের গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

    শেখ মুজিবের বাংলাদেশ-আন্দোলনের সময় দু’ধরনের হিন্দু পূর্ববাংলায় ছিল। তাদের একদল ছিল পেশাজীবী লোকজন যাদের জীবন সম্পর্কে পরিকল্পনা ছিল এবং মুহূর্তের নোটিশে দেশত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল। অন্যদল ছিল কৃষকরা যাদের এখন বাধ্য হয়ে যেতে হবে। সফল আইনজীবীরা বাঁশের চাটাইয়ের বা টিনের তৈরী ঘরে থাকতো। ডাক্তাররা নড়বড়ে ঘরে প্র্যাকটিস করতো। তাদের জীবন, ছেলেমেয়ে ও অর্থ সবকিছু নিরাপত্তার জন্য ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হতো। অন্য হিন্দুরা ছিল কৃষক, কামার, জেলে, তাঁতি এবং এরা সবাই নিুবর্ণের হিন্দু ছিল।

    বর্তমানে কলকাতায় অবস্থানরত একজন ফেরারী মধ্যবিত্ত হলেন চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার ডিজাইন সেন্টারের প্রধান। তিনি নিশ্চিত যে ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্য ছিল দুই ধর্মের মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলন শেষ করে দেয়া, পুরোপুরি রাজনৈতিক একটি ব্যাপারকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা এবং ভারতীয় মুসলমানদের ওপর পাল্টা আঘাত হানাকে উসকে দেয়া। এধরনের ভারত-পাকিস্তান সংঘাত সৃষ্টি হতে দেখে বিশ্বের হয়তো সামরিক শাসনের প্রকৃত নিপীড়নমূলক ভূমিকা থেকে দৃষ্টি সরে যাবে।

    এই পরিকল্পনা হয়তো ভালোভাবে বাস্তবায়িত হতো যদি না হিন্দু উদ্বাস্তুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে নিঃশেষ না হয়ে যেতো। এরপরও ভারতীয় সীমান্ত-শহর বারাসাত ও বসিরহাটে কিছু সাম্প্রদায়িক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। পুলিশের একটি শক্তিশালি দল হিন্দু উদ্বাস্তুদের নিবৃত্ত করতে পেরেছিল। তারা বর্শা, ছুরি, লাঠি হাতে মুর্শিদাবাদ থেকে এখানকার মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করতে এসেছিল। একজন উদ্বাস্তু বলল, “শান্তি-কমিটির লোকজন আমাদের বলেছে ভারতে চলে যেতে কারণ এখানেই নাকি আমাদের সবার জন্য খাদ্য ও জমি আছে। এখন আমরা এখানে মুসলমানদের পাকিস্তানে চলে যেতে বলব”।

    এরমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বের শহর সিলেটে হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়িগুলো স্থানীয় মুসলমানরা ন্যূনতম মূল্যে নিলামে তুলেছে। এমনকি ঢাকায় পরিত্যক্ত বাড়িগুলো বণ্টনের একটি আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন হয়েছে। ইয়াহিয়া খানের সরকারের প্রতি আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে ধানী জমি বণ্টন করা হয়েছে। এপরিস্থিতিতে নিরাপদে দেশে ফিরে যাবার জন্য ইয়াহিয়ার প্রস্তাব উদ্বাস্তুদের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন।

    হাসান মনে করেন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম দালালরা বাঙালি নয়। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রি নূরুল আমিন পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোর গুরুত্বপূর্ণ অনুসারী। কিন্তু তিনিও সামরিক শাসকদের অধীনে পুতুল সরকারের প্রধান হতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এই প্রত্যাখান অন্তঃত একটি ভুয়া গণতান্ত্রিক সরকারের সম্ভাবনাও নাকচ করে দেয় এবং সামরিক শাসন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ইয়াহিয়া খানের শাসনের প্রতি কেবল মুসলিম লীগ (যারা সবসময় সামরিক শাসনকে সমর্থন করে এসেছে) এবং কট্টর ইসলামী দল জামায়াত-ই-ইসলামী ও নিজামী-ই-ইসলাম-এর লোকজনের আনুগত্য আছে। একত্রে তারা সারা দেশের ১৯ শতাংশেরও কম। তাদের মধ্যে মাত্র শতকরা পাঁচ জন বাঙালি। বাকিরা হলো বিহারি মুসলমান — যারা দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিল এবং পাঞ্জাবী — অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য যারা পূর্ব-পাকিস্তানে গিয়েছিল।

    এরকম কিছু ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায় যেখানে বাঙালি মুসলমান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হিন্দুদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এধরনের বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ফিরে যাবার জন্য খুব কমই আশা জাগায়। আমি বিশ্বাস করতে প্রস্তুত আছি যে শেখ মুজিব সাড়ে ছয় কোটি মুসলমান ও এক কোটি হিন্দুদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব ও উদারতার কারণে হিন্দু জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিল। প্রাদেশিক পরিষদের জন্য আওয়ামী লীগের টিকেটে এগারো জন হিন্দু নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে-পরিষদ অবশ্য সামরিক শাসকরা বাস্তবায়িত হতে দেয় নি।

    পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমাঞ্চলের জেলা পাবনার জেলাপ্রশাসক আমাকে যা বললেন হিন্দুদের জন্য তা এরচাইতেও আশাপ্রদ ব্যাপার ছিল। জেলাপ্রশাসকের নাম নূরুল কাদের, তিনি কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের অর্থনীতির গ্র্যাজুয়েট। ডিসেম্বরের নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে তিনি এক হিন্দুর কিছু জমিজমা বিক্রির ব্যাপারে কাজ করছিলেন। লোকটি পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে যেতে চাইছিল। কিন্তু যখন শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করলেন তখন লোকটি দেশে থেকে যেতে চাইলো এবং কেমব্রিজের তরুণটি এখন নির্বাসিত বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি সচিবলায় সংগঠিত করার জন্য কাজ করছেন। কিন্তু এই সরকারের একটি জাতীয় পরিচয় ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু এই সরকারের কোনো নেতার শেখ মুজিবের মতো কারিশমা নেই। কিন্তু কাদের মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে পুনরায় মতৈক্যের কোনো সম্ভাবনা নেই। হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ গভীর দাগ ফেলে গেছে। আর এইসব অপরাধের সঙ্গে ব্যাপকমাত্রায় যুক্ত হয়েছে যৌন হয়রানির ঘটনা। কাদের জানালেন যে, এমনকি উচ্চমধ্যবিত্তের মেয়েদের ক্যান্টনমেন্টের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

    একজন দাড়িওয়ালা ট্রাভেল-এজেন্ট যুবক, যিনি তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন, তিনি জানালেন, “সেনাবাহিনীর আক্রমণের পূর্বে মাত্র ১৫ শতাংশ লোক স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছিল। এখন মাত্র ১৫ শতাংশ পশ্চিম-পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো প্রকার যৌথতার ব্যাপারে সায় দেবে”। কিন্তু যদি একত্রিত পাকিস্তানের আর কোনো সম্ভাবনা না থাকে, পূর্ব বাংলার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অনেক সময় লাগবে। প্রথম প্রতিরোধ শক্ত হাতে দমন করা হয়েছে। প্রথম প্রতিরোধটি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, বিচ্ছিন্ন এবং কেবল আবেগগত তাড়না থেকে পরিচালিত হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত টেকে নি। এতে অনেক ভুল ছিল; এটা ছিল অতিমাত্রায় আশাবাদযুক্ত। বাঙালিরা ভেবেছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অভ্যস্ত পরোক্ষ অবাধ্যতার মাধ্যমেই পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কঠোর সৈন্য ও নিষ্ঠুর অফিসারদের মোকাবেলা করবে।

    দ্বিতীয় পর্বের প্রতিরোধ এখন শুরু হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস্ ও পুলিশ বাহিনীর ২০,০০০ সৈনিক একক নেতৃত্বের অধীনে কাজ করছে। ৮,০০০ কিশোর-তরুণ গেরিলা যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নিচ্ছে। দালালদের শেষ করার জন্য কিলার স্কোয়াড গঠিত হয়েছে। একজন বাংলাদেশী নেতা আমাকে বললেন তিনি সাফল্যের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ “যদি আমরা আমাদের জন্য কাজ করি’’। এর মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানের জন্য কোনো বিদেশী সাহায্যের জন্য অস্বীকৃতি জানালেন। বর্তমানে পূর্বাংশে চার ডিভিশন পাকিস্তানি সৈন্যর জন্য প্রতিদিন এক কোটি রুপি ব্যয় হচ্ছে। পাকিস্তানের জন্য অর্থনৈতিক চাপ নিঃসন্দেহে পাকিস্তানী সৈন্যদের জোর কমিয়ে দেবে, কারণ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ২,৫০০ মাইল পাড়ি দিয়ে সৈন্যদের জন্য ৩০০ টনের সরবরাহ প্রতিদিন আনতে হচ্ছে।

    বাংলাদেশের আন্দোলনকারীরা একটু আশাবাদী হতে পারে এজন্য যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কেবল পূর্ব পাকিস্তানে আর সীমাবদ্ধ নেই, পশ্চিম পাকিস্তানেও ছড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বিশিষ্ট পাঠান-নেতা ওয়ালি খানের কথা উল্লেখ করা যায়। মি. ভুট্টো সেনাবাহিনীকে বলছেন রাজনৈতিক সমস্যা রাজনীতিবিদদের সমাধান করতে হবে এবং তিনি শিগগীরই ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলে আসছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের কুখ্যাত ২১ ধনী পরিবারের লোকজন ঠিকই বুঝতে পারছে পূর্ব পাকিস্তানের বাজার হারিয়ে ফেললে কী বিপদ হবে। ইয়াহিয়া খান এখন বুঝতে পারছেন, পশ্চিমের প্রভাবশালী লোকজন এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে পূর্বের যেকোনো সময়ের মতো কঠোর হয়ে উঠবে। রাষ্ট্রপতি হয়তো দমননীতির চূড়ান্ত পর্যায় পার হয়ে এসেছেন। ঢাকায় উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তি একসময় যে-সমাধানের কথা বলেছিল, ইয়াহিয়ার কার্যকলাপ দেখে মনে হচ্ছে তিনি সেদিকেই যাচ্ছেন। কিন্তু ব্যাপার হলো ঢাকা এখন আর সেকথা শুনবে না।

    কিন্তু একদিন যদি বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়ও, পাকিস্তান সেনাবাহিনী-সৃষ্ট সফল সাম্প্রদায়িক পারিস্থিতি ও বাঙালি হিন্দুদের ব্যাপকমাত্রায় প্রস্থান, বাংলাদেশকে একটি কেবল মুসলমানের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। এমনকি এখনকার তাজউদ্দীনের মন্ত্রিসভায় কোনো হিন্দু সদস্য নেই। এবং বাংলাদেশের জন্য ভারতীয়দের ব্যাপক সহানুভূতি সত্ত্বেও, এটা একটা দুঃখজনক ব্যাপার যে যেসব হিন্দু কয়েক বছর আগে ভারতে বসতিস্থাপনের জন্য গিয়েছিল তারা বাংলাদেশের জন্য কোনোরকম সহযোগিতা প্রদানের বিরোধী।

    সম্পাদকীয়: হত্যা বন্ধ কর

    দি সানডে টাইমস, ১৩ জুন, ১৯৭১

    অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

    পূর্ব-পাকিস্তান সম্পর্কিত একটি আর্টিকেলের জন্য মধ্য-পাতার পুরোটা ব্যয় করে সানডে টাইমস একটি ব্যতিক্রমী ও দায়িত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরাই প্রথম এটি করেছি, কারণ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তার প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানে কী করছে, এটি ছিল তার ওপরে পূর্ণমাত্রায় বিশ্বাসযোগ্য, বি¯তৃত এবং প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট। দ্বিতীয়ত, মিলিয়ন মিলিয়ন উদ্বাস্তু কী থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, সে-সম্পর্কে সংবাদটি নিজেই এমন এত ভয়াবহ বর্ণনা দিচ্ছে যে, এসম্পর্কে বিস্তারিত বলা প্রয়োজন। সানডে টাইমস্ রিপোর্টটির যথার্থতার ব্যাপারটি যতদূর সম্ভব খতিয়ে দেখেছে। কিন্তু যেকোনো ক্ষেত্রেই আমাদের প্রতিবেদকদের ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। তিনি এই সংবাদটি বিশ্ববাসীকে জানাবার জন্য পাকিস্তানে নিজের ক্যারিয়ার ও ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন।

    গত শরতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সমাপ্তি ঘোষণা করতে চাওয়ার পরেই যে কেবল বর্তমান সংকট শুরু হয়েছে তা নয়। সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাঙ্গা হয়ে ওঠে, কিন্তু নির্বাচনের পর তাকে নিষ্ঠুর হাতে দমন করা হয়। কিন্তু তার অনেক পূর্বে ১৯৪৭ সালে দু’টি অসম অংশ নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে এই অনৈক্য ও অসাম্যের বীজ রোপিত হয়। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জনগোষ্ঠী, সঙ্গতকারণেই, নিজেদের এমন একটি দেশে বৈষম্যের শিকার বলে নিজেদের খুঁজে পেয়েছে, যে-দেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদানই বেশি। এছাড়া বর্তমানের রক্তপাত ও উৎপীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে অবাঙালিদের বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্য বাঙালিদেরও কিছু দায়িত্ব স্বীকার করতে হবে। আমাদের সংবাদটি সে-বিষয়টিও স্পষ্ট করেছে।

    কিন্তু এসবকিছু বলার পরও, পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে যে পরিকল্পিত, স্বেচ্ছাকৃত নিষ্ঠুর আক্রমণের অভিযোগ রয়েছে, তা কিছুতেই এড়ানো যাবে না। একটি বেসামরিক শাসনব্যবস্থা ও স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ফিরে যাবার কথা ইয়াহিয়া যখন বলেন তখন সেটা তিনি হয়ত সত্যিকার ভাবনা থেকেই বলেন। কিন্তু পাকিস্তানে এপর্যন্ত যা ঘটেছে তারপর কীভাবে পাকিস্তানি সরকার বাঙালি নেতাদের বোঝাতে সক্ষম হবেন যে তারা পরস্পরের ভাই এবং একই জাতিতে অন্তর্ভুক্ত। সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারের প্রতি বাঙালিদের আনুগত্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এবং পশ্চিম-দেশসমূহের কাছে পাকিস্তানী সরকার যে-সাহায্যের আবেদন করেছে, তা যদি অনুমোদিত হয় তা হলে সেই সাহায্যের অর্থ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনীর চলমান অভিযানেই কাজে লাগানো হবে। অবশ্য সাহায্য বন্ধ করে দিলেও পাকিস্তানে বাড়তি মানবীয় ভোগান্তি বেড়ে যাবে।

    পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য, ব্রিটেন যার অন্তর্ভুক্ত, সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক ফর্মুলা হলো সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রত্যাহারের মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য ইয়াহিয়া বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং সেসব ক্ষেত্রে দাতারা সাহায্য বরাদ্দ করবে। অবশ্য পূর্ব-পাকিস্তানে ত্রাণকার্যে জাতিসংঘ ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী ত্রাণসংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রণ আনতে চাইলেও এই সত্য অস্বীকার করা যাবে না যে পাকিস্তান একটি স্বাধীন দেশ এবং সে যা না-করতে চাইবে, অন্য কেউ তা তাকে দিয়ে করাতে পারবে না। সবচেয়ে ভালো ও একমাত্র রক্ষাকবচ হলো পাকিস্তান-সরকারের কার্যকলাপের ওপর প্রচার চালিয়ে যাওয়া এবং এই আশা করা যে বিশ্ববিবেকের মতামতের চাপ অবশেষে কোনো প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে।

    পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত তা বলা শক্ত। কিন্তু যাই হোক না কেন, এটা অপ্রত্যাশিত যে ভারতে বিরাটসংখ্যক উদ্বাস্তু রয়েছে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই হিন্দু এবং যারা আর পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেতে চায় না। যুদ্ধ ও সহিংসতার এই সময়ে একটা জিনিস খুব স্পষ্ট যে ইয়াহিয়া খান একটি বিরাট ভুল করেছেন এবং এর ভয়াবহ ফলাফল এশিয়া এবং বিশ্বে নতুন করে অস্থিতিশীলতার নতুন একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে; যার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য-সমস্যার মতো জাতিগত ও স্থানিক উপাদান জড়িত রয়েছে। এবং ভবিষ্যতে এখানকার অধিবাসীদের আরও অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হবে।

    উত্তাপ থেকে বেরিয়ে আসা সত্যবক্তা

    এন্থনি মাসকারেনহাস
    দি টাইমস, ১৩ই জুন, ১৯৭১(?)

    অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

    এন্থনি মাসকারেনহাসকে গ্রানাডা টেলিভিশন (পত্রিকাগুলো এনামেই ডাকে) গত সপ্তাহে সাহসী সাংবাদিকতার জন্য বিশেষ পুরস্কার প্রদান করেছে। করাচির একটি পত্রিকার সহকারী সম্পাদক এবং সানডে টাইমসের প্রতিনিধি মাসকারেনহাস পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে রিপোর্ট লিখেছেন। তিনি জানতেন তিনি যা দেখেছিলেন তা তার দেশে ছাপানোর অনুমতি পাওয়া যাবে না। তিনি ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে আসেন এবং সানডে টাইমসে যে রিপোর্ট লেখেন, তা পূর্ব পাকস্তানে কী হচ্ছে সে-সম্পর্কে বিশ্ববাসীর ধারণা পাল্টে দেয়।

    স্থান: কুমিল্লা সার্কিট হাউস, পূর্ব পাকিস্তান।
    তারিখ: এপ্রিল ১৯, ১৯৭১।
    সময়: সন্ধ্যা ৬.১৮।

    এটা হলো সেই মুহূর্ত যা আমার জীবন পরিবর্তন করে দিল। কারফিউ ছয়টার সময়ে শেষ হয়েছে। কয়েক মিনিট আগে আমি সেবাস্টিয়ান এবং তার চারজন সহযোগীকে রাস্তা দিয়ে স্থানীয় সামরিক আইন প্রশাসক পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মেজর আগার অফিসে আসতে দেখলাম। পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টরের পেছনে তারা আসলো, তাদের হাত ও পা একটি দড়িতে আলগা করে বাঁধা। তাদের পরনে যে-ইউনিফর্ম পরা ছিল তা নতুন বলেই মনে হলো।

    আমি সেই সাব-ইন্সপেক্টরকে স্মরণ করতে পারি। সে-সকালে মেজর আগার অফিসে নারিকেলের দুধ খেতে খেতে তিনি লক-আপে আটকে রাখা বন্দিদের তালিকা দেখালেন। তিনি তার গ্লাস পাশে সরিয়ে রাখলেন। এরপর চারটি নামের পাশে টিক চিহ্ন দিলেন। তিনি বললেন, “এই চারজনকে নিকেশ করার জন্য আনেন”। এরপর তিনি আবার তার তালিকার দিকে তাকালেন। আবার পেন্সিল দিয়ে খোঁচা দিলেন। “এবং এই চোরকে তাদের সঙ্গে আনেন”। আমাকে জানানো হলো ‘চোর’টি হলো সেবাস্টিয়ান নামের একজন যে তার হিন্দু বন্ধুর জিনিসপত্র নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবার সময় ধরা পড়ে। এখন কারিফউয়ের পরে আমাকে জানতে হলো নিকেশ করার অর্থ কী। হঠাৎ আমি মারধরের শব্দ শুনলাম এবং এরপর চিৎকার শুনলাম। আরও জোর-আঘাতের শব্দ এবং আরও বিকট চিৎকার শুনলাম। আমি ব্যালকনির শেষ প্রান্তে ছুটে গেলাম কী হচ্ছে তা দেখার জন্য। যখন আপনি দেখবেন মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, সেই দৃশ্য এবং সেই শব্দ আপনি আপনার স্মৃতি থেকে কোনোদিনই মুছতে পারবেন না।

    আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি চিৎকার করতে চাইলাম কিন্তু কোনো শব্দ মুখ থেকে বেরুলো না। তার পরিবর্তে আমি আমার মাথা ও বুকে বিরাট ভার অনুভব করলাম। অসহায়ভাবে আমি চারিদিকে তাকালাম সাহায্যের জন্য। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে-গণহত্যা চালাচ্ছে, তার মুখোমুখি আমি এই প্রথম হলাম, তা নয়। কিন্তু এই প্রথম আমি এতো নিষ্ঠুর কিছু দেখলাম। আমি জানালার পাশের একটি নিচু চেয়ারে বসে পড়লাম এবং মানুষগুলোর চিৎকারের দৃশ্য আর দেখতে চাচ্ছিলাম না। এরপর বিষণ্ণভাবে দেখলাম লেক পার হয়ে অনেকগুলো বাদুড় আমার জানালার দিকে আসছে। তাদের দেখতে ভ্যাম্পায়ারের মতো লাগছিল, কিন্তু তারা আসলে খাদ্যসন্ধানী ‘উড়ন্ত শৃগাল’। মনে পড়ে, আমি নিজেকে বললাম, “সত্যিকারের ভ্যাম্পায়াররা তো নিচের তলায়”।

    আমি হিটলার সম্পর্কে যা কিছু পড়েছি, তার চাইতে ভয়াবহ কিছু প্রত্যক্ষ করলাম― এবং আমাদের নিজেদের মধ্যেই এসব ঘটছিল। আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমার ভাগ্যে যাই ঘটুক না কেন, এই সত্য আমি সবাইকে জানাবো। কিন্তু আমি যা দেখলাম তা হলো, অন্য সৈন্যরা বন্দুক হাতে পুরো ঘটনাবলী দেখছিল এবং অন্যরা নিরবে রাতের খাবার তৈরি করছিল। আমি জানতাম কোনো আশাই কোথাও নেই। আমি হতাশ হয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম এবং খালি ব্যালকনির অপর প্রান্তে আমার রুমে ফিরে আসলাম। আমি আমার জীবনের দীর্ঘতম রাতে জেগে জেগে ঠিক করালাম পরের দিন থেকে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে, যতটুকু সম্ভব দেখতে ও শুনতে হবে এবং বিস্তারিতভাবে আমার নিজস্ব সাঁটলিপি পদ্ধতিতে লিখে রাখতে হবে যাতে কেউ তা বুঝতে না পারে। এভাবে আমি হাজীগঞ্জের হত্যা ও পোড়ানোর দৃশ্য ও কোনো মানুষকে খুঁজে না পাওয়া, অফিসার্স মেসে ‘টপ স্কোর’-এর প্রতিযোগিতা, এবং ১৬ ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে লক্ষ্যের প্রকারভেদ সম্পর্কে আমাকে দেয়া সংজ্ঞা প্রভৃতি জিনিস লিপিবিদ্ধ করি।

    আমি করাচিতে ২৫ এপ্রিল এসব নোট নিয়ে ফিরে যাই এবং বাড়ি পৌঁছি ভোর সাড়ে তিনটায়। সেদিন ছিল আমার স্ত্রীর জন্মদিন। সে তার কানের দুলের জন্য গোলাপী মুক্তো চেয়েছিল, কিন্তু আমি তার জন্য সে-উপহার না নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিরলাম যা ছিল আমার পরিবারের জন্য বিরাট পরিবর্তনের একটা ব্যাপার। যতক্ষণ না পাচকটি এসে ব্রেকফাস্ট তৈরি করল, স্ত্রী ইভন ও বড়ো দুই ছেলে অ্যালান ও কিথের সঙ্গে আলোচনা করলাম। আমি তাদের বললাম আমি কী দেখেছি এবং কী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইভন হতবিহ্বল হয়ে পড়লো। এই সিদ্ধান্তের ফল কী হবে তা তার চাইতে আর কেইবা ভালো বুঝবে। এর ফলে আমাদের সবকিছু পরিত্যাগ করতে হবে, কারণ সামরিক শাসনের পরিস্থিতিতে আমরা কোনো সুযোগই পাবো না। এর অর্থ আমাদের মাথার ওপরের ছাদ, আয়, অর্জিত সম্পদ, সঞ্চয় দ্বারা ক্রয়কৃত বাড়ি করার জন্য জমি― কিছুই থাকবে না। একসময় কিথ বলল, “অবশ্যই আমরা তোমার সঙ্গে যাবো। তুমি অবশ্যই সবকিছু লিখবে”।

    তারা সবাই আমার দিকে তাকালো, সম্ভবত প্রথমবারের মতো আমার চোখে গভীর একাকীত্ব তারা দেখতে পেল। আমরা একসঙ্গে কেঁদে উঠলাম, পরস্পরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। এটা ছিল সামনের ভয়াবহ দিনগুলোর ও পরবর্তী মাসগুলোতে লন্ডনে নতুন জীবন শুরু করার পারস্পরিক আশ্বাস। আমাদের গোপন সিদ্ধান্তের কথা অন্য কেউ জানতো না। আমরা আমাদের আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধব কাউকেই এর মধ্যে জড়াতে চাইনি, বলা যায়, এভাবে বিপদকে এড়াতেই চেয়েছি। আমি লন্ডনে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এটা দেখতে যে সানডে টাইমস সংবাদটি ছাপে কি না। অভিজ্ঞ সাংবাদিক হিসেবে আমার বিশ্বাস ছিল যে, একজন পৃথিবীর সেরা সংবাদকাহিনী নিয়ে ফ্লিট-স্ট্রিটের ভবনগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু ছাপানোর জন্য কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না, তা হতে পারে না। এরপর আমি পত্রিকার জন্য লেখা শুরু করলাম।

    সানডে টাইমসের আমার কথা শুনল, সবকিছু গ্রহণ করল এবং আমি থমসন হাউসে প্রবেশ করার চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই আমি পাকিস্তানে গিয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত হলাম। সংবাদকাহিনীটি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গৃহীত হয় এবং সেখানে সাংবাদিকসুলভ সেই প্রবৃত্তি ও সততার পরিচয় পেয়ে এখন পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে রয়েছি।

    পাকিস্তান থেকে বের হয়ে আসাটাই তখন বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। বহিরাগমণের অনুমতি নিতে হবে। যত নিরবে পারলাম, গুছিয়ে নিলাম। কারণ গোপনীয়তা রক্ষা করতেই হবে। সৌভাগ্যক্রমে আমি লন্ডন থেকে হোটেলের কিছু কাগজপত্র নিয়ে এসেছিলাম। আমি সেটা ব্যবহার করে তার ওপরে মিলান-প্রবাসী আমার স্ত্রীর একমাত্র ভাইয়ের (যিনি একজন বিখ্যাত ফ্যাশনডিজাইনার) পক্ষ থেকে তার বিয়েতে সপরিবারে যাবার আমন্ত্রণপত্র লিখলাম, তাতে তার ভাইয়ের সইও দিলাম। পুরো পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় ভ্রমণবিষয়ক কাগজপত্র সেই চিঠির মাধ্যমে পাওয়া গেল। বাইরে থেকে এইমাত্র ঘুরে আসার কারণে আমি সেই ‘বিবাহঅনুষ্ঠান’-এ যেতে অস্বীকৃতি জানালাম।

    এরপর আমি সানডে টাইমসে একটি টেলিগ্রাম পাঠালাম: “রফতানির প্রক্রিয়া সমাপ্ত। সোমবারে শিপমেন্ট শুরু হচ্ছে”। সেমতে ৭ জুন, সোমবারে আমি আমার পরিবারকে রোমগামী প্যান-আমেরিকান ফ্লাইটে তুলে দিলাম এবং নিজে লাহোর ও রাওয়ালাপিন্ডিগামী অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে রওয়ানা দিলাম। আমি সেখান থেকে আফগানিস্তানের পেশওয়ার বা কাবুলগামী বিমান ধরার জন্য এই রুটের আশ্রয় নিলাম কারণ উভয় দেশের ঐ দু’টি করে স্থানে পাকিস্তানি ও আফগানদের জন্য যাওয়া-আসা উম্মুক্ত ছিল। এটা একটা দুঃস্বপ্নের যাত্রা ছিল। বিমানে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন যারা আমাকে ভালোভাবে চিনতেন। তারা যদি সামন্যতম সন্দেহও করতেন তবে আমি গ্রেফতার হতাম। আমি কোনোক্রমে তাদের সঙ্গে আলাপ করে গেলাম এবং প্রতিশ্র“তি দিলাম তাদের সঙ্গে পরের দিন লাঞ্চ করব। রাওয়ালাপিন্ডিতে গিয়ে দেখলাম পেশওয়ারের ফ্লাইট পুরোপুরি বুকড্ হয়ে গেছে। সে-পর্যায়ে আমি যদি ধরা পড়তাম তবে সব ভেস্তে যেত। ফিরে আসার কোনো উপায় ছিল না।

    সুতরাং আমি ঠিক করেছিলাম আমাকে বলিষ্ঠভাবে চলাফেরা করতে হবে এবং সেখানে একজন আকর্ষণীয় পাঞ্জাবী তরুণী সাহায্য করেছিল। সে প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে বসে ছিল এবং আমাকে দেখছিল। একজন বিমান কর্মকর্তার হাতে একশ’ রুপির একটি নোট গুঁজে দিয়ে মেয়েটির দিকে ইশারা করে চোখ টিপে গোপনভঙ্গীতে বললাম, “আমার একটি সিট দরকার। আমি মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে কিছু মজা করার জন্য কাবুলে যাচ্ছি।” এধরনের কাজ করা থেকে পৃথিবীর কেউই আমাকে আটকে রাখতে পারত না। আমি নিশ্চিত আর কোনো কায়দাই কাজে আসতো না। কর্মকর্তাটি আরেকজন লোককে চোরাচালানের সন্দেহে আটকে দিল এবং আমার জন্য একটি সিট যোগাড় করে দিল। আমার উষ্ণভাবে করমর্দন করলাম এবং পেশওয়ার ও কাবুল হয়ে সানডে টাইমসে আমার দেয়া সময় রক্ষা করতে রওয়ানা হলাম। যে-অচেনা মেয়েটি আমার জীবন রক্ষা করল তাকে ধন্যবাদ দেবার কোনো সুযোগ আমি পাই নি। সে আরেকজন মহিলার সঙ্গে সামনের দিকে বসেছিল। কিন্তু যখন আমরা আফগানিস্তানের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করলাম তখন তার উদ্দেশ্যে মনে মনে শ্যাম্পেন দিয়ে উইশ করলাম।

    গণহত্যা : এ্যান্থনি মাসকারেনহাস

    Genocide_Mascarenhas

    দি সানডে টাইমস, ১৩ জুন ১৯৭১

    অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

    পাঁচ মিলিয়ন লোক বাস্তুভিটা ছেড়ে কেন পালিয়ে গেছে সে মর্মান্তিক কাহিনী নিয়ে পাকিস্তান থেকে এসেছেন সানডে টাইমসের রিপোর্টার।

    মার্চের শেষ থেকে পাকাসেনারা পরিকল্পিতভাবে হাজার হাজার লোককে হত্যা করে চলেছে। মার্চের শেষ থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সংবাদ-ধামাচাপা-দেয়ার পেছনের মর্মান্তিক কাহিনী হলো এই। কলেরা আর দুর্ভিক্ষ নিয়েও ৫০ লক্ষ লোকের পূর্ব পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে ভারতে চলে আসার এই হলো কারণ।

    সানডে টাইমসের পাকিস্তান-প্রতিনিধি অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস এই প্রথামবারের মতো নিরবতার পর্দা উন্মোচন করলেন। তিনি সেখানে পাকসেনাদের কীর্তিকলাপ দেখেছেন। তিনি পাকিস্তান ছেড়ে এসেছেন বিশ্ববাসীকে সেসব জানানোর জন্য। সেনাবাহিনী শুধু স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশ ধারণার সমর্থকদেরই হত্যা করছে না। স্বেচ্ছাকৃতভাবে খুন করা হচ্ছে হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান সবাইকে। হিন্দুদের গুলি করে বা পিটিয়ে মারা হচ্ছে তারা কেবল হিন্দু বলেই। জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের রিপোর্টের পেছনেও রয়েছে একটি দারুণ গল্প।

    মার্চের শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তানে দুই ডিভিশন পাকসেনা গোপনে পাঠানো হয় বিদ্রোহীদের ‘খুঁজে বের করা’র জন্য। কিন্তু দু-সপ্তাহ পরে পাকিস্তান সরকার আটজন পাকিস্তানী সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানায় পূর্ব পাকিস্তানে উড়ে যাবার জন্য। সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সাংবাদিকদের প্রভাবিত করে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে এই ধারণা দেয়াই এর উদ্দেশ্য ছিল যে, দেশের পূর্বাংশে ‘সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে’। সাতজন সাংবাদিক তাদের কথামতো কাজ করেছেন। কিন্তু তা করেননি একজন — তিনি হলেন করাচির মর্নিং নিউজ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ও সানডে টাইমসের পাকিস্তান-প্রতিনিধি অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস।

    ১৮ মে মঙ্গলবার তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে এসে হাজির হন লন্ডস্থ দি সানডে টাইমসের কার্যালয়ে। আমাদের জানালেন, পূর্ব বাংলা ছেড়ে ৫০ লক্ষ লোককে কেন চলে যেতে হয়েছে তার পেছনের কাহিনী। তিনি সোজাসাপ্টভাবে জানালেন এই কাহিনী। এই কাহিনী লেখার পর তার পক্ষে আর করাচি ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। তিনি জানালেন তিনি পাকিস্তানে আর ফিরে না-যাবার ব্যাপারে মনস্থির করেছেন; এজন্য তাকে তার বাড়ি, তার সম্পত্তি, এবং পাকিস্তানের সবচেয়ে সম্মানীয় একজন সাংবাদিকের মর্যাদার মায়া ত্যাগ করতে হবে। তার মাত্র একটি শর্ত ছিল: পাকিস্তানে গিয়ে তার স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তানকে নিয়ে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা যেন তার রিপোর্ট প্রকাশ না করি।

    সানডে টাইমস রাজি হয় এবং তিনি পাকিস্তানে ফিরে যান। দশ দিন অপেক্ষা করার পর সানডে টাইমসের এক নির্বাহীর ব্যক্তিগত ঠিকানায় একটি বৈদেশিক তারবার্তা আসে। তাতে লেখা ছিল, ‘আসার প্রস্তুতি সম্পন্ন, সোমবার জাহাজ ছাড়বে।’ দেশত্যাগ করার ব্যাপারে স্ত্রী ও সন্তানদের অনুমতি পেতে ম্যাসকারেনহাস সফল হন। তার দেশত্যাগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে তিনি কোনোরকমে একটা রাস্তা পেয়ে যান। পাকিস্তানের ভেতরে যাত্রার শেষ পর্যায়ে তিনি প্লেনে একজন তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাকে দেখতে পান যাকে তিনি ভালোমতোই চিনতেন। এয়ারপোর্ট থেকে একটি ফোনকল তাকে গ্রেফতার করার জন্য যথেষ্ট ছিল। তবে কোনো ফোনকল হয়নি এবং তিনি মঙ্গলবার লন্ডনে এসে পৌঁছান।

    পূর্ব পাকিস্তানে ম্যাসকারেনহাস বিশেষ কর্তৃত্ব ও নিরপেক্ষতা সহকারে যা দেখেছেন তা লিখেছেন। তিনি গোয়ার একজন ভদ্র খ্রিস্টান, তিনি হিন্দু বা মুসলমান কোনোটাই নন। জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন পাকিস্তানে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের উদ্ভবের পর থেকেই তিনি পাকিস্তানের পাসপোর্টধারী। তখন থেকে তিনি পাকিস্তানের অনেক নেতার আস্থা অর্জন করেছেন এবং এই রিপোর্ট লিখছেন সত্যিকারের ব্যক্তিগত দুঃখবোধ থেকে।

    তিনি আমাদের কাছে বলেন, ‘তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আমাদের জানান সেনাবাহিনী যে বিরাট দেশপ্রেমের কাজ করছে, ব্যাপারটা সেভাবে উপস্থাপন করতে।’ তিনি তার প্রতিবেদনের জন্য যা দেখেছেন এবং রিপোর্ট করেছেন সে-সম্পর্কে কোন সন্দেহই থাকতে পারে না । তাকে একটি রিপোর্ট লেখার অনুমতি দেয়া হয় যা সানডে টাইমসে ২ মে প্রকাশিত হয়। রিপোর্টটিতে কেবল মার্চ ২৫/২৬-এর ঘটনার বিবরণ ছিল, যখন বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে এবং অবাঙালিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এমনকি দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার প্রসঙ্গ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ সেন্সর করেছিল। এ-ব্যাপারটিই তার নীতিবোধকে পীড়া দিচ্ছিল। কিছুদিন পরে, তার ভাষায়, তিনি স্থির করলেন যে, “হয় যা দেখেছি তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিখবো, নয়তো লেখাই বন্ধ করে দেবো; নইলে সততার সঙ্গে আর লেখা যাবে না।” তাই তিনি প্লেনে চেপেছেন এবং লন্ডন চলে এসেছেন।

    পূর্ব বাংলা থেকে আসা শরণার্থী ও নিরপেক্ষ কূটনীতিবিদদের মধ্যে যাদের এসব ঘটনা সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা রয়েছে তাদের দ্বারা তার প্রতিবেদন আমরা বিস্তৃতভাবে যাচাই করতে সমর্থ হয়েছি।

    শরণার্থীরা কেন পালিয়েছে: সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যাবার পরের বিভীষিকার প্রথম প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা

    আবদুল বারী ভাগ্যের ভরসায় দৌড় দিয়েছিল। পূর্ব বাংলার আরো হাজার মানুষের মতো সেও একটা ভুল করে ফেলেছিলো — সাংঘাতিক ভুল –ও দৌড়াচ্ছিলো পাকসেনাদের একটি টহল-সেনাদলের দৃষ্টিসীমার মধ্যে। পাকসেনারা ঘিরে দাঁড়িয়েছে এই চব্বিশ বছরের সামান্য লোককে। নিশ্চিত গুলির মুখে সে থরথরিয়ে কাঁপে। “কেউ যখন দৌড়ে পালায় তাকে আমরা সাধারণত খুন করে ফেলি”, ৯ম ডিভিশনের জি-২ অপারেশনস-এর মেজর রাঠোর আমাকে মজা করে বলেন। কুমিল্লার বিশ মাইল দক্ষিণে মুজাফরগঞ্জ নামে ছোট্ট একটা গ্রামে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। “ওকে আমরা চেক করছি কেবল আপনার খাতিরে। আপনি এখানে নতুন এসেছেন, এছাড়া আপনার পেটের পীড়া রয়েছে।”
    “ওকে খুন করতে কেন?” উদ্বেগের সঙ্গে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম।
    “কারণ হয় ও হিন্দু, নয়তো বিদ্রোহী, মনে হয় ছাত্র কিংবা আওয়ামী লীগার । ওদের যে খুজছি তা ওরা ভালমতো জানে এবং দৌড়ের মাধ্যমে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে।”
    “কিন্তু তুমি ওদের খুন করছো কেন? হিন্দুদেরই বা খুঁজছ কেন?” আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম । রাঠোর তীব্র কন্ঠে বলেন: “আমি তোমাকে অবশ্যই মনে করিয়ে দিতে চাই, তারা পাকিস্তান ধ্বংস করার কী রকম চেষ্টা করেছে। এখন যুদ্ধের সুযোগে ওদের শেষ করে দেয়ার চমৎকার সুযোগ পেয়েছি।”
    “অবশ্য,” তিনি তাড়াতাড়ি যোগ করেন, “আমরা শুধু হিন্দুদেরই মারছি। আমরা সৈনিক, বিদ্রোহীদের মতো কাপুরুষ নই। তারা আমাদের রমণী ও শিশুদের খুন করেছে।”

    পূর্ব বাংলার শ্যামল ভূমির ওপর ছড়িয়ে দেয়া রক্তের কলঙ্কচিহ্নগুলি আমার চেখে একে একে ধরা পড়ছিল। প্রথমে ব্যাপারটা ছিল বাঙালিদের প্রতি বন্য আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অবাঙালিদের হত্যা। এখন এই গণহত্যা ঘটানো হচ্ছে পাকসেনাদের দ্বারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে। এই সুসংগঠিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হিন্দুরাই শুধু নয়, যারা সাড়ে ৭ কোটি জনসংখ্যার ১০ শতাংশ, বরং হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানরাও। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র, শিক্ষক, আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যসহ সবাই এর মধ্যে রয়েছে। এমন কি ১৭৬,০০০ জন বাঙালি সৈনিক ও পুলিশ যারা ২৬শে মার্চে অসময়োপযোগী ও দুর্বল-সূচনার একটা বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করতে চেয়েছিল, এর ভেতরে তারাও আছে।

    এপ্রিলের শেষ দিকে পূর্ব বাংলায় দশদিনে চোখ আর কানে অবিশ্বাস্য যকিছু আমি দেখেছি ও শুনেছি তাতে এটা ভয়াবহভাবে পরিষ্কার যে এই হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বিচ্ছিন্ন কোনো কার্যকলাপ নয়। পাক সেনাদের দ্বারা বাঙালিদের হত্যাকাণ্ডই অবশ্য একমাত্র সত্য নয়। ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরাই একমাত্র হত্যাকারী ছিল না, পূর্ব পাকিস্তানের সৈন্য ও প্যারামিলিটিারির সদস্যদের বন্য আক্রোশের শিকার হয়েছে অবাঙালিরা। কর্তৃপক্ষের সেন্সর আমাকে এই তথ্য জানানোর সুযোগ দিয়েছে। হাজার হাজার অভাগা মুসলিম পরিবার, যাদের অধিকাংশই ১৯৪৭ সনের দেশ বিভাগের সময় বিহার থেকে শরণার্থী হিশেবে পাকিস্তানে এসেছিল, প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। রমণীরা ধর্ষিত হয়েছে, বিশেষ ধরনের ছুরি দিয়ে কেটে নেয়া হয়েছে তাদের স্তন। এই ভয়াবহতা থেকে শিশুরাও রক্ষা পায়নি। ভাগ্যবানরা বাবা-মার সঙ্গেই মারা গেছে; কিন্তু চোখ উপড়ে ফেলা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিষ্ঠুরভাবে ছিঁড়ে নেয়া হাজার হাজার শিশুর সামনে ভবিষ্যত এখন অনিশ্চিত। চট্টগ্রাম, খুলনা ও যশোরের মতো শহরগুলো থেকে ২০,০০০-এরও বেশি অবাঙালির মৃতদেহ পাওয়া গেছে। নিহতদের সত্যিকারের পরিমাণ, পূর্ব বাংলার সর্বত্র আমি শুনেছি ১০০,০০০-এর মতো হতে পারে; কারণ হাজার হাজার মৃতদেহের কোনো চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

    পাক-সরকার ওই প্রথম ভয়াবহতা সম্পর্কে পৃথিবীকে জানতে দিয়েছে। কিন্তু যা প্রকাশ করতে দেয়া হয়নি তা হলো, তাদের নিজেদের সেনাবহিনী যে-হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা ছিল দ্বিতীয় এবং ভয়াবহতম হত্যাকাণ্ড। পাক-কর্মকর্তারা উভয় পক্ষ মিলিয়ে নিহতদের সংখ্যা ২৫০,০০০-এর মতো বলে গণনা করেছে — এর মধ্যে দুর্ভিক্ষ এবং মহামারিতে মৃতদের ধরা হয়নি। দেশের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত প্রদেশে সফল ধ্বংসকাণ্ড চালানোর মাধ্যমে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তান-সমস্যাকে তার নিজস্ব ‘চরম সমাধানের’ দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।

    “আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে একেবারে সংশোধন করতে চাই এবং বিচ্ছিন্ন হওয়ার সব হুমকিকে রদ করার জন্য আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, এর অর্থ যদি হয় ২০ লক্ষ লোককে হত্যা করা এবং প্রদেশটিকে ৩০ বছর ধরে কলোনি বানিয়ে রাখা, তবুও,” আমাকে বারবার এ-কথা শুনিয়েছেন ঢাকা ও কুমিল্লার ঊধ্বর্তন সামরিক ও সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ। পূর্ব বাংলায় পাকসেনারা ব্যাপকভাবে ও ভয়াবহভাবে ঠিক এই কাজটিই করে চলেছে।

    চাঁদপুর ভ্রমণ শেষে অস্তায়মান সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা ছুটে চলেছি (কারণ, বুদ্ধিমান পাক সেনারা পূর্ব বংলায় ভবনের ভেতরে রাত্রি যাপন করে)। টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজারের পেছন থেকে হঠাৎ এক জওয়ান চেঁচিয়ে উঠল, “একটা লোক দৌড়িয়ে যাচ্ছে, সাহেব।” মেজর রাঠোর মুহূর্তেই গাড়ি থামিয়ে দিলেন, একই সঙ্গে চীনা এলএমজি তাক করলেন দরজার বিপরীতে। দুশো গজেরও কম দূরে হাঁটু-সমান উঁচু ধানক্ষেতের মধ্যে একটা লোককে ছুটে পালাতে দেখা গেল।

    “আল্লাহর দোহাই, ওকে গুলি কর না,” আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, “ও নিরস্ত্র। ও একজন গ্রামবাসী মাত্র।”
    আমার দিকে বাজেভাবে তাকিয়ে রাঠোর একটা সতর্কতামূলক গুলি করলেন। সবুজ ধানের গালিচায় লোকটা কুঁকড়ে ঢুকে যেতেই দু’জন জওয়ান এগিয়ে গেল তাকে টেনে-হিঁচড়ে আনতে।
    বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাতের পর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হল।
    “তুমি কে?”
    “মাফ করে দিন সাহেব, আমার নাম আব্দুল বারী। ঢাকায় নিউ মার্কেটে দর্জির কাজ করি।”
    “মিথ্যে বলবে না। তুমি হিন্দু। না হলে দৌড়াচ্ছিলে কেন?”
    “কারফিউয়ের সময় প্রায় হইয়া আসছে, সাহেব, আমি আমার গ্রামে যাইতেছিলাম।”
    “সত্য কথা বল। দৌড়াচ্ছিলে কেন?”
    প্রশ্নের উত্তর দেবার পূর্বেই তাকে একজন জওয়ান দেহ-তল্লাসী শুরু করল এবং আরেকজন দ্রুত তার লুঙ্গি টেনে খুলল। হাড়জিরজিরে নগ্ন শরীরে সুস্পষ্ট খৎনার চিহ্ন দেখা গেল, যা মুসলমানদের অবশ্যই করতে হয়।

    ট্রাকভর্তি মানুষগুলোকে হত্যা করা হয়

    অন্তঃতপক্ষে এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ হল যে বারী হিন্দু নয়। তারপরও জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল।
    “বল তুমি দৌড় দিয়েছিলে কেন?”
    এতক্ষণে ওর চোখ বুনো হয়ে উঠল। ওর শরীরও কাঁপছিল প্রচণ্ডভাবে। সে উত্তর দিতে পরছিল না, সে হাঁটু চেপে ধরল।
    “স্যার, মনে হচ্ছে ও ফৌজি।” বারী পা খামচে ধরায় এক জওয়ান মন্তব্য করে। (ফৌজি সৈনিকের উর্দু শব্দ, বাঙালি বিপ্লবীদের পাকসেনারা এই নামে চিহ্নিত করে থাকে।)
    “হতে পারে।” আমি শুনলাম রাঠোর হিংস্রভাবে বিড়বিড় করল।
    রাইফেলের বাট দিয়ে প্রচণ্ডভাবে পিটিয়ে আব্দুল বারীকে ভীষণ জোরে ছুঁড়ে দেয়া হল একটি দেয়ালের দিকে। তার আর্তনাদের পর কাছের কুঁড়েঘরের আড়াল থেকে এক তরুণকে উঁকি দিতে দেখা গেল। বাংলায় কী যেন চেঁচিয়ে বলল বারী। মাথাটি সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হল। কিছুক্ষণ পরেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে এল এক বুড়ো মানুষ। রাঠোর তাকে খামচে টেনে আনলো।
    “এই লোকটাকে তুমি চেন?”
    “হ্যাঁ সাহেব। ও আব্দুল বারী।”
    “সে কি ফৌজি?”
    “না সাহেব। হে ঢাকায় দর্জির কাম করে।”
    “সত্যি কথা বল।”
    “খোদার কসম, সাহেব, হে দর্জি।”
    হঠাৎ নিরবতা নেমে এলো। রাঠোর অপ্রস্তুত হয়ে তাকালে আমি বললাম, “আল্লাহর দোহাই, ওকে যেতে দাও। ওর নির্দোষিতার আর কত প্রমাণ চাও?”
    জওয়ানরা তবু সন্তুষ্ট হয় না, তারা বারীকে ঘিরে রাখে। আরো একবার বলার পর রাঠোর বারীকে ছেড়ে দেবার আদেশ দিলেন। ইতোমধ্যে সে ভয়ে জড়োসড়ো ও কুঞ্চিত হয়ে গেছে। তার জীবন বেঁচে গেল। অন্য সবার ভাগ্যে এমন সুযোগ আসে না।

    ৯ম ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমি ছয়দিন কুমিল্লায় ঘুরেছি। আমি কাছ থেকে দেখেছি গ্রামের পর গ্রাম, বাড়ির পর বাড়ি “অস্ত্র অনুসন্ধান”-এর ছলে খৎনা করা হয়নি এমন লোকদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে। কুমিল্লার সার্কিট হাউসে (বেসামরিক প্রশাসনের হেড কোয়ার্টার) মানুষদের মৃত্যুযন্ত্রণার আর্তরব আমি শুনেছি। কারফিউর নামে আমি দেখেছি ট্রাক বোঝাই লোক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে খুন করার জন্য। সেনাবহিনীর “হত্যা ও অগ্নিসংযোগ মিশন’-এর পাশবিকতার আমি প্রত্যক্ষদর্শী। দেখেছি বিপ্লবীদের খতম করার পর কীভাবে গ্রাম-শহরে ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে।

    ‘শাস্তিমূলক পদক্ষেপ” নিয়ে কীভাবে পুরো গ্রামকে ধ্বংস¯তূপে পরিণত করা হয়েছে তাও আমি দেখেছি। আর রাত্রিবেলা শুনেছি তাদের সারাদিনব্যাপী চালানো হত্যাকাণ্ডের অবিশ্বাসযোগ্য, বর্বর রোমন্থন। “তুমি কয়টা খতম করেছ?” তাদের উত্তর এখনও আমার স্মৃতিতে জ্বলন্ত।

    যেকোনো পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার বলবে এর সবই করা হয়েছে ‘পাকিস্তানের আদর্শ, সংহতি ও অখণ্ডতা অক্ষুণ্ন রাখা’-র জন্য। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে। ভারতের দ্বারা হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত দুই অংশকে একত্রে রাখার জন্য এই তথাকথিত সামরিক কার্যক্রমই আদর্শের পতনকে প্রমাণ করেছে। পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত রাখা সম্ভব একমাত্র কঠোর সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। আর পাকসেনাদল পাঞ্জাবীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যারা ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালিদের অপছন্দ করে, ঘৃণা করে।

    পরিস্থিতি এমন অবস্থায় এসেছে যে কিছু বাঙালিকেও পশ্চিম পাকিস্তানী দলের সঙ্গে দেখা গেছে স্বতঃস্ফুর্তভাবে। ঢাকায় এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় এ-রকম আশ্চর্য অদ্ভুত অভিজ্ঞাতার মুখোমুখি হয়েছি আমি। “দুঃখিত”, সে আমাকে বলল, “ছক পাল্টে গেছে। আমি তুমি যে পাকিস্তানকে জানি, তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাকে পেছনেই থাকতে দাও।”

    ঘণ্টাখানেক বাদে এক পাঞ্জাবী সেনা-কর্মকর্তা পাকসেনারা পদক্ষেপ নেয়ার আগের অবাঙালিদের ওপর চালানো হত্যাকাণ্ডের কথা বলা আরম্ভ করল। সে আমাকে বলল, “১৯৪৭-এর দেশবিভাগের সময়কার শিখদের চাইতে পাশবিক আচরণ করেছে তারা। কীভাবে আমরা তা ভুলতে বা মাফ করতে পারি?” সেনাবাহিনীর এই উম্মত ধ্বংসকার্যের দু’টো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। একটিকে কর্তৃপক্ষ ‘শুদ্ধি অভিযান’ নামে চিহ্নিত করতে পছন্দ করেন যা মূলত ধ্বংসলীলাকেই নরমভাবে উচ্চারণ করা। অপরটি হল ‘পুনর্বাসন-উদ্যোগ”। পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের বশীভূত উপনিবেশ বানানোর প্রচেষ্টাকে এভাবে বর্ণনা করা হয়। এই ঢালাও অভিব্যক্তি এবং ‘দুষ্কৃতিকারী’ ও ‘হামলাকারী’ হিসেবে বারংবার উল্লেখ বিশ্বকে সন্তুষ্ট রাখার প্রয়াস। কিন্তু প্রচারণার অন্তরালে হত্যা ও উপনিবেশীকরণই হলো বাস্তবতা।

    হিন্দুদের হত্যালীলার যৌক্তিকতা বিষয়ে ১৮ এপ্রিল রেডিও পাকস্তিান থেকে প্রচারিত পূর্ব পাকিস্তানের মিলিটারি গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের বক্তব্য আমি শুনেছি। তিনি বললেন “পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিল, তারা পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতিজ্ঞ। কিন্তু হিংস্র ও আগ্রাসী সংখ্যালঘুরা জীবন ও ধনসম্পদ ধ্বংস করার হুমকি দিয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠদের দমন করেছে, আওয়ামী লীগকে বাধ্য করেছে হিংসাত্মক নীতি গ্রহণ করতে।”

    অন্যরা যৌক্তিকতা খোঁজার ব্যাপারে আরো বোধ-বুদ্ধিহীন। “টাকার জোরে হিন্দুরা মুসলমান জনগণকে একেবারে খাটো করে দেখেছে,” কুমিল্লার অফিসার্স মেসে ৯ম ডিভিশনের কর্নেল নাঈম আমাকে জানান। “শুষে পুরো শহরকে ওরা রক্তশূন্য করে ফেলেছে। টাকা অর্থ পণ্য সব ভারতে চলে যায় সীমান্ত পার হয়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজে অর্ধেকরও বেশি নিজেদের লোক ঢুকিয়ে আপন ছেলেদের পড়াশোনার জন্য পাঠিয়ে দেয় কলকাতায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে এসেছে যে বাঙালি সংস্কৃতি আসলে হিন্দু সংস্কৃতি এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রকৃতপক্ষে পরিচালনা করছে কলকাতার মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ীরা। জনগণের কাছে তাদের দেশকে ফিরিয়ে দিতে হলে এবং বিশ্বাসের কাছে জনগণকে ফিরিয়ে আনতে হলে আমাদের তাদের খুঁজে বের করতে হবে।”

    অথবা মেজর বশিরের কথাই ধরা যাক। তিনি নিচুপদ পার হয়ে এ পর্যায়ে এসেছেন। কুমিল্লার ৯ম ডিভিশনের এই এসএসও-র নিজস্ব হত্যার খতিয়ান ২৮ বলে দম্ভও আছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে তার আছে একটা নিজস্ব ব্যাখ্যা। “এটা হল শুদ্ধ আর অশুদ্ধর মধ্যে যুদ্ধ”, এক কাপ সবুজ চা খেতে খেতে তিনি আমাকে কথাটা বলেন। “এখানকার লোকদের নাম হয়তো মুসলমানের, পরিচয়ও দেয় হয়তো মুসলমান বলে, কিন্তু মানসিকতায় এরা হিন্দু। আপনার বিশ্বাস হবে না, শুক্রবার এখানকার ক্যান্টনমেন্ট-মসজিদের মৌলবি ফতোয়া দিচ্ছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানীদের খুন করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে। ওই জারজটাকে আমরা খুঁজে বের করেছি, বাদবাকিদেরও খুঁজছি। যারা ওতে অংশ নেয়নি তারা হল খাঁটি মুসলমান। আমরা এমন কি ওদের উর্দু শেখাবো।”

    আমি প্রত্যেক জায়গার কর্মকর্তাদের দেখেছি তাদের হত্যালীলার পেছনে কল্পনামিশ্রিত যথেষ্ট যুক্তিও বানিয়ে নেন। কৃতকার্যের বৈধতা নিরূপণের জন্য অনেক কিছুই বলা যেতে পারে, নিজেদের মানসিক সন্তুষ্টির জন্যও সেটা প্রয়োজন, কিন্তু এই মর্মান্তিক ‘সমাধান’-এর মূল কারণটা রাজনৈতিক; বাঙালিরা নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাঞ্জাবীদের আকাক্সক্ষা এবং স্বার্থ সরকারি নীতি-নির্ধারণে প্রাধান্য স্থাপন করেছে — ক্ষমতা হারানোর ব্যাপারটা তাদের কিছুতেই সহ্য হবে না। আর সামরিক বাহিনী এতে ইন্ধন যুগিয়েছে। কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে এই বলে সাফাই গেয়েছে যে, সামরিক বাহিনী হত্যাকাণ্ড শুরুর পূর্বে অবাঙালিদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার পাল্টা জবাব হিসেবে এখনকার পদক্ষেপগুলো নেয়া হচ্ছে। কিন্তু ঘটনাবলী এমনটা বলে না যে চলমান এই গণহত্যা তাৎক্ষণিক ও বিশৃঙ্খল প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসেছে। এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত।

    ভদ্র ও আত্মবিশ্বাসী অ্যাডমিরাল আহসানের কাছ থেকে পূর্ব বাংলার গভর্নরপদ এবং পণ্ডিতম্মন্য সাহেবজাদা খানের কাছ থেকে সামরিক ক্ষমতা লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান গ্রহণ করার পরই ‘অনুসন্ধান’-এর পরিকল্পনা শুরু হয়, এটা পরিষ্কার। এটা মার্চের শুরুর দিককার কথা, বাঙালিদের বিরাট প্রত্যাশা এসেম্বলি-সভা স্থগিত হবার পর যখন শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ-আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে উঠেছে। বলা হয়ে থাকে যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের দমন-পীড়নের পক্ষের লোক হিসেবে শীর্ষে অবস্থান করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিমালাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলছিল ঢাকাস্থ পাঞ্জাবী ইস্টার্ন কমান্ড। [এটা অত্যন্ত বাজে ব্যখ্যা যে খানরা এর সঙ্গে জড়িত নয়; খান পাকিস্তানীদের নামের একটি পদবী]

    যখন ২৫ মার্চের রাতে পাকসেনারা ঢাকার পথে নামে, পরের দিন সকালে শহর এমনিতেই জনশূন্য ছিল, তাদের সঙ্গে ছিল যাদের শেষ করে দিতে হবে তাদের নামের তালিকা। এতে ছিল হিন্দু আর প্রচুর সংখ্যক মুসলমানের নাম — ছাত্র, আওয়ামী লীগ সমর্থক, অধ্যাপক, সাংবাদিক এবং মুজিবের সহায়তাকারী। মানুষকে বর্তমানে জানানো হচ্ছে যে সৈন্যদের আক্রমণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্রদের আবাসিক ভবন জগন্নাথ হল, রমনা রেসকোর্স মন্দিরের কাছাকাছি অবস্থিত দু’টি হিন্দু কলোনি এবং তৃতীয়ত পুরনো ঢাকার বুকের ওপর শাখারিপট্টিতে। কিন্তু মার্চের ২৬ ও ২৭ তারিখের দিবারাত্রিব্যাপী কারফিউয়ের সময়ে ঢাকা ও নিকটস্থ নারায়নগঞ্জ শিল্প এলাকার হিন্দুদের কেন হত্যা করা হলো তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। কারফিউর সময়ে রাস্তায় চলাচলকারী মুসলিমদেরও কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এই লোকগুলোকে খতম করা হয়েছে পরিকল্পিত অভিযানের মাধ্যমে; হিন্দু দমনের বানোয়াট অভিযোগের ফল এলো আরো বিস্তৃতভাবে, অন্যরকমভাবে।

    একটি পেন্সিলের খোঁচা, একটি লোকের ‘নিকাশ’

    ১৫ই এপ্রিল ঢাকায় ঘোরার সময় ইকবাল হলের ছাদে আমি চারটি ছাত্রের গলিত মাথা পড়ে থাকতে দেখেছি। তত্ত্বাবধায়ক জানান যে, তাদের হত্যা করা হয়েছে ২৫শে মার্চের রাত্রে। দুটো সিঁড়ি এবং চারটি ঘরে প্রচুর রক্তপাতের চিহ্নও আমি দেখেছি। ইকবাল হলের পেছনে একটি বিশাল আবাসিক ভবন সেনাবাহিনীর বিশেষ মনোযোগ পেয়েছিল বলে মনে হল। বিশাল দেয়ালগুলো গুলিতে ঝাঁঝরা এবং সিঁড়িতে বাজে গন্ধের রেশ রয়ে গেছে, যদিও এখানে প্রচুর ডিডিটির গুঁড়ো ছড়ানো হয়েছে। প্রতিবেশীরা জানান ২৩ জন নারী ও শিশুর মৃতুদেহ মাত্র ঘন্টাখানেক আগে সরিয়ে নেয়া হয়েছে গাড়িতে করে। ২৫ তারিখ থেকেই ছাদের ওপর লাশগুলো পচছিল। অনেক প্রশ্নের পর জানা গেল হতভাগ্যরা ছিল কাছের হিন্দু-বাড়ির। এই ভবনে তারা আশ্রয় নিয়েছিল।

    এই গণহত্যা সাধন করা হয়েছে নিতান্ত নির্বিকারভাবে। ১৯শে এপ্রিল সকালে কুমিল্লার সামরিক আইন প্রশাসক মেজর আগার অফিসে বসে থাকার সময়ে আমি দেখেছি এ-সমস্ত নির্দেশ কী নির্মমতার সঙ্গে দেয়া হয়। এক বিহারী সাব-ইন্সপেক্টর বন্দিদের একটি তালিকা নিয়ে এল। ওটার দিকে তাকিয়ে নির্বিকারভাবে চারটি নামের পাশে পেন্সিলের খোঁচা দিয়ে আগা বললেন, “সন্ধ্যার সময় এই চারজনকে নিকাশের জন্যে নিয়ে এসো।” তালিকার দিকে তাকিয়ে আবার তিনি পেন্সিলের দাগ বসালেন, “এই চোরটাকেও নিয়ে এসো ওদের সঙ্গে।”

    মৃত্যুর ঐ আদেশ দেয়া হলো নারকেলের দুধ খেতে খেতে। আমাকে জানানো হল যে বন্দিদের দুজন হিন্দু, তৃতীয়জন ‘ছাত্র’ এবং চতুর্থজন এক আওয়ামী লীগ নেতা। ‘চোরটি,’ জানা গেলো, নিজ বাড়ীতে তার বন্ধুকে থাকতে দিয়েছিল। পরে সন্ধ্যার দিকে দেখলাম একটি দড়ি দিয়ে হাত-পায়ে শিথিলভাবে বেঁধে সার্কিট হাউজগামী রাস্তা দিয়ে ওদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারফিউর কিছু পরে সন্ধ্যা ছয়টার সময় পাখিদের একটি দল কাছে কোথাও কিচিরিমিচির করছিল, হঠাৎ গুলির তীব্র শব্দে তাদের খেলায় ছেদ পড়ল।

    বেলুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আজমতকে নিয়ে প্রায়ই মেসে দুটো ব্যাপার আলোচনা করা হতো। একটি হলো ৯ম ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল শওকত রাজার এডিসি হিসেবে ওর চাকরি। অপরটি নিয়ে ওর সহকর্মীরা ওকে পেয়ে বসতো। জানা গেল আজমত দলের একমাত্র অফিসার যে কোনো ‘খুন’ করেনি। মেজর বশির তাকে নির্মমভাবে খোঁচাতো। “এই যে আজমত,” এক রাতে বশির তাকে বললেন, “কাল আমরা তোমাকে মানুষ করতে যাচ্ছি। কাল দেখব তুমি তাদের কেমন ধাওয়া দিতে পারো। ব্যাপারটা খুবই সোজা।” এই অসামর্থ্যরে জন্যে বশির তার সঙ্গে লেগেই থাকতেন। এসএসও-র চাকরি ছাড়াও বশির হেডকোয়ার্টারে ‘শিক্ষা কর্মকর্তা’ ছিলেন। তাকেই একমাত্র পাঞ্জাবী অফিসার দেখেছি, যে অনর্গল বাংলা বলতে পারতো।

    শুনলাম বশিরের কাছে এক দাড়িঅলা একদিন সকালে তার ভাইয়ের খোঁজ নিতে এসেছিল। তার ভাই ছিল কুমিল্লার বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা। কিছুদিন আগে পাকসেনারা তাকে বন্দি করেছিলো। বশির তাকে জানালেন, “দৌড় গ্যায়া, পালিয়ে গেছে।” বুড়ো লোকটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না কীভাবে ভাঙা পা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। আমিও না। এ-ঘটনা বলে লম্বা হাসি দিয়ে মেজর বশির আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন। পরে জেনেছি ওদের নিজস্ব ভাষায় ‘দৌড় গ্যায়া’ মানে হলো, “পালানোর সময় গুলি করে খুন।”

    আমি জানতে পারিনি ক্যাপ্টেন আজমত কাউকে খুন করতে পেরেছিলেন কি না। চট্টগ্রামের সত্তর মাইল উত্তরে ফেনীর কাছে কুমিল্লা সড়কে বাঙালি-বিদ্রোহীরা পরিখা খনন করেছিল, সে-এলাকার সব ব্রিজ ও কালভার্ট ধ্বংস করে ৯ম ডিভিশনের চলাচলকে সীমিত করে রেখেছিল। ঢাকায় ইস্টার্ন কমান্ড থেকে একের পর এক বাজে খবর পেয়ে জেনারেল রাজা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বিদ্রোহীদের পালিয়ে যাওয়া রদ করার জন্যে জরুরি হয়ে দাঁড়ায় দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত-অঞ্চল বন্ধ করে দেয়া। অথচ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে এসে পৌঁছানো অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্যে বর্তমানে একমাত্র পথ হিশেবে উন্মুক্ত রাখাও দরকার হয়ে পড়ে। তাই জেনারেল রাজা সহজেই উত্তেজিত হয়ে যান। সেখানে তিনি উড়ে যেতেন প্রায় প্রত্যেক দিনই। ফেনীর ভেঙে পড়া ব্রিজ নিয়ে বকবক করতেন দীর্ঘসময় ধরে। ক্যাপ্টেন আজমত সবসময়ের মতো তখনো জেনারেলের ছায়া। আমি তাকে আর দেখতে পাইনি। পরবর্তী তিন সপ্তাহর জন্যে খোঁচা থেকে আজমত মোটামুটি রক্ষা পেয়েছিল। ফেনী ও সংলগ্ন অঞ্চল ৮ই মে ৯ম ডিভিশন আয়ত্তে আনতে পারলো। বাঙালি বিদ্রোহীরা বোমা ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে এতোদিন সেখানে অবরোধ দিয়ে রেখেছিলো। শেষমেষ তারা সীমান্ত টপকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যায়।

    ৯ম ডিভিশন হেডকোয়ার্টারের জি-১ লেফটেন্যান্ট কর্নেল আসলাম বেগ ভারি অস্ত্রসহ বাঙালি বিদ্রোহীদের পালিয়ে যাওয়ার খবরে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি বললেন, “ভারতীয়রা তাদের ওখানে একদমই থাকতে দেবে না। ব্যাপারটা তাদের জন্য খুবই বিপজ্জনক হবে। সীমান্ত-অঞ্চলে তারা যত হামলা করবে আমরা তত ভোগান্তির শিকার হব।” পাক-ভারত যুদ্ধের সময় চীন থেকে অস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল বেগ ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় আর্টিলারি অফিসার। তিনি ছিলেন একজন গর্বিত পরিবারের সদস্য। তিনি ফুলও পছন্দ করতেন। আমাকে গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, কুমিল্লায় এর আগের পোস্টিং-এর সময় চীন থেকে আনিয়ে হেড কোয়ার্টারের উল্টোদিকের পুকুরে তিনি টকটকে লাল রঙের বিশাল জলপদ্ম রোপন করেছিলেন। মেজর বশির তাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। বশির আমাকে জানালেন, একবার এক বিদ্রোহী কর্মকর্তাকে ধরা হলো। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ল, তাকে নিয়ে কী করা যায়। অন্যরা যখন নির্দেশ পাবার জন্য টেলিফোনে খোঁজখবর করছেন তিনি সব সমাধান করে ফেললেন, দৌড় গ্যায়া। শুধু ওর পাটুকুই গর্তের বাইরে বের হয়ে ছিল।

    পরিব্যাপ্ত শ্যামল সৌন্দর্যের মধ্যে কী পাশবিকতা চলছে, তা কল্পনা করাও অসম্ভব। এপ্রিলের শেষ দিকে আমি যখন সেখানে যাই, তখন কুমিল্লা ধ্বংস¯তূপ। পথের দু’পাশের সবুজ ধানক্ষেত দিগন্তে রক্তিম আভার আকাশে গিয়ে মিশেছে। গুলমোহর, ‘অরণ্যের বহ্নিশিখা’ ফোটার সময় এসে গেছে। গ্রামের আম আর নারকেল গাছগুলো ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে। এমন কি রাস্তার পাশে ছাগলের দৌড়ঝাঁপও প্রমাণ করছিলো প্রকৃতিক বাংলার পূর্ণতা। “পুরুষ আর স্ত্রীগুলোকে আলাদা করার একমাত্র উপায় হলো,” আমাকে ওরা বললো, “মেয়ে ছাগলগুলো গর্ভবতী।”

    হত্যা আর অগ্নিকাণ্ড: তাদের শাস্তির নমুনা

    পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল অঞ্চল কুমিল্লার জনসংখ্যার ঘনত্ব হলো প্রতি বর্গমাইল ১,৯০০ জন। অথচ কোথাও কোনো মানুষ দেখা গেলো না। ”বাঙালিরা কোথায়?” কিছুদিন আগে ঢাকার রাস্তাঘাট একেবারে নির্জন দেখে সেনাদলের লোকদের আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওদের তৈরী করা উত্তর ছিলো, “সবাই গ্রামে গেছে।” অথচ গ্রামেও কোনো বাঙালি দেখা যাচ্ছিল না। ঢাকার মতো কুমিল্লাও একেবারে জনশূন্য। লাকসাম দিয়ে আসার সময় দশ মাইল পথে হাতে গোনা কয়েকজন কৃষককে দেখলাম। অবশ্য খাকি-পোশাক-পরা পাকসেনারা গম্ভীর মুখে অটোমেটিক রাইফেল হাতে রাস্তায় অবস্থান করছিল। আদেশমাফিক রাইফেল হাতছাড়া করেনি কেউ। ট্রিগার-সুখী কঠিন লোকজন সবসময় রাস্তা পাহারা দিচ্ছে। যেখানে পাকসেনা, সেখানে কোনো বাঙালিকে পাওয়া যাবে না।

    রেডিও এবং খবরের কাগজে সামরিক আইন ঘোষণা করা হচ্ছে মুহূর্মুহু — চোরাগোপ্তা হামলার জন্য ধরা পড়লে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। রাস্তা বা ব্রিজ ধ্বংস বা খোঁড়ার চেষ্টা করলে ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলের একশ গজের ভেতর সমস্ত বাড়িকে এর জন্য দায়ী করা হবে এবং সেগুলোর ধ্বংসসাধন করা হবে। কার্যক্ষেত্রে ঘোষণাগুলোর চাইতে ভয়াবহ সব পদক্ষেপে নেয়া হয়েছে। ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ এমন একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বাঙালিরা বেপরোয়া ও সহিংস হতে বাধ্য হয়েছে।

    এর যে কী ভয়াবহ অর্থ তা দেখেছি ১৭ এপ্রিল চাঁদপুর যাওয়ার পথে হাজীগঞ্জে। বিদ্রোহীরা, যারা এখনো এ-অঞ্চলে তৎপর, গত রাতে ১৫ ফুট দীর্ঘ একটা ব্রিজ ভেঙে ফেলেছে। মেজর রাঠোরের (জি-২ অপারেশনস্) মাধ্যমে জানা গেলো, তৎক্ষণাৎ এই এলাকায় একদল সেনাদল পাঠিয়ে দেয়া হলো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। ব্রিজের সিকি মাইলব্যাপী অঞ্চলে পেঁচিয়ে ওঠা ঘন ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল তখনও। সাময়িকভাবে কাঠের তক্তা দিয়ে সারানো ব্রিজটি সাবধানে পার হওয়ার সময় দেখলাম ডানদিকের গ্রাম্য বাড়িগুলোতেও আগুন লকলকিয়ে উঠছে।

    গ্রামের পেছন দিকে কিছু জওয়ান আগুন ছড়ানোর চেষ্টা করছিল নারকেলের ছোবড়া দিয়ে। এগুলো কাজও দিচ্ছিল ভালো। কারণ সাধারণত রান্নার কাজে এগুলো ব্যবহার করা হয়। পথের অন্যদিকে ধানক্ষেতের ওপারের গ্রামেও আগুনের চিহ্ন দেখা গেল। বাঁশঝাড় আর কুঁড়েঘরগুলো তখনও পুড়ছিল। শত শত গ্রামবাসী পাকসেনা আসার আগের রাতেই পালিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় মেজর রাঠোর বললেন, ”এই দুর্দশাকে তারা নিজেরাই ডেকে এনেছে।” আমি বললাম, “সামান্য কিছু বিদ্রোহীর জন্য নিরপরাধ লোকদের ওপর এটা বড় বেশি নির্মমতা হয়ে গেছে।” তিনি কোনো উত্তর দিলেন না।

    কয়েকঘণ্টা পরেই চাঁদপুর থেকে ফেরার সময় আমরা আবার হাজীগঞ্জ দিয়ে আসছিলাম। ‘হত্যা আর অগ্নিকাণ্ড অভিযান’-এর বর্বরতা আমি স্বচক্ষে দেখলাম তখন। দুপুরবেলা সে-এলাকার ওপর দিয়ে বেশ কড়া ঝড় বয়ে গেছে। এখন শহরের ওপর পড়েছে মসজিদের মিনারের ভৌতিক ছায়া। পেছনের খোলা জিপে ক্যাপ্টেন আজহার আর চারজন জওয়ানের ইউনিফর্ম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে চুপসানো। বাঁক নিতেই মসজিদের বাইরে আমরা ট্রাকের একটা বহর থেমে থাকতে দেখলাম। গুনে দেখলাম জওয়ান-ভর্তি সাতটা ট্রাক। বহরটির সামনে ছিল একটা জিপ। দু’জন লোক তৃতীয় একজনের নেতৃত্বে পথের পাশে একশোরও বেশি দোকানের বন্ধ দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। দু’টো কুঠার দিয়ে এই ভাঙার চেষ্টা চলছিল, মেজর রাঠোর তার টয়োটা সেখানে থামালেন।

    “তোমরা এখানে কী করছ?”
    তিনজনের মধ্যে লম্বা লোকটা, যে ভাংচুরের তত্ত্বাবধান করছিল, আমাদের দিকে চেঁচিয়ে উঠল, “মোটু, আমরা কী করছি বলে তোমার মনে হয়?” কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে, মেজর রাঠোর মিষ্টি একটা হাসি দিলেন। আমাকে জানালেন তিনি হলেন তার পুরনো দোস্ত ইফতি — টুয়েলভথ ফ্রন্ট্রিয়ার্স ফোর্স রাইফেলের মেজর ইফতিখার।
    রাঠোর বললেন, “আমি ভেবেছিলাম কেউ লুট করছে।”
    “লুট? না না।” জবাব দিল ইফতিখার, “আমরা শুধু খুন করছি আর আগুন জ্বালাচ্ছি।”
    হাত নাড়িয়ে তিনি বোঝালেন যে এসব তিনি ধ্বংস করবেন।
    “ক’জনকে ধরতে পেরেছ?” রাঠোর জিজ্ঞেস করলেন।
    ইফতিখার ভ্রূঁ নাচিয়ে হাসলেন।
    “বল।” রাঠোর আবার জিজ্ঞেস করলেন। “ক’জনকে ধরেছ?”
    “মাত্র বারোজন।” তিনি জবাব দিলেন, “আল্লাহর রহমতে আমরা ওদের পেয়েছি। লোকদের ধাওয়া করার জন্য না পাঠালে তো ওরা পালিয়েই যেত।”
    মেজর রাঠোরের উৎসাহে ইফতিখার তার ঘটনার বর্ণনা শুরু করলেন বিস্তৃতভাবে। কীভাবে হাজীগঞ্জে ব্যাপক অন্বেষণের পর একটা বাড়িতে লুকিয়ে থাকা বারোজন হিন্দুকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন তা রসিয়ে বললেন। তাদের সবাইকে ‘নিকাশ করে দেয়া হয়েছে।’ এখন মেজর ইফতেখার এখন ব্যস্ত তার দ্বিতীয় অভিযানে, অগ্নিকাণ্ডে।

    ইতোমধ্যে একটি দোকানের দরজা ভেঙে ফেলা হয়েছে। বাংলায় দোকানটিতে লেখা আছে ‘মেডিকেল এন্ড স্টোরস’। বাংলা লেখার নিচে সেই সাইনবোর্ডে ইংরেজিতে লেখা আছে ‘অশোক মেডিকেল এন্ড স্টোরস’। তার নিচে লেখা ছিল ‘প্রোপাইটর এ এম বোস”। তালা মেরে অন্যান্যদের মতো জনাব বোসও হাজীগঞ্জ থেকে পালিয়েছেন। দোকানের সামনে ছিল একটা প্রদর্শন কক্ষ। ওষুধ, কফ সিরাপ, ম্যাঙ্গো স্কোয়াসের বোতল, ইমিটেশনের অলঙ্কার, রঙিন পোশাকের প্যাকেট ইত্যাদি অনেক কিছু ওতে সাজানো ছিল। ইফতিখার লাথি মেরে সব ভাঙ্গতে লাগলেন। তিনি কিছু চটের ব্যাগ নিলেন। অন্য একটি তাক থেকে নিল কিছু প্লাস্টিকের খেলনা আর রুমালের বাণ্ডিল। তারপর মেঝেতে সব জড়ো করে টয়োটায় বসা এক জওয়ানের কাছ থেকে দেশলাই নিয়ে এলেন। ওই জওয়ানের মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি ভালোই ছিল। সে গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে দৌড় দিয়ে দোকানে ঢুকে একটা ছাতা বের করে আনল। ইফতিখার তাকে বেরিয়ে যাওয়ার আদেশ করলেন।

    লুট করা, তিনি মনে করিয়ে দিলেন, নিয়মবিরুদ্ধ। এরপর দ্রুত আগুন ধরিয়ে দিলেন ইফতিখার। চটের জ্বলন্ত স্তূপ তিনি ছুঁড়ে দিলেন দোকানের এক কোণে, অন্য কোণে কাপড়ের বাণ্ডিল। মুহূর্তেই দোকানটি দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। মিনিটখানেকর মধ্যেই একটি দোকান পরে তেলের দোকানে আগুন পৌঁছলে বন্ধ শাটারের পেছনে আগুনের আওয়াজ শোনা গেল। এ-সময়ে ঘনায়মান অন্ধকার দেখে রাঠোর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। আবার আমাদের যাত্রা শুরু হল। পরদিন দেখা হতেই মেজর ইফতিখার আমাকে বললেন, “আমি মাত্র ষাটটা ঘর জ্বালিয়েছি। বৃষ্টি না এলে সবগুলোই শেষ করে করে ফেলতাম।”

    মুজাফফরগঞ্জের কয়েক মাইল দূরে এক গ্রামে আমাদের থামানো হলো। দেখা গেল একজন মাটির দেয়ালের সঙ্গে কুঁকড়ে রয়েছে। এক জওয়ান সর্তক করে দিল যে সে ফৌজি হতে পারে। কিন্ত কিছুক্ষণ সর্তক নিরীক্ষণের পর বোঝা গেলো, সে একটি মিষ্টি হিন্দু মেয়ে। আর খোদাই জানে কার জন্য মেয়েটি নিরবে অপেক্ষা করছিল। এক জওয়ান দশ বছর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলে কাজ করার সুবাদে কিছু বাজারী বাংলা রপ্ত করেছিলো। সে মেয়েটিকে গ্রামে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলো। ওখানে বসে থেকেই মেয়েটি কী যেন বিড়বিড় করল। তখন তাকে দ্বিতীয়বার নির্দেশ দেয়া হল। তবু চলে আসার পরও সে ওখানেই বসে রইল। আমাকে জানানো হল, “মেয়েটির যাওয়ার জায়গা নেই — না আছে পরিবার না আছে ঘর।”

    হত্যা ও অগ্নিকাণ্ড অভিযানের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মেজর ইফতিখারও একজন। বিদ্রোহীদের খুঁজে বের করার নামে হিন্দু ও ‘দুষ্কৃতিকারীদের’ (বিপ্লবীদের অফিসিয়াল পরিভাষা) অবাধে খুন করার এবং আশপাশের সবকিছু জ্বালিয়ে দেবার অনুমতি তারা পেয়েছে। এই টিঙটিঙে পাঞ্জাবী অফিসারটি নিজের কাজ নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন। কুমিল্লার সার্কিট হাউজে ইফতিখারের সঙ্গে যাবার সময় তিনি তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি দিলেন।

    “আমি এক বুড়োকে পেয়েছিলাম”, তিনি বললেন। “হারামজাদার দাড়ি ছিলো, আর ভান করছিলো পাক্কা মুসলমানের মতো। এমনকি নিজের নাম বলল আব্দুল মান্নান। কিন্তু মেডিক্যাল ইন্সপেকশনে পাঠাতেই ওর খেল খতম হয়ে গেল।” ইফতিখার বলে যাচ্ছিলেন, “আমি তাকে তক্ষুণি সেখানে শেষ করে ফেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার লোকেরা বললো — এরকম জারজের জন্যে তিনটা গুলি দরকার। তাই আমি তাকে একটা গুলি করলাম গোপনাঙ্গে, একটা পেটে। তারপর মাথায় গুলি করে তাকে খতম করে দিলাম।”

    আমি যখন চলে আসি তখন তাকে নেতৃত্ব-ক্ষমতা প্রদান করে উত্তর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়েছে। আবারো তার অভিযান হত্যা আর অগ্নিকাণ্ড।

    আতঙ্কে মুহ্যমান হয়ে বাঙালিদের দুটো প্রতিক্রিয়া হয়। যারা পালাতে পারে তারা সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হয়। পাকসেনার উপস্থিতিতে যারা পালাতে পারে না তারা বশ্য ক্রীতদাসের মতো আচরণ করে — যা তাদের কপালে দুর্ভোগ ছাড়া অন্য কিছুই বয়ে আনে না। চাঁদপুর ছিল প্রথমটির উদাহরণ।

    মেঘনা নদীবন্দর সংলগ্ন এই অঞ্চল আগে ব্যবসা-কেন্দ্র হিসেবে খুবই বিখ্যাত ছিল। রাত্রিবেলা নদীর পাড়ে ভেড়ানো হাজারো নৌকা আলোয় আলোয় এক রূপকথার রাজ্য বানিয়ে ফেলে। চাঁদপুর জনমানবহীন হয়ে পড়ে ১৮ই এপ্রিলে। না ছিল মানুষ, না কোনো নৌকা। বড়জোর এক শতাংশ মানুষ সেখানে ছিল। বাদবাকিরা, বিশেষ করে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধাংশ হিন্দুরা, পালিয়ে গিয়েছিল। ওরা পালিয়ে গেলেও বাড়িতে, দোকানে, ছাদে হাজার হাজার পাকিস্তানী পাতাকা উড়ছিল। মনে হচ্ছিল জনমানুষ ছাড়াই জাতীয় দিবস উদযাপিত হচ্ছে। হিংস্র দৃষ্টি থেকে বাঁচবার জন্যেই ছিল এই ব্যবস্থা। এই পতাকা ছিল তাদের আত্মরক্ষার উপায়।

    কীভাবে যেন তারা জেনেছে পাকিস্তানী পতাকা ওড়ালে পাকসেনাদের হিংস্র ও নির্মম ধংসাত্মক তৎপরতা থেকে রক্ষা পওয়া যাবে। পতাকা কীভাবে বানানো হচ্ছে সেদিকে কোনো খেয়াল রাখা হয়নি, কোনো রকমে একটা চাঁদতারা থাকলেই যথেষ্ট। ওগুলোর রঙ, কাঠামো গড়ন তাই হয়েছে বিচিত্র। সবুজের জায়গায় কোনোটার জমি নীল। তারা যে বাংলাদেশী পতাকার মালমশলা দিয়ে এই পতাকা বানিয়েছে এটা নিশ্চিত। সবুজের জায়গায় সর্বত্র দেখা গেছে নীল পতাকা। চাঁদপুরের মতো একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে হাজীগঞ্জ, মুজাফফরগঞ্জ, কসবা আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কিন্তু পতাকা উড়েছে — ভৌতিক পতাকা।

    একটি ‘কুচকাওয়াজ’ ও একটি চেনা ইশারা

    আরেক ক্রীতদাসসুলভ বশ্যতা দেখা গেছে লাকসামে। পরদিন সকালে যখন আমি শহরে ঢুকি তখন বিপ্লবীমুক্ত হয়ে গেছে। দেখতে পেলাম শুধু পাকসেনা এবং আক্ষরিক অর্থে হাজার হাজার পাকিস্তানী পতাকা। সেখানকার মেজর ইন-চার্জ পুলিশ-স্টেশনে ঘাঁটি গেড়েছিলেন, মেজর রাঠোর সেখানে আমাদের নিয়ে গেলেন। আমার সহকর্মী পাক-টিভির একজন ক্যামেরাম্যান একটা প্রচারণা-ফিল্মের কাজে লাকসামে এসেছেন, ‘স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে’ নামের নিয়মিত এই সিরিজ প্রতিদিন স্বাগত- কুচকাওয়াজ আর ‘শান্তিসভার’ খবর প্রচার করতো।

    সে কীভাবে এটা করে ভেবে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, কিন্তু মেজর জানালেন জিনিসটা মোটেও সুমধুর নয়। “হারামজাদারা এর চেয়ে বেশি মাত্রায় এসে ব্যাপারটাকে দর্শনীয় করে তুলতে পারে। আমাকে বিশ মিনিট সময় দাও।” ৩৯তম বেলুচ ল্যাফটেন্যান্ট জাবেদের ওপর ভার পড়েছিল জনতাকে একত্রিত করার। তিনি দাড়িওয়ালা বুড়ো একজন লোককে ডাকলেন। তাকে আনা হয়েছে বানানো সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্যে। লোকটি, পরে জানিয়েছিলেন তার নাম মৌলানা সৈয়দ মোহাম্মদ সাইদুল হক, বললেন তিনি একজন “খাঁটি মুসলিম লীগার; আওয়ামী লীগের লোক নন”। (১৯৪৭ সনে স্বাধীন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলো মুসলিম লীগ।) খুশি করার জন্যে তিনি আগ্রহের সাঙ্গে আরো জানালেন, “বিশ মিনিটের মধ্যে আমি আপনাদের অবশ্যই অন্তঃতপক্ষে ষাটজন লোক জোগাড় করে দেব।” জাবেদকে তিনি বললেন, “দু’ঘন্টা সময় দিলে দুশো জন লোক জোগাড় করতে পারব।”

    মৌলানা সাইদুল হকের সাচ্চা জবান। মেজরের দেয়া চমৎকার নারকেলের দুধে যেই চুমুক দিয়েছি, অমনি দূর থেকে আওয়াজ ভেসে এলো — “পাকিস্তান জিন্দাবাদ!” “পাকসেনা জিন্দাবাদ!” “মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ!” ( জিন্দাবাদ হলো ‘চিরজীবী হোক’-এর উর্দু শব্দ।) কিছুক্ষণ পরেই তাদের কুচকাওয়াজ করে আসতে দেখা গেল। ওদের মধ্যে বুড়ো অসুস্থ লোক আর হাঁটুসমান ছেলেপিলে মিলিয়ে পঞ্চাশজন মানুষ ছিল। সবাই পাকিস্তানী পতাকা উঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছিল। লেফটেন্যান্ট জাভেদ আমাকে একটি চেনা ইশারা দিলেন। মিনিটখানেকর মধ্যে কুচকাওয়াজটি একটি জনসভায় পরিণত হল, একটি মাইক জোগাড় হয়ে গেল, বক্তৃতা করতে আগ্রহীর সংখ্যা বাড়তে থাকল।

    সৈনিকদের উদ্দেশ্যে স্বাগত ভাষণ দেয়ার জন্যে সামনে ঠেলে দেয়া হল মাহবুব-উর রহমানকে। ‘এন এফ কলেজের ইংরেজি ও আরবির অধ্যাপক এবং মুসলিম লীগের আজীবন সদস্য’ হিসেবে তিনি নিজের পরিচয় দিলেন। পরিচয় দেয়ার পরে তিনি নিজস্ব কায়দায় বলা শুরু করলেন, “পাঞ্জাবী ও বাঙালিরা পাকিস্তানের জন্যে একত্র হয়েছে। আমাদের রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। কিন্তু হিন্দু ও আওয়ামী লীগারদের কারণে আমরা সন্ত্রাসের কবলে পড়েছি এবং আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম ধ্বংসের দিকে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে পাঞ্জাবী সৈনিকেরা আমাদের রক্ষা করেছে। তারা বিশ্বের সেরা সৈনিকদল এবং মানবতার নায়ক। আমরা হৃদয়ের অতল গভীর থেকে তাদের শ্রদ্ধা করি ও ভালোবাসি।” এবং এভাবেই সে বেশ কিছুক্ষণ চালিয়ে গেল।

    ‘সভা’শেষে মেজরকে জিগ্যেস করলাম ভাষণ সম্পর্কে তিনি কী ভাবছেন। ”উদ্দেশ্য সফল হয়েছে” তিনি বললেন, “কিন্তু এই হারামজাদাকে আমি মোটেই বিশ্বাস করি না। তার নামও আমার তালিকায় রাখব।”

    পূর্ব বাংলার যন্ত্রণা এখনও শেষ হয়নি। সবচেয়ে খারাপ সময় এখনও আসেনি। ‘বিশুদ্ধি অভিযান’ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত পাকসেনারা ফিরে না-আসার ব্যাপারে দৃঢপ্রতিজ্ঞ। আর এই কাজের অর্ধেক মাত্র এখন পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ৯ম ও ১৬শ, এই দুই ডিভিশন পাক সেনাকে বাঙালি বিদ্রোহী ও হিন্দুদের খুঁজে বের করার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঠানো হয়েছে। পাকিস্তানের মতো দেশের জন্য এই পরিমাণ যথেষ্ট কার্যকরী। পশ্চিম থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে ২৫০০০-এরও বেশি লোক। ২৮শে মার্চ দুই ডিভিশন সৈন্যকে ৪৮ ঘন্টার নোটিশ দেয়া হয়েছিল রওয়ানা হবার জন্য। খরিযান ও মুলতান থেকে করাচিতে তাদের আনা হয়েছিলো ট্রেনে করে। হালকা বেড রোল ও সামরিক র‌্যাকসাকসহ জাতীয় এয়ারলাইন পিআইএ-র বিমানে তাদের নিয়ে আসা হয়েছে ঢাকায় (তাদের অস্ত্রশস্ত্র সমুদ্রপথে পাঠানো হয়েছিল)। পিআইয়ের সাতটি বোয়িং বিমান আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বাতিল করে সিলোন দিয়ে দীর্ঘ ১৪ দিন ধরে তাদের পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে এসেছে। এয়ার-ফোর্সের কিছু ট্রান্সপোর্ট-এয়ারক্র্যাফট এব্যাপারে সাহায্য করেছে।

    পাকসেনারা তৎক্ষণাৎই পূর্ব-কমাণ্ডের ১৪শ ডিভিশনের অস্ত্রপাতি নিয়ে তৎপরতায় নেমে গেছে। কুমিল্লা থেকে নিয়ন্ত্রিত ৯ম ডিভিশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো পূর্ব-সীমান্ত বন্ধ করে দিতে― যাতে বিপ্লবীরা তাদের চলাফেরা ও সরঞ্জাম-সরবরাহ না-করতে পারে। যশোর হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে মিলে ১৬শ ডিভিশনও প্রদেশের পশ্চিম সীমান্তে একই ধরনের কাজে ন্যস্ত ছিলো। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহের ভেতরে তারা এই কাজ সম্পন্ন করে ফেলে। যেসব বিপ্লবী ভারতে পালাতে পারেনি―ইস্পাত আর আগুনের বৃত্তে তারা বন্দি হয়ে পড়ে―দুই সেনা ডিভিশন তাদের জন্যে ব্যাপক চিরুনি-অপারেশন কর্মসূচী গ্রহণ করে। কাজেই নিঃসন্দেহে আশংকা করা যায়, সীমান্তের সহিংসতা এখন মধ্যাঞ্চালে শুরু হবে। এটি হবে আরো বেদনাদায়ক। মানুষদের পালানোর আর কোনো পথ থাকবে না।

    ৯ম ডিভিশনের জি-১-এর পুষ্পপ্রেমিক লেফটেন্যান্ট জেনারেল বেগ ২০শে এপ্রিল ধারণা পোষণ করেছিলেন যে এই অনুসন্ধান কর্মসূচী দু’মাস অর্থাৎ জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় নেবে। কিন্তুু এই পরিকল্পনা বিফলে গেছে বলে মনে হচ্ছে। গেরিলা কায়দা গ্রহণকারী এই বিপ্লবীদের সামরিক কর্মকর্তারা যত সহজে দমন করবেন বলে আশা করেছিলেন, বাস্তবে তা ঘটেনি। বিচ্ছিন্ন ও আপাত অসংগঠিত গেরিলারা পরিকল্পিতভাবে রাস্তা ও রেলপথের ধ্বংসসাধন করে পাক সেনাদের কাবু করে ফেলছে। কারণ এর ফলে তাদের যাতায়াত-ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ৯ম ডিভিশনের কাজও অনাকাক্সিক্ষতভাবে পিছিয়ে গেছে এজন্যে। এদিকে তিন মাসব্যাপী ঝড়বাদলের মৌসুম চলে আসায় সামরিক কার্যক্রম বন্ধ হবার যোগাড় হয়েছে।

    বর্ষাকালের জন্যে পাক সরকার মে-র দ্বিতীয় সপ্তাহে চীনের কাছ থেকে নয়টি বৃষ্টিরোধক গানবোট নিয়ে এসেছে। বাদবাকিগুলোও আসার পথে। আশি টনী, ব্যাপক গোলাবর্ষণ-ক্ষমতাধারী এই গানবোটগুলো বিমান বাহিনী ও আর্টিলারীর সৈনিকদের এখন পর্যন্ত ব্যবহারের জন্যে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি এলে এগুলো কাজ করবে না। এই বোটগুলোবে সহায়তা করবে কয়েকশ দেশীয় পরিবহণ যা সেনাবাহিনীর ব্যবহারের জন্য ইস্যু ও পরিবর্তিত করা হয়েছে। সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের খোঁজে জলপথেও বেরুতে চায়।

    পূর্ব বাংলার উপনিবেশীকরণ

    বণ্টন-ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠেছে। পূর্ব পাকিস্তানের সতেরোটির মধ্যে তেরোটি জেলাতেই খাদ্যের অভাব আছেÑযা পূরণ করা হয় চাল ও গমের পর্যাপ্ত আমদানির মাধ্যমে। গৃহযুদ্ধের জন্যে এবছর আর তা সম্ভব হচ্ছে না। ছয়টি বড়ো ও সহস্রাধিক ছোটোখাটো ব্রিজ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, অনেক রাস্তাঘাটও অতিক্রমের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। রেল-যোগাযোগও একই ভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, যদিও সরকার বলছে যে সবকিছু “প্রায় স্বাভাবিক’’। ৭ই মে পর্যস্ত তৎপরতা চালিয়ে বিপ্লবীরা চট্রগ্রাম সমুদ্র-বন্দর থেকে উত্তর পর্যন্ত সড়ক ও রেল যোগাযোগ, বিশেষ করে ফেনীর মতো বিশিষ্ট সড়ক, জংশন ধ্বংস করে দিয়েছে। খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না এই ধ্বংসকাণ্ডের জন্যে। স্বাভাবিক সময়ে চট্রগ্রাম থেকে অন্যান্য এলাকায় নৌপথে ১৫ শতাংশ খাদ্য সরবরাহ করা হয়। বাকি ৮৫ ভাগ সরবরাহ করা হয় সড়ক ও রেলপথে। এমনকি নৌপথের পূর্ণ যোগাযোগ ও তৎপরতা গ্রহণ করা গেলেও চট্টগ্রাম গুদামে জমা খাদ্য মজুতের ৭০ শতাংশ খাদ্য সরবরাহ সম্ভব হবে না।

    অন্য দুটো কারণও এর সঙ্গে যোগ করা দরকার। প্রথমত দুর্ভিক্ষের মোকাবেলার জন্যে লোকজন খাদ্যশস্য নিজেদের কাছেই মজুত করে রেখেছে। এই অবস্থা আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। অপরটি হলো দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে জনসাধারণকে ওয়াকিবহাল করার ব্যাপারে পাক সরকারের অস্বীকৃতি। পূর্ব বাংলার সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ১৮ই এপ্রিল এক বেতারভাষণে বলেন যে খাদ্যশস্যের সরবরাহের ব্যাপরে তিনি ওয়াকিবহাল আছেন। তখন থেকে সরকারি সব কায়দা ব্যবহার করা হয়েছে খাদ্য-সংকটের তথ্য গোপন করার ব্যাপারে। এর কারণ হল, এসবের পূর্বে সাইক্লোনের কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের মতো দুর্ভিক্ষে বিপুল বৈদেশিক সাহায্যের প্রবাহ তৈরি হবে এবং বণ্টন-ব্যবস্থা দেখতে পরিদর্শন-দল আসবে। তা হলে হত্যাকাণ্ডের খবর বিশ্ববাাসীর কাছে গোপন রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। সেজন্যে বিশুদ্ধি অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত ক্ষুধার কারণে লোকের মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করা হয়েছে। কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান জনাব কারনির সঙ্গে কিছুদিন আগে এই সমস্যা নিয়ে কথা হয়েছিল। করাচীতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুসজ্জিত অফিসে দুর্ভিক্ষ প্রসঙ্গে নির্দয়ের মতো তিনি বলেন, ‘এই দুর্ভিক্ষ তাদের স্যাবোটাজের ফল। কাজেই, তাদের মরতে দাও। মনে হয় এতে বাঙালিদের বোধোদয় হবে।’

    সামরিক সরকারের পূর্ব বাংলা-নীতি আপাতভাবে এত স্ববিরোধী ও আত্মবিনাশী ছিলো যে শাসকরা নিজেরাই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। প্রথমদিকে বলপ্রয়োগের ভ্রান্ত নীতি গ্রহণ করে সরকার অযৌক্তিকভাবে ও বোকার মতো জল ঘোলা করে ফেলেছে। এর আপাত কিছু কারণ ছিলো। একদিকে, এটা সত্যি যে সন্ত্রাসের তীব্রতা হ্রাস হয়নি। কিন্তু দমননীতি পূর্ব বাংলার বিক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একারণে প্রতিদিন সরকারের হাজার হাজার শত্র“ গড়ে উঠছে এবং পাকিস্তানকে ঠেলে দিচ্ছে বিচ্ছিন্নতার পথে।

    অন্যদিকে, কোনো সরকারই সচেতন হতে পারে নি যে এই নীতিমালা ব্যর্থ হতে পারে (পূর্ব বাংলাকে অনির্দিষ্টভাবে আটকে রাখার জন্য যথেষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানী নেই)। দৃঢ় প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কারণে এবং বৈদেশিক উন্নয়ন সহযোগিতায় বিশেষত আমেরিকার কঠোর বিবেচনার কারণে, যত দ্রুত সম্ভব একটি রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের ২৫শে মে-র সংবাদ-সম্মেলন জানান দেন যে তিনি বিষয়গুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এবং তিনি বলেন যে মধ্য জুনে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের ব্যাপারে তিনি তার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করবেন।

    এসবকিছু এটাই নির্দেশ করছে যে, পাকিস্তানের সামরিক সরকার স্ববিরোধী আচরণ করছে এবং দেশের ২৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে তীব্র সঙ্কটের সমাধানে উল্টোপথে হাঁটা শুরু করেছে। এটি হল বি¯তৃতভাবে ফুটে ওঠা চিত্র। কিন্তু এটা কি সত্য? আমার ব্যক্তিগত মত হল এসব সত্য নয়। পশ্চিম পাকিস্তানে নেতারা কী বলেন, আর পূর্বে কাজে কী করেন এই দুইটি চিত্রই আমার সরাসরি দেখার দুঃখজনক সুযোগ হয়েছে। আমি মনে করি সরকারের র্প্বূ বাংলার নীতিতে সত্যিকার অর্থে কোনো স্ববিরোধ নেই। পূর্ব বাংলায় উপনিবেশীকরণ প্রক্রিয়া চলেছে। এটা আমার কোনো স্বে^চ্ছাচারী মতামত নয়। বাস্তবতা নিজেই সে কথা বলছে।

    পূর্ব বাংলা বিচ্ছিন্নতাবাদের সমস্ত চিহ্ন বিলোপ করাই পাক সামরিক বাহিনীর প্রথম বিবেচনা ছিল এবং এখনো আছে। ২৫শে মার্চ থেকে সরকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে চলমান দমননীতির মাধ্যমে এবং যেকোনো উপায়ে এই সিদ্ধান্ত বজায় রেখে চলেছে। ঠাণ্ডা মাথায় এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং ঠাণ্ডা মাথায় সেদিকে এগুচ্ছেও। পূর্ব বাংলায় ধ্বংসলীলা চলার সময় কোনো অর্থপূর্ণ ও বাস্তবায়নযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়। জটিল প্রশ্ন হল: হত্যাকাণ্ড কি আদৌ থামবে ? ৯ম ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল শওকত রাজা ১৬ এপ্রিল কুমিল্লায় আমাদের প্রথম সাক্ষাতে এর উত্তর দিয়েছিলেন।

    ‘‘তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো’’, তিনি বললেন, ‘‘আমরা মানুষ আর অর্থ দুদিক থেকেই ব্যাপক আর ব্যয়বহুল অভিযান খামোখা গ্রহণ করিনি। আমরা এটাকে একটা দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছি এবং তা শেষ করতে যাচ্ছি। আধাখেচরা করে শেষ করলে রাজনীতিবিদরা এটাকে আবার খুঁচিয়ে তুলবে। তিন চার বছর পর পরই এই সমস্যাটিকে উঠতে দিতে সামরিক বাহিনী নারাজ। সেনাবাহিনীর অন্য প্রয়োজনীয় কাজ আছে। আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিতে পারে, আমরা যে পরিকল্পনা নিয়েছি, তা পুরোপুরি সম্পন্ন করতে পারলে এরকম অভিযানের আর প্রয়োজন হবে না।” কর্মরত তিন ডিভিশনাল কমান্ডারের মধ্যে মেজর জেনারেল শওকত রাজা অন্যতম। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন তিনি। তাকে নিশ্চয় অসংলগ্ন কথা বলার জন্য ঐ পদে রাখা হয়নি।

    লক্ষ্যণীয় যে, পূর্ব বাংলায় আমার দশ দিনের সফরে প্রতিটি সামরিক কর্মকর্তার মুখে মেজর জেনারেল শওকত রাজার কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। আর রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জানেন যে যুদ্ধক্ষেত্রে যারা সৈন্য পরিচালনা করছেন তারাই পাকিস্তানের নিয়তির নিয়ন্তা। সামরিক অভিযানই সেনা কর্মকর্তাদের মতৈক্যের প্রমাণ দেয়। যেকোনো মাত্রায়ই এটা একটা প্রধান কাজ। এটা এমন একটা বিষয় যার সুইচ বৃহত্তম ফলাফল ছাড়া অফ বা অন করা যাবে না।

    সামরিক বাহিনী তাদের কাজ করে যাচ্ছে

    সামরিক বাহিনী ইতোমধ্যে হত এবং আহতের বিরাট পাহাড় গড়েছে। ঢাকায় ব্যক্তিগতভাবে শুনেছি যে সাধারণ মানুষের চেয়ে অফিসারদের বেশি হত্যা করা হয়েছে এবং হতাহতের পরিমাণ ১৯৬৫ সনের সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধকে অতিক্রম করে গেছে। সেনাবাহিনী অবশ্যই এসব ‘জীবনোৎসর্গ’কে রাজনৈতিক সমাধানের খাতিরে, যার প্রচেষ্টা অতীতে বারবার ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে, পাত্তা দেবে না। তারা যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এ অবস্থায় তা স্থগিত করলে তা আত্মবিনাশী হয়ে উঠবে। এর মানে এটাই দাঁড়াবে যে, বাঙালি বিপ্লবীদের সঙ্গে তাতে আরো সঙ্কট তৈরি হবে। প্রচণ্ড আক্রোশ এখন দু’পক্ষেই তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

    আলোচনা সাপেক্ষে সমঝোতাও এখন সম্ভব নয়। এখন সম্পূর্ণ জয় বা পরাজয়ই হল একমাত্র সমাধান। সময় এখন, বিচ্ছিন্ন অসংগঠিত আধুনিক অস্ত্রহীন বিপ্লবীদলের নয়, পাকসেনাদের পক্ষে। কিন্তু অন্যান্য শর্ত যেমন বৃহৎ শক্তিদের দ্বন্দ্ব, পরিস্থিতির চেহারা পুরো পাল্টে দিতে পারে। তবে বর্তমান অবস্থায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দিক থেকে লক্ষ্যার্জনের ব্যাপারে তাদের কোনো সন্দেহ নেই। তাই বর্তমান ক্ষয়ক্ষতি তাদের কাছে সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

    ইতোমধ্যেই প্রচুর অর্থ খরচ হয়ে গেছে পূর্ব বাংলায় অভিযান চালাতে গিয়ে, এবং এই ক্রমবর্ধমান ব্যয় ভারই পাক সরকারের প্রতিজ্ঞার পরীক্ষা করছে। তহবিলের ব্যাপক খরচাপাতি এটা স্পষ্ট করে যে সৈন্যদল ব্যবহারের ক্ষেত্রে হিসেব-নিকেশ করে কাজে নামা সেনাবাহিনীর সকল স্তরেই প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ব্যাপারে অনুমোদন ও সমর্থন রয়েছে। ২৫,০০০ পাকসেনাকে পূর্ব বাংলায় নিয়ে যাবার মতো সাহসী ও ব্যয়বহুল উদ্যোগ শুধু শুধু নেয়া হয়নি। ৯ম ও ১৬শ ডিভিশন দু’টো পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক মজুত হিসেবে রাখা হয়েছিলো । বর্তমানে তাদের নবনিযুক্তি ঘটেছে প্রচণ্ড খরচের মাধ্যমে।

    চীন কারাকোরাম মহাসড়ক দিয়ে বিপুল অস্ত্রসাহায্য পাঠিয়েছে। সম্প্রতি এই অস্ত্রবন্যা হ্রাস পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে; পাকিস্তানের সামরিক সরকারের প্রতি প্রতিশ্র“তির ব্যাপারে তাদের হয়তো দ্বিতীয় কোনো ভাবনার উদয় হয়েছে। কিন্তু এরপরও বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের তলানি থেকে এক মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের অস্ত্র ইউরোপীয় অস্ত্র বিক্রেতাদের কাছ থেকে কিনতে পাক-সরকার বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি। ঢাকা, রাওয়ালপিন্ডি ও করাচিতে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে তারা সমস্যা সমাধানের উপায় দেখছে পূর্ব বাংলা অভিযান দ্রুত শেষ করে ফেলার মধ্যে ও ভয়ংকর আক্রমণের মাধ্যমে। এই উদ্দেশ্য সফলের জন্য প্রয়োজনীয় টাকার পরিমাণ সরকারি অন্যান্য সব খরচের ওপরে অবস্থান করছে। উন্নয়ন সত্যিকার অর্থে থেমে গেছে। একবাক্যে বলা যায়, রাজনৈতিক কোনো সমাধান সরকার যদি আন্তরিকভাবে চাইতো তা হলে পূর্ব বাংলার অপারেশন পরিত্যাগ করতো, কিন্তু সরকার তা থেকে সামরিকভাবে প্রতিশ্র“তবদ্ধ হয়ে অনেক দূরে অবস্থান করছে। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া এখন বসে আছেন বাঘের পিঠে। তবে তার পিঠে ওঠার আগে অনেক হিসাব-নিকাশও করেছেন।

    কাজেই সামরিক সেনাদের সহজে প্রত্যাহার করা হচ্ছে না। ঢাকার ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারে সরকারের পূর্ব বাংলা নীতি সম্পর্কে আমি জানলাম । এর তিনটি সূত্র আছে:

    (১) বাঙালিরা নিজেদের ‘অবিশ্বস্ত’ হিসেবে প্রমাণিত করেছে এবং তারা অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা শাসিত হবে।
    (২) ইসলামী পদ্ধতিতে বাঙালিদের পুনরায় শিক্ষা দিতে হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রবণতা দূর করতে ‘জনগণের ইসলামিকরণ’ (অফিসিয়াল পরিভাষায় এরকমই বলা হয়ে থাকে) করতে হবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে শক্তিশালী ধর্মীয় বন্ধন তৈরী করতে হবে।
    (৩) হত্যা ও দেশত্যাগের মাধ্যমে যখন হিন্দুরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তখন তাদের সম্পত্তি সুযোগবঞ্চিত বাঙালি মুসলমানদের মন জয় করতে সোনালি পুরস্কার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এটা ভবিষ্যতের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করবে।

    এই নীতিমালা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে সুপারিশ করা হয়েছে। প্রকাশ্য বিদ্রোহের অপরাধে সরকারি আদেশবলে প্রতিরক্ষাবাহিনীতে আর কোনো বাঙালির নিয়োগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর যেসব সিনিয়র অফিসার জড়িত ছিলেন না ‘আগাম-সতর্কতা হিসেবে’ তাদের গুরুত্বহীন জায়গায় বদলি করা হয়েছে। বাঙালি ফাইটার-পাইলট, যাদের মধ্যে কারো কারো পাঁচ বা ততোধিক শত্রু-বিমান ধ্বংসের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের গ্রাউন্ডে পাঠানো এবং বিমান-পরিচালনাবহির্ভূত কাজকর্মে নিযুক্তির মাধ্যমে মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। এমনকি দেশের দু’অংশের মধ্যে যাত্রী-পরিবহনে পরিচালিত পিআইয়ের বিমানক্রুদেরকেও বাঙালিমুক্ত করা হয়েছে।

    পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস হলো কেবল বাঙালিদের নিয়ে আধাসামরিক বাহিনী; বিদ্রোহ সমাপ্তি না আসা পর্যন্ত তাদের বাতিল করে দেয়া হয়েছে। বিহারী ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বেচ্ছকর্মীদের নিয়ে সিভিল ডিফেন্স ফোর্স নামে নতুন বাহিনী গঠন হয়েছে। পুলিশে নিযুক্তির ব্যাপারেও বাঙালির জায়গায় বিহারীদের নেয়া হচ্ছে। এগুলো তত্ত্বাবধান করছেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঠানো ও সেনাবাহিনী কর্তৃক অনুমোদিত কর্মকর্তাগণ। চাঁদপুরের এপ্রিল মাসের শেষদিকে পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন একজন মিলিটারি-পুলিশ-মেজর। শত শত পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারি কর্মচারী ডাক্তার এবং রেডিও, টিভি, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন কলাকৌশলীদের পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে। এদর সবাইকেই দেয়া হয়েছে এক বা দুই ধাপ প্রমোশনের লোভ। অবশ্য এই বদলী করা হয়েছে বাধ্যতামূলকভাবে। সরকারি কর্মকর্তাদের দেশের যে কোনো স্থানে ইচ্ছেমত বদলী করার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সাম্প্রতিককালে একটি নির্দেশনামা জারি করেছেন।

    বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অনুসন্ধান’

    আমাকে বলা হয়েছে যে ভবিষ্যতে ডেপুটি কমিশনার বা পূর্ব বাংলার কমিশনারদের নেয়া হবে হয় বিহারী নয়তো পূর্ব পাকিস্তানী সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে। জানা গেছে যে, জেলা ডেপুটি কমিশনাররা আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, যেমন কুমিল্লায়, এসব ডেপুটি কমিশনারদের ধরা হয়েছে এবং গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কুমিল্লার সেই বিশেষ কর্মকর্তাটি ‘শেখ মুজিবের লিখিত নির্দেশ ছাড়া’ পেট্রল ও খাদ্য সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানানোয় পাকসেনাদের রোষে নিপতিত হন ২০ মার্চ।

    সরকার পূর্ব বাংলার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপরও হিংস্র হয়ে উঠেছে। ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে ঘোষণা করে সেগুলোতে ‘অনুসন্ধান’ করার আদেশ দেয়া হয়। অনেক অধ্যাপক পালিয়ে গেছেন; গুলিতে মারা গেছেন কেউ কেউ। তাদের স্থানে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নতুন নিযুক্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বাঙালি কর্মকর্তাদের স্থানান্তরিত করা হয়েছে প্রশাসনিক ও পররাষ্ট্রীয় সংবেদনশীল পদ থেকে। সবকিছু এই সময়ে চরম সীমায় এসে ঠেকেছে। তবে প্রশাসন যেমন চায়, এই উপনিবেশীকরণ প্রক্রিয়া স্পষ্টত তার অর্ধেকও কাজে দেয়নি। কুমিল্লার সামরিক আইন প্রশাসক মেজর আগা আমাকে এর বহু প্রমাণ আমাকে দেখিয়েছেন। বিপ্লবীদের দ্বারা বিধ্বস্ত ব্রিজ ও রাস্তা মেরামতে তিনি স্থানীয় বাঙালি নির্বাহী প্রকৌশলীদের কাছ থেকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিলেন। কাজগুলো লাল ফিতায় বন্দি হয়ে আছে এবং ব্রিজগুলো তেমনই পড়ে আছে। “আপনি আশা করতে পারেন না যে ওরা কাজ করবে।” তিনি আমাকে বলেন, “কারণ ওদেরই আমরা হত্যা করেছি, ধ্বংস করেছি ওদেরই দেশ। তাদের দিক থেকে চিন্তা করলে তাই দাঁড়ায়, এবং আমরা এর দাম দিচ্ছি।”

    বেলুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন দুররানি ছিলেন কুমিল্লা-বিমানবন্দরে পাহারারত কোম্পানির দায়িত্বে। এসব সমস্যা মোকাবেলায় তার ছিল নিজস্ব কায়দা। কন্ট্রোল টাওয়ারে কর্মরত বাঙালিদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ওদের বলে দিয়েছি সন্দেহজনক কিছূ করছে এরকম মনে হলেও তাদের গুলি করে মারা হবে।” দুররানি তার কথা ও কাজে এক। কিছুদিন আগে রাতে বিমান-বন্দরের আশে-পাশে ঘোরাফেরা করছিল এমন এক বাঙালিকে তিনি গুলি করে মেরে ফেলেছেন। “সে একজন বিপ্লবী হতে পারতো” আমাকে তিনি বললেন। দুররানির আরকটি বিষয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বিমানবন্দরের আশেপাশের গ্রামে অভিযান চালানোর সময় তিনি নিজেই ‘৬০ জনেরও বেশি মানুষকে’ খতম করেছিলেন।

    পূর্ব বাংলার উপনিবেশীকরণের রূঢ় বাস্তবতাকে নির্লজ্জ ছদ্ম-পোশাক দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। ইয়াহিয়া খান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান কয়েক সপ্তাহ ধরে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের কার্যকলাপের জন্য রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলাফল অবশ্য আদৌ সন্তোষজনক নয়। সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার বাঙালি আইনজ্ঞ মৌলভী ফরিদ আহমেদ এবং জামাতে ইসলামের গোলাম আজম ও ফজলুল কাদের চৌধুরীর মতো লোকদের যাদের প্রত্যেকে গত সাধারণ নির্বাচনে প্রচণ্ড মার খেয়েছিলেন। একমাত্র উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি নূরুল আমিনের সমর্থনই ধর্তব্য। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে নির্বাচিত দু’জনের মধ্যে তিনি একজন। এছাড়াও বয়ষ্ক এই মুসলিম লীগার পূর্ব বাংলার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। তার বয়স এখন সত্তর। কিন্তু নূরুল আমিনও সতর্কভাবে তার মতামত দিচ্ছেন। তিনি আজ পর্যন্ত শুধু দুটো বিবৃতি দিয়েছেন যার বিষয়বস্তু হল ‘ভারতের হস্তক্ষেপ’।

    এসব ‘দালাল’ বাঙালিদের রোষানলে পড়েছেন। ফরিদ আহমেদ ও ফজলুল কাদের চৌধুরী এসব থেকে সতর্ক হয়ে চলেছেন। ফরিদ আহমেদ তার বাড়ির দরজা-জানালা সবসময় বন্ধ করে রাখেন। দরজার ফাঁক দিয়ে যাদের সনাক্ত করতে পারেন, তারাই কেবল ভেতরে ঢোকার অনুমতি পাচ্ছেন।

    একটি বিশেষ অকার্যকর পদ্ধতির মাধ্যমে সরকার জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদের জন্য নির্বাচিত ৩১ জন আওয়ামী লীগ নেতার ক্ষুব্ধ মৌনতা আদায় করেছে। পরিবার ছাড়া আর সকলের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের আটকে রাখা হয়েছে আসন্ন ‘প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের’ অভিষেকের জন্য। যদিও তারা এখন নিজেদের ছাড়া আর কারও প্রতিনিধিত্ব করছেন না।

    বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবান দর্জি আব্দুল বারীর বয়স ২৪ বছর। পাকিস্তানের বয়সও আব্দুল বারীর সমান। বলপ্রয়োগ করে সামরিক বাহিনী দেশটিকে একত্রিত রাখতে পারবে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে যা করা হয়েছে তার অর্থ দাঁড়ায় একটাই; তা হল, ১৯৪৭ সালে দু’টি সমান অংশের মুসলিম জাতির সমন্বয়ে একটি দেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন মানুষের ছিল, সেটা এখন মৃত। পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবিরা আর পূর্ব বাংলার বাঙালিরা একই জাতির অভিন্ন জাতি হিসেবে নিজেদের ভাবার সম্ভাবনা এখন সুদূরপরাহত। বাঙালিদের এখন একটাই ঝাপসা ভবিষ্যৎ আছে: উপনিবেশের অসুখী অবদমন থেকে বিজয়ী হিসেবে নিজেদের উত্তরণ।